নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-১১৫

২৩৭।
১২ তারিখ সোমবারে জসীম বিকেলের ফ্লাইটে চলে যাবে এই দিনেই সকালে রাশেদ সাহেব তার ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে দেখে আহাদ জিজ্ঞেস করল -কোথায় যাচ্ছ?
-কেন জসীম আজ চলে যাচ্ছে না, আমি ওর ওখানে উঠি, যাতে ডিউটি সেরে ওখানে যেতে পারি তাই ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছি
-তোমাকে কে যেতে বলেছে? তুমি এখানেই থাকবে বলেছি না?
হাতের ব্যাগটা ছেড়ে দিয়ে রাশেদ সাহেব এক মুহূর্ত ভাবলেন, সেদিন বলেছে কিন্তু ওটা কথার কথা মনে করে গুরুত্ব দেয়নি কিন্তু আজ! এখন কি করবে?
-না আহাদ, আমার মনে হয় আমার ওখানে থাকাই ভাল হবে
-কেন, ওখানে ভাল হবে কেন?
-তুমি আমাকে তোমার নিজের কাছে আশ্রয় দিয়েছ আমার জন্য অনেক করেছ এবং এখনও করছ এ কথা আমি অস্বীকার করতে পারব না কোন দিন এমনকি ভুলতেও পারব না তাই বলে..................
কথা শেষ করতে না দিয়ে আহাদ বললো-
-তাহলে চলে যেতে চাইছ কেন, কি সম্মানের ভয়ে?
-ছি ছি, কি বলছ! তা হবে কেন?
-আচ্ছা তোমার যদি এতই সংকোচ লাগে তাহলে তুমি ভেবে নাও এখানেও তোমার একটা চাকরি আছে
-যেমন?
-এই যেমন তুমি এখানে আমার জন্য রান্না করবে, বলেই রাশেদ সাহেবের মুখের দিকে তাকাল
রাশেদ সাহেব আর কিছু বলা ন্যায়সঙ্গত হবে না মনে করে ওর দিকে তাকিয়ে হো হো করে হেসে উঠলেন,
-তার মানে তুমি বলতে চাইছ সেফ এর চাকরি?
-তাই ধরে নাও
-আচ্ছা আচ্ছা ভাই, ঠিক আছে, আমি এখানেই থাকছি, হয়েছে এবার? চল বের হই
-চল, তবে এদেশে আমি যতদিন আছি বা তুমি যতদিন আছ এই কথা আর কখনও ভাববে না, মনে রেখ
-ঠক আছে তাই হবে, এখন চল


২৩৮।
শুরু হলো রাশেদ সাহেবের জীবনের নতুন অধ্যায়। গোডাউনে পৌঁছে জসীমের সাথে যে আর একজন বাংলাদেশি আছে ইমতিয়াজ সে দেখিয়ে দিল কি করতে হবে। ফল একটা মাপে বাছাই করে শুধু ভাল ফ্রেশ ফল এই ভাবে কাগজে মুড়িয়ে কার্টুনে ভরে ট্রলিতে করে ওই বাইরের ভ্যানে তোলার জন্য বড় ওই উইন্ডোর পাশে রেখে দিতে হবে। আর এক দল আছে যারা শুধু ওখান থেকে কার্টুনগুলা ভ্যানে তুলে এয়ারপোর্টে বা যেখানে নেয়ার নিয়ে যাবে। তবে খুব সাবধানে করতে হবে যেন কোন অবস্থায় দুই একদিনের মধ্যে পচন ধরবে এমন ফল দেয়া যাবে না। তাহলে কোম্পানির দুর্নাম হয়ে গেলে ক্ষতি হয়ে যাবে। বিভিন্ন ফলের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিরাশেদ সাহেব মনে মনে ভাবলেন এ আর এমন কঠিন কি! তবে অসুবিধা হলো সারাদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই কাজ করতে হয়। সকাল নয়টা থেকে কাজ শুরু, দুপুরে একটায় আধা ঘণ্টার লাঞ্চ ব্রেক আবার বিকেল পাঁচটায় ছুটি। রবিবারে সবার ছুটির দিন। মাঝে দুইবার পনের মিনিট করে টি ব্রেক, এখানে খাবার বা চা সব কোম্পানিই দেয়, পাশের রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার দিয়ে যায়। আহাদ নিজেও আগে এখানেই খেয়েছে ইদানীং কয়েকদিন যাবত খাচ্ছে না। তবে যখন খুব আর্জেন্ট কোন ডেলিভারি থাকে তখন ডিউটির কোন হিসাব থাকে না, অবশ্য এজন্যে আলাদা ওভারটাইম দেয়। ওই যে গেটের পাশে টেবিলে বসে আছে মোটকু সাকা, ওর কাছে সবার হাজিরা খাতা থাকে। ওই সব হিসাব রাখে। রাশেদ সাহেব দেখলেন ওকে সবাই মোটকু বলে ডাকে আর এতে ও বেশি খেতে পারে বলে একটু মোটা হয়েছে এটা সবাই মেনে নিয়েছে জেনে ও খুব খুশি।

এভাবেই রাশেদ সাহেব তার নতুন জীবন শুরু করলেনপ্রতিদিন নিয়ম করে আহাদের সাথে বের হয়, যেদিন আহাদকে বাইরে অন্য কোথাও যেতে হয় সেদিন হেঁটেই আসেনআহাদকে মাসে অন্তত একবার দেশের বাইরে যেতে হয়। বিদেশের কাস্টমারদের সাথে মিটিং থাকে। বিকেলে বাসায় ফিরে একটু ফ্রেশ হয়ে রান্না করে। বাসায় ফ্রিজ মাইক্রোওয়েভ ওভেন আছে আর চিন্তা কি? রাশেদ সাহেব এখানে থাকবে না বললেও আহাদের ব্যবস্থায় মনে মনে ভালই মনে করছেনএই এলাকায় কি আর সে নিজের পয়সায় থাকতে পারত? অভিজাত এলাকা, ভাড়া অনেক বেশি। ছুটির দিনে আহাদের সাথে বা নিজে একাই কোথাও বেড়াতে যায়। ব্রিটেনের চেয়ে এখানেই থাকতে ভাল লাগছে। কিন্তু কতদিন?

২৩৯
দেখতে দেখতে প্রায় মাস কেটে গেল। এখন লন্ডনের ওদের জানান যায়। এক এক করে ফিরোজ, শাহেদ, মর্জিনা, তানিম সবার সাথে আলাপ হলো ওরা শুনে সবাই প্রায় আঁতকে ওঠার মত। বলেন কি? তাইতো আমি ফোন করে পাচ্ছি না! মিজান, গফুর ভাইয়ের সাথেও কথা হয়েছেপাকিস্তানি আসাদের কাছে যেতে হয়নি বলে মিজান বললো, ভালই হয়েছে চাচা। ওখানে আর যারা ছিল তাদের সবার সাথে কথা হয়েছে। এখান থেকে এখন ফোন কার্ড নিয়ে এসে বাসার ল্যান্ড ফোন দিয়ে কথা হয়। মোবাইলে খরচ কিছু বেশিই হয়। বাড়িতে মনি এবং মেয়েরা ভালই আছে মাঝে বীথীর একটা ছোট অপারেশন করাতে হয়েছে, এখন সুস্থ। এবার এমএসসিতে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে, এবার চাকরি খুজছেযূথীও এমবিএতে ভর্তি হয়েছে। রাজীব ভাল চাকরি করছেআলাদা বাসা নিয়ে ওরা থাকতে পারবে না দুইজনেই অনেকদিন দেশের বাইরে থেকে এসেছেএর মধ্যে দেশে অনেক পরিবর্তন হয়েছে, মানিয়ে নিতে সময় নিবে তাই মনি ওদের যেতে দেয়নি। মনি কিছুতেই আর সময় দিতে চাইছে না। প্রতিবারে ফোনে কথা হলেই এক কথা তুমি কবে আসছ?
-দেশে গেলে কি উপায় হবে ভেবেছ? ওরাসবাইচাকরিপেলেতখনদেখব
-না তুমি চলে আস, যা হয় একটা কিছু হবে
-যা হয় আবার কি? ওখানে কে আমাকে চাকরি দিবে বল! খাবে কি? এ যাবত কিছু জমাতে পেরেছ? কাজেই আর একটু ধৈর্য ধর এতদিন গেছে এখন এইতো আর বছর দুয়েক থেকেই চলে আসছি। আশা করি এর মধ্যে
যা হোক অন্তত কিছু সঞ্চয় হবে। গিয়েই কি কারো কাছে হাত পাততে পারব?
-না তুমি চলে আস, আমি আর পারছি না
এমনি কান্নাকাটি। রাশেদ সাহেব নিজেও ক্লান্ত। কিন্তু সে কথা সে বলতে পারছে নাকতদিন এভাবে থাকা যায়? দেশের কথা ভুলেই যেতে বসেছে। চিংড়ি মাছের ভর্তা, গরম পিয়াজু আর মুড়ি, বাতাসি মাছের চচ্চড়ি, ধনে পাতা ছড়ান চাপিলা মাছ আর টমাটোর ঝোল এগুলি এখন শুধু নামই মনে আছে স্বাদ কেমন ভুলে গেছে। দেশের কোন রাস্তার কি নাম সেও অনেকক্ষণ ভেবে মনে করতে হয় আবার কোনটা মনে আসেই না। সামনে আর কয়দিন বাঁচবে? স্ত্রী সন্তানের সেই চেহারাই শুধু মনে ভাষে যে চেহারা দেখে এসেছে। স্কাইপিতে ভিডিও আলাপ হয় কিন্তু তা হলেই কি আর মেয়ের হাতের গালের উষ্ণতা অনুভব করা যায়? স্ত্রীর হাতের এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি, গোসলের সময় এগিয়ে দেয়া তোয়ালের টান কতদিন ভুলে থাকার অভিনয় করা যায়? রাশেদ সাহেবও আর পারছেন না ক্লান্তির শেষ পর্যায়ে এসে গেছেনরাস্তা পার হবার সময় সিগনাল দেখার কথা মনে থাকে না। সেদিন তো প্রায় এক এক্সিডেন্ট হতে যাচ্ছিল নেহায়েত ভাগ্য ভাল বলে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন

লিফটে ওঠার সময় সাত তলার বোতাম না চেপে পাঁচ তলার বোতাম চেপে দিয়ে পাঁচ তলায় এসে তার ফ্ল্যাট খুঁজে পায় না। একদিন ফিরতে দেরি হয়েছিল সেদিন নিজেদের বিল্ডিঙে না ঢুকে পাশের বিল্ডিঙে ঢুকতে যাচ্ছিল আর পাশে দাঁড়ানো এক ভদ্রলোক ডেকে ভুল দেখিয়ে দিল, হাই জেন্টলম্যান! ফিরে তাকিয়ে দেখল সে ইশারা করছে পাশের বিল্ডিঙে যেতে। কাছে আসলে বলেছিল বেশি পান করেছ বুঝি? রাশেদ সাহেবের কানে কথাটা গিয়েছিল কিন্তু তা কিছুতেই মুছে ফেলতে পারছে না। আয়নার সামনে দাঁড়ালে সামনের দুই একটা পাকা চুল চোখে পড়ে। আগের মত কিছুতেই ধৈর্য রাখতে পারে না কারো কথা সহ্য হতে চায় না। কয়েকদিন আগে এক দোকানির সাথে একচোট গরম বাক্য নিক্ষেপ করলেনএদেশের মানুষ ঝগরা বিবাদ করতে জানে না বলে রক্ষা না হলে আমাদের দেশের মত হলে মারামারি লেগে যেত। ৩২১ নম্বর বাসকে ১৩২ নম্বর মনে করে উঠে পরেনএই এক জীবনে কত সহ্য হয়? সীমা ছাড়িয়ে গেছে কিন্তু তার পকেটের সীমা এখনও তলানিও স্পর্শ করতে পারেনি। যা আয় হচ্ছে সব মেয়েদের পড়াশুনার পিছনেই চলে গেছেঢাকায় জিনিষ পত্রের দাম দিনকে দিন আকাশের কাছে চলে যাচ্ছে। তার মত রাশেদ সাহেবরা কি করে কাছে পৌঁছতে পারে? সে যেখানে বাসে করে যেতে পারত সেখানে মনিকে সিএনজিতে যেতে হয়, কি করবে মহিলা মানুষ কি আর ঠ্যালা ঠেলি করে বাসে উঠতে পারে? বাজারে যেয়ে বাজার করলে কিছু কমে কেনা যায় কিন্তু মনি তা পারে না বাসায় যা আসে তাই বেশি দামে কিনতে হয়। এমনি করেই দিন মাস বছর যাচ্ছে এখানেও প্রায় একটা বছর চলে গেল। যখন খারাপ লাগে তখন ওই ব্যালকনিতে যেয়ে সাগরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন আর হাতে সময় থাকলে সমুদ্রের কাছে চলে যানজোসনা রাতে এখানে বসে সাগর দেখতে খুব সুন্দর লাগে। ঢেউ এর উপরে সাদা চূড়া গুলাকে মুক্তার মত মনে হয়, একটা মায়াবী পরিবেশ আচ্ছন্ন করে রাখে। ব্যালকনির চেয়ার ছেড়ে উঠে আসতে ইচ্ছে করে না। অনেক সময় রাত গভীর হয়ে যায় কিন্তু রাশেদ সাহেবের কোন বোধ থাকে না। হয়ত কোন জাহাজের হুইস্যাল শুনে ফিরে আসে বাস্তবে আর তখন নিতান্ত অনিচ্ছা সত্যেও উঠে এসে বিছানায় নিজেকে ছেড়ে দেয়। সকালেই আবার কাজে যেতে হবে।

এদিকে আবার আহাদের ব্যবসার মন্দা যাচ্ছে জোহানসবার্গ অথবা কেপ-জুলুতে চলে যাবে বলে ভাবছে নয়ত মিশরেই ফিরে যাবে। যদিও ওকে নিয়ে যাবে বলেছে কিন্তু তা হবার নয়। রাশেদ সাহেবের ভিসা এক্সটেন্ড করা হয়নি বা তা সম্ভবও নয়। তাকে মাত্র এক মাসের ভিসা দিয়েছিল বেড়াবার জন্য, লুকিয়ে থাকার জন্য নয়। এই এক বছর পরে এক্সটেনশন চাইতে গেলে সোজা দেশে পাঠিয়ে দিবে।
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top