নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-১১৬

২৪০।
আজ রবিবার। একটু দেরি করে ঘুম ভাঙল। রাতে অনেক দেরি করে টেলিভিশনে একটা সিনেমা দেখেছে, আহাদও ডারবানে নেই ছুটিতে গেছে, মায়ের অসুখ। ফোন বেজে উঠল, এ সময় এখানকার কেও ফোন করবে না নিশ্চয়
বাংলাদেশ অথবা ইংল্যান্ডের কেও হবে। চোখ ডলতে ডলতে উঠে এসে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে-
-হ্যালো
-কি করছ? মনির গলা
-মনি এখন রাখ, আমি পরে ফোন করব
-কেন রাখব কেন?
-ঘুমচ্ছি, রাতে ঘুমাতে পারিনি
-আচ্ছা রাখছি ঘুম থেকে উঠে ফোন দিও
-আচ্ছা। বলে কোন রকমে রিসিভারটা ক্রেডলে রেখে আবার শুয়ে পড়লেনএক বারে সন্ধ্যার একটু আগে ঘুম ভাংলহঠাৎ মনে পড়ল আরে মনি অপেক্ষা করছে। সঙ্গে সংগে উঠে ফোন করলেন
-হ্যালো, মনি!
-হ্যাঁ বল শুনছি
-আমি কি বলব ফোন তো তুমিই করতে বলেছিলে।
-বলতে চেয়েছিলাম যে শাহেদরা আগামী মাসে দেশে আসার প্ল্যান করেছে তোমার সাথে আলাপ হয়েছে?
-না আমি অনেকদিন যাবত কারও কোন খোজ খবর নেই না
-কেন?
-কি হবে? যে যেমন আছে ভালই আছে, আর এত দূরে থেকে এত খবর নিয়ে হবে কি? আমার আর কিছুই ভাল লাগে না।
-ভাল লাগে না তাহলে তোমাকে ওখানে থাকতে বলছে কে? চলে আস আমি আর পারছি না

রাশেদ সাহেব মনে মনে ভাবলেন আমি নিজেই কি পারছি? গেলেই বা কি করবে? এখন ঝোঁকের মাথায় যেতে বলছ কিন্তু যখন বাজারে যতে বলবে আর আমি টাকা চাইব তখন, তখন কি করবে? বেকার উপার্জন অক্ষম স্বামী বা বাবা কিংবা সন্তানকে কেও ভালবাসতে পারে না, তুমিও এর বাইরের কেও নও মনি! টাকা না থাকলে ঘরে শান্তি থাকে না। শুধু ভালবাসা দিয়ে আবেগ দিয়ে সংসার চলে না। শুরু হবে অশান্তি। তার চেয়ে এইতো বেশ আছি, তুমিই বা খারাপ আছ কোথায়? দিনতো চলেই যাচ্ছে, আর কয়দিনই বা টিকব! একে তো ডায়াবেটিসের রুগী তারপরে খাবারের কোন ঠিক ঠিকানা নেই যেখন যা পাই তাই খাই, তবুও এখানে প্রেসক্রিপশন ছাড়া এক দোকান থেকে ওষুধের ব্যবস্থা করে দিয়েছে বলে এত দিন আছি নয়ত কবেই কিছু একটা শুনতে পেতে। আসলে out of sight out of mind কথাটা যে মানুষে বলে এ কথা একেবারে মিথ্যে নয়। রাশেদ সাহেব উদগ্রীব হয়ে থাকে কখন মনির সাথে কথা বলবে কখন কোথায় কি দেখে এসেছে আজ কি হয়েছে সব বলবে কিন্তু আজকাল মনি কেমন যেন এড়িয়ে যেতে পারলে বেঁচে যায় মনে হয়। নেহায়েত টাকা না হলে সংসার চালাতে পারবে না তাই নিরুপায় হয়েই কথা বলাচুলায় রান্না দিয়ে এসেছি, ঘুমচ্ছিলাম, মেহমান এসেছে এমনি নানা অজুহাত শুনে রাশেদ সাহেব আর কিছু বলার আগ্রহ খুঁজে পায় না। আচ্ছা রাখি বলে ফোনটা রেখে দেন

এত কিছু ভাবলেও মুখে কিছুই বলতে পারলেন না।
-কি হলো, চুপ করে আছ কেন?
-না মাত্র ঘুম থেকে উঠেছি তো তাই ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে
-কি খাবে এখন?
-দেখি ফ্রিজে কি আছে, আহাদ নেই বলে তেমন কিছু করি না, ব্রেড ফেড যা থাকে তাই খেয়েই চলে যায়
-আজতো রবিবার গেল কিছু রাঁধলেই পারতে!
-বললাম না ঘুমে ছিলাম, দেখি এখন কিছু রান্না করতে পারি কিনা
-তুমি চলে আস আমি আর পারছি না, কিছুই রান্না করতে পারি না, মেয়েরা খেতে পারে না, সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়, কিছুই মনে রাখতে পারি না
-কিন্তু আমি গেলে এগুলা আরও বাড়বে এবং তার সাথে যোগ হবে নিত্য কলহ তখন কি হবে? এই ভাবে ভাবার চেষ্টা কর
-বললেই কি হয়, এভাবে কি ভাবা যায়? তোমার খুকু আর রাজীব বলেছে আব্বাকে চলে আসতে বলেন আমার চাকরি আছে আব্বা যদি কিছু নাও করে তাহলে কি চলবে না?
-তোমার কি মনে হয়? মেয়ে, জামাই এদের উপর নির্ভর করে আমি জীবন কাটাবার জন্য সেই কবে বাড়ি থেকে বের হয়েছি? আমাকে কি তুমি এতটাই অলস ভাবলে? এতদিনে এই চিনেছ? সময় কিন্তু কম যায়নি, প্রায় ৩৪ বছর হয়ে গেছে তুমি আমার সাথে রয়েছ, মনে আছে?
-তুমি অলস আমি কি এ কথা বলেছি কখনও?
-তাহলে কি করে ভাবলে যে ওরা বললো আর আমি চলে গেলাম? আমি জানি ওখানে এখন আমার উপযুক্ত কোন কাজ নেই, থাকত যদি আমার তেমন কোন আত্মীয় স্বজনের কোন বড় ব্যবসা থাকত তাহলে হয়ত তারা কোন একটা কাজে লাগিয়ে দিত, কিন্তু তেমন কেও কি আছে? আমারও কেও নেই তোমারও কেও নেই কাজেই এভাবে চিন্তা না করাই ভালদুই দিন পরে তুমি যখন সংসারের এটা লাগবে ওটা লাগবে বলবে তখন আমি দিতেও পারব না আবার সইতেও পারব না। এমনিই অভাবের সংসারে সামান্য তুচ্ছ কারণেই প্রথমে খিটিমিটি এবং আস্তে আস্তে সেটা চরম অশান্তি দেখা দেয়
-না, আমি তোমাকে কোন কিছুর কথাই বলব না, তোমার কাছে কিছুই চাইব না
-তাহলে কি মেয়ের কাছে জামাইর কাছে হাত পাতবে?
-তোমার আমার ভাগ্য যদি তেমনই হয় তাহলে চাইতে হবে। আর তুমিই বা এমন করে ভাবছ কেন? আমাদের জামাই তেমন ছেলেই না
-না না মনি তুমি আমাকে আরও কিছু সময় দাও
-মাঝুর একটা ভাল চাকরি হয়েছে, ও বলছে আব্বুকে আসতে বল........................
মনির কথা থামিয়ে দিয়ে বললেন, -মেয়ের বিয়ে দিবে না? কি দিয়ে দিবে? বলেইফোনরেখেদিলেন

নিজের মনে অনেক ঝড় অনেক কষ্ট দমিয়ে রেখে রাশেদ সাহেব পাষাণ হয়ে গেছেনমনির কোন কাকুতি মিনতি তার কানে পৌঁছাতে পারছে না। সে নিজেও তেমন করে চাইছে না। যেমন করেই হোক মনির মন থেকে এই ধারনা দূর করতেই হবে। কিন্তু কেমন করে তা করবে? দেশে ফোন করাই বন্ধ করে দিবে? তাহলে ও করবে, মেয়ে করবে তখন কি না ধরে থাকতে পারবে? মস্ত ভুল হয়ে গেছে এখানে আসার কথা জানিয়েনা জানালে আজ তাকে কেও খুঁজেই পেত না! মাসে মাসে টাকা পাঠিয়ে দিত ব্যাস, কে কোথা থেকে টাকা পাঠাচ্ছে জানতেই পারত না। দরকার হলে আহাদের নামে পাঠাত! ভুল হয়ে গেছে। তাহলে কি এখান থেকে আবার অন্য কোথাও চলে যাবে? আহাদ যেমন বলছে! কথা বলতে বলতে রাত হয়ে গেছে।

২৪১।
এখানে ওল্ড হলবর্ন তামাক পাওয়া যায় না তবে আইরিশ এরিনমোর পেয়েছে এখন আবার এরিনমোরই খায়। তামাকের ব্যাপারে রাশেদ সাহেব খুবই সৌখিন মানুষ। সব সময় দামি তামাকে অভ্যস্ত। সিগারেট খায় না কারণ তামাকে আলাদা একটা বনেদীয়ানা অনুভব করে সিগারেটে সেটা পায় না। লন্ডনের হলবর্নে তৈরি ওল্ড হলবর্ন বা আইরিশ এরিনমোর অন্যান্য তামাকের চেয়ে বেশ দামি। পাশে দিয়ে কেও হেঁটে গেলে সুঘ্রাণ পেয়ে বুঝতে পারে এখানে কেও তামাক টানছেতবে পাইপ পছন্দ করে না, ওতে বেশি নিকোটিন জমে। সোফায় বসে পাশের টেবিল থেকে এরিনমোরের টিনটা নিয়ে একটা বিড়ি বানিয়ে জ্বালিয়ে ব্যালকনির চেয়ারে বসলেন

দূরে সাগরের ঢেউ দেখা যাচ্ছে মাথার চূড়ায় সাদা মুক্তার মালা পড়ে এগিয়ে এসে আবার কিনারে ভেঙ্গে যাচ্ছেসম্ভবত এখন জোয়ার চলছে তাই ঢেউগুলা বড় দেখাচ্ছে। এক কাপ কফি হলে ভাল হোত। উঠে কিচেনে এসে কফি নিয়ে আবার বসলেনআরে হ্যাঁ, এত ভাবছে কেন? মোবাইলের সিমটা বদলে ফেললেই হয়ে যায়! তাই তো! তাহলে আর এত ভাববে না। কাল সকালে গিয়েই একটা নতুন সিম নিয়ে নিবে। ওহ! আহাদ তো নেই তাহলে? না আহাদ নেই তো কি হয়েছে ইমতিয়াজ নিয়ে দিবে। আরে আমি এত ভাবছি কেন? ফোনটা অফ করে রাখলেই হয়ে যায়! হ্যাঁ তাইতো! এখানে আমাকে আর কে ফোন করবে? সাথে সাথে রুমে এসে মোবাইলটা নিয়ে অফ করে রেখে দিলেনএটা এ ভাবেই থাকুক। নিরুদ্দেশ হয়ে থাকাই ভাল, আর এত কিছু ভাল লাগে না। মনি আর আগের সে মনি নেইদীর্ঘদিন দূরে থেকে তার প্রতি আগ্রহ বা হৃদয়ের টান ঢিলে হয়ে গেছে, সেও যান্ত্রিক হয়ে গেছে। প্রকৃতিই হয়ত তার এই পরিবর্তন এনে দিয়েছে নয়ত এত দিন কি করে কাটাত? এখন টেলিফোনে যা কথা বার্তা হয় সবই প্রায় সংসার আর টাকা পয়সার চাহিদার কথাই বেশি হয়মনির কাছে কি রাশেদ সাহেব এখন শুধুই উপার্জনের মেশিন? জীবন যখন মেশিনের মত হয়ে যায় তখন মায়া মমতা, স্নেহ ভালবাসা এই সব অনুভূতি গুলা শুকিয়ে যায়, কোন মাদকতা থাকে না, প্রেম ভালবাসার সৌরভ থাকে না, কুপি বাতির মত মিটমিট করে জ্বলে কোনরকম আঁধার দূরে সরিয়ে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা চলতে থাকে কিন্তু কেও কিছু প্রকাশ পারে না। লোকলজ্জার ভয়ে নীরবে যার যার মত টিকে থাকার অভিনয় করে যায়। আলাদা হতেও পারে না আবার না হলেই চলবে না এমন করেও আর ভাবে না। রাশেদ সাহেব বুঝতে পারেনহৃদয়টা ভেঙ্গে চৌচির হতে থাকে কিন্তু শুধু তার সন্তানদের তাগিদে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। মেয়েরাও কি মায়ের মত দূরে সরে গেছে? তাহলে সে কাকে নিয়ে, কার জন্য বেঁচে থাকবে? কার জন্য দেশে ফিরে যাবে? কে আছে ওখানে? দূরের অন্ধকার সাগরের দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে আছেনতার ছিল, অনেক কিছুই ছিল, তার মনি ছিল, মেয়েরা এসেছিল, সংসার সুখ ছিল, ছিল সীমাহীন বিশাল শান্তির সাগর। যে সাগরে ভেসে বেড়াত সে আর মনি। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে তার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। সময় তাকে অনেক বড় পুরষ্কার দিয়েছে। তার জীবন থেকে সব কিছু মুছে দিয়েছেসাগর পাড়ে বালিয়ারিতে অনেকেই শখ করে এটা ওটা নাম লেখে নানা কিছু লেখে কিন্তু সাগরের ঢেউ এসে এক মুহুর্তে সব মুছে পরিষ্কার করে দেয়, তার জীবন থেকেও কে যেন এমনি করে সব মুছে দিয়েছে।
এখন আর দেশে গিয়ে কি করবে? যেমন আছে তেমনি চলুক না! এই নয় বছরে পৃথিবীর অনেক পরিবর্তন হয়েছে সেই সাথে তাল মিলিয়ে মনিরও অনেক পরিবর্তন হয়েছে সেও অনেক বদলে গেছে রাশেদ সাহেব নিজে কি একটুও বদলায় নি? তাই তো, আমি নিজেও কি তেমন আছি যেমন আমি এসেছিলাম আজ থেকে নয় বছর আগে! এ প্রশ্নের জবাব কি আমি জানি? তাহলে আমার মনের আকাশে সারাক্ষণ মনি, তিথি, বীথী আর যূথী ছেয়ে থাকে কেন? আমি কি ওদের ভুলে গেছি? ওদের উপরে আমার দায়িত্ব কর্তব্য পালন করছি না? ওদের কষ্ট কি আমাকে দোলা দিচ্ছে না?
ইংল্যান্ডের সিকিউরিটি কোম্পানিতে যতদিন কাজ করেছে ততদিনে অনেক টাকা বেতন পেলেও নিজে হাতে নিয়ে দেখার সুযোগ হয়নি, সে টাকা মিজান সরাসরি মনির কাছে নয়ত লন্ডনে খুকুর একাউন্টে পাঠিয়ে দিয়েছে শুধু তার চলার জন্য সামান্য যা লাগে তাই তাকে দিতে বলেছে। তাকে দিয়ে যা থাকে সবই পাঠিয়ে দিয়েছে। বলতে গেলে মনিই সব টাকা হাতে পেয়েছে। টাকা না থাকলে ভালবাসে না কেও। এই টাকাই যদি রাশেদ সাহেব হিসেব করে পাঠাত তাহলে হয়ত আজ মনির অবস্থা অন্যরকম হোত। কিন্তু রাশেদ সাহেব তা পারেনি। প্রথমত তার কোন একাউন্ট ছিল না আর দ্বিতীয়ত মনির কাছে পাঠাবে না তাহলে কার কাছে পাঠাবে? মনিই যে তার সব। ভিতর বাহির অন্তরাত্মা সবই যে মনি। তাহলে? এতক্ষণে মনে হলো মনিকে সেই কখন বলেছে ক্ষুধা লেগেছে। যাই দেখি কি আছে, এখন আর কিছু রান্নার ইচ্ছে নেই সে শক্তিও নেই। কাল সকালে ব্রেড খেয়ে যাবে আবার দুপুরে গোডাউনেই খাবে কাজেই সন্ধ্যায় বাসায় এসেই একবারে রান্না করবে।
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top