নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-১১৪

২৩৫।
আহাদ তাকে মার্কেটের কাছে বাস স্টপেজে নামিয়ে দিল আর রাশেদ সাহেব পিপলস মুভারের স্ট্যান্ড খুঁজে এসে দাঁড়িয়ে রইলেনপনের মিনিট পরে পরেই বাস আসে। বেশ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন কোন দিক থেকে
কোন বাস আসছে যাচ্ছে। হালকা উজ্জ্বল সবুজ রঙের ডবল ক্যারেজ একটা  পিপল মুভার এর সিটি লুপ বাস এসে
সামনে দাঁড়াল এটা শহরের ভিতরে সার্কুলার লাইনে চলে। ডঃ পিক্সলি কাসামি থেকে ছেড়ে এসে সিটি হিল পর্যন্ত যাবে পথে প্লে হাউজ থিয়েটার, ট্যুরিজম ইনফরমেশন সেন্টার, ইংকোসি আলবার্ট লুথিলি কনভেনশন সেন্টার, ভিক্টোরিয়া মার্কেট এবং ডারবান জুমা মসজিদে থামবে। এটা চলে যাবার পরে আর একটা আসল সেটা বিচ লাইনে চলাচল করে। সান কোস্ট ক্যাসিনো থেকে ছেড়ে এসে উসাকা ম্যারিন ওয়ার্ল্ড পর্যন্ত এর চলাচল। পথে সাগর পাড়ের বিভিন্ন স্টপেজে থামবে আবার কেও ইচ্ছে করলে ডঃ পিক্সলি কাসামি স্ট্রিটে নেমে বাস বদলে সিটি লুপে ভ্রমণ করতে পারে। আর একটু অপেক্ষা করে দেখলেন এর পরে সিটি লুপ বাস এসেছে এক পথে যাত্রার ভাড়া সাড়ে ৫ রেন্ড আর ডে টিকেট ১৬ রেন্ডরাশেদ সাহেব একটা ডে টিকেট নিয়ে নিলেন, আজ সারা দিন ঘুরবেবাসে উঠে সামনের দিকেই বাম দিকে জানালার পাশে বসলেনএখানে যাতায়াতে খরচ ব্রিটেনের চেয়ে অনেক কম। মাত্র এক পাউন্ডেরও কমে ডে টিকেট ভাবতেও পারেনি, ব্রিটেনে ডে টিকেট ৭ পাউন্ডের কম না। আজকে যেখানে বাস থামছে সেখানেই নেমে একটু এদিক ওদিক হেঁটে দেখছেনপনের মিনিট পরে তো আর একটা বাস আসছে কাজেই অসুবিধা কি? তার এমন কোন কাজ নেই, রাতে রান্না করতে হবে না। এভাবে শেষ পর্যন্ত ডঃ পিক্সলি কাসামি থেকে ডারবান জুমা মসজিদ এবং ক্যাথিড্রাল পর্যন্ত সম্পূর্ণটাই দেখা হয়ে গেল। ভিক্টোরিয়া মার্কেটে নেমে হাঁটতে হাঁটতে আসছেন এমন সময় পকেটের মোবাইল বেজে উঠল, এখানে আমাকে আবার কে ফোন করবে? আহাদ নাকি?
মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলেন আহাদ ফোন করেছে
-কি ব্যাপার তুমি কোথায়?
-আমি এইতো হেঁটে আসছি, কেন তুমি কি ভেবেছ আমি হারিয়ে গেছি?
-না না আমি জানি তুমি হারাবে না, আচ্ছা আস
রাত ৮ টার দিকে বাসায় এসে পৌঁছলেনপৌঁছে দেখে কিচেনের খাবার টেবিলের উপরে কফি, চা পাতা, দুধ, ড্রিঙ্কস, বাটার, চিজ এমনি অনেক কিছু। নিশ্চয় আহাদ নিয়ে এসেছে। ওগুলি জায়গা মত গুছিয়ে রেখে এসে
বসার পরে আহাদ বলল-
-চল ক্ষুধা লেগেছে খেয়ে নিই
-হ্যাঁ আমারও ক্ষুধা লেগেছে সিটি হিলে নেমে একটু কেক খেয়েছিলাম, ভাবলাম অন্য কিছু হালাল না কি কে জানে তাই অন্য কিছু নেইনি
-ভালই করেছ তবে এখানে অনেক হালাল ফুড আছে ডেবোনায়ার পিজা, উইমপি, বার্সেলোজ, কন্টিনেন্টাল, চিকেন লিকেন, রোমানা পিজা, বাদশা, নান্দোজ এরা সবাই হালাল আরও আছে সে তুমি দেখলেই বুঝতে পারবে
-আমি ব্রিটেনে বাইরে সব জায়গায় সবজি আর ডিম ছাড়া আর কিছু খেতাম না
-হ্যাঁ এখানে ওরকম না ওখানকার চেয়ে এখানে মুসলিম বেশি বিশেষ করে কাউয়া জুলু আর নাটালে অনেক মুসলিম। এদেশে আসলে ধর্মের কোন মা বাবা নেই এখানকার ৭০% খ্রিস্টান আর ১৫% এর কোন ধর্মই নেই বাকি ১৫% মুসলিম, হিন্দু, ইহুদি এবং আরও অনেক ধর্ম আছে আমি এত নাম জানি না তবে তুমি হালাল দোকান খাবার এগুলি অনেক পাবে একটু দেখে নিবে বা জিজ্ঞেস করে নিতে পার এতে কেও কিছু মাইন্ড করবে না।
-ওকে চল খেয়ে নিই পরে গল্প করি।
খেতে বসে আজকের যাত্রার কাহিনী শোনালেন
-বাহ তুমি তো অনেক দেখে ফেলেছ!
-হ্যাঁ কাল আবার বিচ লাইনের বাসে উঠবো।
-পিপল মুভারে?
-হ্যাঁ হ্যাঁ পিপল মুভারেই গেছি আজকে। আচ্ছা আহাদ এখানে দেখছি ব্রিটেনের মত অনেক চেহারার মানুষ
-হ্যাঁ এখানে এরা মানে জুলুরা তো আছেই প্রচুর ইন্ডিয়ানও আছে তাছাড়া এই আফ্রিকান অনেক দেশের মানুষের বসবাস আছে
-সাদা চামড়াও তো দেখলাম
-আছে, তবে ওদের মধ্যে ডাচ, ইংলিশ আর পর্তুগিজ বেশি
-এখানে কোন লাইবেরি আছে?
-আছে, তুমি মার্কেটে যাবার আগে বাম দিকে যে রাস্তাটা গেছে ওই দিকে গেলে দেখবে ৯৯ উমগেনি রোডে এথিকেনি মিউনিসিপাল লাইবেরি সার্ভিস, কেন লাইবেরিতে কি করবে?
-এমনি কোন কাজ নেই শুধু এই দেশ সম্পর্কে জানার জন্য, একদিন যেতে হবে


২৩৬।
কয়েকটা দিন বেশ ভালই গেল সময় মত মসজিদে যেতে পারছে। শুধু একবেলা রান্না করে। সকালে  ব্রেড, চিজ, ডিম পোঁচ বা অমলেট দিয়ে নাশতা সেরে নেয় এ ছাড়া কর্নফ্ল্যাক্স দুধ তো আছেই। আহাদ এখন বাংলাদেশি স্টাইলে ঝাল অমলেট পছন্দ করেছে বলে অমলেটই বেশি করে। মাত্র দুইজন মানুষ আর কত রান্না করবে! একটু বেশি করেই করে যাতে আর একদিন চলে যায়। রান্না করা, খাওয়া, বেড়ান আর মসজিদে যাওয়া এই তো কাজ! দুই তিনদিন পরে একদিন কোন কাজ নেই, গতকাল পোলাও, মাংস রান্না করেছিল আর ভিতরে কিমার পুর দিয়ে আলুর চপ বানিয়েছিল তাই অনেক রয়ে গেছে আজ রান্না করতে হবে না। আহাদ অফিসে চলে যাবার পর বাসা থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে লাইবেরিত গেলেনবিশাল লাইবেরিএকপাশে লাইন ধরে কয়েকটা কম্পিউটারে ছেলে মেয়েরা সার্ফিং করছে ওপাশে দুই সেট সোফায় বসে বুড়ো বুড়িরা কেও সংবাদপত্র কেও বই পড়ছে। নীরব, পাশেই মেইন রোড কিন্তু ভিতরে কোন সাড়া শব্দ নেই। একেবারে ব্রিটেনের মত। এরা কাল হলে কি হবে আচার আচরণে সভ্যতায় অনেক এগিয়ে গেছে। এতদিন আফ্রিকানদের আমরা জানতাম অসভ্য মানুষ খেকো জংলি জাত কিন্তু বাস্তবে এদের ভিন্ন চেহারা দেখে রাশেদ সাহেব অবাক হচ্ছেন  রিসিপসন কাউন্টারে কম্পিউটারের আড়ালে বসে থাকা অল্প বয়সী কাল নিনিয়াকে জিজ্ঞেস করল-
-আমি তোমাদের এই দেশ সম্পর্কে জানতে চাই কোন বইতে এগুলা পাব?
-এখানে বসে পড়বে?
-হ্যাঁ এখানেই
-চল আমি বের করে দিচ্ছি
বলে কাউন্টার থেকে বের হয়ে সেলফ খুঁজে কয়েকটা বই বের করে দিলনাও, -আমার মনে হয় তুমি যা খুঁজছ তা এগুলিতেই পাবে।
নিনিয়াকে ধন্যবাদ জানিয়ে বইগুলা নিয়ে এক কোণার এক ছোট টেবিলে নামিয়ে মনে হলো অনেকক্ষণ ধরে পড়তে হবে শুরু করার আগে একটা বিড়ি টেনে আসি। বইগুলা নামিয়ে রেখে বের হবার পথে নিনিয়ার চোখে চোখ পড়ল। ইশারায় জিজ্ঞেস করল কি হলো? সেও তেমনি করে দুই আঙ্গুল এক করে দেখিয়ে বললো বিড়ি টেনে আসি।
আবার এসে বসলেনসেই ১৪৯৭ সাল থেকে পর্তুগিজ, ডাচ এবং ইংরেজ নাবিকদের দৃষ্টি এড়াতে পারেনি এই কাল মানুষের দেশের লোকেরা। প্রথমত শিকার করাই ছিল এদের পেশা পরে কৃষিকাজ। কোয়া-জুলু এদেশের সবচেয়ে বড় শহর এখান থেকেই এদের বিস্তার। ধীরে ধীরে ইউরোপীয় নাবিক বণিকের আনাগোনায় ভরে গেছে। ক্রমে ক্রমে তাদের বংশ বিস্তার হয়েছেব্রিটিশরাআঠার দশকে অনেক ভারতীয় এনেছে এদেশের উন্নয়নের জন্য। একসময় তারাও এখানকার বাসিন্দা হয়ে গেছে। অনেক স্থানীয় ভাষা চালু থাকলেও জুলু ভাষার প্রচলন বেশি। এছাড়া ইংরেজি এবং ডাচ ভাষাও সমান চলে। ডারবান এদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর। এই শহরের উন্নয়নের কাজ  হয়েছে ব্রিটিশ উপনিবেশের সময়। অনেক দীর্ঘ ইতিহাসজুলুদের নিজস্ব এই ভূখণ্ডে ইংরেজদের বিরুদ্ধে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে। ডারবানের কাছে জুলু নাটালও বেশ সমৃদ্ধ জনপদ ওখানে জুলুদের আধিক্য বেশ তবে ডারবানে ইংরেজ এবং ভারতীয়র সংখ্যা অনেক।
রাশেদ সাহেব পড়ছেন আর তার দেখা বাস্তবের সাথে মিলিয়ে তুলনা করছেনএখানে আফ্রিকান অনেক দেশের মানুষ দেখেছেন পথে বাজারে। মিশরিয় তো আছেই এছাড়া ইয়েমেনি, লিবিয়ান, সোমালি এমনি অনেক মানুষের ভিড় দেখেছেনদোকানিদের অধিকাংশই বিদেশি। এদেশের আবহাওয়া চরমভাবাপন্ন নয়। বৃষ্টিও ভালই হয়। আর্দ্রতার পরিমাণ স্বাভাবিক বলে বসবাসের জন্য বেশ আরামদায়ক।

ডারবান রেডিও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রেডিও স্টেশন। এখানে নিয়মিত জুলু, সাউথ আফ্রিকান ইংরেজি এবং ভারতীয় ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার হয়। ডারবান পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত বন্দর, এখানে জাহাজ মেরামতের জন্য অনেক শিপইয়ার্ড আছেএদেশের অধিকাংশ মালামাল পরিবহন এই বন্দরের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। এদের মেট্রো রেল, মটর ওয়ে সহ যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক উন্নত। রাশেদ সাহেব ওখানে যা যা দেখেছেন এখানেও একই ব্যবস্থা। পুরনো বিল্ডিং গুলাও ব্রিটেনের মত। রাস্তা ঘাট, বাস স্টপেজ, শহর সাজানোর ডিজাইন বা স্থাপত্য শৈলী একই রকম শুধু ভৌগোলিক কিছু ব্যবধান যেমন এখানে কিছু রুক্ষ পাথুরি পাহাড়ি মরু এলাকা আছে যা ওখানে দেখেনি। বন জঙ্গলের গাছপালার মধ্যে শীত প্রধান এলাকার গাছগাছালি যেমন ওক, সাইডার, পপলার গাছ এবং জুনিপারের ঝোপ ব্যতীত অন্যান্য প্রায় সব গাছই এখানে আছে। এখানে আরও অনেক গাছপালা আছে যা শীতের দেশে নেই এর মধ্যে বাওবাব গাছের নিজস্ব একটা বৈশিষ্ট্য আছে দেখতে বেশ ভাল লাগে। এমনকি এই লাইবেরিও ওখানকার মতই। দোকান পাট, বাস চলাচলের নিয়ম শৃঙ্খলা, টেলিফোন ব্যবস্থা এমনি শহুরে সব কিছুই এক।
অনেকক্ষণ পড়লেন, যখন ক্ষুধা লেগেছে তখন বই পত্র গুটিয়ে ভাবলেন আমার এত কিছু জানার দরকার নেই, কয় দিনই-বা এখানে থাকতে পারব এত কিছু জেনে কি হবে? দেখার বাকি ছিল ব্রিটেনের হোম অফিসের বদৌলতে দেখা হলো। ব্যাস, আরকি? যা হয়েছে অনেক হয়েছে।
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top