নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-১০৮

২২৩।
আহাদের ডাকে সম্বিত ফিরে আসল। -কিছু ভাবছ?
-হ্যাঁ অনেক কিছুই ভাবছি
-কি ভাবছ?
-না তেমন কিছু না, অনেকদিন ছিলাম তো এখানে তাই নানা স্মৃতি মনে আসছিল

রাতের খাবার সার্ভ করার জন্য হোস্টেসদের ছোটাছুটি দেখে রাশেদ সাহেব নিজেকে সম্বরণ করে নিলেন। আহাদের সাথে কথায় কথায় জেনে নিলেন মাতসাফা থেকে কেমন করে ডারবান ফ্লি মার্কেটে যেতে হবে।
-তুমি ইচ্ছে করলে আমার সাথেই যেতে পারবে
-আমি যে এখানে কয়েকদিন থাকব
-, বেড়াবে বুঝি?
-না ঠিক বেড়ান নয়..................
এ পর্যন্ত বলে একটু ভেবে দেখলেন তার এখানে আসার কারণ একে খুলে বলা যায়।
-আসলে আমি ডারবান যাবার জন্যেই এসেছি কিন্তু আমার সাউথ আফ্রিকার ভিসা নেই
-তাহলে চল আমার সাথেই চল আমি তোমাকে জোসেফডিল বর্ডার পার হবার সময় আমার গেস্ট হিসেবে নিয়ে যেতে পারব
-ভিসা দিবে?
-হ্যাঁ এক মাসের ভিসা পাবে
ভেবে দেখলেন, তাহলে আর এখানে থেকে সময় এবং হোটেল ভাড়া বাবদ টাকা খরচ করার কি দরকার? এত কষ্টের টাকা! ওর সাথে যাবার জন্য রাজি হয়ে গেলেই ভাল হবে।
-আচ্ছা তাহলে চল তোমার সাথেই যাব
-তুমি ডারবানে কোথায় যেন যাবে বলছিলে?
-জেকব জেকসন রোড, ফ্লি মার্কেট
-আমি পৌঁছে দিব


২২৪।
সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা পরে মাইকে এয়ার হোস্টেসের কণ্ঠ ভেসে আসল। ভদ্র মহিলা এবং মহোদয়দের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানাল তারা একটু পরেই মাতসাফা এয়ারপোর্টে নামবে। যাত্রীরা সবাই সিট বেল্ট বেঁধে নামার জন্য রেডি হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে জানালা দিয়ে দেখলেন প্লেন আস্তে আস্তে নিচে নামছে। মাতসাফা শহরের ছড়ানো ছিটানো বাতি দেখা যাচ্ছে, পূর্ব দিগন্তে লাল সূর্য উঁকি দিতে চাইছে। রাশেদ সাহেবের ভাগ্যের আকাশেও যদি এমনি একটা নতুন সূর্য উদয় হোত তাহলে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কি এমন ক্ষতি হোত? দিনরাত কত জনেরই কত কি হচ্ছে রাশেদ সাহেবের বেলায় এত কৃপণতা কেন? এক সময় একটু ঝাঁকুনি পেয়ে টের পেল প্লেন মাটি স্পর্শ করেছে। একটু পরেই গ্যাং ওয়ের কাছে এসে প্লেন থেমে গেল। দরজা খুলে দিল। সব যাত্রী নামার জন্য ব্যাকুল কিন্তু রাশেদ সাহেবের কোন তাড়া নেই। চুপচাপ বসেই রইলেনআহাদ কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিল
-কি হলো, নামবে না?
-হ্যাঁ চল
নেমে এসে আহাদের পিছনে ইমিগ্রেশন কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়ালেনবুক ঢিবঢিব করছে, কি জিজ্ঞেস করে কে জানে! না এখানেও কিছুই হলো না শুধু জিজ্ঞেস করল কতদিন থাকবে?
-এক সপ্তাহ
এক মাসের থাকার অনুমতি দিয়ে একটা স্টিকার লাগিয়ে দিলে পাসপোর্ট নিয়ে আবার আহাদের পিছে পিছে বের হয়ে এলেন

এয়ারপোর্টের বাইরে এসে নতুন দেশ দেখার আগ্রহ নেই, এখান থেকে কেমন করে বের হয়ে ডারবান পৌঁছাবে সেই ভাবনায় অস্থির। প্লেনে বসে আহাদ কথা দিয়েছে কোথাও কিছু না পেলে তার ওখানেই কাজ করতে পারবে এমনকি ওর ওখানেই থাকতে পারবে বলেছে। মেরিয়েন্টে বুলদানা রোডে ছোট একটা ফ্ল্যাট নিয়ে সে একাই থাকে। পাশেই মাদুলা এবং মার্টিন রোডের কোণায় একটা মসজিদ আছে ওখানে নামাজ পড়েআগে নাটালে থাকত নাটাল তার অফিস থেকে দূরে হয় বলে অল্প কিছুদিন আগে এই নতুন বাসায় এসেছে। সাগর পাড়ে  সুন্দর খোলামেলা এলাকা।
রাস্তায় এসে দেখল এই সাত সকালেই বিভিন্ন জায়গায় যাবার জন্য অনেক ধরনের যান বাহন। ওদের ভাষায় প্যাসেঞ্জার ডাকছে। ট্যাক্সি তো আছেই মিনি বাস যা এখানে চাপাস বলে তাতে করেও যাবার সুবিধা আছে। লোকাল বাস আছে আবার একটু এগিয়ে দেখলেন গ্রেহাউন্ড কোম্পানির কোচ দাঁড়িয়ে আছে। আহাদ কিসে করে যাবে রাশেদ সাহেব জানে না। কিছু জিজ্ঞেস করতে লজ্জা পাচ্ছে। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে আহাদের পিছনে হেঁটে সামনে এগুচ্ছে। একটা খাবারের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বললো চল খেয়ে যাই নয়ত সামনে খাবার পেতে অনেক দেরি হবে। মোটা নান জাতিয় রুটি আর অমলেট দিয়ে নাস্তা খেয়ে বের হয়ে একটা চাপাস এর পাশে এসে দাঁড়াল। অর্ধেকের বেশি যাত্রী বসে আছে, সবাই স্থানীয়। দরদাম করে আহাদ ইশারায় উঠতে বলে নিজেও উঠে বসল। আর কয়েকজন হলেই ছেড়ে দিবে। এতক্ষণে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলেনপাহাড়ি এলাকা তবে বেশ সবুজ গাছপালা আছে রাস্তা গুলিও চকচকে। রাস্তার পাশে খাবার দোকান সহ অন্যান্য অনেক দোকান কিছু বন্ধ আবার কিছু খুলেছে। মিনিট দশেকের মধ্যে গাড়িটা ভরে গেলেই ছেড়ে দিল। এয়ারপোর্ট এলাকা থেকে বের হয়ে সকালের খালি রাস্তায় বেশ স্পীডেই চালাচ্ছে। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে সোয়াজিল্যান্ডের বর্ডার পার হয়ে সাউথ আফ্রিকার সীমানায় চেকপোস্টের সামনে এসে গাড়ি থামল। এখানে যাত্রীদের পাসপোর্ট দেখবে। আহাদ রাশেদ সাহেবের পাসপোর্ট চেয়ে নিয়ে নেমে পড়ল। রাশেদ সাহেব এবং অন্যান্য যাত্রী সবাই নেমে কিউতে দাঁড়াল। একে একে চেক করে যখন আহাদের পাসপোর্ট ওই ইমিগ্রেশন অফিসারের হাতে দিল তখন স্থানীয় ভাষায় কি কি বললো রাশেদ সাহেব কিছুই বুঝতে পারল না। ওদের নিয়ে ভিতরে যেয়ে একটা ফর্ম আর তার সাথে একটা কলম দিল ফিল আপ করার জন্য। একটা চেয়ারে বসে রাশেদ সাহেব ফর্ম পূরণ করে সই স্বাক্ষর দিয়ে আহাদের হাতে দিলেনআহাদ স্পন্সর এর ঘরে সই করে ওর নাম ঠিকানা দিয়ে অফিসারের হাতে দিয়ে দিল। অফিসার সব কিছু দেখে রাশেদ সাহেবের পাসপোর্টে এক মাসের ভিসার সিল লাগিয়ে ধন্যবাদ বলে ফেরত দিয়ে দিল। এতক্ষণে রাশেদ সাহেব ঘেমে প্রায় ভিজে গেছেন

-চল একটু কফি খেয়ে নিই
এ পর্যন্ত দুর্দান্ত রকমের অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিল বলে বোধ বুদ্ধি কিছুটা বিলুপ্ত হয়ে ছিল কিন্তু এখন নির্বিঘ্নে সব কিছু হয়ে যাওয়াতে বুঝতে পারলেন বেশ ক্ষুধা লেগেছে তাই দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে বললেন চল। কেক আর কফি খেয়ে এবার নিশ্চিন্ত হয়ে আবার গাড়িতে উঠে বসলেনগাড়ি ছুটছে তো ছুটছেই। রাস্তার পাশের দৃশ্য এতক্ষণ চোখে পরেনি কিন্তু এবার পড়ছে। বেশ সুন্দর দেশ। কোথাও পাহাড়ি, কোথাও মরু এলাকার মত আবার কোথাও সবুজ বনজঙ্গল, দূরে আগে দেখা আফ্রিকার গোল ঘরের গ্রাম বসতিও দেখা যাচ্ছে কোথাও কোথাও তবে খুবই কম। বাউবাব, মোপান, মারুলা এমনি নানা গাছ, নারা ঝোপ, লালা পাম ঝোপ, বুশ উইলো রাস্তার পাশে দেখা যাচ্ছে। একটা গ্রামের পাশে দিয়ে যাবার সময় আপেল বাগান দেখা গেল। পথের পাশে স্ট্রবেরি, লেবু, আলু, ভুট্টা, ধনে পাতা এবং স্পিনাস ক্ষেত দেখা যাচ্ছে। সুন্দর দেশ। মনে হচ্ছিল ব্রিটেনের চেয়েও সুন্দর।

২২৫।
সন্ধ্যা হবার একটু আগে উমগেনি রোড এবং মাসাবালালা ইয়েঙ্গু এভিনিউর মাঝামাঝি এসে ওদের চাপাস থামলএ যাবত গাড়ি ভাড়া বা খাবার যা বিল হয়েছে সব আহাদই দিয়েছে রাশেদ সাহেবকে দিতে দেয়নি। রাশেদ সাহেব খুবই লজ্জায় ছিল কিন্তু জোর করে দিতে গেলে আবার কি করে বসে সেই ভয়ে তেমন চাপাচাপি করেনিএখানে নেমে একটা ট্যাক্সি নিয়ে আহাদের বাসায় চলে আসল। লিফট দিয়ে সাত তলায় উঠে তালা খুলে ভিতরে ঢুকে দেখে এক রুমের স্টুডিও টাইপের ছোট্ট ফ্ল্যাট। একা থাকার জন্য যথেষ্ট। কার্পেট পাতা একটা বড় রুম, একটা কিচেন, কিচেনের সাথে ছোট একটা খাবার টেবিল পাতা আর একটা টয়লেট। রুমে একটা খাট আর এক সেট সোফা পাতা পাশে একটা টেবিল, টেবিলে একটা কম্পিউটার এবং তার আনুসাঙ্গিক সরঞ্জাম।

পাকিস্তানি আসাদের চেয়ে এখানে আসাটাই নিরাপদ মনে হলেও বাসার এই অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করলেন-
-তুমি যে আমাকে এখানে নিয়ে আসলে এখানে দুইজনে থাকবে কেমন করে?
-আজকের মত এই সোফায় রাতটা কাটিয়ে দেয়া যাবে না?
-হ্যাঁ তা আর যাবে না কেন?
মনে মনে ভাবলেন, কি দুশ্চিন্তায়ই যে ছিলাম সে কথা কি আর তুমি জান? তোমাকে না পেলে কত দুর্ভোগ পোয়াতে হোত কে জানে নিশ্চয়ই কোন পুণ্যের ফলেই তোমাকে পেয়েছিলাম, তুমি ডারবানের ডাইরেক্ট ফ্লাইট পাওনিআদৌ এখানে এসে পৌঁছতে পারতাম কিনা তাই বা কে জানে!
-তাহলে চল আগে গোসল করে নাও তারপরে দেখি ফ্রিজে কি আছে। না থাকলে অসুবিধা নেই মার্কেটে চলে যাব ওখান থেকে খেয়ে আসব। চল চেঞ্জ করে শাওয়ার সেরে নাও। পরে দেখব, তোমার একটা থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। এত ভাবছ কেন? যতদিন না পাচ্ছ এখানেই থাকবে, আমার কোন অসুবিধা নেই।
রান্না ঘরে ফ্রিজ খুলে দেখল কয়েকটা আইস (নান রুটির মত), অল্প কিছু ফালাফাল (সবজি) এবং কয়েকটা সোমক মাশি (মাছের গ্রিল) আছে, রাশেদ সাহেবকে দেখিয়ে বললো -হবে না এতে?
-যথেষ্ট
-তাহলে চল গরম করে খেয়ে শুয়ে পরি।
পাশে রাখা মাইক্রোওয়েভে গরম করে খেয়ে নামাজ পড়ে আহাদ তার বিছানায় আর রাশেদ সাহেব সোফায় শুয়ে পড়লমিশরীয়দের আগেও দেখেছে, ওরা বিশেষ কোন কারণ ছাড়া নামাজ কাজা করে না। গতকাল তানিমের বাসা থেকে বের হবার পর থেকেই যে কি পরিমাণ উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিল সে আর কাওকে বুঝিয়ে বলার মত না। শরীরের ঘাম শুকচ্ছিল না, গলা শুকিয়ে আসছিল, কিছু ভাবতে পারছিল না সবকিছুই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল এমনি সব নানা উপসর্গ। এত সহজেই এখানে পৌঁছাতে পারবে কল্পনাও করতে পারেনি। নামাজের পরে তার নিয়তিকে শোকর জানিয়েছেনসোফার পাশে একটা ছোট্ট টেবিলে ফোন সেট দেখে মনে হলো এবার নিউ ক্যাসেলে মিজানকে একটা সংবাদ দিতে হয়! কিন্তু কি করে বলি? একটু ভেবে দেখলেন যে কি না এত কিছু করেছে সে একটা ফোন করতে বারণ করবে? না না তা হতে পারে না। নিজের পকেটের মোবাইলের কথা ভুলেই গেছেনলজ্জা  সংকোচ রেখে বলেই ফেললেন-
-আহাদ, ইউকেতে আমার বন্ধুকে একটা ফোন করে এরাইভ্যাল নিউজটা জানাব?
-অবশ্যই, ওই তো ফোন
এত সহজে আজই ডারবানে পৌছার কথা জেনে মিজান অবাক হলো
-আপনার ভাগ্য খুব ভাল চাচা
পথে আহাদের সাথে যে সব আলাপ হয়েছে তা সংক্ষেপে জানালেন
-তাহলে চাচা আপনি একেই ধরে রাখার চেষ্টা করেন আসাদের কাছে যাবার দরকার নেই, তবুও ওর ঠিকানা আর ফোন নম্বরটা রেখে দিবেন বলা যায় না কখনও যদি লাগে।

সকালে ল্যাপটপের ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে আহাদ বললো চল বের হই, বাইরেই খেয়ে নিব। লিফট দিয়ে নেমে আহাদ বললো একটু দাঁড়াও আমি গাড়ি বের করছি বলে ডানদিকে যেখানে এই বিল্ডিঙের বাসিন্দারা গাড়ি রেখেছে ওখানে চলে গেল। গত রাতে দেখেনি আজ দেখল নিচের পুরোটাই গাড়ি রাখার জায়গা। গাড়ি বের করার পরে রাশেদ সাহেব একটু এগিয়ে গাড়িতে উঠে বসলেনআবাসিক এলাকা ছাড়িয়ে মেইন রোডে এসে ডান দিকে ঘুরে সোজা চলল ওর অফিসে।
অচেনা শহর দেখতে বেশ ভালই লাগছিল। বেশ সুন্দর, আসার পথে যে সব গাছপালা দেখেছে এখানে শহরেও তেমনি বাউবাব গাছ এবং প্রায় প্রতিটা দালানের সামনেই সুন্দর বাগানে নানা ফুল ফুটে আছে। মিনিট দশেকের মধ্যেই কি যেন রাস্তার নাম লক্ষ করতে পারেনি একটা মার্কেট ছাড়িয়ে বেশ উঁচু বিল্ডিঙের সামনে এসে থেমে রাশেদ সাহেবকে নামতে বলে নিজেও নেমে একটু হেঁটে ওর অফিসে ঢুকল। অফিসটা খুবই সাধারণ গোছের, একটাই রুম তিনটা টেবিলে কম্পিউটার আর কয়েকটা চেয়ার ছাড়া বিশেষ কিছু নেই। ফ্লোরে বেশ কিছু ফলের কার্টুন পড়ে রয়েছে। রুমের মধ্যে নানা ফলের মিশ্রণের একটা গন্ধ। বুঝতে পারলেন ব্যবসা খুব বড় কিছু না। যাই হোক আহাদের ব্যবসার হিসাব নিতে সে এখানে আসেনি। তার একটা আয়ের পথ হলেই সে খুশি। থাকার জন্য কোন চিন্তা নেই, এটা অন্তত ইউরোপের মত শীতের দেশ না এখানে হয়ত ফুটপাথেও থাকা যাবে। এ ভাবে আহাদকে পাওয়া মানে আল্লাহতালা কোন দূত পাঠিয়েছেন। রাশেদ সাহেব এখন পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারছে না সে সত্যিই কোথায় আছে!
একটা চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলে আহাদ তার নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে বললো-
-এখানে একটু কাজ আছে এটা সেরে পরে গোডাউনে নিয়ে যাব।

রাশেদ সাহেব বসে বসে আবার ভাবনার সাগরে সাঁতার কাটতে শুরু করলেনমনি এবং মেয়েরা যখন জানবে তখন কি হবে? না, আগেই জানাবার কি দরকার? যেমন চলছে দেখা যাক কি হয়। ফিরোজ বা ব্রিটেনের ওরা জানলেই বা কি বলবে? মনে পড়ল তার পকেটে একটা মোবাইল রয়েছে। পকেট থেকে মোবাইল সেটটা বের করে অন করে ওদের সবার নম্বরগুলা দেখলেনব্রিটেনের সিম কার্ড রয়েছে, এখানকার কোন এক লাইনের সাথে নেটওয়ার্ক পাচ্ছে। একবার ভাবলেন ফিরোজকে একটা কল দিবে নাকি? কার্ডে কয়েক পাউন্ড রয়ে গেছে, এটা তো আর কোন কাজে লাগবে না! না থাক আরও কিছুদিন যাক তখন এখানকার একটা সিম নিয়ে সব কিছু খুলে বলা যাবে। এখানে থাকা হলে সিম একটা নিতে হবেআবার বাড়ির কথা মনে এলো মনি কি করছে? মনি কি কিছু বুঝতে পেরেছে তার জীবনের এত বড় একটা পরিবর্তন হয়ে গেছে? ও তো অনেক কিছুই কেমন করে যেন বুঝে ফেলে!

কতক্ষণ বসে থাকবে? আহাদকে বলে বাইরে দেখার জন্য একটু বের হয়ে পায়চারি করছেন আর তামাক টানছেনআসলে বিড়ি ধরাবার জন্যেই বের হয়েছেপকেটে একটা ওল্ড হলবর্নের নতুন প্যাকেট ছিলকার্ডিফের কাছে আবারগাভানি এলাকায় ডিউটি করার সময় ওখানে এরিনমোর না পেয়ে এই ওল্ড হলবর্ন ধরেছিলেন তারপরে আরা ছাড়তে পারেনি এটাই এখন ভাল লাগে। হাঁটতে হাঁটতে দেখলেন এটা বার্থা এমখিজ স্ট্রিটে ভিক্টোরিয়া স্ট্রিট মার্কেট। দোকানিরা ফুটপাথের পাশে নানা রকম সবজি ফল ফুলের পসরা সাজিয়ে বসেছে লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেলের মতইএকটু ঘুরে মার্কেটের ভিতরে ঢুকলেনানা রকম দোকানপাট। কাপর চোপর, প্রসাধনী, মেয়েদের গলার মালা চুরি ইত্যাদি, বিশেষ যেটা চোখে পড়ল তা হচ্ছে ইন্ডিয়ান মশলা সহ নানা দেশের নানা রকম মশলা কোনটা পাউডার আবার কোনটা আস্ত তবে প্রতিটা বস্তায় কাঠি দিয়ে কাগজে লেখা কোনটা কী আর দাম কত। আর একটু ভিতরে ঢুকে দেখলেন কাঁচা বাজার, নানা জাতের মাছ এবং মাংসের দোকান। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। অধিকাংশ দোকানিই স্থানীয় কাল চামড়ার তবে এশিয়ান কিছু দোকানিও আছেদেখে আবার আহাদের অফিসের সামনে ফিরে এসেছেন এমন সময় আহাদ বের হয়ে ইশারায় রাশেদ সাহেবকে ডেকে গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিল। কয়েক মিনিটের মধ্যে মার্কেট এলাকা ছাড়িয়ে আর একটা পুরনো বিল্ডিং ঘেঁষে গলির মধ্যে ঢুকে সামনেই একটা পুরনো বিল্ডিঙের সামনে দাঁড়ালগেট খোলা ছিল। ভিতরে ঢুকে দেখলেন বড় পাল্লার পাশে কাল মোটা একজন একটা ছোট টেবিলে বসে কি লিখছে। মাঝারি আকারের একটা হল ঘরের মত তার ভিতরে ১০/১২ জন কাল আর দুইজন বাংলাদেশের মত মনে হলো, বেশ বড় বড় টেবিলে বিভিন্ন ফল আপেল, মোসাম্বি, শ্যারন প্যাকিং করছেরুম বোঝাই বড় বড় ঝুরি ভরা ফল, আশেপাশে নানা সাইজের কার্টুন সাজান রয়েছে। সম্ভবত বাগান থেকে ওই ঝুরিগুলা এসেছে। রাশেদ সাহেবকে ইশারায় টেবিলের সামনের চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলে প্যাকিঙের ওখানে চলে গেল। একটু পরে একজনকে সাথে নিয়ে এসে রাশেদ সাহেবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।

লোকটা একটু হেসে বললো আমি জসীম, করমর্দন করে জিজ্ঞেস করল
-ভাই আপনি কবে এসেছেন?
-আমি রাশেদ। আপনি বাংলাদেশি? হ্যাঁ আমিও ভাবছিলাম, আপনারা মনে হয় দুইজনই তাই না?
-হ্যাঁ হ্যাঁ আমরা এইতো এই দুই জনেই বাংলাদেশি
-আমি গতকালই এসেছি, ইশারায় আহাদকে দেখিয়ে  ওর সাথেই লন্ডন থেকে এসেছি। এখানে কোথায় থাকেন?
-ওইতো সামনেই রাস্তার ওপাড়ে
এমনি আরও দুই চারটা কথা বলে, আচ্ছা ভাই পরে আলাপ করব আমাদের একটা অর্ডার আছে তার মাল প্যাক করছি বলে জসীম চলে গেল।
আহাদ আর একটা চেয়ার টেনে বসে বললো-
-তুমি ইচ্ছা করলে এখানেই কাজ করতে পারবে জসীম সামনের সপ্তাহে দেশে চলে যাবে। আপাতত আমার সাথেই থাক, কয়েকদিন বেড়াও পরে জসীম চলে গেলে ওর ওখানে থাকবে আর এখানে কাজ করবে। তোমাকে অফিসের কাজ দিতে পারতাম কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তুমি এদেশের ভাষা জান না। নানা জায়গায় যেতে হবে, স্থানীয় লোকদের সাথে কথা বলতে হবে বলে ভাষা জানা জরুরি যদিও এখানে ইংলিশ চলে কিন্তু সবাই তো আর ইংলিশ জানে না।
-না না ঠিক আছে আমি এই কাজই করতে পারব।
শুনে রাশেদ সাহেবের মনের যত ভয় ছিল সব ভোজবাজির মত উড়ে গেল। লন্ডন ছেড়ে আসার পর থেকে মনে যে ভয় ছিল, অনিশ্চয়তার ধুকপুক ছিল, কি হবে কি হবেনার মাঝে টলমল করছিল সব নিশ্চিহ্ন হয়ে কোথায় চলে গেল! এখন মনে শক্তি এসেছে। মনে মনে এক নিমেষেই মনি আর মেয়েদের সাথে কথা হলো। হে আল্লাহ, তুমি অনেক মেহেরবান। সত্যিই তার নিয়তি তাকে কোন স্থায়ী কিছু না দিলেও একেবারে পথে ফেলে দিচ্ছে না। তার পকেটে এখনও প্রায় দুই হাজারের বেশি ব্রিটিশ পাউন্ড আছে।
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top