নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-১০৭

২২০।
এ বিষয়ে আর কারও সাথে কোন আলাপ করার দরকার নেইএমনকি মনির সাথেও না। মনিকে শুধু বললেন আগামী কয়েকদিন একটু ব্যস্ত থাকতে হবে কাজেই ফোন না পেলে চিন্তা করবে না। তবুও মনি কি আর এমনিই ছাড়ার মানুষ?
কি কাজে এমন ব্যস্ত থাকবে যে ফোন করতে পারবে না? জীবনে কোনদিন মিথ্যে বলেনি বিশেষ করে মনির কাছে মিথ্যে বলা কিছুতেই সম্ভব নয়। বাস্তবের কঠিন অবস্থার প্রেক্ষিতে নিরুপায় হয়ে এটা সেটা বলে আপাতত বুঝিয়ে দিয়েছেনমাঝে একবার বার্মিংহাম গিয়ে পাসপোর্ট ঠিক করে এনে রেখেছেন, কখন কি করতে হয় তাই ভেবে। ওখানে সহকারি  ইমিগ্রেশন অফিসার ভাল একটা পরামর্শ দিয়েছিল, বলেছিল আপনার এত পুরনো পাসপোর্ট রিনিউ করতে যে খরচ হবে তার চেয়ে আপনি যদি বলেন তবে  নতুন একটা বই ইস্যু করে দিতে পারি, এটাই কিন্তু ভাল হয়, ভেবে দেখেন। তাই করেন বলে নতুন পাসপোর্ট ইস্যু করিয়ে এনেছিলেনদেশে ফিরে যেতে হলেও এটা দরকার হবে। মিজানের সাথে হিসাব নিকাশ মিটিয়ে টাকা পয়সা যা পাওনা ছিল তা নিয়ে ইউকে এর পাট চুকিয়ে রাশেদ সাহেব একদিন নিউ ক্যাসেল ছেড়ে তার একান্ত বন্ধু ল্যাপটপ আর কিছু পরনের কাপর একটা ব্যাগে নিয়ে লন্ডনে চলে আসলেনওখানে তেমন শীত পড়ে না তাই অতিরিক্ত শীতের কাপর নেয়ার দরকার নেই। এখন এখানে শীতকাল হলেও ওখানে সামার কাজেই এত বোঝা টেনে নেয়ার দরকার নেই। যাবার পর প্রয়োজনমত ওখান থেকেই কিনে নেয়া যাবে।

হঠাৎ করে রাশেদ ভাই কোন যোগাযোগ না করে চলে এসেছে বলে তানিম একটু অবাক হলো
-কি ব্যাপার ভাইয়া, হঠাৎ করে এসে পরলেন যে!
-এমনিই একটু কাজ আছে তাই আসলাম। আসল ঘটনা আড়ালেই রেখে দিলেন
পরদিন বাসা থেকে বের হয়ে সোজা চলে আসলেন হোয়াইট চ্যাপেলের এক ট্রাভেল এজেন্টের অফিসে। বেশি কোন কথা হলো নাপাসপোর্ট দেখে আগামী পরশু দিন রাত আটটার একটা টিকেট দিয়ে দিল। টিকেট নিয়ে চলে সোজা ফিরোজের বাসায়। যাবার আগে যতটা সম্ভব দেখা করে যাই। সন্ধ্যায় তানিমের বাসায় ফিরে রাতে খাবার সময় রাশেদ সাহেব বললেন আমি আগামী কাল একটু ব্রিস্টল যাব, সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে আসব।
-, আমরা ভাবছিলাম এখানেই বুঝি থাকবেন
-না, এতদূরে এসেছি তাই ওদের সাথে একটু দেখা করে আসি আবার কবে আসতে পারি তার কি ঠিক আছে?
-কালকেই আসবেন?,
-হ্যাঁ সকালে যাব আবার সন্ধ্যার কোচে বা ট্রেনে চলে আসব, পরশু বিকেলে বের হব।
-আচ্ছা ঠিক আছে ভাইয়া।

শাহেদও দাদার অবস্থা নিয়ে চিন্তিত ছিল। এখানে যে অবস্থা চলছে তাতে কখন যে কি হয়ে যায়! কিন্তু এই অবস্থায় নিজেদের কিছুই করার নেই। শাহেদের বৌ রেখাও হঠাৎ করে দাদাকে দেখে অবাক হলো।
-কি ব্যাপার দাদা! আপনি আসবেন আগে কিছু বললেন না, বলেই হা করে মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
-না চিন্তার কিছু নেই। একটা কাজে লন্ডন এসেছিলাম তাই ভাবলাম তোমাদের দেখে যাই।
শাহেদ কাজে গেছে, বিকেলের আগে ফিরবে না। রাশেদ সাহেব এদেশে আসার পর ভাতিজা হয়েছিল। তাকে দেখার সুযোগ পেয়েছে ওরা এখানে আসার পর। মাঝে মাঝে বড় চাচাকে পেয়ে ভাতিজা তাসিনের সাথে বেশ ভাব জমে উঠেছিল। বড় চাচাকে পেলে তার নানা কথা, নানা আবদার। কাকু তুমি নাকি বাবাকে অনেক কিছু শিখিয়েছ? কাকু, শোন মা সেদিন আমাকে বকেছিল তুমি মা কে একটু বকে দিও। আচ্ছা বাবা বকে দিব। বিকেল হলেই, চল না কাকু বাইরে থেকে ঘুরে আসি, পার্কে যাই, আমাকে সাইকেল চালান শিখিয়ে দিবে ইত্যাদি নানা আবদার, নানা কথা। তাসিনের দিকে তাকিয়েই রাশেদ সাহেবের মনটা কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। মেয়ে যাবার সময়েও এমন হয়নি। এদের সবাইকে ছেড়ে যেতে হবে? আর কোনদিন এখানে আসতে পারব না? তাসিন আর কোনদিন তার বড়কাকুকে এখানে দেখবে না? কাকে বলবে, মাকে বকে দিও! চোখ ভিজে আসার আগেই কঠিন রুক্ষ পাষাণের মত নিজেকে সামলে নিলেনএকে তো দেখে গেলাম কিন্তু জাহিদের মেয়েটা? ওকে দেখার সুযোগ করতে পারলাম না! যাক সব কিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে করা যায় না, কিছু এদিক ওদিক হয়েই যাবে। এটাও তেমনি। কিছু করার নেই। বেঁচে থাক ভাল থাক, একদিন দেখা হবে।

রাতে বাসা থেকে বের হবার সময় ওদের দিকে তাকিয়ে মনটা কেঁদে উঠল। তোমরা জান না আমি এখান থেকে চিরদিনের জন্য চলে যাচ্ছি সে কথা তোমাদের বলার মত শক্তিও আমার নেই, লুকিয়েই যাচ্ছি। এই ব্রিটেনের মাটিতে আর আমার পায়ের চিহ্ন পড়বে না আমাকে তোমরা কেও আর কোনদিন এখানে দেখবে না। আমার নিয়তি আমার নতুন গন্তব্য নির্ধারণ করে দিয়েছে আমাকে সেখানেই যেতে হচ্ছে। চোখ ভিজে ওঠার আগেই ভাতিজার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বাসা থেকে বের হলেন


২২১।
ব্রিস্টল থেকে রাত প্রায় এগারটা নাগাদ ফিরে এসেছেনরাতে তেমন কথাবার্তা হলো না। সকালে উঠে তানিম কাজে বের হবার আগে নাশতার টেবিলে তানিমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলেনতানিম বেরিয়ে যাবার পর আর কিছু করার নেই। মনটা ভীষণ ভাবে অস্থির। কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে নাবসার ঘরে গিয়ে টিভি খুলে বসে রইলেন আর একটু পরে রান্না ঘরে গিয়ে চা নিয়ে আসছেজীবনের প্রতি কেমন একটা বিতৃষ্ণা বোধ করছে কিন্তু মনি, খুকু, মাঝু আর ছোটনের কথা মনে এলেই আবার কেমন যেন হয়ে উঠেনএকা বসে বসে একে একে মর্জিনা সহ সবাইকে ফোন করে খোজ খবর জেনে নিলেনসূর্যাস্তের পরে আবার নতুন সূর্য উদয় হয় কিন্তু ততক্ষণ রাশেদ সাহেব টিকে থাকবে তো?
কেয়া এগিয়ে আসল
-কি ব্যাপার ভাইয়া আপনাকে কেমন যেন অস্থির মনে হচ্ছে
শুনেই চমকে উঠলেন, ধরা পড়ে গেল নাকি?
-না না তেমন কিছু না, রাতে ঘুম হয়নি তো তাই একটু কেমন লাগছে।

২২২।
বিকেলে চারটার মধ্যে রেডি হয়ে কেয়ার কাছে বিদায় নিয়ে বের হলেনকেয়ার চোখে চোখ পড়তেই কালকের মত চোখ ভিজে উঠতে চাইছিল কিন্তু আর দেরি করার উপায় নেই, কেয়ার কাছেও ধরা দেয়া যাবে না। বের হয়ে হেঁটে টিউব স্টেশনে এসে ডিসট্রিক্ট লাইনে চেপে অল্ডগেট ইস্টে এসে আবার হেমারস্মিথ লাইনে করে হেমারস্মিথ নেমে পিকাডেলি লাইনের টিউবে করে সোজা হিথরো এয়ারপোর্ট। আগেই এসে পড়েছে, চেক ইন হতে দেরি আছে। এয়ারলাইন্সের কাউন্টারের পাশে একটা সোফায় বসে রইলেনঅনেক কিছু ভাবনার স্রোতে ভেসে আসছে যাচ্ছে। মাটির এই পৃথিবীতে কিছুই নিশ্চিত নয়, যে যত পরিকল্পনা করুক না কেন কিংবা যত নিখুঁত হিসেব নিকাশ করে সিদ্ধান্তে আসুক না কেন শেষ পর্যন্ত ভাগ্য বা নিয়তির উপরে বিশ্বাস রাখতেই হবে। পরিশ্রম করে নিজের মেধা খাটিয়ে সব কিছুতে সফলতা আসে না। কি করেই বা আসবে সব কিছুই যে নিয়তি তার রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে পরিচালনা করছেন। গায়ে গরম জ্যাকেট ছিল তাই বেশ গরম লাগছে, আসলে মনের অস্থিরতার জন্যেই কিছু ভাল লাগছে না। উঠে এক কাপ কফি নিয়ে আসলেনজ্যাকেটটা কি এখানেই বিনে ফেলে দিয়ে যাবে? ওখানে লাগবে না! না থাক, বলে খুলে হাতে নিয়ে বসে বসে ভাবছেন

এই হিথরোতে আর কোনদিন আসা হবে না। গুডবাই লন্ডন, গুডবাই হিথরো। ভাবনার সাগরে ডুবে থেকে লক্ষ করেনি কফি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। যাত্রীদের হৈ চৈ কানে এসে ভাবনার সাগর থেকে ফিরে এলেনএক চুমুকে কফি শেষ করে চেয়ে দেখে কাউন্টার খুলেছে। এর মধ্যে কয়েকজন যাত্রী এসে কিউতে দাঁড়িয়েছে। রাশেদ সাহেব বসে বসে যাত্রীদের আচার আচরণ, গতিবিধি লক্ষ করছেনযেখানে যাচ্ছে তারা কেমন একটু বোঝার চেষ্টা করছেসবাই ওদেশের যাত্রী নয়, অধিকাংশই বিদেশি বিশেষ করে সাদা চামড়ার ইউরোপীয় বা আমেরিকান হবে হয়ত তবে এদের দিকে তার তেমন নজর নেই, সে বিশেষ করে লক্ষ করছে যাদের দেশে যাচ্ছে সেই দেশের নাগরিকদের। কালরা সাধারণত যেমন হয় এদের দেখে তেমন মনে হচ্ছে না, প্রায় সবাই নিরীহ শ্রেণীর। ছোট ছোট ছেলে মেয়েও আছে। সম্ভবত এখানেই থাকে। এর মধ্যে একজন এসে তার পাশে  বসলপ্রথমে একটু বিরক্ত হলেও লোকটা যখন নিজেই আলাপ শুরু করল তখন আর বিরক্তি রইল না। অল্প বয়সী ইজিপশিয়ান ভদ্রলোক, নাম আহাদ। সাউথ আফ্রিকার ডারবানে থাকে এখানে ব্যবসার কাজে এসেছিল। সরাসরি ডারবানের ফ্লাইট পায়নি বলে এই পথে যাচ্ছে। রাশেদ সাহেবও ডারবান যাচ্ছে ভেবে আগ্রহ নিয়ে আলাপ করলেনকথায় কথায় অনেক কিছু জানা হলোভদ্রলোক ফলের ব্যবসা করে, এদেশে ফল পাঠায়, মাঝে মাঝেই আসতে হয়। রাশেদ সাহেবকে দেখেই জিজ্ঞেস করল-
-তুমি কি বাংলাদেশী?
-কি করে বুঝলে?
-ডারবানে আমার সাথে কয়েকজন বাংলাদেশি কাজ করে, আমি বাংলাদেশিদের চিনতে পারি
-বাহ! বেশ ভাল কথা! কিন্তু কি ভাবে চিন?
-বাংলাদেশিদের চেহারার মধ্যে একটু নমনীয় কমনীয় ভাব আছে পাকিস্তানিদের মত উগ্র নয়

কথা বলতে বলতে চেক ইন শুরু হলো। ওরা উঠে গিয়ে কিউতে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েও আলাপ করছিল। ভদ্রলোকের সাথে আলাপ করে ভাল হয়েছে, এতক্ষণ বিষণ্ণ মনে একা বসে ছিল আর এখন অন্তত এই দীর্ঘ সময় কাটাবার একজন সঙ্গী পেয়েছেন তাছাড়া যেখানে যাচ্ছে সে সম্পর্কেও অনেক কিছু জানতে পারছেনমিজান যা বলে দিয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। চেক ইনের সময় রাশেদ সাহেব ভয়ে ঘামছিলেনকি জানি যদি ভিসা বা পাসপোর্টের অবস্থা দেখে কিছু জিজ্ঞেস করে তাহলে কি জবাব দিবে? কিন্তু কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। বোর্ডিং কার্ড পেয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলেনযাক অন্তত প্লেনে তো উঠে বসতে পারবে, পরে যাই হোক দেখা যাবে।

প্লেনে উঠেও মিসরিয় ভদ্রলোকের পাশাপাশি সিটেই বসল। একটু পরেই প্লেন টেক অফ করলজানালা দিয়ে বাইরের দিকে আলো ঝলমল হিথরোর দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ মনে আবার বললেন গুডবাই লন্ডন, গুডবাই হিথরো! যে আশা নিয়ে এখানে এসেছিলাম তার অনেকটা তুমি দিয়েছ কিন্তু আমার যে দরকার আরও অনেক বেশি। সেটুকু তুমি দিতে পারলে না! আমাকে আবার ছুটে যেতে হচ্ছে ভিন্ন দেশে! যাক তুমিই বা আর কি করবে? সবই আমার নিয়তি! আমার নিয়তি যেখানে নিয়ে যাবে আমাকে সেখানেই যেতে হবে। ওহে নিয়তি, যাযাবরের মত আমাকে আর কত ঘুরতে হবে? আমার কি কোন ঠিকানা হবে না? আর কত খড়কুটার মত ভেসে বেড়াতে হবে? নিয়তি তাকে দেখিয়ে দিয়েছে মানুষের জীবনের আশা ভঙ্গ আর দুর্দশার কোন হিসেব কেও মেলাতে পারে না, এমন কোন অঙ্কবিদ এই হিসাব মেলাতে পারেনি। সে কি করে পারবে এমন জটিল হিসাবের সুরাহা করতে?

কিছুক্ষণের মধ্যেই এত দিনের চেনা লন্ডন মহানগরীর রাতের নানা রঙের বাতির বাহার নিচে ফেলে রেখে প্লেন উড়ে চলল আফ্রিকার সোয়াজিল্যান্ডের মাতসাফা এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। সেই যেদিন এমনি করে ঢাকা এয়ারপোর্ট ছেড়ে এসেছিলেন সেদিনের মত নানা স্মৃতি ভেসে আসল মনের সাগরে, বুকের কোণায় জুড়ে থাকা অনেক পাওয়া না পাওয়ার স্বপ্ন পিছনে ফেলে এগিয়ে চললেন আর এক নিরুদ্দেশের পথে। সেদিন মনি সাথে ছিল আজ সে একা।
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top