নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-১১৭

২৪২।
দিন যতই গড়িয়ে যাচ্ছে রাশেদ সাহেবের সব কিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আগের মত কিছুতেই আর নিজের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কাজে লাগাতে পারছে না। সবসময় কেমন যেন উদাসী, বিষণ্ণ মনে হয়। এখানে আসার পর থেকে বাংলায় কথা
বলা এক স্বপ্নের ব্যাপার হয়ে গেছে ইউকে তে ওদের সাথে তেমন কথা হয় না এদেশে যাতায়াত বাবদ খরচ কম হলেও ফোনের জন্য অনেক খরচ। কাজের জায়গায় ইমতিয়াজের সাথে তেমন কথা বলার সুযোগ পাওয়া যায় না। দেশে মনি এবং মেয়েদের সাথে বিনে খরচে কম্পিউটার দিয়ে স্কাইপিতে কথা বলা গেলেও কতটা বলা যায়? আজকাল কথা বলতেও আর ভাল লাগে না। আগের মত ছুটির দিনে বাসের ডে টিকেট নিয়ে বেরিয়ে পড়ে না, কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না, কিছু দেখতে ইচ্ছে করে না এমনকি ভোজন রসিক নামে বিখ্যাত রাশেদ সাহেবের আজকাল কিছুই খেতেও ইচ্ছে হয় না। এখানে সুপারস্টোরে টিনে বা প্যাকেটে যা রেডি পায় তাই খেয়েই দিন কাটিয়ে দেয়। রান্না বান্না ঝামেলা মনে হয়। আহাদ ঠিক করেছে এখান থেকে কায়রো চলে যাবে। দেশে বড় ভাই একা সামাল দিতে পারছে না আবার এদিকে ও নিজেও খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না।

২৪৩।
এদেশে নানা ফলের বহারক্রো বেরি, ক্লাউড বেরি, হানি বেরি, ব্ল্যাক বেরি, আপেল, রোজ আপেল, আঙ্গুর, কাল আঙ্গুর, বাতাবি লেবু, ডুমুর, চেরি, কলা, পেঁপে, এপরিকোট, প্লাম, কাঁঠাল, আনারস, লিচু, পেয়ারা কি হয়না এখানে? রাশেদ সাহেব অবাক হয়েছেনযথেষ্ট কাল আঙ্গুর হয় বলে এখানে লাল ওয়াইনের অনেক ডিস্টিলারি দেখেছে, এখানকার তৈরি লাল ওয়াইন নাকি বেশ বিখ্যাত সাড়া বিশ্বেই এর কদর। তাছাড়া প্রতিদিন নিজেই কত রকমের ফল প্যাক করছেনআবার ফসলের জমিতে দেখেছেন ভুট্টা, গম, আলু, ধান, তুলা, পালং শাক, আখ, পিঁয়াজ, কাঁচামরিচ, ভেড়া, ছাগল, গরু, টার্কি অনেক, অনেক কিছুই এদের আছে। সম্পদে ভরা, কোন কিছুর অভাব নেই। অনেক ফল দেখেছেন যা চিনতে পারেনি।
আহাদের ব্যবসা এতদিন ভালই চলেছে কিন্তু এখন কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। বড় ভাই বলেছে সে সাউথ ইস্ট এশিয়াতে শুধু খেজুর রপ্তানি করে কুলিয়ে উঠতে পারছে না তুমি এখানে চলে এসোকি করবে ভেবে পাচ্ছে না।
আহাদ চলে গেলে রাশেদ সাহেবকেও চলে যেতে হবে। একমাত্র আহাদই তাকে এখানে রাখতে পারছিল। থাকার জায়গা থেকে কাজ এবং একটা বনেদি এলাকায় দামি বাসায় থাকার সুবিধা সেই দিয়েছিল ও চলে গেলে কে আর এমন করে দিতে পারবে? ওদিকে বাড়ি থেকে মনি তো বলছেই এখন তার সাথে যোগ হয়েছে মেয়েরা। বড় মেয়ে সেদিন বলে দিয়েছে তুমি এক সপ্তাহের মধ্যে চলে আস। বীথীও কয়েকদিন যাবত একই কথা বলে যাচ্ছে, আব্বু আমি এখন চাকরি করছি তুমি চলে আস।  কয়েকদিনের মধ্যেই যূথীর রেজাল্ট হবে ও একটা কিছু করতে পারবে, তুমি এত ভাবছ কেন আব্বু? আমরা তোমাকে ছাড়া আর কত দিন থাকব? রাশেদ সাহেব মেয়ের এই প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারেনি, শুধু চোখের পানি ঝরেছে। আবার শাহেদের বৌ দেশ থেকে ফিরে  বিলাত গিয়ে বলেছিল-
-দাদা ভাবীর অবস্থা ভাল না, আপনি চলে যান।
কিন্তু বাস্তবতা ভেবে রাশেদ সাহেবের মন সায় দিতে পারেনি। দেখি কি করা যায়। এদিকেও এই অবস্থা। কি করবে আর কি করবে না এক দোদুল্যমান অবস্থায় পড়ে গেলেনকারো সাথেই পরামর্শ করার নেই। আর পরামর্শ করেই বা কি হবে? সবাই এক বাক্যে বলবে দেশে ফিরে যাও কিন্তু দেশে ফিরে গেলে যে প্রতিদিন সকাল হবার আগেই খাবারের জোগান রাখতে হবে তা কোথায় পাবে? সে জোগান আর কেও দিবে না কাজেই আর কারো সাথে পরামর্শ করে কোন লাভ নেই। যা ভাবার তাকেই ভাবতে হবেভাগ্যনামেরঅদৃশ্যশক্তিরাশেদসাহেবেরসাথেঅসাধারণনৈপুন্যেরসাথেনিদারুনখেলাখেলছেকিন্তুরাশেদসাহেবপেরেউঠছেননাএখেলায়একতরফাভাবেইতারভাগ্য তার বিরুদ্ধেগোলেরপরগোলদিয়েযাচ্ছেতারযদিতেভরাজীবনকোননিশ্চয়তাখুঁজেপাচ্ছেনাকিন্তুমনিকেএইসাধারণকথাকিছুতেইবোঝাতেপারছেননাশুধুমনিকেনকাওকেইবোঝাতেপারছেননা
মাসখানিক পরে আবার বড় মেয়ে ফোন করে বললো-
-কি ব্যাপার তোমাকে বললাম না এক সপ্তাহের মধ্যে চলে আস, আসছ না কেন?
-বললেই কি আর যেতে পারি?
-কেন পারবে না? আজই টিকেট করে চলে আস।
সেদিন বলেছিল এক সপ্তাহের মধ্যে যেতে আর আজ বলছে আজই যেতে! হয়েছে কি? কারো সাথে কথা বলবে না বলে ফোন অফ করে রেখেছিল কয়েকদিন কিন্তু মন থেকে সায় পাচ্ছিল না। ক্লান্ত দুর্বল মন মেনে নিতে পারছিল না তাই আবার অন করেছে।


২৪৪।
রাতে খাবার টেবিলে আহাদের সাথে আলাপ হলো।
-তাহলে তুমি কী ভাবছ, চলেই যাবে?
-হ্যাঁ তাই যেতে হবে, থাকার উপায় নেই তুমিও চলে যাচ্ছ তুমি কি বল?
-আমার মনে হয় চলে যাওয়াই ভাল। তোমার সবাই থাকতেও কতদিন এভাবে একা একা থাকবে?
-বেশ চল কাল ট্রাভেল এজেন্টের অফিসে যাই

পরদিন সকালে অফিসের সময়ে বের হয়ে ওভার পোর্ট সিটি সেন্টারে হার্ভি ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল এজেন্টের অফিসে চলে আসলএখানে ইয়াসমিন ওয়াকারের সাথে আলাপ করে কাতার এয়ারওয়েজের একটা টিকেট নিয়ে নিলেন সামনের বুধবার বিকেলে ফ্লাইট, আজ শনিবার। ডারবান নগরী থেকে বাইশ মাইল উত্তরে কিং সাকা বিমান বন্দর থেকে ফ্লাই করে দোহা ট্রানজিট হয়ে ঢাকা পৌঁছবে। বিশাল জার্নি, দোহাতেই প্রায় বিশ ঘণ্টা ট্রানজিট আর দুই পাশে তের ঘণ্টা ফ্লাইং। আহাদের মনটা খুব বিষণ্ণ। আহাদ আপন কেও না হলেও অনেকদিন এক সাথে কাটিয়েছে। সুখ দুঃখে একত্রেই ছিল। এখানে অচেনা প্রবাসে সেই তো আশ্রয় দিয়েছিল, সে না হলে কি হোত কে জানে? এই আশ্রয় ছেড়ে কোন এক অদৃশ্য ব্যবস্থায় আজ দুজনকে দুই দেশে চলে যেতে হবে। আহাদও আর মাত্র মাস খানিক থাকবে তারপরে কায়রো চলে যাবে। আহাদ ভেবেছিল দুইজনে একসাথে যাবে।

রাশেদ সাহেব নানা চিন্তায় অস্থির। অনাগত অনিশ্চয়তা, দীর্ঘদিন সবার থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে এখন কি আর ওরা আমাকে সাদরে মেনে নিবে? বিশেষ করে কেও খালি হাতে বা অসুস্থ হয়ে বিদেশ থেকে ফিরে গেলে, তা সে যত আপনই হোক না কেন বরণ করে নেয়ার জন্য, সাদরে গ্রহণ করার জন্য ডালা সাজিয়ে বসে থাকে না। অনেকদিন একা থেকে তার মনে একাকীত্বের দুরূহ যে যন্ত্রণা বয়ে যাচ্ছে সে কি পারবে কেও মুছে দিতে? কেও তো বুঝতেই চাইবে না। আপনজন ছাড়া বিদেশের মাটিতে এতগুলা দিন তার কি ভাবে গেছে! একা থাকার কি যন্ত্রণা সে অনুভব করেছে কতখানি হৃদয় বিদারক অবস্থায় সে দিন কাটিয়েছে এই কি কেও বুঝতে চাইবে? দেশে ফিরে যাচ্ছে কিন্তু তার মনে কিছুতেই আনন্দ উচ্ছ্বাসের ঢেউ বইতে পারছে না। তার পরিবর্তে হতাশা নিরাশার একটা কালো ছায়া তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সে জানে তাকে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top