রেশমি-[৩]-২

৪।
ঠিকানা হীন ভাসমান জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে বেদেরা ইসলাম ও হিন্দু উভয় ধর্মই মেনে চলে তবে তারা নিজেদেরকে মুসলমান দাবি করে এবং অনেকেই ওয়াক্তিয়া নামাজ সহ জুম্মার নামাজ এবং ঈদের নামাজ মসজিদে
আদায় করে কিন্তু রোজা রাখার ব্যাপারে এদের অনীহা। উপার্জনের মৌসুম শেষ হলে বেদে পরিবারে বিয়ের আয়োজন করে। বিয়ে শাদীর সময় হিন্দু রীতিনীতি পালন করে, বিয়ের পরদিন সূর্য ওঠার আগে কনের মাথায় সিঁদুর দেয়া হয় যদিও বিয়ে পড়ানো হয় ইসলামি মতে মওলানা দিয়ে। মেয়ে যে পুরুষকে পছন্দ করবে সে পুরুষের সম্মতি থাকলে সে
বিয়ে হবে। বিয়ে করতে হলে কনেকে যৌতুক দিতে হয়। যার যেমন সামর্থ্য, সে তাই দেয়। এ অর্থ বেদেনীর কাছে জমা থাকে শত বিপদ আপদেও খরচ করতে চায় না।  বিয়ে এবং তালাক উভয়ই হয় কনের ইচ্ছায়, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনও কারণে ছাড়াছাড়ি হলে সম্পত্তি সহ ছেলে-মেয়েও ভাগাভাগি হয় এবং তালাকের সময় স্বামীর দেয়া যৌতুকের অর্ধেক স্বামীর পরিবারকে ফেরত দিতে হয়। বিয়ের রাতে স্বামীকে সন্তান পালনের জন্য প্রতিজ্ঞা করতে হয়। যতদিন স্ত্রী উপার্জনের জন্য বাইরে থাকে, ততদিন স্বামী-সন্তানের প্রতিপালন করে। বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর নৌকায় যায়। স্ত্রীর নৌকাই স্বামীর নৌকা। ঈদের চেয়ে এরা বিয়েতেই বেশি আনন্দ করে তবে বিয়েতে আপ্যায়ন বা উপহার দেয়ার কোন রীতি নেই। এমনিই নাচ গান করে এই আনন্দ করে। বিয়েতে বর কনেসহ উপস্থিত সবাইকে নাচগান করতে হয়। বাইরের কেউ এলে তাকেও নাচতে হয়। এসব নাচ গান একান্তই বেদে সম্প্রদায়ের নিজস্ব সংস্কৃতি। অবিবাহিত মেয়েরা আকর্ষণীয় জমকালো সাজ গোঁজ করে কোমর দুলিয়ে নেচে গেয়ে নিজেদের শারীরিক সৌন্দর্য তুলে ধরে অন্য যুবকের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে। তরুণ-তরুণীরা এভাবেই  বিয়ের অনুষ্ঠানে নিজেদের সঙ্গী খুঁজে নেয়। ভিন্ন সমাজের কোনও যুবক উপস্থিত থাকলে তাকেও বেদে নারীরা বিয়ের জন্য প্রলুব্ধ করে এবং সে তরুণ যদি বেদে তরুণীকে বিয়ে করে, তাহলে তাকেও বেদেদের গোত্রভুক্ত হতে হয় নতুবা তাদের সমাজচ্যুত করা হয়। মৃত্যুর পর ইসলামি নিয়ম অনুযায়ী দাফন করে এবং চল্লিশা বা কুলখানির আয়োজন করে। আবার সর্প দংশন থেকে বাঁচতে মা মনসার পূজা করে এবং শিব, ব্রহ্মাও বিশ্বাস করে।

৫।
ঝিটকা আসার আগে শিবালয় ঘাটে যখন ছিল তখন থেকে লক্ষ করছে আসা যাওয়ার পথে নৌকায় বা ঘাটে বসে কেমন করে চোখ বাকিয়ে জসীম তাকিয়ে থাকে। ইশারায় ইঙ্গিতে কিছু বলতে চায়, একা থাকলে এটা সেটা কিনে দিতে চায় কিন্তু রেশমি পাত্তা দেয় না তবে মনে মনে বসন্তের আনাগোনা অনুভব করে। ইশারার তোয়াক্কা না করে সেদিন বলেই ফেলল চল না ওই গাছের নিচে একটু বসি! রেশমি কোন জবাব না দিয়ে চলে এসেছিল। সমবয়সী ফুলির বিয়ের সময় নাচতে নাচতে কখন যেন জসীম কাছে এসে হাতটা ধরে ফেলল।
কি হলো আমার কাছে আসছস না কেন?
চমকে উঠে বলল, হাত ছাড় কইলাম, তুই আমারে ছুবি না
কেন, কি হইছে আমি কি তোর যোগ্য না?
আগে হাত ছাড় পরে অন্য কথা
হাত ছাড়ার জন্যে ধরছি মনে করছস?
হাত ছাড় নইলে সবাইরে ডাক দিমু আমি

দলের নিয়ম অনুযায়ী জোর করে প্রেম হয় না। নালিশ হলে কঠিন শাস্তি। তাই ভয়ে হাত ছেড়ে দিল কিন্তু ওর কথা ভেবে দেখার এবং অনেক যৌতুক দেয়ার লোভ দেখাল।
সারা জীবন তোর গোলাম হয়ে থাকব রে রেশমি তুই শুধু আমার কথা একটু ভেবে দেখবি।
তুই আমার দিকে তাকাবি না, আমার কাছে আসার চেষ্টা করবি না
সেদিনের মত ছাড়া পেল কিন্তু তার পরে থেকেই রেশমি বুঝতে পারে তার মনে জোয়ার এসেছে, পরিপূর্ণ টইটুম্বুর জোয়ার টলমল করছে। গায়েও তেমনি নতুন জোয়ারের ঢেউ এসে দোলা দিয়েছে। বাড়ন্ত গড়নের জন্য মায়ের কড়া নির্দেশে অনেকদিন আগেই ফ্রক ছাড়তে হয়েছে। শারীর আঁচল দিয়ে নিজেকে ঢেকে রাখতে শিখিয়েছে মা। বসন্তের সদ্য ফোটা কৃষ্ণচূড়ার থোকা থোকা লাল ফুলের আবেশ ছড়িয়ে যাচ্ছে রেশমির দেহে মনে। চারদিকে যা দেখে সব কিছু রঙ্গিন মনে হয়। রেশমি বুঝতে পারে সে এখন বড় হয়েছে। পনের থেকে ষোলয় পা দেয়া রেশমি জসীমকে নিরস্ত করতে পেরেছে কিন্তু তার মনে রঙ ধরাবার মত কাওকে দেখা যাচ্ছে না! কে আসবে তার কাল নাগ হয়ে? যে ছোবল দিতে জানে! এমন কাওকে দেখছি না!  আমাদের এই দলে এমন কেও নেই। এই ঘাট ছেড়ে অন্য ঘাটে গেলে খুঁজতে হবে। জসীম একটা ঢোঁরা সাপ! ওর মধ্যে কিছু নেই ওর ডাকে সারা দেয়ার চেয়ে গলায় কলশী বেঁধে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়া অনেক ভাল।

৬।
গোপীনাথপুর থেকে ফিরে আসার পরের দিন রেশমি দলের সাথে বের হয়েছে। আজ তার পরনে সবুজ পাড়ে কুসুম রঙ শারী, হলুদ ব্লাউজ, গলায় আগের মত পুতির মালা, হাতে লাল চুরিতে দারুণ মানিয়েছে। জরিনা বলেই ফেলল
তরে আইজ খুউব সুন্দর লাগতেছেরে রেশমি, তুই যে আজ কারে পাগল করবি কে জানে! দেখিস সাবধানে থাকবি নাইলে কিন্তু সর্দার দল থিকা বাইর কইরা দিবনে।
এই শুনে সুফি বলল
দেখস না একটু কাজল দেয় নাই কপালে একটা টিপও নাই তাও কি সুন্দর লাগতেছে!
হিরা খিল খিল করে হেসে বলল
অরে আবার দল ছাড়া করব কেরা ওতো সর্দারের মাইয়া!
এমনি হাসি আনন্দে এগিয়ে যাচ্ছে। আজকে ওপাড়ে যাব না চল ওইদিকে যাই বলে ঝিটকা স্কুল ছাড়িয়ে পুব দিকে গেল। যেতে যেতে হুগলাকান্দি এসে পৌঁছল। গ্রামে ঢুকে হাঁক দিল
চুরি নিবেন চুরি! রেশমি চুরি বেলোয়ারি চুরি আরও আছে ফিতা, কাটা, আলতা, কাজল!
মাঝে মাঝে সুরেলা গলায় গান গাইছে
সঙ্গীরা নানা দিকে ছড়িয়ে গেল। এক সাথে থাকলে কে বেচবে কে দেখবে তাই এদের এই রীতি। এক সাথে বের হয়ে পরে যার যার সুবিধা মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। আবার বেলা শেষে এক জায়গায় জড় হয়ে এক সাথে ঘাটে ফিরে আসে।
গ্রামের ভিতরের দিকে একটু এগিয়ে যেতেই এক বাড়ি থেকে ডাকল
এই বাইদানী!
রেশমি শব্দ অনুসরণ করে বাড়ির উঠানে ঢুকে মাথার ঝাঁকা নামিয়ে ডাকল
কইগো বিবি সাবেরা আহেন
বাড়ির মেয়েদের একে একে তার পণ্য সম্ভার দেখাচ্ছে। বাড়ির মেয়ে মহিলা সহ বুড়িরা পর্যন্ত সবাই ঘিরে ধরেছে। পাশের বাড়ি থেকেও বৌ ঝিরা এসেছে।
রতন এই বাড়ির ছেলে, ঝিটকা প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করে। স্কুলে যাবার জন্য বের হয়ে দেখে উঠানের মাঝখানে মা বোন এবং ভাবিদের জটলা। কি ব্যাপার এরা সবাই কি দেখছে? পায়ে পায়ে কাছে এগিয়ে এক বোনকে সরিয়ে দাঁড়াল। বেদেনীর মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক স্তব্ধ হয়ে গেল। আগেও অনেক বেদেনী দেখেছে কিন্তু তারা শুধুই বেদেনী আর কিছু নয়। কিন্তু এ যেন ভিন্ন কেও, এ কি আসলেই বেদেনী? এত সুন্দর! মানুষ এত সুন্দর হতে পারে? অবাক চোখে ওর মুখের দিকে তাকিয়েই রইল। বোন ভাবিরা নানা কিছু কেনা কাটা করছে কিন্তু রতনের কোন দিকে হুশ নেই। স্কুলের দেরি হচ্ছে সেদিকেও মন নেই। হঠাৎ করেই এক ভাবির চোখে রতনের কাণ্ড ধরা পরল। সে আবার বড় জা কে দেখাল। কিরে রতন বাইদানীরে এত দেখার কি আছে? মনে ধরেছে নাকিরে রতন? ভাল করে দেখ, পছন্দ হলে বল, কি সুন্দর বেদেনী! সবাই এদিকে রতনের অবস্থা দেখে অনেকক্ষণ হাসাহাসি। ওরাও বলাবলি করছিল মেয়েটা খুব সুন্দর। আহারে, কি জন্যে যে এই মেয়ে বাইদার ঘরে জন্মেছে! এই রূপ নিয়ে কি গাও গেড়ামে ঘুরে ফেরি করা যায়? কবে কি হবে কে জানে! রতন বুঝতে পেরে স্কুলের পথে পা বাড়াল। কিন্তু বাড়ি ছেড়ে আসার পরেই তৃষ্ণার্ত মন আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেল। বাড়িতে ওঠার পথের পাশে বড় জাম গাছের নিচে বেদেনীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল। বেচা বিক্রি করে বেদেনী বাড়ির বাইরে এসে জাম গাছের নিচে রতনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে
কি গো বাবু, তুমি যে কিছু নিলা না?
কি নেব, আমার কিছু কি তোমার কাছে আছে?
কি যে কও, কত কি আছে, বিবি সাবের জন্যে চুরি নেও খুশি হইব, কও কি নিবা বলেই মাথার ঝাঁকা আবার নামাল
আচ্ছা নেব, আগে বল তোমার নাম কি?
আমরা হইলাম ছোট জাত, আমার নাম দিয়া কি করবা
তোমরা কোন ঘাটে থেমেছ
ওইতো ঝিটকা বাজারে
বল না তোমার নাম কি?
কইলামতো আমার নাম দিয়া কি করবা? আমারে বিয়া করবা?
আহা! বল না!
রেশমি। কইলামতো এহন কি নিবা কও
রতন বিপদে পড়ল। এখন কি করে? বোনেরা তাদের সব নিয়ে নিয়েছে। কার জন্যে নিবে?
নিরুপায় হয়ে ছোট বোনকে ডাকল
এই ঊষা
ঊষা বাইরে এসে ভাইকে দেখে অবাক, দাদা তুই স্কুলে যাসনি?
তোরা কি কি নিয়েছিস? আর কিছু নিবি?
তুই কিনে দিবি?
দেখ আর কি লাগবে
ঊষা সুযোগ পেয়ে আরও অনেক কিছু কিনে বাড়ির ভিতরে চলে গেল।
রতন পকেট থেকে টাকা বের করে বেদেনীর হাতে দিতে দিতে বলল
কাল কোন গ্রামে যাবে?
কি যে কও বাবু! আমাগো কি কোন ঠিক ঠিকানা আছে যেদিন যেদিকে মনে চায় সেদিকেই যাই, কেন? আবার কি নিবা?
আশেপাশে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিয়ে সাহস করে রতন বলেই ফেলল
আর কি নিব? আমি তোমাকেই নিতে চাই
কি কইলা বাবু?
আমতা আমতা করে রতন আবার কথাটা বলল, আমি তোমাকে নিতে চাই
রেশমি অবাক চোখে বাবুর আপাদমস্তক দেখল। বাবুর ঠাট আছে, শরীরতো নয় যেন এক্কেবারে কেউটে সাপ! দাতে বিষ আছে! এরেই কয় পুরুষ মানুষ। পুরুষ হইলে এমনই হইতে হয়। এর আগে গাওয়ালে এমন কথা কেও বলেনি। তবে ঠারে ঠারে চাউনি দেখেছে, পুরুষ মানুষের চাউনির মানে রেশমি বুঝতে শিখেছে। নানান প্রস্তাব শুনেছে, ইতর প্রস্তাব। ওকে দেখে কোথাও কোথাও আবার শীষ দেয়, গানের কলি আওড়ায়। এই বাবু তেমন বাবু না। মনে ঘোর লেগে আসছিল, বসন্তের টকটকে লাল কৃষ্ণচূড়ার বনে কে যেন উঁকি দিতে চাইছিল কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
ছি! ছি বাবু! তোমরা হইলা গেল খেনুস (ভদ্রলোক মানুষ), তুমি এইডা কি কইলা? কইলাম না আমরা ছোট জাত আমাগো দিকে নজর দিতে নাই। আমার বাবা আমাগো দলের সর্দার, লোকে জানলে বাবা আমারে আস্ত থুইবো না, কাইটা গাঙ্গে ভাসাইয়া দিব।
বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে কে যেন যাচ্ছিল তাকে দেখে রতন থেমে গেল। বলল
আচ্ছা ঠিক আছে এখন যাও
রেশমি খুচরা টাকা বাবুর হাতে দিয়ে ঝাঁকা গোছান শুরু করল আর রতন স্কুলের পথে পা বাড়াল।
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top