রেশমি-[৩]-৩, শেষ পর্ব

৭।
বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে খেয়ে দেয়ে প্রতিদিনের মত বের হলো। ঝিটকা আসবে, বন্ধুরা মিলে রাজার চায়ের দোকানে আড্ডা দেয়। রাত আটটা নয়টা বাজলে যার যার বাড়ির পথ ধরে। আজও বের হলো। কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে
বেলা ডোবার পরেপরেই আমার কাজ আছে বলে আড্ডা থেকে বেরিয়ে এসে বেদের ঘাটে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক খুঁজছে। ২০/২৫ টা নৌকার মধ্যে রেশমি কোন নৌকায় রয়েছে কে জানে! নৌকার ভিতরে মিট মিট করে হারিকেন জ্বলছে, সবাই খাওয়া দাওয়া নিয়ে ব্যস্ত, কেও আবার শুয়ে পড়েছে। কি করেই বা কাকে জিজ্ঞেস করবে? অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে না পেয়ে হঠাৎ মনে হলো রেশমি বলছিল না ওর বাবা ওদের দলের সর্দার? সর্দারের নৌকা খুঁজে পেতে আর এমন কি!
একজনকে পাছা নৌকায় বসে বিড়ি ফুকতে দেখে তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল
এই যে শুনছেন
আমারে কইলেন?
হ্যাঁ হ্যাঁ আপনাদের সর্দারের নৌকা কোনটা?
কেন? সর্দাররে দিয়া কি হইব?
কাজ আছে, একটু ডেকে দিবেন?
ওই যে ডাইনের তিন নাও বাদের নাও
রতন এগিয়ে গেল নৌকার কাছে। বুক ঢিব ঢিব করছে, কি বলবে? এতক্ষণ ভাবেনি! কিছু না ভেবেই হঠাৎ ডাকল
সর্দার নায় আছে?
কে ডাকে?
বলতে বলতে লুঙ্গি পরা ফতুয়া গায়ে মাঝ বয়সী এক লোক ছৈয়ের ভিতর থেকে বেরিয়ে রতনকে দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। আপনে, কি হইছে, কি চান?
আপনে কি এই দলের সর্দার?
হয়, কি হইছে?
আপনার কাছে দাঁতের পোকা বের করার ওষুধ আছে?
আছে, কার জন্যে?
আমার ভাতিজার
ও! কাইল সকালে বেলা ওঠার আগে নিয়া আইতে পারবেন?
বাবার কথার শব্দ শুনে রেশমি আর তার মা বাইরে এসে দেখে কে একজনের সাথে সর্দার কথা বলছে। রেশমি চিনতে পারল সকালে যার সাথে কথা হয়েছে সেই লোক। একটু অবাক হলো। কি ব্যাপার? এর মধ্যে নায়ে এসে হাজির! বসন্তের সেই টকটকে লাল কৃষ্ণচূড়া আবার উকি দিতে চাইল কিন্তু আকাশ কুসুম ভেবে নিজেকে বোঝাল। লোকটা না হয় ভাবের মোহে পইড়া মনে যা আইছে কইয়া ফালাইছে আবার এই খানেও আইসা পরছে কিন্তু যা সম্ভব নয় তারে প্রশ্রয় দিতে নাই। আমরা বাইদার জাত আমাগো এত স্বপ্ন দেখতে নাই।
আপনের বাড়ি কোন গ্রামে?
এই ফাঁকে রতন দেখল ছৈয়ের ভিতর থেকে বের হয়ে রেশমি বোকার মত আগা নায়ে তার দিকে চেয়ে বসে আছে। আল আধারিতে আরও বেশি সুন্দর লাগছে
না আনা যাবে না, আপনারা বাড়ি যেতে পারবেন না? বেশি ফি দেব! যাবেন না?
আপনের বাড়ি কনে?
কাছেই, হুগলাকান্দি, এই রাস্তা দিয়ে সামনে গেলে যে গ্রাম পড়বে সেখানে রতন মাস্টারের বাড়ি বললেই দেখিয়ে দিবে। আমি এই যে এই প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করি।
বুঝলাম
যাবেনতো?
আইচ্ছা, আমি যামু না তয় আর কেউরে পাঠাইয়া দিমু।

৮।
রতন সে রাতের মত আশ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফিরে এলো। সর্দারের কথায় বুঝতে পারল না কাকে পাঠাবে। যাকেই পাঠাক রেশমির আস্তানা চিনতে পেরেছে। দেখা যাক, এখন সকালের অপেক্ষা। রেশমির স্বপনে মগ্ন হয়েই কোথা দিয়ে যেন সারা রাত চলে গেল কিছুই বুঝতে পারল না। কি মায়া ভরা চোখ! এই চোখ দিয়ে যাকে দেখবে সেই ধন্য হয়ে যাবে। বারবার বাম থুতনির নিচের তিলের কথাও মনে হচ্ছিল। মনে মনে সমস্ত চেহারা দেখে এসে ওই তিলেই চোখ আটকে যায়। ভোরে যখন মোরগের বাগ শুনে উঠে বাড়ির বাইরে এসে পথের দিকে চেয়ে আছে কে আসে, কখন আসে! পুব আকাশ লাল হয়ে গেছে একটু পরেই বেলা উঠবে। রতনকে বলে দিয়েছে বেলা ওঠার আগেই দাঁতের পোকা বের করতে হবে। পথ থেকে দৃষ্টি সরছে না। হঠাৎ চমকে উঠল কালকের ওই শারী পরে রেশমি হাতে একটা থলে নিয়ে দুই পাশের ধান ক্ষেতের মাঝের রাস্তা দিয়ে ভোরের আলো হয়ে এদিকেই এগিয়ে আসছে। কাছে এলে দেখল মাথার এলো চুল আলতো করে খোঁপা বাধা। গলায় মালাও নেই হাতেও চুরি নেই। এই নিরাভরণ দেহে সত্যিই ভোরের আলোর মতই মনে হচ্ছে। জাম গাছের নিচে রতনকে দেখে রেশমি চমকে দাঁড়াল!
বাবু, আপনার ভাতিজা কোথায় ওরে নিয়া আসেন, সময় বেশি নাই, বেলা উঠার আগেই সারতে হইব।
তুমি আসবে আমি ভাবতেও পারিনি
দেরি কইরেন না, তাড়াতাড়ি নিয়া আসেন
কাকে আনব? আমার কোন ভাইই নেই তো ভাতিজা আসবে কোথা থেকে?
তাইলে যে রাইতে কইয়া আসলেন!
বলেছি শুধু তোমাকে দেখার জন্য
বাবা যদি মায়েরে পাঠাইত তাইলে কি করতেন?
একটা কিছু বলে দিতাম আর সে ফিরে যেত
কামডা ভাল করেন নাই, বাবা শুনলে রাগ করবো। একটু ভেবে, তাইলে আমি যাইগা?
যাবার জন্যেতো তোমাকে আসতে বলিনি!
তাইলে কি করুম?
আস, এই খানে একটু বসি। ডর নাই বাড়ির মানুষ উঠতে দেরি আছে। এতক্ষণ তোমার সাথে গল্প করি
রতন ওর হাত ধরে টেনে এগিয়ে গেল বাংলা ঘরের পাশে খড়ের গাদার আড়ালে যাতে সামনের রাস্তা থেকে ওদের দেখা না যায়।
বাবু, আপনে কামডা ভুল করতেছেন, দেহেন আমরা নিচা জাতের বাইদা আমাগো কেও মানুষ বইলা মনে করে না। আমাগো কোন ঠিক ঠিকানা নাই আমাগো সাথে এত মেলামেশা ভাল দেখায় না। আপনে আর এমন কাম কইরেন না, আমাগো নায়েও আর যাইবেন না।
তাহলে তোমার সাথে দেখা হবে কেমন করে?
কইলামতো আপনে এই পথে পাও বাড়াইয়েন না। মনে যা আইছে মুইছা ফালান
বললেই কি তা হয়?
কেন হইব না? আপনে জানেন এর ফল কি হইতে পারে? আপনের কিছু হইব না কিন্তু আমার মরণ ছাড়া কোন উপায় থাকবো না। আমার বাবারে কেও সর্দার বইলা মানব না, বাবার মান সম্মান থকব না
রেশমি, তুমি কি বল! দরকার হলে আমি তোমাকে নিয়ে দূরে অনেক দূরে কোথাও চলে যাব
তাই কি হয়? আপনের ঘর আছে ঠিকানা আছে সংসার আছে সমাজ আছে, আপনে শিক্ষিত মানুষ
আমার কি আছে কোন? না জানি লেখা পড়া না আছে ঘর, ঠিকানা, সমাজ কিছুই নাই। খড় কুটার মত গাঙ্গের জলে ভাইসা বেড়াই। তেলে জলে কি কোনদিন মিশ খায়?
ভয়ে রেশমির গলা শুকিয়ে এসেছে, মুখ শুকিয়ে গেছে, দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে, হাঁপাচ্ছে, বুক ওঠা নামা দেখে বোঝা যাচ্ছে। কথা বলার সময় ঠোট কাঁপছিল, বাবু আমি যাই
বলেই পিছনে ঘুরে দাঁড়াল
কি হলো কোথায় যাচ্ছ? বলে আঁচল টেনে ধরল
নায়ে যাই
টাকা নিয়ে যাবে না?
না
তাহলে সর্দারকে কি বলবে?
একটা কিছু কমুনে
না শোন তোমার সাথে আবার কখন কোথায় দেখা হবে?
বসন্তের টকটকে লাল কৃষ্ণচূড়ার ছায়া উদয় হয়ে আবার সঙ্গে সঙ্গে সমাজ নামের পাহাড়ের আড়ালে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। এ পাহাড় ডিঙ্গানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। এই বসন্ত তার মত বাইদার মেয়ের জন্যে নয়। যে পুরুষের দাতে সাপের মত বিষ আছে, যে পুরুষ কাল নাগের মত ফণা তুলতে পারে তেমন কাল কেউটেইতো সে চেয়েছিল। তার অপেক্ষায় সে দিন গুনে জসীমকে প্রত্যাখ্যান করেছে, কিন্তু! বাবু, আপনে আমারে বিপদে ফালাইয়েন না, আপনের পায়ে ধরি
বলে সত্যি সত্যি রেশমি নিচু হয়ে রতনের পা ধরে বলল
বাবু আপনে এই পাগলামি কইরেন না, আমারে রেহাই দেন
রতন রেশমির বাহু ধরে টেনে তুলে বলল
না রেশমি আমি পাগলামি করছি না, আমি তোমার আশায় থাকব
জীবনে এই প্রথম কোন পুরুষের ছোঁয়া কয়েক মুহূর্তের জন্য রেশমিকে অনেক দূরের ঝর্ণা ধারার তান শুনিয়ে দিল কিন্তু রেশমি হাত ছাড়িয়ে পিছনে ঘুরে দৌড়ের মত ছুটে পালাল
রতন ওর পথের দিকে চেয়ে রইল। আবার দেখা পাবার সুযোগ খুঁজছিল মনে মনে। নৌকার কাছাকাছি থাকলেই হবে। সকালে গাওয়ালে যাবার সময় কিংবা সন্ধ্যায় যখন ফিরে আসবে তখন পেতেই হবে।

৯।
প্রায় দৌড়েই নৌকায় ফিরে এলো। নৌকার সামনের গলুইতে বাবাকে দেখে বুকের ধড়ফড়ানি বেড়ে গেল। কি বলবে বাবাকে? এতক্ষণ কিছু ভাবেনি দৌড়ে পালিয়ে এসেছে। কাছে এসে বাবাকে দেখে আপনা আপনি গতি কমে গেল। একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়!
কি রে কি হইছিল?
না বাবা রুগীরে পাই নাই, কাইল বিকেলে মামা বাড়ি গেছেগা, ফিরা আইলে খবর দিব কইছে
, ঠিক আছে যা দেখ রান্ধনের যোগার দেখ তর মায়ের জ্বর আইছে
ডিম, ডাল ভাত রান্না করে সঙ্গীদের নিয়ে আবার বের হলো গাওয়ালে।
ওই, আইজ কুন দিকে যাবি?
চল আইজ ওই তাল গাছ দেহা যায় ওই দিকে যাই।
চল।
বাজারের শেষ প্রান্তে বড় তাল গাছের নিচে দিয়ে ডিসট্রিক্ট বোর্ডের বাঁধানো রাস্তা ধরে পশ্চিমে মালচির দিকে চলে গেল। রেশমি হাঁটছে আর সকালের ঘটে যাওয়া অপ্রত্যাশিত ঘটনার স্রোতে ভাসছে আবার কখনও ডুবেও যাচ্ছে। জীবনের প্রথম বসন্তের স্পর্শ! ষোল বছরের রেশমির মনে ঘোর লেগে আসছে। তাদের বহরে এই বয়সেই ফুলি দুইজনের মা হয়েছে। মাস্টার বাবুর মুখ কিছুতেই দূরে সরিয়ে দিতে পারছে না। অন্যমনস্ক ভাবে কয়েকবার হোঁচট খেল দেখে প্রিয় বান্ধবী সুফি জিজ্ঞেস করল
কিরে আইজ তর কি হইছে মুখে কথা নাই আবার হাঁটতে হাঁটতে উস্টা খাইলি কয়বার। ওই ছেমরি গান ধর!
রেশমির মুখে কোন কথা নেই। স্বপ্নের ছায়া তরী মন যমুনায় ঘোরা ঘুরি করছে কিন্তু কিছুতেই কোন ঘাটে ভিড়াবার ঠাই খুঁজে পাচ্ছে না। এ কি সম্ভব? মাস্টার বলেছে দূরে কোথাও চলে যাবে! কোথায় যাবে? এতদিনে আশেপাশের পুরুষদের চাউনি দেখে রেশমি তার রূপের কথা বুঝতে পেরেছে কিন্তু এই রূপ যৌবনের মোহ কয়দিন থাকবে? মোহ ফুরিয়ে গেলে! তখন সে কোথায় দাঁড়াবে?
সেদিনের মত সন্ধ্যায় বাইদানীর দল ফিরে এসেছে। আসার পথে মাস্টারকে দেখল বাজারে চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে। এক পলকের জন্য চোখাচোখি হলো।

১০।
পরের দিন বিকেলের আড্ডা বাদ দিয়ে নদীর পাড় থেকে বাজারের ও মাথা পর্যন্ত এদিক ওদিক ঘোরা ঘুরি করছিল আর রেশমি কোন পথে ফিরে আসে দেখছিল। তাদের গ্রামে যাবার পথে না যেয়ে উত্তরে গেলে কৌড়ি যেতে পারে, তাদের গ্রাম ছাড়িয়ে চালা, মানিক নগর, আবার ঝিটকা থেকে উত্তরে গেলে কান্দা লংকা, ধুসুরিয়া, গালা, পশ্চিমে মালচি, বাল্লা যেতে পারে। আজ কোন দিকে গেছে? রাজার চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে এক কাপ চা হাতে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে আর পথ পাহারা দিচ্ছে। বেলা ডোবার আগে তাল গাছের নিচে দিয়ে ঝাঁকা মাথায় ওদের আসতে দেখল। সামনে দিয়ে যাবার সময় থামিয়ে জিজ্ঞেস করতে চাইল সর্দারকে কি বলেছে কিন্তু ভারী দল দেখে নীরব রইল। শুধু এক পলকের জন্য একটু দৃষ্টি বিনিময় হলো।
আবার প্রতীক্ষা। কাল সকালে স্কুলে না গিয়ে ইউনিয়ন অফিসের সামনে ঝাউ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রইল। আজ যেদিকেই যাক পিছনে অনুসরণ করবে। বেলা নয়টা দশটার দিকে একে একে দলের সবাই নৌকা থেকে নেমে এসে উত্তর দিকে যাচ্ছে। একটু দূরত্ব রেখে রতন পিছু নিল। ওরা কান্দা লংকার পথে যাচ্ছে। রতন ঘুরে বাস স্ট্যান্ডের সামনে দিয়ে, গার্লস স্কুলের সামনে দিয়ে কান্দা লংকার পথে গরু হাটের বট গাছের নিচে দাঁড়াল। ওরা এখনও আসেনি। হ্যাঁ ওইতো দেখা যাচ্ছে। সামনেই রেশমি।
ও বাইদানী, কি আছে তোমাদের কাছে?
ওরা ওর সামনে এসে থামল। রেশমি বাবুকে দূর থেকেই দেখেছে। মনের ভিতর উথাল পাথাল শুরু হয়েছে কিন্তু সামনে এসে কাওকে কিছু বুঝতে না দিয়ে একটু হেসে জিজ্ঞেস করল
কি গো বাবু কি নিবা? বৌর লিগা নিয়া যাও, পুতির মালা আছে, কাজল আছে, কপালের টিপ আছে
বলে মাথার ঝাঁকাটা বট গাছের নিচে পথের পাশে নামিয়ে বাবুর সামনে মেলে ধরল। দলের ওরা সামনে এগিয়ে যেতে যেতে বলল রেশমি তর ভাগ্য ভাল, আইতে না আইতেই কাস্টমার পাইলি। তুই বাবুরে সামলা আমরা যাই। ওরা এগিয়ে গেল।
আপনেরা না কইছি আমার পিছ ছাড়েন! এইহানে খারাইয়া রইছেন কেন?
কেন দাঁড়িয়ে আছি তুমি বুঝ না?
বুঝি দেইখাইতো না করি। এইটা সম্ভব না মাস্টার বাবু, আমরা নিচু জাতের আমাগো দিকে নজর দিতে নাই
বলেছিতো তোমাকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাব কেও কিছুই জানবে না। আমাদের ঘর হবে, সংসার হবে তুমি বৌ হবে
কিন্তু
কিন্তু বলেই রেশমি থেমে গেল। মনের মাঝ দরিয়ায় উত্তাল ঢেউ উঠেছে সে ঢেউ কিছুতেই সামাল দিতে পারছে না। মুখে কোন কথা নেই। এমন সময় রাস্তা দিয়ে লোকজন বাজারের দিকে আসছে দেখে রেশমিকে বলল দাও দেখি আজ কি দিবে! যন্ত্রের মত রেশমি কিছু চুরি বের করে দিল আর রতন তার দাম দিয়ে বলল কাল আবার দেখা করব। রতন দেখল টুপ করে রেশমির চোখ দিয়ে এক ফোটা জল পড়ল।
১১।
সূর্য তার প্রতিদিনের উদয় অস্তের সাথে রতন রেশমির সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর করে প্রায় দুটি মাস কেমন করে কোথায় নিয়ে গেছে ওদের কেও বুঝতে পারেনি। কেও কাওকে একদিন না দেখে থাকতে পারে না। নানা রকম ফন্দি করে অন্তত একবার হলেও দেখা হতেই হবে। রেশমি তার এত দিনের সমস্ত ভয় দূরে ঠেলে দিয়ে নির্ভয় হতে পেরেছে। স্বপ্ন দেখতে পারছে। মাস্টার বাবুর উপর আস্থা রাখা যায়, সে ওকে ঠকাতে পারে না। মাস্টার বাবুর মত মানুষ শুধু রেশমি কেন কাওকেই ফাঁকি দিতে পারে না। বসন্তের টকটকে লাল কৃষ্ণচূড়া এত দিনে হাতের কাছে এসে ধরা দিতে চাইছে।
এদিকে যেমন ধীরে ধীরে চাঁদটা পূর্ণতা পেয়েছে, পূর্ণিমার চকচকে জোসনার আলোতে দুইজনে স্নান করছে ওদিকে তেমনি বাজারের ঘাটের বেদের বহরের এক উঠতি বয়সের বেদেনীর সাথে রতনের মাখামাখির কথা ছড়িয়ে গেছে। রতনের বাড়ি, স্কুল এবং বেদের বহরও বাদ পড়েনি। জনাব আলির কানেও কথাটা গেছে। স্কুলের অন্যান্য মাস্টার, বাজার কমিটি জনাব আলিকে ডেকে ইউনিয়ন পরিষদের এক রুমে বসে সালিশ করেছে। জনাব আলিকে তিন দিনের মধ্যে এখান থেকে তার বহর নিয়ে চলে যেতে বলেছে।

অতি আদরের মেয়ে রেশমির সম্পর্কে এমন একটা সিদ্ধান্ত শুনে জনাব আলি হতভম্ব হয়ে গেছে, নির্বাক হয়ে গেছে। দলের কাছে মুখ দেখাবে কেমন করে? পরিষদ থেকে বের হয়ে এসেই নদীর পাড়ে বসে ছিল। দুপুরে খেতেও আসেনি। কি চেয়েছিল আর কি হলো তাই ভাবছে। কোন কুল কিনারা পাচ্ছে না। কারো সাথে পরামর্শ করার নেই কারণ সে যে এই দলের সর্দার সে কার সাথে আলাপ করবে? সে নিজে সবাইকে বুদ্ধি দেয় কিন্তু তাকে কে দিবে? সেদিনের মত শুয়ে পরল। যা হয় কাল সকালে দেখব। ঘুম আসেনা তবুও শুয়ে থাকতে হয়। এতদিন এই ঘাটে থাকাটাই মস্ত ভুল হয়ে গেছে। এর আগে এমন কোন ঘটনা ঘটেনি বলে এদিকটা জনাব আলির মাথায় আসেনি তাই নিশ্চিন্তায় ছিল।
রেশমি এবং রতনও সালিশের রায় সাথে সাথেই জানতে পেরেছে। এখন কি হবে? পরদিন স্বাভাবিক ভাবে যখন রেশমি সঙ্গীদের সাথে গাওয়ালে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিল তখন বাবা বলে দিল আইজ থিকা এই ঘাটে যদ্দিন আছি তর আর গাওয়ালে যাওন লাগব না।
কেন বাবা?
জানস না কি করছস? এত বড় সর্বনাশ কইরাও তর হুশ হয় নাই?
বাবা, ওই মালচির কয়ডা বাড়িতে কিছু পাওনা আছে হেগুলি আইজ নিয়া আসি তারপরে আর যামু না
জানসনা আমরা বাইদার জাত, যে কোন সময় ঘাট ছাইড়া যাওন লাগে তুই বাকি থুইয়া আইছস কেন?
ভুল হইছে বাবা, আর থুমু না
যা, তয় ঝাঁকা নেওন লাগব না, পাওনা যা আছে দিলে দিব না দিলে আইসা পরবি
ঝাঁকা নিয়া গেলে কি হইবো, নিয়া যাই?
একটু ভেবে জনাব আলি সম্মতি জানাল, আইচ্ছা যা, তাড়াতাড়ি আইবি
আচ্ছা বলে ঝাঁকা নিয়ে রেশমি বেরিয়ে পড়ল।
ঘাটে নেমে একটু আড়ালে যেয়ে এদিক ওদিকে দেখল, রতন যে দোকানে চা খায় ওখানে দেখল কিন্তু সে কোথাও নেই। চায়ের দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চে বসে পরল। এক কাপ চায়ের অর্ডার দিল। অনেকক্ষণ ধরে চা খেল কিন্তু এর মধ্যেও রতনের দেখা নেই। দোকানি একটু ইয়ার্কি করল,
কি বাইদানী আইজ যে বড় চা খাওনের ইচ্ছা হইছে?
শরীরডা ভাল না একটু জ্বর জ্বর লাগতেছে তাই



১২।
ওদিকে রতন ঘাটে আসার পথে দেখে বেদেনীরা আজ ওদের পথে সম্ভবত চালার দিকে যাচ্ছে কিন্তু দলের সাথে রেশমি নেই। মুখোমুখি হলে একটু দাঁড়াল।
কি গো নাগর কারে খুঁজ? আইজ তুমার রেশমি আসে নাই
সবাই একসাথে খিল খিল করে হেসে উঠল
কেন? আসে নাই কেন?
ওর বাবায় অরে আইতে দেয় নাই, আমরা কাইল এই ঘাট ছাইরা যামু তাই রেশমি আইজ পাওনা আদায়ের জন্যে মালচি গেছে
কথাটা শুনেই রতন এক মুহূর্ত দেরি না করে হন হন করে হেটে মালচির পথে পা বাড়াল। বাজারের উত্তর দিক দিয়ে এসে বাজারের পশ্চিম পাশের তাল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রইল।

১৩।
অনেকক্ষণ বসে থেকে মাস্টার বাবুর দেখা না পেয়ে মনে মনে অনেক কিছু ভাবছে কিন্তু আর কতক্ষণ বসে থাকবে? এক সময় উঠে পড়ল। কোথায় যাবে? বাবাকে বলে এসেছে মালচি যেতে হবে। যাই একবার মালচি থেকে ঘুরে আসি। মনে করেই উঠে এগিয়ে চলল মালচির দিকে। বাজার ছাড়িয়ে দূর থেকে তাল গাছের নিচে রতনকে দেখে স্বস্তি পেল। কাছে এসে মাথার ঝাঁকাটা এক পাশে নামিয়ে লোকজনকে দেখাবার জন্য বোচকা খুলে জিনিসপত্র নারা চারা করে একটা হাতে নিচ্ছে আবার সেটা নামিয়ে আর একটা দেখাচ্ছে আর এর ফাঁকে ফাঁকে কথা বলছে।
মাস্টার বাবু সবতো হুনছ, এখন কি করবা? বাবা আইজ থিকা আমারে গাওয়ালে আসা বন্ধ কইরা দিছে আমি বুদ্ধি কইরা পাওনা আদায়ের কথা কইয়া বাইর হইছি। আমারে একশ টাকা দেও আগে, বাবারে দেওয়া লাগব
শোন, এটা সহজে কেও মেনে নিবে না তাই আমি তোমাকে আগেই বলেছি আমরা দূরে কোথাও চলে যাব
কেমনে যাইবা, কোথায় যাইবা? তুমি আমারে কিসের মধ্যে জড়াইলা মাস্টার বাবু, আমি এখন কি করুম? বাবার মুখের দিকে দেখতে আমার ডর করতেছে। ওদিকে বাবা সবাইরে কইয়া দিছে আমরা কাইল এই ঘাট ছাইড়া চইলা যামু
কোথায় যাবে জান?
না, কেউ জানে না, বাবাও জানে না
চিন্তার বিষয়, কি করা যায় বলতো, যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। চল আমরা আজ রাতেই পালাই!
রাইতে কেমনে পলাইবা? রাইতে তুমি বাইর হইতে পারবা কিন্তু আমি কেমনে নাও থিকা বাইর হমু?
তাহলে? বলেই রেশমির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল
একটু ভেবে রেশমি বলল
একটা বুদ্ধি পাইছি, পারবা তুমি আমারে উদ্ধার করতে? খুব কঠিন কাজ! পারবা?
কি করতে হবে বলই না!
পলাইতে হইব দিনে দুফুরে
দিনে? বল কি!
হ্যাঁ দিনের বেলা। আমি যখন গোসল করতে গাঙ্গে নামুম তখন তুমি একটা নাও নিয়ে চালা যাইয়া বইসা থাকবা আর আমি ডুব দিয়া অনেক খানি যাইয়া তারপরে সাঁতরাইয়া স্রোতের সাথে ভাটিতে চালা পর্যন্ত যাইয়া কিনারে উঠুম। পারবা আমারে উদ্ধার করতে?
বল কি? এত দূর সাঁতরে যাবে? পারবে? আর ডুব দিয়েই বা কতদূর যাবে?
শুনে রেশমি হো হো করে হেসে উঠল, কি যে কও মাস্টার বাবু! আমরা বাইদা না? ডুব দিয়া আমরা গাং পার হই, পানিতে আমাগো বসবাস আর এইটুক সাঁতরাইয়া যাইতে পারুম না? কি যে কও! তুমি আমারে উদ্ধার করতে পারবা নাকি তাই কও
আমার ভীষণ ভয় করছে রেশমি
কিসের ভয়?
তোমাকে এত দূর সাঁতরে যেতে কি করে বলি? কিছু হয়ে গেলে?
কইলামতো এইডা আমাগো জন্যে কিছুই না, আমি পারুম, তুমি পারবা নাকি তাই কও
ঠিক আছে তাহলে এই কথাই ফাইনাল! কি বল
হয়, কাইল দুফুরে, এখন আমারে একশ টাকা দিয়া তুমি বাড়ি যাও।

১৪।
পরদিন বাড়ি থেকে টাকা পয়সা যা কাছে আছে পকেটে নিয়ে সকাল সকাল নাস্তা খেয়ে রতন মালচির পথে রওয়ানা হলো। ওখান থেকে নৌকা ভাড়া করতে হবে। ঝিটকা থেকে কোন নৌকা নেয়া যাবে না, এখানকার মাঝিরা সবাই চেনা। মালচি এসে বাজার থেকে একটা শারী, পেটিকোট, ব্লাউজ, গামছা আর এক জোড়া স্যান্ডেল কিনে জিজ্ঞেস করে দূর এলাকার মাঝি দেখে হরিরামপুর যাবার জন্য একটা নৌকা ভাড়া করল। রেশমির কথামত ঝিটকা বাজার এবং বেদেদের বহর পার হওয়া পর্যন্ত ছৈয়ের ভিতরে বসে রইল। রেশমি কি ওর প্ল্যান মত ডুব দিতে পেরেছে? সাঁতরে অত দূরে যেতে পারবেতো? ভয়ে চিন্তায় রতন ঘামছে। ওদের পার হয়ে বেশ কিছুটা দূরে এসে নিরাপদ মনে করে ছৈয়ের বাইরে বসে নদীর দিকে চোখ রেখে এগুচ্ছে। চালার কাছে এসে দেখে সত্যিই এক মেয়ে ভাদ্র মাসের ভরা গাঙ্গের মাঝ গাং দিয়ে সাঁতরে সামনে যাচ্ছে। মাঝিকে ইশারা করে ওই মেয়ের কাছে যেতে বলল। মাঝি মেয়েটার কাছে যেতেই দেখল রেশমি। নৌকায় তুলে একটু শান্ত হলে গামছা এবং সদ্য কেনা কাপড়ের প্যাকেট এগিয়ে দিল। 
উহ্! আমি যে কি দুশ্চিন্তায় ছিলাম, কি ভয়েই ছিলাম তুমি আসতে পারবে কি না!
এখন কোথায় যাইবা?
আগে হরিরামপুর তারপর ওখান থেকে সোজা ঢাকা।
দুইজনেই চুপচাপ। কারও মুখে কোন কথা নেই। ঘণ্টা খানিক পরে নৌকা হরিরামপুর ঘাটে এসে ভিড়ল। নৌকার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে দুইজনে বাস স্ট্যান্ডে এসে ঢাকা গামী বাসে উঠে পিছনের দিকে সুবিধাজনক সীট নিয়ে বসার অল্প পরেই ওদের নিয়ে বাস ছুটে চলল ঢাকার পথে।

No comments:

Post a Comment

Back to Top