নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৫

১০।
ভোরের দিকে জাহাজ চিটাগাং পৌছার পর পতেঙ্গায় তেল কোম্পানির জেটি গুলির কাছে কর্ণফুলী নদীর এক পাশে নোঙ্গর করে রেখে সবাই কিছুক্ষণের জন্য শুয়ে পড়লো। সারা রাতই প্রায় গল্প করে চা খেতে খেতে এসেছে। সকাল
নয়টায় অফিস খোলার পর রফিক অফিসে গিয়ে লোডিং অর্ডার নিয়ে এলে জাহাজ নোঙ্গর তুলে জেটিতে এসে ভিড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাইপ কানেকশন করে লোড শুরু করে রফিক আর মহিউদ্দিন চলে এলো। বিকেল নাগাদ লোড শেষ হলে রাতের জোয়ার নিয়ে খুলনা যাবে।
-দেখলেন রাশেদ ভাই, কিছু চন্দন কাঠ পুরিয়ে এই যে এই লোডিং অর্ডার আনলাম ওই দেখেন ময়ূরপঙ্খী আমাদের আগে এসে বসে আছে। সারা বছরই এই ভাবে চলে। কাঠ খর না পোড়ালে লোডিং অর্ডার দিবে না, এক সপ্তাহ বসে থাকলে কোম্পানিই বা বাঁচে কি ভাবে আর আমরাই বা বাঁচি কি ভাবে। কোম্পানিও জানে তাই চন্দনের যোগাড় দিয়ে দেয়, মাথা ঘামায় না। এদিকে বেতনও কমিয়ে দিয়েছে কাজেই এই ভাবে নানান কলা কৌশল ফন্দি ফিকির করে আমরাও টিকে আছি আবার কোম্পানিকেও টিকিয়ে রেখেছি। নতুবা কোম্পানির লাল বাতি জ্বলে যেত অনেক আগেএই অবস্থায় আমার মনে হয়না, আপনার যে আদর্শ দেখে এসেছি এতোদিন তা বিসর্জন দিয়ে এখানে টিকতে পারবেন।
-ঠিকই বলেছ মহিউদ্দিন। এসব আমি করতে পারবো না। দেখি শেষ পর্যন্ত মনে হচ্ছে বিলাতেই যেতে হবে। আমি যেতে চাই না। বিদেশে যারা থাকে তাদের কয়জন মান সম্মত কাজ করতে পারে তা দেখেছ। যে দেশে থাকে তারাই বা কী রকম ঘৃণার চোখে দেখে তাও জান, এই সব নানা কিছু ভেবে আমি বিদেশে যেতে চাই না। অথচ এদেশে আমি প্রথম শ্রেণীর নাগরিক আর ওখানে গেলে কি হব, সাধারণ দিন মজুর তাই না? কারণ পরিচয় দেবার মত কাজ পাওয়া আমার সম্ভব নয়, আমার যে যোগ্যতা তাতে তা পাবো না, এটাও একটা কারণ তার পর যাদের দেশে থাকবো তারা যদি আন্তরিক হতো তাহলেও একটা কথা ছিলো, কিন্তু সে কি আর সম্ভব? ওরা জানে যে এই সব তৃতীয় বিশ্বের আধা কাল মানুষ গুলি আমাদের দেশ থেকে রোজগার করে নিজ দেশে ধনী সাজতে এখানে এসেছে। এই তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞা আমি কোন দিন সহ্য করতে পারিনি মহিউদ্দিন। আমার নিয়তি যদি তাই লিখে থাকে আমার ভাগ্যে তাহলে তা খণ্ডাবার কোন উপায় নেই। এই বয়সে স্ত্রী সন্তান ছেড়ে থাকা যে কি কঠিন কাজ সে তো আর তোমাদের বলতে হবে না নিজেরাই এখন বুঝতে পার। তবুও যেতেই হবে।
কথার ফাঁকে স্টুয়ার্ড এসে দুপুরের খাবার রেডি হয়েছে কখন খাবে জানতে চাইল।
-চলেন ভাই খেয়ে নিই
-চলো
টেবিলে বসার পর মহিউদ্দিন বিরাট একটা ভাজা কৈ মাছ তুলে দিল রাশেদ সাহেবের পাতে, প্লেটের প্রায় এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত।
-একি মহিউদ্দিন, এতো বড় কৈ কোথায় পেলে?
-আপনার জন্য জোগাড় করেছি, কথা বলবেন না খেয়ে নেন
বিকেলে লোড হবার পর হিসেব নিকেশ করে জেটি ছেড়ে আবার বাইরে গিয়ে জোয়ারের অপেক্ষা করবে। জেটি ছাড়ার আগে রফিক রাশেদ সাহেবকে নিয়ে লাল খাঁ বাজারের কাছে কোচ স্টেশনে এলো। রফিক স্কুটার থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে কাউন্টার থেকে কোচের টিকেট কিনে রাশেদ সাহেবের হাতে দিল। রাস্তায় খাবার জন্য কিছু কমলা, দুটা স্যান্ডউইচ আর এক বোতল পানি কিনে দিল।
-রাশেদ ভাই কিছু মনে করবেন না, ভীষণ নির্দয় ভাবেই কথাটা বলছি, মহিউদ্দিন যা বলেছে আমার মনে হয় তাই ভাল হবে, আপনি শুধু শুধু এখানে আর কিছু খোজা খুঁজির চেষ্টা না করে পারলে ওখানেই চলে যান, আপনার তো আর ভিসার সমস্যা হবে না। কি করবেন, আপনার কাছেই শিখেছি, জীবন যেখানে যেমন তেমন করেই চলতে দিওকথাটা আপনি বলতেন কিন্তু তখন এর মানে বুঝিনি এখন বুঝি। মাঝে মাঝে মানুষের জীবনে এমন সব জটিল মুহূর্ত এসে পড়ে যে কি করবে, কোথায় যাবে হিতাহিত বিচার করার কোন সুযোগ থাকে না। কষ্ট হলেও কিছু করার নেই, ভাগ্যকে মেনে নিতেই হবে। নয়তো কে ভেবেছে যে সারা জীবন এমন ন্যায় নীতি আর আদর্শ নিয়ে চলে আপনার আজ এই পরিণতি হবে। আমার কষ্ট হচ্ছে যে আপনার এই দুর্যোগের মধ্যে আমি কিছু করতে পারলাম না, আমার ক্ষমতাই বা কতটুক, আমাকে ভুল বুঝবেন না, আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি আগেও আপনাকে যেমন শ্রদ্ধা করতাম এখনও তেমনি করি। এ কদিন ভেবে আমি এ ছাড়া আর কোন সহজ সমাধান পাইনি
ওদের কথা বলতে বলতে ড্রাইভার এসে গাড়ি স্টার্ট দিল।
-যান গাড়িতে বসুন গিয়ে, আসি তাহলে।
রাশেদ সাহেব রফিককে বুকে জড়িয়ে ধরে প্রায় কেঁদে ফেললেন।
-তাহলে আসি, তোমরা সাবধানে থাকবে, ভালো থাকবে
বলে গাড়িতে উঠে পরলেন। জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলেন রফিক কোচ অফিসের সামনের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছে, কোচ ছেড়ে দিল।

১১।
রাশেদ সাহেব আর একটা ব্যর্থ মিশন শেষ করে এগিয়ে চললেন রাজধানী ঢাকা শহরের দিকে। যে শহর আজ তার জন্য বিভীষিকার মত। যে শহরের নাম মনে হলে তিনি চমকে উঠেন, যে শহর তার আর তার স্ত্রী সন্তানের জন্য দুমুঠো অন্যের সংস্থান করেনি। যে শহর তাকে ঠাঁই দিতে রাজী নয়, যে শহর তাকে তার স্ত্রী সন্তানদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। যে শহরে তার প্রিয় স্ত্রী সন্তানদের একা অসহায় ভাবে রেখে তাকে চলে যেতে হবে ভিন্ন কোন শহরে যেখানে তার পথ চেয়ে কেও বসে থাকবে না। বারবার ফোন করে কেও তার তদারকি করবে না। অসুস্থ হলে বা অসহনীয় ক্লান্তির পর কেও কপালে একটু মমতা ভেজা হাতের পরশ বুলিয়ে দিবে না।
যতক্ষণ দেখা গেলো দেখলেন রফিক দাঁড়িয়েই আছে তার কোচের দিকে তাকিয়ে। সন্ধ্যার ট্রাফিক জ্যামের জন্য কোচ স্পিডে চালাতে পারছে না বলে অনেকক্ষণ দেখলেন এ ভাবে। এক সময় চোখের সীমানার বাইরে চলে গেলো রফিক।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোচের আরামদায়ক সিটে বসে পিছনে হেলান দিলেন। চোখ বন্ধ হয়ে এলো। গাড়ির ভিতরের আলো নিভিয়ে বিলাস বহুল কোচের সৌখিন যাত্রীদের আয়েশের জন্য মৃদু এক টুকরো নীল আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে ড্রাইভার। চোখ বন্ধ হবার সাথে সাথে চোখের পাতার পর্দায় একটা সিনেমা দেখতে পেলেন।
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top