নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৬

১২।
ছোট ছোট ভাই বোনদের সুখের জন্য, তাদের লেখাপড়া করে মানুষ করার জন্য, তদের সুনাম হবার জন্য, সুখ সমৃদ্ধিতে জীবন যাপনের জন্য, সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য আনার জন্য এক জন নিতান্ত যে বয়সে মন

দিয়ে পড়া শুনা করার কথা তা না করে বাড়ি ছেড়ে, ঢাকা শহর ছেড়ে, অবশেষে দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন। শিক্ষা, শান্তি, সুখ সচ্ছলতা কুড়িয়ে আনতে। কিছুটা এনেছিলেন যার উপযুক্ত ব্যবহার হলে আজ তাকে এভাবে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হোত না। যা পেয়েছিলেন তা দিয়ে সব পাওয়া হয়নি তবে তখনকার মত কিছু সামাল দেয়া গেছে। ভাই বোনেরা আজ সবাই উচ্চ শিক্ষিত হয়েছে, কিছু দিন সংসার চলেছে কিন্তু সাথে আর একটি প্রাপ্তি যা বাড়ির সবার অলক্ষ্যে, একান্ত নীরবে সে একাই পেয়েছে বাড়ির আর কেও তা বুঝতে পারেনি। দীর্ঘ দিন বাড়ির বাইরে থাকার ফলে অতি ধীরে ধীরে বাড়ির সাথে তার একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
প্রথম দিকে দুই তিন মাস পর পর তিন চার দিনের জন্য বাড়ি আসার পথে ভাই বোনেরা কে কি পছন্দ করে সে অনুযায়ী ফলমুল, কাপড় চোপর নিয়ে আসতেন, এসে মাকে সংসারের কিছু বাজার করে দিতেন, রান্না ঘরে বা বাড়ির যা যা প্রয়োজন তা কিনে দিয়ে যেতেন বা মনে করে মাথায় করে একটা ফর্দ তৈরি করে নিয়ে যেতেন আবার আসার সময় নিয়ে আসতেন। ভাই বোনেরা নিতান্ত ছোট ছিলো বলে তারা অনেক দিন পর পর বড় ভাইকে দেখত বলে তাদের মনে একটা ধারনা জন্মেছিলো যে এতো আমাদের মেহমান। পরে যখন দেশ ছেড়ে চলে গেলেন তখন তো বৎসরে একবার আসা হতো।
বাড়ির মানুষ কি আর এতো দিন পরে আসে, এমন ধারনা জন্মান অস্বাভাবিক কিছু নয়। নিয়ম করে টাকা পাঠাত। যে অভাবের যন্ত্রণা সে দেখেছে, সে অভাবের ছোঁয়া যেন ছোট ভাই বোনদের গায়ে না লাগে। প্রতি মাসে একটা করে বিরাট চিঠি লিখত মায়ের কাছে, বাবার কাছে। তাতে ওই এক কথাই বারবার লিখত ওদের যেন কোন অসুবিধা না হয়, বিশেষ খেয়াল রাখবেন। ছুটিতে আসার সময় পছন্দ মত খেলনা, পোষাক আসাক সবার জন্য যা মনে হতো নিয়ে আসতো।

কখন যে এই সব টাকা আর জিনিষ পত্রের সম্পর্কটা টিকে গেলো আর রক্তের সম্পর্কটা ম্লান হতে হতে এক সময় মুছে গেছে তা হঠাৎ করেই একদিন লক্ষ্য করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিন্তু তরী তখন কূল ছেড়ে উত্তাল বাতাস আর স্রোতের টানে মাঝ গাঙ্গে চলে গেছে। আর সে তরী পাড়ে ফিরিয়ে আনার কোন উপায় নেই। থাক, তবুও আমার মা, আমার বাবা, আমারই ভাই বোন। ওদের জন্যেই সব ছেড়েছি, ওরা সুখী হলেই যথেষ্ট। সময়ের স্রোত আমাকে দূরে টেনে নিয়ে গেছে। যাক, আমি তো দূরে যেতে পারি না। আমার হৃদয়ের গভীর কুঠরি ওদের জন্যই পূর্ণ হয়ে আছে ওরা আমাকে আর কত দূরে ঠেলে দিবে? আবার ভাবে, না তা কি করে হয়? আমি এ বাড়ির বড় ছেলে, আমার ইচ্ছা অনিচ্ছা, সিদ্ধান্ত, মতামত অনেক মূল্যবান। আবার ভাবে কিন্তু বাস্তব যে এর বিপরীত!
তাহলে? নিজেকেই প্রশ্ন করে মনে মনে আহত হলেও মন কিছুতেই তা মেনে নিতে পারে না। ভাবে, যাক ওরা যা খুশি করুক আমি আমার কাজ করে যাব তাতে যা হয় হবে।

১৩।
মনিরাও এই মুছে যাওয়া সম্পর্কের জের টের পেয়েছে কিন্তু স্বামীর কাছে প্রকাশ করার ভাষা খুঁজে পায়নি। এমনিই দুজনে দুজনের মত ভিন্ন ভাবে লক্ষ করে কিন্তু কেও কারো কাছে প্রকাশ করতে পারে না। মনিরা নিজেও বিশাল একান্নবর্তী পরিবার থেকে স্কুল শেষ না হতেই বালিকা বধূ সেজে এ বাড়ির বড় বৌ হয়ে এসেছে। দৈনন্দিন কাজে যখন রাশেদ সাহেব বাড়িতে থাকে না তখন বাড়ির এক রূপ আবার যখন সে বাড়িতে থাকে তখন আর এক রূপ।
এই দুই রূপের তারতম্য মনিরার বালিকা মাথায় কিছুতেই ঢুকতে চায় না, কোন অবস্থাতেই সে মেলাতে পারে না। ছোট বেলা থেকে দেখে আসছে সবাইকে কিন্তু সেই আগের দেখা আর বিয়ের পর এই দেখার মধ্যে এই তফাত কেন সে কথা মনিরা তার স্বামীকে জিজ্ঞেস করতে পারে না, মেনে নিতে পারেনা, সহ্য করতেও পারে না। বিয়ের পর প্রথম দিকে মনিরার বাবা একবার মনিকে নিতে এলে শাশুড়ি তাকে আড়ালে ডেকে বললো  তোমার বাবা যখন আমাকে তোমাকে নিয়ে যাবার কথা বলবে তখন আমি বলবো নিয়ে যান, কিন্তু তুমি বলবে না বাবা আমি আর ক’দিন পরে যাই। এই কথার কোন মানে খুঁজে পায় না। কেন এমন কথার কি এমন প্রয়োজন? সেই তো সরাসরি নিষেধ করে দিতে পারে। এই লুকোচুরি কেন? তার স্বামীর প্রতি উদাসীনতা, অবহেলা, অবজ্ঞা, অমর্যাদা কেন? তার ইচ্ছার কোন মূল্যায়ন নেই, তার মতামতের কোন গুরুত্ব নেই। যে সন্তান নিজের ভবিষ্যৎ বিসর্জন দিয়ে সংসারের হাল ধরতে সাঁতার না জেনে সাগর পাড়ি দিয়েছে তার প্রতি এই মনোভাব কেন?
এই এত গুলি চেপে রাখা কেন তার বুকের ভিতর বাসা বাঁধতে থাকে, ক্ষত বিক্ষত হয়ে অসহ্য যন্ত্রণার কামড়ে সে দগ্ধ হতে থাকে। কেমন যেন একটা শূন্যতা, একটা বিষাদ, একটা হাহাকার, কিছু অব্যক্ত বেদনায় দগ্ধ মনিরা নিজেকে স্বামীর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। কি জানি আবার কখনো যদি ভুল করে এর কিছু স্বামীর কাছে বলে ফেলে তা হলে যে সে মনে ব্যথা পাবে, আঘাত পাবে এই মনে করে। এ কি মনি! আমার মা, বাবা, ভাই বোনদের সম্পর্কে এই ধারনা পোষণ কর? তখন সে কি জবাব দিবে? সে নিজেই তো এর কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না।
কাছের রাশেদ আর দূরের রাশেদের মধ্যে এই পার্থক্যের বোঝা সব গিয়ে পরে মনিরার মাথায়। যে স্বামীর জন্য জীবনের সঞ্চিত সমস্ত শ্রদ্ধা, ভালবাসা, সমস্ত মমতা উজাড় করে দিয়েছে তার প্রতি এই আচরণ কি করে মেনে নিতে পারে? কিছু না বুঝে ক্রমান্বয়ে তার বুকে চাপা পাথর জমে জমে এখন শ্বাস নিতেও কষ্ট বোধ করে।  শ্বাস নেয়ার জন্য শ্বাসনালী সংকুচিত হতে হতে এখন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তবুও তার প্রিয় স্বামীকে কিছু বুঝতে দিতে চায় না। সমস্ত যন্ত্রণা তার একার উপর দিয়েই যাক। যে তার সংসারের প্রতি অন্ধ ভালোবাসা নিয়ে বিভোর রয়েছে সে থাকুক তার আপন মনে, যা হবার আমারই হোক। আভাসে ইঙ্গিতেও যাকে বোঝানো যায় না, বুঝতে চায়না সে তার ধারনা নিয়ে সুখে থাক।

একদিন যেদিন প্রথম মনিরার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তখন স্বামীকে বললো-
-আমার এমন লাগছে কেন?
-কি হয়েছে মনি?
-আমি যে শ্বাস নিতে পারছিনা।
-বল কি?
রাশেদ সাহেব তাড়াতাড়ি মাকে ডেকে এনে দেখাল,
-আম্মা দেখেন মনি এমন করছে কেন?
-কি হয়েছে?
ইশারায় দেখাল শ্বাস নিতে পারছি না।
-আম্মা ডাক্তার ডাকবো?
-না থাক এমনিই শুয়ে থাক ঠিক হয়ে যাবে।
-থাকবে কেন? তুমি থাক, আমি আসছি!
বলেই সার্টটা কোন মতে গায়ে দিয়ে বের হয়ে গেলো ডাক্তারের সন্ধানে। বাড়ির কাছে তাদের চেনা ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে ডাক্তারকে পেয়ে সাথে সাথে ধরে নিয়ে আসার মত করে নিয়ে এলো। ডাক্তার রুগী দেখে জানালো অনেক দিন থেকেই এমন চলছে মনে হচ্ছে, প্রচণ্ড মানসিক চাপ থেকে এমন হয়। রাশেদ সাহেব মেনে নিতে চাইলেন না।
-না, ওর কেন মানসিক চাপ থাকবে?
-তুমি পুরুষ মানুষ তুমি কি বুঝবে? মেয়েদের অনেক কারণে মানসিক চাপ হতে পারে।
প্রেসক্রিপশন লিখে দিল আর বলে দিল মানসিক চাপ কমাতে হবে, না হলে এ রোগ কিন্তু জটিল আকার ধারণ করতে পারে। শোন, তোমার স্ত্রীর এই অবস্থা তুমি কিছু জান না এটা কিন্তু মেনে নেয়া যায় না বাবা! ওষুধ গুলি এনে সময় মত খাওয়াবে আর কোন মানসিক চাপের কারণ হয় এমন কিছু করবে না।
এ কথা শুনে রাশেদ সাহেব কিছু বলতে পারলো না মাথা নিচু করে ভাবতে লাগলেন।
ডাক্তারের সাথে রাশেদ সাহেব বের হলেন ওষুধ আনার জন্য। ওষুধ এনে মনিকে খাইয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
-মনি বলতো তোমার কি এমন চাপ, প্রায়ই লক্ষ করি তুমি যেন কোথায় হারিয়ে যাও। আমার পাশে শুয়ে থাক তবুও মনে হয় তুমি আমার নাগালের বাইরে। কি এমন ব্যাপার বলতো মনি!
মনি নিরুত্তর।
-কী, কথা বলছ না যে!
-না কিছু না।
-কিছু না আবার কি? তাহলে এমন হয় কেন? বল, আজ তোমাকে বলতেই হবে, ডাক্তার কি এমনি এমনিই বলেছে? কি হয়েছে তোমার বল।
মনি নিরুত্তর।
-কথা বলছ না কেন?
-কি বলবো, বললাম না কিছু না।
-তাহলে এমন হলো কেন?
-কিছু হয়েছে তা বোঝার ক্ষমতা তোমার নেই, আর তুমি তা চেষ্টাও করনি কখনো।
-হ্যাঁ তোমার একথা আমি মেনে নিচ্ছি, আমিতো তোমাকেই সব ভার দিয়ে দিয়েছি কাজেই আমাকে আলাদা করে কিছু ভাবতে হবে তা কি আমাকে বলেছ কখনো? না কি আমি সে ভাবে ভেবেছি? আমি জানি আমার মনি আছে, ব্যাস আর কি? কি হয়েছে সে কথা তুমি আমাকে বল না কেন?

১৪।
তার বুকটা চিরে তো আর তার স্বপ্ন গুলো দেখাতে পারে না, তাকে কে বিশ্বাস করবে, সবার কাছেই যে সে আজ এক চলমান রাহু, তার ছায়া দেখা বা সকালে উঠে তার মুখ দেখাও যে আজ সবার কাছে অশুভ দিনের পূর্বাভাস। এ না বোঝার মত খোকা সে নয়। জীবনের অনেকটা পথ সে পেড়িয়ে এসেছে, অনেক আলো ছায়া, বাতাসের স্পর্শ, জলের তরঙ্গ সে দেখেছে, অনুভব করেছে প্রকৃতির কঠিন কোমল নিস্তব্ধ মুহূর্ত গুলি, পান করেছে নানা ঘাটের জল। আজ তার একমাত্র আশ্রয় মনিরার বিশাল হৃদয় নামক শান্ত নীড়, যেখানে একমাত্র তারই প্রবেশাধিকার। সেখানে তার জন্য সাজানো রয়েছে এক বিশাল কুঞ্জবন, পাতা রয়েছে বরফ নীল রঙের কোমল গালিচা, যেখানে রয়েছে তার স্বর্গ বিশ্ব যার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত যতদূর দৃষ্টি যায় সবটাই তার একার। যেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা এমন কঠিন যে আর কোন প্রাণীর প্রবেশ সম্ভব নয়।
যে মনিকে সে অকৃত্রিম ভাবে ভালোবাসে, মনিও তাকে ভালবাসে। মনিকে ছাড়া রাশেদ সাহেব কিছুই ভাবতে পারে না। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সমস্ত পৃথিবীকে চিৎকার করে বলে দেয় আমি মনিকে খুব বেশি ভালোবাসি, মনিই আমার জীবন, মনি শুধুই আমার, ওই আমার বেঁচে থাকা, ওই আমার সব, আমার জীয়ন কাঠি মরণ কাঠি সবই মনি। কখনো আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে নিমন্ত্রণে গেলে ওদের জন্য ভিন্ন বিছানা দেয়া যাবে না তা সবাই জেনে গেছে।

বিয়ের পর মনির বড় বোনের ছেলের মুসলমানির অনুষ্ঠান গ্রামের বাড়িতে করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ওদের যখন নিমন্ত্রণ করতে এলো তখন রাশেদ সাহেব কোন লাজ লজ্জার বালাই না রেখে বলেই ফেললো যে,
-ওখানে যেতে বলছ বেশ যাব কিন্তু এতো মানুষ দাওয়াত দিয়েছ তারা সবাই এলে আমাদের থাকতে দিবে কোথায়? আমি কিন্তু মনিকে ছাড়া থাকতে পারবো না।
এ কথা শুনে ওর বোন বলেছিলো-
-আমি সে ব্যবস্থা করে রেখেছি, তোমরা সে চিন্তা করবে না। তোমরা ওই দক্ষিণ ঘরে থাকবে, হয়েছে?
-হ্যাঁ এবার যেতে আপত্তি নেই।
সেই ছাব্বিশ বছর আগে বিয়ের দিনেই রাশেদ সাহেব তার মনির কাছে সব বুঝিয়ে দিয়ে বলেছিলেন আজ থেকে আমি বলে আর কিছু নেই যা আছে সবই তোমার, তুমি তোমার মত করে গড়ে নিও।
[চলবে]
Back to Home

No comments:

Post a Comment

Back to Top