নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৭২

১৪৪।
ভারতীয় রেস্টুরেন্ট। ভারতীয়ই বললাম কারণ যখন এই রেস্টুরেন্টের গোঁড়া পত্তন হয়, যখন এই সব রেস্টুরেন্টে ভারতীয় নাবিক থেকে শুরু করে ভারতে জবর দখল করে শাসন থেকে শোষণ কাজে নিয়োজিত যে সব ইংরেজরা
ভারতে গিয়ে মশলা যুক্ত খাবারের ঘ্রাণ ও স্বাদ পেয়ে নিজ দেশে ফিরে এসেও ওই খাবারের লোভে এই রেস্টুরেন্টে খেতে আসত তখন ওই দেশের নাম ছিলো ভারত। তারা ওই দেশটাকে তিন ভাগ করে দিয়ে এলেও তাদের বর্তমান বংশধর অনেকেই তা জানে না। তারা এখনও ভারত বলেই জানে। তাদের এসব ইতিহাস জানার দরকার নেই, চেষ্টাও নেই বা ইচ্ছেও নেই। এদের দরকার সুগন্ধি মশলাদার সুস্বাদু খাবার। তা সে যে দেশেরই হোক তাতে কি এমন আসে যায়?

কবে কে এই রেস্টুরেন্ট চালু করেছে অনেক খুঁজেও সে ইতিহাস সংগ্রহ করা যায়নিবিলাতে এই ব্যবসার সাথে জড়িত কয়েক জন প্রবীণ ব্যক্তির সাথে আলাপ করে যা জানা গেছে এর মধ্যে ইদ্রিস মিয়া, যিনি এসেছিলেন বর্তমান বাংলাদেশের সিলেটের মৌলবি বাজার থেকে ১৯৩৫ সালে, তার ভাতিজা নটরাজ রেস্টুরেন্টের সালিক মিয়ার কাছ থেকে পাওয়া কিছু সামান্য তথ্য এখানে দিচ্ছি। ১৯০০ সালের প্রথম দিকে ভারতীয় নাবিক বা অন্য কাজের জন্য যারা বিলাতে এসেছে তারা একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছে যে ইংরেজরা দেশ দখল করার কৌশল জানলেও রান্নার কাজে এরা খুবই দুর্বল। বিশেষ করে আমাদের নুন মশলার ঝাল খাবার ক্রমেই এদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। হবে না কেন, এরা যা খায় তাকে আর কিছু বলা গেলেও রান্না বলা যায় না। কোন রকম একটু সেদ্ধ করে লবণ, গোল মরিচের গুড়া আর একটু টমাটো সস বা সিরকা  ছিটিয়ে খেয়ে নেয়এই মুখে যদি একটু মশলা ছিটিয়ে দেয়া যায় তাহলে যেন ধন্য হয়ে যায় এমন একটা ভাব।
লন্ডন, ব্রিস্টল, লিভারপুল, ডান্ডি এই সব বিভিন্ন বন্দরে কিছু ভারতীয় নাবিক আসা যাওয়া করতে করতে তাদের কেও কেও সমুদ্রের নোনা জলের মায়া কাটিয়ে এখানেই থেকে যায়। এরা যেহেতু দেশ থেকে বিয়ে শাদী করে বৌ নিয়ে আসেনি কাজেই এখানেই সাদা চামড়ার পাত্রী খুঁজে বিয়ে করে স্থায়ী ভাবে ঘর সংসার পেতে বসেছিলো। নাবিকের পেশা ছেড়ে দিয়েছে এখন সংসার চলবে কি করে? ধীরে ধীরে নানান কল কারখানায়, কয়লার খনিতে কাজ জোগাড় করে নেয়। ইংরেজ বৌর সাথে সেদ্ধ বা আধা সেদ্ধ খেয়ে কোন মতে দিন যায়। কিন্তু ভারতীয়দের কি আর এই খাবারে মন ভরে? তাই যে সব জাহাজ ভারতে আসা যাওয়া করে তাদের দিয়ে ওখান থেকে মশলা পাতি আনিয়ে বাড়িতে মা চাচীকে যেভাবে রান্না করতে দেখেছে সেই ভাবে চেষ্টা করে কিছুটা হলেও মনকে প্রবোধ দিতে পেরেছে। এদিকে বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হলে অনেক কল কারখানা হুমকির মুখে পরে যায় তখন শুরু হলো ছাটাই। তখন এই সব ভারতীয়দের যারা চাকুরী হারিয়েছে তারা ইতোমধ্যেই এদের রান্নার দুর্বলতা ধরে ফেলেছে। এখান থেকেই উৎপত্তি হলো এক নতুন দিগন্তের উন্মেষ।

১৪৫।
ভারতে যাতায়াত কারি  জাহাজে করে এর মধ্যেই বেশ কিছু মশলা আসছে আর চিন্তা কি? খুলে ফেলল খাবার ঘর। যেখানে নাবিক সহ ওই যে ভারত ফেরত ইংরেজরা যারা এই সব মশলাদার খাবার খেয়ে অভ্যাস করে এসেছে তারা ওই স্বাদ, ওই গন্ধ ভুলতে পারেনি। ভুলবেই বা কি করে, পৃথিবীর সেরা স্বাদ এই ভারতীয় রান্না, এর কোন তুলনা নেই। সাধে আমাদের গুণীজনেরা বলেনি যে ঘ্রাণং অর্ধ্বং ভোজনংজিভে জল আসা ঘ্রাণেই অর্ধেক ভোজনের তৃপ্তি। জিহ্বাটা তীর্থের কাকার মত চেয়ে থাকে কখন এই খাবারের সংস্পর্শে আসবে।
বিলাতিদের ভারতীয় খাবারের আসক্তি এবং সাগরের মায়া কাটিয়ে এখানে যারা বসতি গড়েছে তাদের জীবীকার তাগিদ এই দুয়ে মিলে যাত্রা আরম্ভ হলো ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টের। প্রথম দিকে নোঙ্গর ফেলে মাটির স্পর্শ নিতে আসা কিছু নাবিক আর ভারত ফেরত কিছু বিলাতি মিলে খেতে শুর করলো এই রেস্টুরেন্টে।

ভারতীয় স্বামী রান্না করে আর তার বিলেতি বৌ সামনে গ্রাহকদের সেই খাবার পরিবেশন করে। সাদা ভাত, সামুদ্রিক ম্যাকারেল, কড বা সার্ডিন মাছ, এদেশের নদীর হেরিং, ট্রাউট মাছ, মুরগী বা ভেড়ার মাংস যা আমরা সচরাচর খেয়ে থাকি তাই দিয়েই যাত্রা। পরবর্তীতে সময়ের সাথে মানুষের চাহিদা বাড়তে শুরু হলো আর সেই সুযোগে এই সব রেস্টুরেন্টে যারা রান্না করে তাদের পারদর্শিতাও বাড়তে থাকে। ক্রমে ক্রমে ভারতের নানা এলাকা যেমন বাংলা, মাদ্রাজ, গুজরাট, কেরালা, পাঞ্জাব বিভিন্ন এলাকা থেকে রন্ধন পটীয়সীরা তাদের নানা রকম ভাণ্ডার এনে চমক দেখাতে আরম্ভ করলো।

রান্না বান্না! এতো এক মস্ত শিল্প। যে শিল্পের কারুকাজ দিয়ে মানুষের মন জয় করা যায় তাৎক্ষনিক ভাবে অতি সহজে। পেটের ক্ষুধা, মনের ক্ষুধা দুয়ে মিলে পায় সীমাহীন তৃপ্তি। তখন মেনু ছিলো চিকেন বা মিট (মিট বলতে এদেশে ভেড়ার মাংস বোঝায়) কারি, দোপিয়াজা, ভুনা, মালাই কারি, কোর্মা, বয়েল্ড রাইস, পোলাও রাইস, বিরিয়ানি এবং সুপ। চিকেন পোলাও ছিলো তখনকার একটা বিশেষ চাহিদার খাবার। কিন্তু মানুষ বৈচিত্র্যের সন্ধানী। কত কাল আর এই এক খাবার চলবে? নতুন কিছু চাই। রাঁধিয়েরা চেষ্টা করছে, গবেষণা করছে কি কি উদ্ভাবন করা যায়। রাঁধিয়ে বললাম এই জন্য যে তখন রান্না করত পুরুষ মানুষ তাকে তো আর রাঁধুনি বলা যায় না! অবশ্য মাঝে মাঝে তার স্ত্রীও কিচেনে সাহায্য করেছে।
এই গবেষণা বা চেষ্টা যাই বলি না কেন এর ফলে যুক্ত হলো আর এক নতুন মাত্রা। টিক্কা এবং তন্দুরি। বিশেষ ভাবে কাটা মাংস টক দৈ বা ইওগার্টের সাথে মশলা পাতি মিশিয়ে সারারাত রেখে দিয়ে লোহার শিকে গেঁথে সরাসরি আগুনে ঝলসে টিক্কা বা তন্দুরি করা হোতএগুলি ঝলসিয়ে খাওয়া যায় আবার এই ঝলসান মাংস রান্না করেও এক নতুন পদ তৈরি করেছে। এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হচ্ছে টিক্কা মাশাল্লা, সে চিকেন বা মিট যাই হোক।

১৪৬।
এই সব মশলা এবং রেস্টুরেন্টের নানাবিধ মালামাল যোগান দেয়ার জন্য আর এক দল তৈরি হয়ে গেলো। যারা রেস্টুরেন্টের চাহিদা অনুযায়ী মালামাল রেস্টুরেন্টে পৌঁছে দিয়ে যায়। প্রথম দিকে আস্ত মশলা বা আস্ত মুরগী, ভেড়া দিয়ে যেত। আজকাল আর সে দিন নেই। এখন বিজ্ঞানের দৌলতে গ্রাইন্ডিং মেশিন এসে গেছে, রেফ্রিজারেটর এসেছে। এখন গুড়া মশলা আসছে, চাহিদা মত টুকরা করা মাংস প্যাকেটে বরফ করে দিয়ে যাচ্ছে। গ্রাহকদের খাবার পর হাত মুখ মোছার জন্য সুগন্ধযুক্ত ভেজা ছোট তোয়ালের প্যাকেট, শাকসবজি, মদ বা নানা রকম পানীয়ও একই ভাবে আসছে। সপ্তাহের একটা নির্দিষ্ট দিনে টেলিফোনে অর্ডার নিয়ে সময় মত পৌঁছে দিচ্ছে। একই ভাবে টেবিল ক্লথ, ন্যাপকিন, সার্ভিস টাওয়েল ইত্যাদি লন্ড্রি থেকে ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে। শুধু দিয়ে যাচ্ছে বললে ভুল হবে। একে বারে যে জিনিস যেখানে থাকে সেখানেই তুলে দিয়ে যাচ্ছে।

যারা খেতে আসে তাদের মনোরঞ্জনের জন্য যার যার সামর্থ্য ও রুচি অনুযায়ী রেস্টুরেন্টগুলি সুন্দর পরিপাটি করে সাজান। তবে অধিকাংশই উপমহাদেশীয় কায়দায় সাজান। এমনকি দেয়ালে টানানো ছবিতেও উপমহাদেশীয় কৃষ্টি সংস্কৃতির প্রতিফলন ফুটে উঠেছে। এই বিজাতি ইউরোপীয় সংস্কৃতির মাঝে চমৎকার বিদেশি সংস্কৃতি ধরে রেখেছে। এতে রেস্টুরেন্টের মালিকদের দেশ প্রেম এবং তা ইউরোপের মাঝে ফুটিয়ে তোলার যে প্রচেষ্টা তাতে তাদেরকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়। ভিতরে অন্যান্য সাজসজ্জার সাথে মৃদু লয়ে মূর্ছিত বাংলা বা হিন্দি সুর লহরীর ঝংকার যা প্রকৃত পক্ষেই এই সুদূর পশ্চিমা সভ্যতার মাঝে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি পরিচয় করিয়ে দেয়ার এক অসাধারণ প্রচেষ্টা এবং এটাই এদের সফলতা। এটা তখন বোঝা যায় যখন এই বিলেতিদের মুখ থেকে শোনা যায় বাহ! বেশ সুন্দর বাজনা, কোন কোন মাতাল আবার এই বাংলা সুরের সাথে নেচেও ওঠে।
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top