নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৭৩

 ১৪৭।
এই যে আমাদের বাংলাদেশিরা তার নিজের ভাবমূর্তি, সংস্কৃতি, নিজের খাদ্যের স্বাদ গন্ধ ভিন্ন জাতির মাঝে পরিচিত করে দিচ্ছে তাদেরকে এর সাথে একাত্ম করে দিচ্ছে যে প্রচেষ্টা দিয়ে সে অবশ্যই আনন্দের এবং গর্বের। একটা ব্যাপার
যা উল্লেখ না করে পারছি না তা হচ্ছে এই প্রচেষ্টা যা আজ একটা বিশাল শিল্পে পরিণত হয়েছে তার যারা উদ্যোক্তা তারা কিন্তু কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত নয় এমনকি তাদের তেমন কোন সাধারণ শিক্ষাও নেই। কেবল মাত্র নিজের সংসার পরিচালনার তাগিদে নিজের অভিজ্ঞতা এবং আগ্রহের উপর ভিত্তি করে এর বিকাশ ঘটিয়েছে। যা আজ বিলাতের সরকারি  পর্যায়ে স্বীকৃত এমনকি ব্যক্তিগত ভাবে সরকারি উচ্চ মহলের পদস্থ ব্যক্তিবর্গ অত্যন্ত আগ্রহের সাথে এই খাদ্য গ্রহণ করছেন।

কোন রকম শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ ছাড়াই যে ভাবে এই শিল্পের প্রসার ঘটেছে তাতে অবাক না হয়ে পারা যায় না। আমাদের দেশে বা এই দেশে যদি সরকার বা বেসরকারি পর্যায়ে এমন কোন প্রতিষ্ঠান থাকতো যেখানে এসব শিক্ষা দেয়া হয় তা হলে নিশ্চয়ই এর প্রতিফলন আরও ব্যাপক আরও বিস্তৃত হতে পারত। তবে, এখনও সে সুযোগ হারিয়ে যায় নি। এখনও সারা যুক্তরাজ্যে প্রায় বিশ হাজার রেস্টুরেন্ট এবং টেক এওয়ে রয়েছে যার অন্তত ৮০% আমাদের বাংলাদেশিদের মালিকানায় রয়েছে। কোনটা একক মালিকানায় আবার কোনটা একাধিক মালিকানায় রয়েছে। শুধু যুক্তরাজ্যেই নয় সারা ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা সহ অনেক জায়গায় এই ব্যবসা বিস্তারিত। তবে বিলাতে এর প্রসার উল্লেখযোগ্য।

এতে যে শুধু ভিন দেশীদের রসনা তৃপ্ত হচ্ছে তা নয় এর মাধ্যমে এই রেস্টুরেন্টের স্বত্বাধিকারি দের সম্পদের বিশাল ভাণ্ডার জমে উঠছে যার বেশ একটা মোটা অংশ আমাদের দেশে যাচ্ছে। নানা ভাবে যাচ্ছে। তারা নিজেরাও পাঠাচ্ছে আবার এখানে যারা কাজ করে তাদের অধিকাংশবাংলাদেশি কাজেই তারা যে মজুরী পাচ্ছে তা থেকে সে নিজের জন্য কিছু রেখে প্রায় সবটাই পাঠিয়ে দিচ্ছে দেশে। বাংলা দেশের ছাত্র যারা এখানে পড়তে আসে তাদের একটা আশ্রয় হয়েছে। রেস্টুরেন্টে কাজ করলে অন্তত থাকা খাওয়ার কোন চিন্তা নেই, অধিকন্তু সপ্তাহ শেষ কিছু স্টার্লিং পাউন্ড পাচ্ছে যা এদেশের জন্য নগণ্য হলেও আমাদের দেশের জন্য অনেক।

একাধিক মালিকানায় যে সব রেস্টুরেন্ট রয়েছে তাদের কাজ পরিচালনা অত্যন্ত সহজ। তাদের নিজেদের কেও কিচেনে সেফ এর কাজ করছে, কেও গ্রাহদের সাথে মিশে গিয়ে তাদেরকে বুঝিয়ে কিছু দামি খাবারের অর্ডার নিচ্ছে নিদেন পক্ষে একটা অতিরিক্ত ড্রিঙ্কের অর্ডার আদায় করে নিচ্ছেআবার রাতের শেষে রেস্টুরেন্ট বন্ধ হলে সবাই মিলে মিশে হিসাব নিকাস করে নিচ্ছে। পর দিন কে গ্যাস বিল দিবে, কে পানির বিল দিবে বা কে কি করবে তা ঠিক করে নিচ্ছে। সবসময়ই যে এমন সু সম্পর্ক বজায় থাকছে তা নয়, মাঝে মাঝে অংশীদারদের মধ্যে মারামারি  হাতাহাতি এমনকি আদালত পর্যন্তও গড়াচ্ছে। আবার এমনও দেখা গেছে যে কেও কৌশলগত বা অন্য কোন কারণে ব্যবসায় সফল হতে পারেনি তবে এ ঘটনা খুবই কম। কেও আবার আশাতিরিক্ত লাভের মুখ দেখে বিপথেও চলে যাচ্ছে। এদেশের ব্যবসা অধিকাংশই লাভ জনক, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে সমস্ত খরচ বাদ দিয়ে বিক্রির সত্তর থেকে পঁচাত্তর ভাগ লাভ থেকে যায়।

 [একটি দুর্লভ মুহূর্তের বিবরণ:

যখন আমি এই লেখা লিখছি তখন বিবিসি-২ থেকে একটা কালচারাল প্রোগ্রামের জন্য আমার সাক্ষাতকার নিতে এসেছে। অনুষ্ঠানটি ২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ২ তারিখ রাত আটটায় বিবিসি-২ চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছে।

এখন আমি বিবিসির ক্যামেরার সামনে বসে এই লেখা লিখছিএ যে আমার জন্য কত বড় আনন্দের ব্যাপার তা বোঝাই কি করে, এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কি হতে পার জানি না। আমি জীবনেও যা কল্পনা করিনি যে বিশ্বের প্রথম শ্রেণীর একটা মিডিয়ার ক্যামেরার সামনে বসে আমি সাক্ষাতকার দিব আর লিখবো। এটা শুধু আনন্দের এবং আনন্দের, চরম আনন্দের ব্যাপার। যা কেবল মাত্র মনে মনেই ভাবা যায় অনুভব করা যায়, যা প্রকাশ করার মত ভাষার স্বল্পতা এই মুহূর্তে আমাকে ভীষণ ভাবে আলোড়িত করছে। মনে হচ্ছে আমি যদি নতুন কিছু শব্দ বানিয়ে এখানে যোগ করতে পারতাম! হয়তোবা এমন কোন শব্দ রয়েছে যা এই মুহূর্তে আনন্দের আতিশয্যে আমার মনে আসছে না।
পৃথিবীর সমস্ত ভাল লাগা গুলি যেন আমার ভাবনার মিছিলে যোগ দিয়েছে। এই এত ভাল লাগা আমি কি করে প্রকাশ করি, ভেবে পাচ্ছি না। এই চরম প্রাপ্তির জন্য আমার সৃষ্টিকর্তার কাছে শোকর জানাবার ভাষাও খুঁজে পাচ্ছি না। যে আমাকে হাজার  হাজার মাইল দূরের বাংলাদেশের ঢাকা জেলার রৌহা গ্রামের এক ছোট্ট কুড়ে ঘর থেকে তুলে এনে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছে। যা অসংখ্য কোটি কোটি দর্শকে দেখবে। জানি না কে কি ভাববে, কি ভাবে এর মূল্যায়ন করবে। তবে যে যাই ভাবুক বা যে ভাবেই এর মূল্যায়ন করুক এ যে আমার এক চরম প্রাপ্তি তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই বিশ্বে অনেক বড় বড় নামি দামি গুণী লেখক অনেক মূল্যবান লেখা লিখে গেছেন যা হৃদয়ে দোলা দেয়, অনন্ত কাল ধরে যে লেখা সারা বিশ্বকে আলোকিত করে রাখবে। জানিনা কয় জন লেখকের ভাগ্যে এই সৌভাগ্য এসেছেধন্যবাদ বিবিসির প্রয়োজক ফেনোলাকে এবং তার সম্পূর্ণ টিমকে।]

[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top