নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৮৫

১৬৪।
রাত ঠিক সাড়ে এগারটায় খুকুর সুটকেস আর তার নিজের ২/১টা কাপড় চোপড়ের ব্যাগ নিয়ে নাসিরের সাথে বের হলেনবরফের উপর দিয়ে সুটকেস টেনে নিয়ে যেতে বেশ কষ্ট হলো মনে হচ্ছিল যেন ঘেমে যাচ্ছে কিন্তু কন্যার মুখ
দেখার, তার সান্নিধ্য পাবার আনন্দে সে কষ্ট গায়ে লাগছিল না। নাসিরও সাহায্য করেছে। সাধারণত কোচ স্টেশনে আসতে যে সময় লাগে আজ তার চেয়ে কিছু বেশি লাগল। কোচ স্টেশনে ঢুকে দেখে বাইরের গেটে সোয়ান সি থেকে আসা কোচ দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভারকে টিকেট দেখাতে সে সুটকেস নিয়ে নিচের লাগেজ কম্পার্টমেন্টে রেখে দিল। পথে খাবার জন্য নাসির কয়েকটা স্যান্ডউইচ আর এক বোতল পানি এনেছিল কোচে উঠার আগে রাশেদ সাহেবের হাতে দিয়ে দিল। পুরো কোচ প্রায় খালি বলতে হয়। মাত্র ৩/৪ জন যাত্রী নিয়ে এই কোচ লন্ডন যাবেসময় হতেই ড্রাইভার যাত্রী গুনে নিয়ে লন্ডনের পথে ছেড়ে দিল। ফোন বের করে ফিরোজকে ফোন করল।
-কি খবর রাশেদ, তোমাদের স্নো কমেছে?
-হ্যাঁ ফিরোজ, কোচ এই মাত্র ছাড়ল।
-লন্ডন পৌঁছাবে কখন?
-সকাল ৬টায়, আমি ওখানে পৌঁছে আগে তানিমের বাসায় যাব তিথির বাসা চিনে নেয়ার জন্য, নয়ত ওকে সাথে নিয়ে মালামাল সহ খোজা খুঁজি ঝামেলা হবে।
-ঠিক আছে তাই ভাল হবে, আমার এখানে আসবে না?
-যদি সময় থাকে তা হলে আসব না হলে পরশু ওকে নিয়ে একবারে আসব।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
এবার তানিমকে বলা দরকার। তানিমকে ফোনে না পেয়ে ওর বৌ কেয়াকে পেল।
-কি ভাইয়া, আপনি আসতে পারছেন, আপনাদের স্নো কমেছে?
-এইতো আমি এখন কোচে, সকাল ছয়টায় ভিক্টোরিয়া পৌঁছেই তোমাদের ওখানে যাব, তানিমকে নিয়ে তিথির বাসা চিনে লাগেজটা ওখানে রেখে তারপর হিথরো যাব, তুমি তানিমকে বলে রেখ, আমি ওকে পেলাম না।
-হ্যাঁ ভাইয়া ও এখন কাজে তাই ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছে
-, আচ্ছা, ঠিক আছে তাহলে রাখি, সকালে দেখা হচ্ছে
কিছুক্ষণের মধ্যেই কোচ মোটর ওয়েতে চলে এলো। সারা দিন যে ভয়ে ছিল এখানে এসে দেখা গেল বরফের কোন চিহ্নই নেই সব পরিষ্কার। অল্প স্বল্প যা ছিল তা গাড়ি চলাচলে গলে পানি হয়ে এখন বাষ্প হবার অপেক্ষা করছে। মন চলে গেল ঢাকার বাড়িতে। ওরা এখন কি করছে? খুকুর মা কি এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছেছে? সাথে কে কে এসেছে? খুকুর মনে কি হচ্ছে? মাকে ছেড়ে যাবার শোকে কাতর নাকি বাবাকে দেখার আনন্দ, নাকি শোক আর আনন্দের মিশ্র অনুভূতিতে দিশা হারা? মাঝু এবং ছোটনের কেমন লাগছে, বড় আপু চলে যাচ্ছে এই ব্যথায় অস্থির নাকি বড় আপু গিয়ে বাবাকে দেখবে এই আনন্দ? খুকুর মা নিশ্চয়ই একটা ভাব গম্ভীর লেকচার শুনিয়েছে, মাঝুওনিশ্চয়কম করেনি!

বড়াপু, তুমি কিন্তু বাবার খেয়াল রেখ, বাবা যা খেতে চায় রেঁধে দিও, সাবধানে থেকো দেখবে আবার ঠাণ্ডা লাগিয়ে নিও না, বাবা যে ভাবে বলে তেমনি চলবে, বেশি মাতব্বরি করতে যেও নাএই সব ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছে। সাধারণত জার্নিতে ঘুম আসে না কিন্তু আজ কি হলো হয়ত বা মনের কোণে জমে থাকা সন্তানের মুখ দেখতে না পাবার অতৃপ্তি, পিতৃ স্নেহের হাহাকার, একা থাকার এক যন্ত্রণার কিঞ্চিত অবসানের আভাসে ক্লান্ত মন কখন যেন নিস্তেজ হয়ে অবসাদে ঝিমিয়ে পরেছে। রাত প্রায় দুটার দিকে মাইকে ড্রাইভারের কণ্ঠে ঝিমানি ভাব ভেঙ্গে গেল। গাড়ি কোথায় এসেছে কিছু বুঝল না। ড্রাইভার বলছে সামনের সার্ভিসে আধা ঘণ্টার জন্য থামবে। নাসির যে খাবার দিয়ে দিয়েছে তাই এখনও খায়নি, যাক ভালই হয়েছে। স্যান্ডউইচের প্যাকেট খুলে খেয়ে নিলেনএর মধ্যেই সার্ভিসে এসে গাড়ি পার্ক করল। কয়েক জন যাত্রী ছিল সবাই নেমে গেল। প্রথমে টয়লেটের কাজ সেরে দুই পাউন্ড দিয়ে এক গ্লাস চা নিয়ে পাশে রাখা দুধের প্যাকেট আর ক্যান্ডিরালের দুইটা প্যাকেট নিয়ে চায়ের সাথে মিশিয়ে কাঠি দিয়ে নেড়ে কাঠি, দুধের খালি প্যাকেট, ক্যান্ডিরালের প্যাকেট বিনে ফেলে বাইরে এসে চা খাচ্ছে আর হাতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবছে খুকু এতক্ষণে ফ্লাই করেছে। ভাবতে ভাবতেই দেখে ফোন বাজছে। এতো রাতে কে ফোন করলো! পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে ওভার সিজ নাম্বার
-হ্যালো
-হ্যাঁ, আমি
-ও! মনি! কি খবর?
-তোমার খুকুকে উঠিয়ে দিয়ে আমরা এই মাত্র বাড়ি পৌঁছলাম।
-খুকু কি আমার একার নাকি? তোমার খুকু বলছ কেন?
-না তোমার একার হবে কেন, তোমার কাছে পাঠিয়ে দিয়ে এলাম তাই বললাম।
-কান্না কাটি করেছ?
-বুঝ না? মায়ের মন কেমন হতে পারে? তবে তোমার কাছে যাচ্ছে বলে তেমন খারাপ লাগেনি তবুও মায়ের মন না? শুধু কি আমি, তিন বোনে মিলে যা করেছে তা দেখলে অবাক হতে। এক বার ওদের দুজনকে ছেড়ে ভিতরে চলে যায় আবার ফিরে এসে জড়িয়ে ধরে কান্না, আবার ভিতরে যায় একটু গিয়েই আবার ফিরে আসে। বলে মা, যদি বাবা ওখানে না থাকত তাহলে আমি যেতাম না। বুঝিয়ে সুঝায়ে তারপর ঠেলে দেয়ার মত করে দিয়েছি।
-হ্যাঁ তা হবেই, যাক তুমি চিন্তা করবে না, হিথরোতে ওকে দেখা মাত্রই আমি জানাব। মন খারাপ করে থেক না, তুমি এইতো আর কয়েক মাস পরেই আবার আসছ তখন দেখবে, আমিও ছুটি নিয়ে লন্ডন যাব, কাজেই মন খারাপ করে থেক না ওদের দিকে খেয়াল রেখ।
-শোন, জাহিদ ফোন করেছিল, ওরা এয়ারপোর্টে আসবে
-আমাকে কিছু বলেনি কেন? আমাকে বললে কি আমি নিষেধ করতাম, তুমি নিষেধ করতে পারলে না? আমি তো যাচ্ছি। ওরা যা করেছে তারপরে এখানে আসার কি উদ্দেশ্য? ওরা যা করেছে সে কথা কি আর তুমি আমি জীবনে কোনদিন ভুলতে পারব মনে করেছ?
-দেখ, আমাদের সাথে যাই করুক না কেন মেয়ের ব্যাপারে কি আর তেমন করতে পারবে? তুমি আমি নিষেধ করলেই কি ওরা মানবে? মেয়ে তো আর তোমার একার না কাজেই মেয়ে যাচ্ছে আর চাচা চাচী কি রিসিভ করবে না? তুমি কী যে বল!
-আচ্ছা ঠিক আছে আসুক, হিথরো থেকে ওদের গাড়িতে বাসায় যেতে সুবিধা হবে।

১৬৫।
সকাল ঠিক ৬টায় এসে ভিক্টোরিয়া পৌঁছে কোচ থেকে নেমে সোজা টিউব স্টেশনে এসে অল জোনের একটা ডে টিকেট নিয়ে চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে ইঁদুরের গর্তের মত স্টেশনের নিচে নেমে তানিমের বাসায় যেতে মাইল এন্ডের উদ্দেশ্যে ডিসট্রিক্ট লাইনে উঠে বসলেনঘণ্টা খানেকের মধ্যে বাসায় পৌঁছে নাস্তা করে তানিমের সাথে আবার স্টেপনি গ্রিন। এখানে নেমে বাসায় যেয়ে বাড়ির লোকজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।
-ইনি রাশেদ ভাই, যে মেয়েটা আসছে তার বাবা।
-ও আছা! ভিতরে নিয়ে রুম দেখিয়ে দিল।
সুটকেস ব্যাগ রেখে বললো -তাহলে আমি এখন আসি।
-এখনি যাবেন, একটু চা খেয়ে যান!
-না না আমাকে আবার ইস্ট একটন যেতে হবে, একটু পরে তো আসছি তখন খাব।
-ও কখন ল্যান্ড করবে?
-দুপুর দুইটায়, তবে সব কিছু সেরে আসতে আসতে ৫/৬টা বেজে যেতে পারে।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
ওই বাসা থেকে বের হয়ে তানিম জিজ্ঞেস করল ভাইয়া ইস্ট একটনে কোথায় যাবেন?
ওই যে আমার বন্ধু, ফিরোজের বাসায়। তুমি কি এখন বাসায় যাবে নাকি কাজে?
-কাজে যাব। ভাইয়া, আমি কিন্তু এয়ারপোর্টে যেতে পারছি না তবে রাতে এসে ওর সাথে দেখা করব। আপনি একটন যাবেন যখন তাহলে স্টেপনি গ্রিন না গিয়ে মাইল এন্ড থেকে সেন্ট্রাল লাইনে চলে যান, চলেন কুইন্স মেরি ইউনিভার্সিটির ভিতর দিয়ে সোজা পথ আছে আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।

বাসার সাথেই ইউনিভার্সিটির পিছনের একটা গেটের ভিতর দিয়ে হেঁটে মাইল এন্ড টিউব স্টেশনে এসে তানিম চলে গেল ডিসট্রিক্ট লাইনে রাশেদ সাহেব সেন্ট্রাল লাইনের জন্য একটু অপেক্ষা করলেন
ফিরোজের বাসায় বসে চা খেতে খেতে ভাবী সহ গল্প হলো কতক্ষণ। ভাবীবললো -কি ভাই মেয়ে আসছে বলে মনে খুশি লাগছে না?
-কি যে বলেন ভাবী, সে কি আর বুঝেন না? আচ্ছা ফিরোজ, আমাকে কখন বের হতে হবে?
-কোন এয়ার লাইনে আসছে যেন?
-ব্রিটিশ এয়ারে।
-তাহলে তুমি দুটায় বের হলেই হবে কারণ ও শিডিউল টাইমে ল্যান্ড করলেও ইমিগ্রেশন, হেলথ, লাগেজ, কাস্টম এসব সেরে দুই ঘণ্টার আগে বের হতে পারবে না, আর ভাল কথা মনে হয়েছে, ব্রিটিশ এয়ার কোন টার্মিনালে ল্যান্ড করে জান?
-না।
-৪ নম্বরে।
-তাই নাকি, না বললে তো আমি ৩ নম্বরে যেয়ে খুঁজতাম। আচ্ছা দুটা বাজার বেশি বাকি নেই। একটু আগেই বের হই আমি কখনও ৪ নম্বর টার্মিনালে যাইনি।
-তা হলে চলেন ভাই খেয়ে নেন
-ঘড়ি দেখে বললো দেন কি দিবেন খেয়েই যাই।

খেয়ে দেয়ে ওদের আছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলেনযাবার আগে ভাবী বলে দিল মেয়ে আসার পর ও একটু ঠিক হলে এনে বাড়ি চিনিয়ে দিয়ে যাবেন, আর বলে দিবেন যেন যে কোন সময় যে কোন দরকার হলে চলে আসে।
ফিরোজের বাসা থেকে টিউবে সেন্ট্রাল লাইনে এসে ইলিং ব্রড ওয়ে নেমে ডিসট্রিক্ট লাইনে একটন টাউন থেকে ট্রেন বদলে পিকাডেলি লাইনে হিথরো ৪ নম্বর টার্মিনাল যেতে হবে। ইলিং ব্রড ওয়ে থেকে ডিসট্রিক্ট লাইনে উঠেছে, সামনে মাত্র একটা স্টেশন পরেই একটন টাউনে নেমে ট্রেন বদলে পিকাডেলি লাইনে উঠার কথা কিন্তু অন্যমনস্ক ছিল বলে কখন একটন টাউন ফেলে টোটেনহেম গ্রিনে চলে গেছে তা আর খেয়াল করেনি। স্টেশনের নাম দেখে হঠাৎ খেয়াল হলো কি ব্যাপার এখানে এলো কি করে? তাড়াতাড়ি নেমে আবার নিচের আর এক প্ল্যাটফর্মে যেয়ে পিকাডেলি লাইনের অপেক্ষা করছিলেনএমনিই সময় কম, মন অস্থির তারপর আবার উলটো পথে এসে সময় আরও কমে গেল।
পরের যে স্টেশনে থেমেছে জানালা দিয়ে সে স্টেশনের নাম আর ট্রেনের জানালার উপরে তার চলা পথের ম্যাপ মিলিয়ে আরও নিশ্চিত হয়ে নিলেন এবার আর ভুল হবার সম্ভাবনা নেই।
কেন যেন মনে হচ্ছিল ট্রেন খুব আস্তে চলছে। আরও একটু স্পিড বাড়ালে কি এমন ক্ষতি হয়? এত আস্তে গেলে কখন পৌঁছবে কে জানে। পথ একে বারে কম না। এখান থেকে ১১টা স্টেশন। সময় মত যেতে পারবে তো? ঘড়িতে দেখে তিনটার বেশি বাজে। খুকু বের হবার আগেই পৌঁছা দরকার। ও যেন বের হয়েই বাবাকে দেখতে পায়। না পেলেও ক্ষতি নেই অন্তত চাচা চাচীকে পাবে।
ভাবছিল, ওরা একটা ফোনও করলো না, আগে আলাপ করেনি বলে রাশেদ সাহেবও আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি।
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top