নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৮৩

১৬২।
সকালে রাশেদ সাহেবের ঘুম ভেঙ্গে গেল, উঠতে ইচ্ছা করছিল না, ভারী কম্বল গায়ে অনেকক্ষণ শুয়েই রইলেনগত কয়েক দিন থেকে তুষারপাত হচ্ছে। এমন দিনে কম্বল গায়ে হিটারে গরম বিছানায় শুয়ে থাকার আমেজই ভিন্ন রকমের
কিন্তু এক সময় তো উঠতেই হবে তাই উঠেই পরলেনসকালের কাজ কর্ম সেরে কিচেনে গিয়ে ভাবছেন কি খাই? ব্রেড? কর্ণ ফ্লাক্স? পরিজ? মজলি? নুডলস? কিছুই যে আর খেতে ভালো লাগে না। মনে হচ্ছিল এই তুষার সকালে ভাজা ইলিশের সাথে গরম খিচুড়ি হলে,ভালই হোত! না, ভাগ্যে আছে টোস্ট, ব্রেড, বাটার আর তার সাথে কিছু বেকড বিনস। তাই খেয়ে চায়ের কাপটা হাতে ঘরে এসে জানালার পর্দা সরিয়ে দেখে ঝুর ঝুর করে স্নো ঝরছে। রাস্তায় অন্তত ৬ ইঞ্চি জমেছে। কোন গাড়ি নেইএই বরফের মধ্যে গাড়ি চলেই বা কি করে! ঘড়ির সাথে লাগানো মিটারে ঘরের ভিতরে তাপ ১৪ ডিগ্রিতে নেমে এসেছে অথচ রাতে শোবার আগে ২৩ ডিগ্রী ছিল, কী ঠাণ্ডা! পর্দা সরিয়ে আলগা হিটারটা টেবিলের নিচে রেখে চেয়ারে বসলেনগরম ধোয়া উঠা চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেদৃষ্টি চলে গেল সামনের রাস্তা পেরিয়ে দূরের ওই রাগবি ক্লাবের ওপাশে জঙ্গলের দিকে। ঝাপসা ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। চারিদিকে বরফ জমে সব কিছু হালকা মরি মরি ভাবের নীলে মেশানো সাদায় ভরে আছে। কেমন একটা মায়া ভরা দৃশ্য। কাল রাতে ডিউটি শেষে নাসিরের সাথে বাইরে বের হয়ে হাঁটা হাটি করার সময় পথে নাক দিয়ে নিশ্বাসের সাথে পেটের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা গরম বাষ্প, চোখে স্নো ছিটে এসে জ্বালা ধরানো পানি বের হওয়া আর শীতের ভাব দেখেই বুঝতে পারছিলেন এই স্নো আর কদিন থাকবে কে জানে! রেস্টুরেন্টের পাশে বাসস্ট্যান্ড প্রায় শূন্য, খা খা করছে। বাস থেকে নেমে সামনে যে পাব সেখানে ভিড় নেই, কে আসে এই বরফ বিছানো রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে? সবাই যার যার ঘরে হিটারের কাছে বসেই বিয়ারের গ্লাস নিয়ে বসেছে।

হাতে চায়ের কাপ আর চোখে সামনের ঝুর ঝুর তুষার পড়ার দৃশ্য। মনটা উদাস হয়ে চলে গেল আষাঢ় মাসে। আষাঢ়ের সাথে এই তুষারের তুলনা চলে না তবুও মন যখন ভেবে নিয়েছে কি করা! মনের সাথে রাশেদ সাহেবও চলে গেলেনটিনের চালের বারান্দায় বসে চোখ চলে গেল বাড়ির সামনে বাগানে কামিনী গাছে ফোটা ফুল বৃষ্টির ভার সইতে না পেরে ঝড়ে পড়েছে তা ছাড়িয়ে নদীর ওপাড়ে তাল গাছের মাথায়। টিনের চালে বৃষ্টির রিম ঝিম সুর আর নদী থেকে ভেসে আসা ভেজা বাতাসে সেদিনও এমনই ভাব হয়েছিল। কত বৎসর হবে? প্রায় আঠারো বৎসর তো হবেই, খুকু যখন চার বছরের। ভেজা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ধরে ধরে এনে বাবার হাতে দিচ্ছিল,
-বাবা দেখ বিত্তি এনেছি কি সুন্দর না বাবা?
-হ্যাঁ মা সুন্দর, খুবই সুন্দর। দেখ মা ওই যে তাল গাছটা একা কেমন করে ভিজছে।
-ও ভিজছে কেন বাবা? ঘরে আসতে পারে না?

সেদিন তাল গাছের ঘরে আসা না আসা নিয়ে খুকু কে কোন জবাব দিতে পারেনি। সেই খুকু কাল বিলাত আসছে। রাশেদ সাহেবের প্রথম সন্তান খুকু, শারমিন সান ওরফে তিথি। রাশেদ সাহেব সোহাগ করে খুকু বলেই ডাকে। কাল তাকে লন্ডনে হিথরো এয়ারপোর্টে যেতে হবে। তিন দিনের ছুটি নিয়েছে। এই বরফ বিছানো পথে কোচ কি চলবে? মনে একটা প্রশ্ন এলো। এখানকার রাস্তায় তো কোন গাড়ি চলছে না, কি জানি মটর ওয়েতে কি হয়ে রয়েছে কে জানে! যদি না চলে তাহলে খুকু কি করবে? হিথরো এয়ারপোর্টে নেমে ইমিগ্রেশন, লাগেজ কালেকশন, কাস্টমের ঝামেলা ছাড়িয়ে যখন বাইরে এসে দেখবে বাবা নেই তখন কি করবে? নিজে যাচ্ছে বলে কাউকে বলাও হয়নি যে সে গিয়ে নিয়ে আসবে। আজ রাতের কোচে যাবার কথা। কি হবে কে জানে! ওকে রিসিভ করে বাসায় উঠিয়ে, কলেজে ভর্তি করে প্রয়োজনীয় সব কিছু দেখিয়ে চিনিয়ে দিয়ে আসবে, এই রকমই ভেবেছিলেনকত দিন পরে দেখবে খুকুকে!মনটা স্বাভাবিক ভাবে একটু চঞ্চল হয়েই ছিল। এই এতো বছর পরে বাবাকে দেখে খুকু কি করবে, খুকুকে প্রথম দেখে কি ভাবে বুকে জড়িয়ে ধরে এতো দিনের জমা মরু তৃষার মত পিতৃ স্নেহ কি ভাবে নিবারিত হবে এই নিয়ে কত কি ভেবেছে। স্বপ্নের কত সাগর পাড়ি দিয়েছে। সেদিনের বিত্তি ধরে আনা খুকু আজ একা একাই বিলাত আসছে, পড়তে। লন্ডনে একাই থাকবে। ভাবতে ভাবতে কখন যে বাইরের স্নোর সাথে চোখের স্নো টপ টপ করে গলে গলে পরতে শুরু করেছে বুঝতে পারেনি।
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top