নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-১২৩

২৫৭।
আস্তে আস্তে আত্মীয় মহলে জানাজানি হয়ে গেল রাশেদ সাহেব পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেঢাকার বাড়ির কোন অংশ সে পাচ্ছে না। ছোট শ্যালক এমরানের কানেও এ কথা পৌঁছেছে। একদিন সে এসে জেনে গেল। যাবার
আগে বোনকে বললো -এত ভাবছেন কেন মেঝআপা? দুলাভাইয়ের যদি কোন জায়গা নাও থাকে আমাদের ওখানে আপনি পাবেন না? বাবার জমি আছে না? আমাদের বাড়ির পিছনে যে জমিটা আছে ওটার সবটাই আপনাকে দিয়ে দিব, ওখানে একটা পুকুর করে মাটি কেটে বাকি অংশ ভরাট করে নিজের বাড়ি করে নিবেন। খুব সুন্দর বাড়ি হবে। কোন ভাবনা নেই, অনেক বড় বাড়িই হবে। আপনি ইচ্ছা করলে সামনের চৈত্র মাসে মাটি কাটার কাজ শুরু করতে পারেন। চিন্তা করবেন না, তাছাড়া আপনার মেয়েরা আল্লাহর রহমতে সবাই মানুষ হয়েছে, আপনার এত চিন্তা কিসের? ওরাই তো আপনার সবচেয়ে বড় সম্পদ। দুলাভাই আর কিছু করতে না পারলেও মেয়েদের মানুষ করেছে। মেয়েরাও বাবার মন মানসিকতা পেয়েছে। ওরা যেখানে থাকবে আপনি যখন যার কাছে যতদিন থাকতে ইচ্ছা হয় থাকবেন। মাঝে মাঝে আমাদের ওখানে যাবেন। মন খারাপ করছেন কেন?
এমরান চলে যাবার পর রাশেদ সাহেবের সাথে মনি আলাপ করল।
-এমরান কি বলে গেল শুনবে?
-বল
সব শুনে রাশেদ সাহেব বললেন মন্দ কি, তুমি তোমার বাবার কিছু জমি পাবে ওগুলা আমি কোনদিনই চেয়ে দেখিনি বা নেয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। এখন পরিস্থিতি যদি আমাদের ওগুলো নিতে বাধ্য করে তাহলে ও যা বলেছে তাই করব। কাওকে ঠকিয়ে তো আর নিচ্ছি না তাহলে এত দুর্ভাবনা কিসের?
-না দুর্ভাবনার কথা বলছি না, বলছি রাজীবের আর মেয়েদের মতামত ছাড়া কি কিছু করা যাবে?
-না তা করব কেন, ওদের সম্মতি নিয়েই করব।
কিন্তু মানুষ যা ভাবে তার সাথে তার নিয়তির পরিকল্পনা সবসময় মিলে না। এদিকে রাজীব আর খুকু অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছে। ওরা যে এপ্লাই করেছিল সেটা মঞ্জুর হয়েছে কিন্তু ওরা যেতে চাইছে না। তোমরা কোথায় থাকবে?
কেন মাঝু আছে। এ দেশে থেকে কি করবে? চলে যাওয়াই ভাল। দেখ তোমরাও ভেবে দেখ, আমাদের জন্যেই যদি ভাব তাহলে তোমরা ওখানে গিয়ে আমাদেরও নিয়ে যেতে পারবে কাজেই ভাবছ কেন? যখন ওখানে সেটল হবে তখন না হয় কিছু কিছু টাকা পাঠিও বা আমাদের নিয়েই যেয়োআমি তো কোন অসুবিধা দেখছি না।

 ২৫৮
বাবা আর মায়ের কথায় আশ্বস্ত হয়ে মাস ছয়েকের মধ্যে খুকু আর রাজীব চলে গেল। ওরা যাবার পরে মনি আর রাশেদ সাহেব বীথীর কাছে থাকে। মেঝ জামাই আহসানও ছেলের মত। আসলে রাশেদ সাহেবের জামাই ভাগ্য খুবই ভাল বলতে হবে। কয়েক দিনের মধ্যে বীথীও জাতি সঙ্ঘে ভাল একটা চাকরি পেয়ে ইন্দোনেশিয়া চলে গেল। যূথী যাবার এক বছরের মধ্যে সব কেমন যেন কাকতালীয় ভাবে হয়ে গেল। রাশেদ সাহেব আর মনি একা হয়ে গেল, এখানে মেঝ জামাই ছাড়া ওদের কেও রইল না। তিথি বা যূথী সবাই চেষ্টা করবে বাবা মাকে নিয়ে যেতে কেও ওদের এখানে একা থাকতে দিবে না শুধু সময়ের ব্যাপার। কাগজপত্র গুছিয়ে নিতে যতটা সময় লাগে। মা বাবাকে একা থাকতে হবে বলে বীথী চাকরিটা নিতে চাইছিল না। কিন্তু রাশেদ সাহেব, মনি, রাজীব এবং ছোট মামা অনেক বুঝিয়ে তবে রাজি করিয়েছেকি হবে? ছয় মাস পরপর ছুটি পাবে তখন আসবে! আহসান এখানে থাকছে কাজেই তুমি এত ভাবছ কেন?
বাবা মায়ের জন্য কেও এত ভাল চাকরি ছেড়ে দেয়? বোকা মেয়ে! তোমার বাবা মা কি পানিতে পড়েছে? আমি আছি না? ওখানে তোমার মায়ের জমি আছে না? আমি এবারই বাড়ি গিয়ে মেঝআপা যা পাবে সব তার নামে রেজিস্ট্রি করে দিচ্ছি। তুমি কোন চিন্তা করবে না। ওখানে একটা ঘর উঠিয়ে নিলেই হয়ে যাবে কিংবা তারা যদি গ্রামে থাকতে না চায় তাহলে এখানে আহসানের সঙ্গে থাকবে এখন যেমন আছেবীথী দুলাভাই আর মামার কথা মেনে তবে গেছে।


২৫৯।
রাশেদ সাহেব সারা জীবন পৃথিবীর বড়বড় শহরে থেকেছে তাই মনি ভাবছিল হয়ত ও গ্রামে থাকতে চাইবে না। আহসান সারাদিন অফিসে থাকে, বাসায় ফিরতে ফরতে রাত হয়ে যায়। রাশেদ সাহেব বাজার করে আর মনি শুধু রান্না বান্না নিয়েই ব্যস্ত থাকে। জামাই কি খাবে সারাক্ষণ এই এক চিন্তা যদিও দুপুরে অফিসেই খায় শুধু সকালে আর রাতে বাসায় খাবার সুযোগ হয়। এভাবেই প্রায় বছর খানিক থাকার পর একা একা ভাল লাগে না, মন টিকে না বলে রাশেদ সাহেব বললেন-
-চল না আমরা কিছুদিন গালা যেয়ে এমরানের ওখান থেকে বেড়িয়ে আসি!
-আহসানের রান্না বান্না কি হবে?
-ও হ্যাঁ তাই তো!

একদিন রাতে খাবার সময় আহসান তার শাশুড়িকে বললো-
-আম্মা আপনার ইচ্ছে করলে কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসেন
-তোমাকে কে দেখবে বাবা?
-আমাকে দেখার কি আছে, আমি ভাত রান্না করে নিব আপনি বেশি করে তরকারি রান্না করে ফ্রিজে রেখে দিবেন মাইক্রোওয়েভে গরম করে খেয়ে নিব, আমার একার জন্য চিন্তা করতে হবে না।
-তোমার আব্বাও গ্রামে যেতে চাইছিল
-তাহলে যান, কয়েকদিন থেকে আসেন।

২৬০।
গ্রামে আসার পর একদিন বিকেলে যে জমিটা এমরান দিবে বলেছে তার পাশে মনি আর রাশেদ সাহেব দুইজনে ক্ষেতের আইলের ঘাসের উপরে বসে বলাবলি করছিল এখানে বাড়ি হলে ভালই হয়
-ওমা! তুমি কি এখানে থাকতে পারবে? আমি তো তোমার কথা ভেবেই এখানে কিছু করতে চাইনি
-মনি, তুমি কি যে বল, আমাদের বাড়িটা যদি একটু থাকার মত হোত তাহলে কি আমি ঢাকায় থাকি? ঢাকা শহর কি বসবাসের যোগ্য আর তাছাড়া ওখানে থাকতে হয় একা একা এখানে দেখ তো সবাই আছে। অন্তত এখানে যারা থাকে তাদের ফরমালিন খেতে হয় না, দেখ এরা কত সুখে আছে
একটু ভেবে মনি বললো, -আমরা এখানে চলে আসলে আহসানের কি হবে? ও একা হয়ে যাবে না?
-হ্যাঁ আমিও তাই ভাবছি তবে ভাবনার আর কি, মাঝু তো ছয় মাস পরে পরে আসবে আবার আমরাও কি আর মাসে এক আধবার যাব না, আমার ডাক্তারি চেক আপ আছে তখন এবারের মত বেশি করে রান্না করে দিয়ে আসলেই হবে
-দেখি ওর সাথে আলাপ করে দেখি কি বলেতাই যদি হয় তাহলে এমরানকে বলি ব্যবস্থা করে ফেলতে, আমার কাছে যা আছে তা দিয়ে ভাল ভাবেই সুন্দর বাড়ি হবে, বলে স্বামীর মুখের দিকে তাকাল
-বল, আমিতো কখনও নিষেধ করিনি
রাতে খাবার পর সবাই মিলে বসল। আলাপ শেষে এমরান বললো, -তাহলে চলেন সামনের সোমবারে রেজিস্ট্রি অফিসে যেয়ে রেজিস্ট্রি করে দিয়ে আসি, এর মধ্যে মাহতাব মুহুরিকে কাগজপত্র গুছিয়ে নিতে বলি
রাশেদ সাহেব আপত্তি জানালেন
-কেন রেজিস্ট্রি করার এমন কি দরকার, ওতে ভবিষ্যতে ঝামেলা হবে
এমরান জিজ্ঞেস করল,-ঝামেলা আবার কি?
-শোন, আমরা এখন থাকব আর কোথাও থাকার জায়গা নেই বলে কিন্তু আমাদের মেয়েরা কি কেও কোনদিন এখানে ফিরে আসবে? তিথি যেখানে গেছে ওর আসার সম্ভাবনা মোটেও নেই, যূথীর একই অবস্থা আর বীথী চাকরি শেষ হলে যখন অবসরে যাবে তখন ওরা এখানে কেও আসবে না এ জমি তোমারই থাকবে বরং তুমি তখন এটা বিক্রি করতে পারবে না, বিক্রি করতে গেলেও ওদের তিন বোনকেই লাগবে তখন ওদের তিনজনকে একত্রে কোথায় পাবে? তার চেয়ে যেমন আছে তেমনই থাক
মনিও এই কথায় সায় দিল কিন্তু এমরান মেনে নিল না।
-না আমি নিয়ত করেছি এটা আপার জমি, আপারই হবে। মেয়েরা যদি কোনদিন বিক্রি করতে চায়, যদিও আমার মনে হয় না ওরা এটা বিক্রি করবে কারণ মা বাবার স্মৃতি কে হারাতে চায় বলেন? তবুও যদি তেমন করে চায় তাহলে একজন থাকলেই হবে বাকিরা ওই একজনকে পাওয়ার অফ এটর্নি দিয়ে দিলেই হবে। নিয়ম যেটা সেটা নিয়ম মেনেই হোক। আপনি আর অমত করবেন না দুলাভাই
একথার পরে রাশেদ সাহেব আর অমত করতে পারলেন না। এমরানের কথায় যুক্তি আছে।
-দাও তাহলে তুমি যখন দিতে চাইছ।

২৬১।
জমি রেজিস্ট্রি হয়ে গেলে এমরান চৈত্র মাসেই মাটি কাটার কাজ শুরু করে দিলএর মধ্যে মনি আর রাশেদ সাহেব একবার বাড়ি গিয়ে ডিজাইন দেখিয়ে দিয়ে এসেছে। মাটি কাটা হয়ে গেল, তাতে সুন্দর একটা পুকুর হয়েছে আবার মুল ভিটাও বেশ বড়সড় হয়েছে। কাছের ইট ভাটা থেকে বর্ষাকালে নৌকায় করে ইট নেয়া হলো, ঢাকা থেকে রড, টিন নিয়ে এমরানের বাড়িতে রেখে দিল সামনের অঘ্রাণ মাসে বাড়ির কাজ শুরু হবে।
মাস ছয়েকের মধ্যে দেয়ালের উপরে টিনের চাল দেয়া সুন্দর বাংলো ধরনের বাড়ি হয়ে গেল। চতুর্দিকে বারান্দা, সামনে বসার ঘর পিছনে রান্না ঘর আর তার পাশে খাবার ঘর সহ মোট চারটা বেড রুম। বিদ্যুতের লাইন নেয়া হলো, টিউব ওয়েল, মটর বসান হলো, ছাদের উপরে দুইটা পানির ট্যাংক একটা খাবার পানি আর একটা গোসলের জন্য পুকুরের পানি। এমরান জানে আপা লাকড়ি দিয়ে রান্না করতে পারবে না,ঝিটকা বাজার থেকে গ্যাসের বোতল এনে রান্নার ব্যবস্থা করল। পুকুরের পাড় বাঁধান সব করতে প্রায় বছর খানিক লেগে গেল। চারটা রুম করেছে মেয়েরা যখন ছুটিতে আসবে তখন যেন কোন অসুবিধা না হয়। 
এর মাঝে বীথী দুইবার ছুটিতে এসেছিল। বেশ ভাল চাকরী। মাঝু বলেছে কয়েক বছর বাইরে বাইরে থাকতে হবে তারপরে ঢাকায় পোস্টিং নিতে পারবে। মাঝু থাকতে থাকতেই বাড়ির কাজ শেষ হলোমাঝু এবং আহসানকে নিয়ে একদিন মনি আর রাশেদ সাহেব বাড়িতে উঠে আসলেনদুই তিন দিন থেকে ওরা চলে গেল।

এখানে এসে রাশেদ সাহেবের চেহারাই বদলে গেল। ঢাকায় যেমন সবসময় টিভি দেখা ছাড়া অবসর কাটাবার আর কোন পথ ছিল না। প্রায়ই দুইজনে বিষণ্ণ মনে টিভির সামনে বসে থাকত সেই তারা এখন মনের আনন্দে দিন কাটাচ্ছে। পাশেই মসজিদ আছে। যাবার আগে বীথী একটা মোবাইল ইন্টারনেট কানেকশন কিনে দিয়ে গেছে। রাশেদ সাহেবের পুরনো ল্যাপটপটা নষ্ট হয়ে গেছে বলে তিথি টাকা পাঠিয়েছিল নতুন একটা কেনার জন্য। সাথে আবার বলে দিয়েছিল ভাল দেখে কিনবে আজেবাজে কিছু কিনে টাকা বাঁচিও না। প্রায় প্রতিদিনই তিন মেয়ের সাথে কথা হয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাগানের কাজ করে। রাশেদ সাহেব ঢাকা থেকে ভাল ভাল ফুলের চাড়া এনে বাড়ির সামনে সুন্দর একটা বাগান করেছেনসারা জীবনের অতৃপ্ত মনের সাধ মিটিয়ে মনের মত সুন্দর করে সাজিয়েছে বাড়িটা। মনি করেছে সবজি বাগান। কলা, পেঁপে, কাগজি লেবু বার মাস থাকবে। বেগুন, মরিচ, লাউ, শসা, ঝিঙ্গা, সিম সহ সিজনাল সবজি কিছুই প্রায় কিনতে হয় না। বাড়ির পিছনে একটা সজনে গাছও লাগিয়েছে। এমরানও নিয়মিত সবজির চাষ করে ওর কাছেই চাড়া পায়। পুকুরে মাছ ছেড়েছে। প্রায় প্রতি মাসেই একবার ঢাকা যেতে হয়। ওদের ডাক্তারি চেক আপ ছাড়াও আহসানের জন্য রান্না বান্না করে দিয়ে আসে। আবার আহসানও নিয়ম করে নিয়েছে, প্রতি মাসে একবার মায়ের সাথে দেখা করে আবার পরের মাসে এখানে এসে শ্বশুর শাশুড়িকে দেখে যায়।
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top