১১৬।
ভেবেছিলেন আরও কোথাও যাবেন, তা আর হলো না। ফোর্ট উইলিয়াম তো নয়ই কিছুই দেখা হলো না। তার আগেই তাকে এখান থেকে চলে যেতে হচ্ছে। তবুও যা দেখা হয়েছে কম কী, ভালোই দেখেছে। দেখার কোন শেষ আছে?
এতো বড় পৃথিবীর কে আর কতটা দেখতে পারে? এযাবৎ সে যা দেখেছে কম হয়নি, মনে শুধু একটাই কষ্ট, মনিকে সাথে নিয়ে কোথাও যাওয়া হলো না। মনির হাত ধরে কিছু দেখা হলো না, মনির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখা হলো না কে বেশি সুন্দর তার মনি না প্রকৃতি!
রাশেদ সাহেবের স্কটল্যান্ডের মেয়াদ আজই শেষ, সন্ধ্যায় কোচ। সকালে ময়না ভাই এসেছে। আজ তার কোন কাজ নেই ছুটি। বিকেলে টেসকোতে গিয়ে রাস্তায় খাবার জন্য কিছু নিয়ে এসে বাসা থেকে ব্যাগ নিয়ে রেস্টুরেন্টে গেলো।
ময়না ভাই বললো -আপনার ফোন এসেছিলো।
-কে? কিছু বলেছে?
-হ্যাঁ আপনার রিতা আপা, আপনাকে ফোন করতে বলেছে।
একটু ঘাবড়ে গেলেন, কি ব্যাপার হঠাৎ রিতা আপার ফোন কেন? রাশেদ সাহেব বাইরে গিয়ে কয়েন বক্স থেকে রিতা আপার বাসায় লাইন পাবার চেষ্টা করলেন। অনেকক্ষণ, রিং হচ্ছে কিন্তু কেও ধরছে না। এর পর ফিরোজের বাসায়, ভাবী ধরেছে কিন্তু ফিরোজ বাসায় নেই।
-ভাবী আমি আজ সন্ধ্যা সাতটায় রওনা হয়ে লন্ডন আসছি।
-আসেন, এখানেই আসছেন?
-না ভাবী এবার রিতা আপার ওখানে যাব।
-কেন, কি হলো আবার?
-না, এমনিই, ওখানে যাওয়া হয়নি তাই ভাবলাম এই সুযোগে যাই, ফিরোজকে দরকার ছিলো। আচ্ছা আমি গ্লাসগো পৌঁছে আবার চেষ্টা করবো ও আসলে আপনি বলবেন আমি ফোন করেছিলাম।
রিতা আপা তার এই রেস্টুরেন্টের ফোন নম্বর জানেনা তাহলে সে ফোন নম্বর পেল কোথায়? নিশ্চয় ফিরোজের কাছে ফোন করে জেনে নিয়েছে। এখন ফিরোজই বলতে পারবে সে কেন ফোন করেছিলো। মনের মধ্যে একটা খুঁতখুঁতানি রয়ে গেলো। ফোন সেরে এসে বসলেন। ময়না ভাই আর দেলুর সাথে কিছুক্ষণ গল্প গুজব করে সাড়ে ছয়টায় বিদায় নিয়ে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে এক বোতল পানি সহ নাস্তার ব্যাগ হাতে বের হয়ে সোজা বাসস্ট্যান্ড। ময়না ভাই কাঁচুমাচু করে তার অক্ষমতার কথা বললেন আরও বললেন আপনাকে ছেড়ে দিতে আমার খুব খারাপ লাগছে কিন্তু কি করব উপায় নেই, তবে যেখানেই যাবেন আমাকে ফোন করে নম্বর জানাবেন, আমি ফোন করব। দেলুকে বললো যাও উনাকে এগিয়ে দিয়ে এসো। সাথে দেলু আসলো এগিয়ে দেয়ার জন্য।
১১৭।
আজ সোমবার, বারোই জানুয়ারি। অনেকক্ষণ আগেই কাউকে কিছু না জানিয়ে ওবান শহরে শীতের আকাশ অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। চারিদিকে রঙ্গিন নিওন বাতি আর রাস্তার সোডিয়াম বাতি অনেকক্ষণ থেকেই সন্ধ্যার অন্ধকারের সাথে যুদ্ধ করছে। রাশেদ সাহেবের মনে ওবান শহরের চেয়েও বেশি অন্ধকার। কিন্তু সে অন্ধকারের মধ্যে নিওন বাতি জ্বালাবার মত কোন জ্বালানির সন্ধান তিনি এখনও খুঁজে পাননি। সন্ধ্যা সাতটায় কোচ ছেড়ে দিয়েছে। কি ভাবে কি করলে, কোথায় গেলে তার এই অন্ধকার দূর হবে তাই খুঁজে পাবার জন্য যে লন্ডন থেকে বুকে অনেক গুলি আশা নিয়ে স্কটল্যান্ড এসেছিলেন, অজানা আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা আর বেশ বড় ধরনের একটা ভয়ের বোঝা বুকে নিয়ে এই কোচে বসে আবার সেই লন্ডনের পথে ফিরে চলেছেন। রিতা আপা কেন ফোন করলেন সেও জানা হলো না। এ আবার আর এক চিন্তা। অন্ধকারের মধ্যে রাস্তার আলোতে কোচের জানালার পর্দা সরিয়ে যতক্ষণ দেখা যায় তিনি দেখলেন দেলু তার চলন্ত কোচের দিকে চেয়ে আছে।
রাশেদ সাহেবের জীবনে এরকম বিচ্ছেদ অনেক হয়েছে। অনেক জায়গায় অনেক জনের কাছ থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। বিদায় সব সময়েই বিষাদে ভরা। বিদায় কখনো মধুর হয় না। তা সে আপন জনের কাছেই হোক কিংবা পরের কাছেই হোক। মানুষ যেখানে যায় সেখানেই তার নিজের অজান্তেই আস্তে আস্তে শিকড় ছড়িয়ে দেয়। সে শিকড় কত খানি গভীরে যাচ্ছে তা বুঝতে পারেনা। বুঝে তখন, যখন সে জায়গা ছেড়ে চলে যেতে হয়। মনের গভীর থেকে টেনে শিকর ছিঁড়ে বের করে নেয়া কত কঠিন। মনটা কেমন যেন হয়ে যায়। মানুষের প্রকৃতিই এমন। দুদিনের পরিচয়েও আপন হয়ে যায়। হয়তো আর কোন দিন দেখা হবে না। কালের চরকায় বসে ছিটকে কে কোথায় চলে যায় তবুও কিসের একটা অদৃশ্য বন্ধন তৈরি হয়। যা ছিঁড়ে দেয়া কঠিন, চাইলেও পারা যায়না। থাক না, যেমন রয়েছে তেমনই থাক। তারপরেও যেতে হয়। অদৃশ্য বন্ধন ছিঁড়ে দিতে হয়। তবে এর মধ্যেও কোন কোন বন্ধন থেকে যায়। দীর্ঘ দিন। সে ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক। থেকে যায়, কখনো সারা জীবনের জন্যেই রয়ে যায়।
কোচ এগিয়ে চলেছে। আজ অন্ধকার, বাইরে কিছু দেখা যাচ্ছে না। ছোট্ট শহর এলাকা ছেড়ে আসতে বেশিক্ষণ লাগেনি। শহরের বাইরে মনে হচ্ছে নিশীথের কোলে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। সামনে গাড়ির হেড লাইটের আলো ছাড়া আর কোন আলো নেই। শুধু একটু মৃদু নীল আলো গাড়ির ভিতরের ডেক আলোকিত করে রেখেছে। বিদায় ওবান, বিদায় স্কটল্যান্ড। আবার কবে দেখা হবে জানিনা। আদৌ দেখা হবে কিনা তাও জানিনা। তুমি খুব সুন্দর স্কটল্যান্ড, তুমি খুবই সুন্দর! অসাধারণ তোমার রূপ, তোমার সৌন্দর্য, তোমার প্রকৃতি! তোমার কাছে যত দিন ছিলাম অনেক দুখ: ভুলে ছিলাম। কি জানি তোমার কোন মোহে পরে তোমার সম্মোহনী গুনে সব কিছুই ভুলে ছিলাম। অনেক কিছুই ভুলিয়ে রেখেছিলে তুমি। এভাবেই তুমি সবাইকে আনন্দ দিয়ে যেও। সবার মনে সুখের ছবি এঁকে দিও। যেন তোমার সুখ স্মৃতি তাদের কোন অলস সময়ের সঙ্গী হয়ে থাকে। তোমার আকাশে আমার অনিশ্চিতে ভরা দুঃখের তপ্ত নিশ্বাসের বাতাস আর তোমার বুকে শুধু টলমল পায়ের চিহ্ন গুলিই রেখে গেলাম। আমার আর কীইবা আছে? আসবে, তোমার কাছে অনেক মানুষ আসবে, এতো দিন যে ভাবে এসেছে। পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তের অনেক মানুষ আসবে। তারা আমার মত নয়। তারা আসবে আনন্দ পাবার জন্য, আনন্দ দেবার জন্য। তারা আসবে তাদের সুখস্মৃতির বোঝা ভারি করার জন্য। আমার মত কাউকে যেন দুঃখের বোঝা নিয়ে ফিরে যেতে না হয়। তুমি তাদের দেখবে। তাদের সাথে করে নিয়ে আসা পায়ের ধুলোর আস্তরণে আমার রেখে যাওয়া পদচিহ্ন এক সময় মুছে যাবে। তুমিও আমার কথা ভুলে যাবে। কিন্তু, সত্যিই বলছি, আমি তোমার কথা, তোমার মায়া, তোমার মমতা আর তোমার স্মৃতি কখনো ভুলবো না।
১১৮।
আজ তেমন কুয়াশা নেই। গাড়ি স্বাভাবিক গতিতেই চলছে। ভিতরে হিটার রয়েছে তাই ঠাণ্ডা লাগছে না। নানা এলোমেলো ভাবনা নিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। মনে কত কি আসছে যাচ্ছে। আকাশে যেমন উঁচুতে নিচুতে, ছেড়া কাটা ফাটা, টুকরো টুকরো, ছিন্ন ভিন্ন নানা রঙ্গের নানা বর্ণের মেঘ ভেসে যায় রাশেদ সাহেবের মনের আকাশেও তেমন ভাবনার মেঘ ভেসে যাচ্ছে। অনেক কিছু ভাবার চেষ্টা করছে কিন্তু কোনটাই স্থির হতে পারছে না। কেমন যেন সব কিছু তাল গোল পাকিয়ে গেলো। কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছেন তার কোন ঠিকানা নেই। হঠাৎ মাইকে ড্রাইভারের কণ্ঠে ফিরে এলেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে গ্লাসগো টার্মিনালের নির্দিষ্ট গেটের সামনে দাঁড়িয়ে গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভার নিচে নেমে যাত্রীদের লাগেজ বের করছে। রাশেদ সাহেব তার ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে কোচ থেকে নেমে টার্মিনালের ভিতরে এসে ফোন বুথের কাছে গেলেন। রিতা আপা বা ফিরোজকে ফোন করতে হবে। এখনও রিতা আপার বাসায় কেও ফোন ধরল না। ফিরোজ বাসায় ফেরেনি। এদিকে লন্ডনের কোচ ছাড়তে আর মাত্র বিশ মিনিট বাকি। ফোন রেখে লাউঞ্জে বসলেন। দেখি একটু পর আবার চেষ্টা করে কাওকে পাই কিনা। উঠে গেটের বাইরে গিয়ে একটা সিগারেট জ্বালালেন। ঘড়ি দেখে সিগারেটটা ফেলে দিয়ে আবার ফোন। না এবারেও কাউকে পেলেন না। মনটা আরও অস্থির হলো, কেমন যেন একটা ছটফট ভাব অনুভব করছেন। রিসিভারটা রেখে দেয়ার সময় মনির কথা মনে হলো। তার পথের আলো মেয়েদের কথা মনে হলো। একবার চেষ্টা করবো? হাতের ঘড়ি দেখলেন। না এখনও ওরা ঘুম থেকে উঠেনি, থাক লন্ডন গিয়ে কি হয় তাই বুঝে ওখান থেকে কথা বলা যাবে। কিছু করার নেই, লন্ডন নেমে রিতা আপার বাসা পর্যন্ত পৌছার আগে কিছুই বোঝার উপায় নেই। কিন্তু, সেতো সকাল নয়টার আগে সম্ভব না, কারণ কোচ ভিক্টোরিয়া পৌঁছবে সকাল সাড়ে সাতটায়। হয়ত রিতা আপা তার লন্ডন যাবার ব্যাপার কনফার্ম কিনা সে কথা জানার জন্যই ফোন করেছিলো! ওই যে কথা বলেছে তার পরে আর কথা হয়নি। আর কী হতে পারে? যাই হোক, একটা কিছু হবে এ নিয়ে এতো চিন্তা করার দরকার নেই।
বোর্ডিং গেট দিয়ে লোকজনকে এগিয়ে যেতে দেখে রাশেদ সাহেবও এগিয়ে গেলেন। এবারও দোতলা কোচ। কাঁধের ব্যাগটা লাগেজ বক্সে দিয়ে আজ দোতলায় উঠে একেবারে সামনের একটা সিটে বসে পরলেন। পাশে কেও নেই, দুই জনের সিটে সে একা। রাত হোক আর দিনে হোক জার্নিতে তার ঘুম হয় না, হয়তোবা কখনো একটু আধটু চোখ লেগে আসে। ব্যাস, ঐ পর্যন্তই। সামনে বসলে রাতের ব্রিটেন দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে। যাত্রী বেশি নেই, বিশ পঁচিশ জন হতে পারে। কোচ ছেড়ে দেবার পর বুঝলেন অনেকক্ষণ আগেই ক্ষুধা লেগেছে এতক্ষণ উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিলেন বলে টের পাননি। টেসকো থেকে আইরিশ পটাটো ব্রেড, কলা আর আপেল এনেছিলেন, সাথে এক লিটার অরেঞ্জ জুসের প্যাকেট। রেস্টুরেন্ট থেকে দুই লিটার কোকের বোতল ভরে পানি এনেছেন। ময়না ভাই দেলুকে বলেছিলো একটা নান বানিয়ে সাথে কিছু চিকেন টিক্কা দিয়ে দিতে। রাশেদ নিষেধ করেছে। না, আমি টেসকো থেকে খাবার নিয়ে এসেছি তাই আর কিছু লাগবে না। দেরি না করে খেয়ে নিলেন।
[চলবে]
No comments:
Post a Comment