কাল পরীর সমাধি [৭]-পর্ব-৫

[ পূর্ব সূত্রঃ  যা হবার হয়েছে এখন কি করবে, লিয়ের যেভাবে রেগে চলে গেল কি জানি কি করে?
উপায় একটা বের করতে হবে। গ্রামের সবার সাথে আলাপ করে দেখি কে কি বলে। আরে, ওর পক্ষে এখন আর
আগের মত কেউ নেই। শক্তিও কমে গেছে লক্ষ করেছ? এখন বাঘ সিংহ কেন একটা ভেড়াও মারতে পারবে না। তবে হাঙ্গামা অবশ্যই একটা হবে এবং আমাদের এ জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে।
ওরা একসাথে অনেকক্ষণ বসে রইল। বুজিবার হাতে তামাকের নল। চিন্তিত।
একটু পরে উঠে দাঁড়িয়ে বলল দাও দেখি কিছু খেতে দাও। খেয়ে একটু বের হই।]
৮।
বুজিবা বাড়ি থেকে চিন্তিত মুখে বের হয়ে তার ঘনিষ্ঠ জনদের সাথে দেখা করে আজ সকালে ফোলামির ঘটনা নিয়ে আলাপ করল। সবাই এক বাক্যে বলল।
আরে বাদ দাও, ও এখন কি করবে? আমরা এখন নতুন লিয়ের বানাবার চিন্তায় আছি। কাজেই ওর পক্ষে আর আমরা কেউ নেই, ও দাঙ্গা করবে কাকে নিয়ে? তুমি কিচ্ছু ভেবো না।
বন্ধু বা ঘনিষ্ঠ জনেরা আশ্বাস দিলেও বাস্তবে ভিন্নতা দেখা দিল। ফোলামি ভিতরে ভিতরে বেশ অনেকটা এগিয়ে আছে। ওর পক্ষেও অনেক লোক আছে।
ফোলামির রাগ হবে না কেন, এই এত টুক একটা মেয়ের কাছে হেরে যাবে? মেয়ে বলে কিনা লিয়েরের ছেলে হলে হবে কি ও হয়েছে একটা বিড়াল। আবার বলে ওর শক্তি দিয়ে আমাকে এখান থেকে তুলে নিয়ে যাকতো দেখি! কি আশ্চর্য! এর একটা উপযুক্ত জবাব দিতে হবে। প্রতিশোধ নিতে হবে। আমার মুখের সামনে এত বড় কথা!
আস্তে আস্তে দিন যাচ্ছে আর সারা গ্রামে কেমন যেন একটা থমথমে ভাব ছড়িয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে চাপা উত্তেজনা। গ্রামের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত এই এক কথা নিয়েই ফিসফাস কানাকানি। আশেপাশেও কিছুটা ছড়িয়ে গেছে। সেদিন বুজিবার বন্ধু আদিসা কোসি গিয়েছিল সেখান থেকেও শুনে এসেছে। ওরা জিজ্ঞেস করেছিল তোমাদের গ্রামে নাকি দাঙ্গা হতে যাচ্ছে? ফোলামি আমাদের কাছে দূত পাঠিয়েছিল সাহায্যের জন্যে, আমরা সম্মতি দিতে পারিনি। বুজিবার সাথে আমাদের অনেকদিনের ব্যবসা। শুধু তাই নয় ওর সাথে আমাদের সম্পর্কটাও খুব ঘনিষ্ঠ কাজেই ওর বিরুদ্ধে আমাদের কিছু করা সম্ভব নয় বরং বুজিবা যদি আমাদের সাহায্য আশা করে তাহলে আমরা নিষেধ করতে পারব না। আদিসা এসে বুজিবাকে বলতেই বুজিবা বলল
তাহলে তুমি ওদের বলে এলেই পারতে!
বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু তোমার সম্মতি ছাড়া বলা সঙ্গত হবে কিনা বুঝে উঠতে পারিনি। তুমি সম্মতি দিলে আমি কালই আবার যেতে পারি।
আচ্ছা অপেক্ষা কর দেখি অবস্থা কোন দিকে যায়। দরকার হলে তুমি ওদের বলে আসবে।


৯।
মালাইকা ভাবছে আতো কেন আসছে না। কবে আসবে? বলে গেল তাড়াতাড়িই আসবে কিন্তু একটা পূর্ণিমা চলে গেল এখনো কোন দেখা নেই! অবাক কাণ্ড! এদিকে এই অবস্থা চলছে সে কি কোন সংবাদ পায়নি! এখনও হয়ত এত দূরে এই সংবাদ পৌঁছায়নি। সংবাদ পেলে নিশ্চয় আসবে। আবেল না এসে পারবে না। ওকে আসতেই হবে। দরকার হলে দলবল নিয়েই আসবে। সারা গ্রামের অবস্থা দিনকে দিন খারাপ হতেই চলেছে। কি ভয়ংকর অবস্থা দাঁড়াবে কে জানে! না জানি কতজন মরে যাবে! আমার জন্য একটা গ্রামের শান্তি নষ্ট হবে? এত মানুষ মারা যাবে? কিন্তু আমিতো এমনটা চাই না! কি করব এখন? গ্রামের এই পরিস্থিতি কি করে শান্ত করা যায়? আবেল এলে ওর সাথে পরামর্শ করতে পারতাম কিন্তু ওকে জানাব কি করে? একদিকে বিরহ জ্বালা আবার এদিকে পারিবারিক এমনকি সমস্ত গ্রামের শান্তির প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এই অবস্থায় কি করা উচিত কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। বাবা কাজকর্ম ফেলে সারাদিন এদিক ওদিক দৌড়া দৌড়ী করছে। মা উত্তেজিত, চিন্তিত, নীরব কোন কথা বলে না মেজাজ খিটখিটে। গ্রামের পরিস্থিতি উত্তপ্ত। প্রতিটি ঘরে অস্ত্র শস্ত্র শাণ দেয়া হচ্ছে, ধোয়া মুছা হচ্ছে, তীরে বিষ মাখান হচ্ছে। যে কোন সময় শুরু হবে ভয়ংকর একটা কিছু। কি করা যায়?

১০।
এদিকে যখন এমন অবস্থা চলছে যখন বুন্না চাষের সময় এসেছে তখন একদিন ওবি আবেলকে ডেকে বলল যা বুজিবাকে নেমন্তন্ন করে একেবারে সাথে নিয়ে আয়, পারবি?
কবে যাব?
কালই যা
আচ্ছা

আবেল আটনাগো যাবার সুযোগ খুঁজছিল। কতদিন হয়ে গেল মালাইকার সাথে দেখা হয় না কথা হয় না। কি ভাবছে সে? ওদিকে আবার বলে এসেছে আমি তাড়াতাড়িই আসব। বাবার কথা শুনে দেরি না করে কালই যাবার জন্য তৈরি হলো। সকালে তার প্রিয় গাধাটাকে ভাল করে খাবার পানি খাইয়ে মাকে বলে বের হলো। সারা পথে আবেলের মনের আনন্দ দেখে কে? আজ তার মিনার (প্রেমিকা) এর সাথে দেখা করতে যাচ্ছে! মনের সুখে গান ধরল। গাধাটা কেন আর একটু জোরে হাঁটছে না! মনে মনে অনেক স্বপ্ন দেখতে দেখতে একসময় সেদিনের মত সময়েই আটনাগো গ্রামের সীমানায় পাহাড়ের উপরে এসে পৌছার আগেই কয়েকজন সশস্ত্র মানুষ মিলে দূর থেকে হাঁক দিয়ে আবেলকে থামাল। কাছে এলে নানা প্রশ্ন! কোথা থেকে এসেছে, কেন এসেছে, কোথায় যাবে এইরকম নানা প্রশ্ন। আবেল অবাক হলো, এর আগে যখন এসেছে তখন এমন কিছু হয়নি। তার মানে কি দাঁড়াচ্ছে?  নিশ্চয় এই গ্রামে কিছু ঘটতে যাচ্ছে। দাঙ্গা হাঙ্গামার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে! কিন্তু কি হয়েছে, কেন হচ্ছে? জানতে হবে। যারা পথ রোধ করেছিল তারা ওর জবাব শুনে কেমন করে যেন আশ্বস্ত হয়ে ওকে ছেড়ে দিল।
আবেল বুজিবার বাড়িতে পৌঁছে বাইরে থেকে হাঁক দিল
বুজিবা বাড়ি আছ?
মালাইকা উঠান ঝাড়ু দিচ্ছিল, এই শব্দ এই কণ্ঠ শোনার জন্য অনেকদিন অপেক্ষা করে আছে । আহা কি মিষ্টি পৌরুষ ভরা গমগমে কণ্ঠ। কথা শুনেই মন ভরে উঠে। শোনার সাথে সাথে দৌড়ে বাইরে এসে দেখে গাধার রশি ধরে আবেল দাঁড়িয়ে। দুইজনেই হতবিহবল হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। কেউ কথা বলতে পারছে না। বেশ অনেকক্ষণ এভাবে থাকার পর মালাইকার সম্বিত ফিরে এলো।
তুমি কোথায় ছিলে আবেল? এত দেরি করে কেন আসলে? কেন আরও আগে আসলে না? জান এদিকে কি সব হচ্ছে?
কি হচ্ছে? আমি পথে কিছুটা অনুমান করেছি। ওরা আমার পথ আটকে নানা জিজ্ঞাসাবাদ করে তবে আমাকে এ গ্রামে ঢুকতে দিয়েছে। কি হয়েছে বল
মালাইকা আবেলকে নিয়ে ভিতরে এসে মাকে জানিয়ে ওকে বসতে দিয়ে বলে গেল বস আমি আসছি।
একটু পরে কিছু ফলমূল আর বুন্না এনে আবেলের সামনে টুলে নামিয়ে রেখে এদিক ওদিক দেখে শুরু থেকে আজ অবধি যা যা ঘটেছে এবং গ্রামের বর্তমান পরিস্থিতির কথা বিস্তারিত জানাল। এবার একটু থেমে ফিসফিস করে এ ব্যাপারে সে নিজে কি ভাবছে তাও বলল।
শুনে আবেল স্তম্ভিত হয়ে গেল।
বল কি? এমন দুঃসময়ে আমাকে একটু খবর দিতে পারলে না?
অত দূরে কাকে দিয়ে খবর দেই বল!
তুমি বুজিবাকে আমার কথা বলনি?
আগে বলিনি পরে বলেছি
আগে বলনি কেন?
ভাবছিলাম তুমিইতো আসছ তাই
বুজিবা আমার বাবার বন্ধু সে এ সংবাদ জানলেই আমরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে আসতাম। আমার মিনারকে ছিনিয়ে নেয় এমন সাধ্য কার? এই তল্লাটে এমন কেউ নেই। আমি এখুনি বাড়ি যাচ্ছি এবং আমার পুরো গ্রাম নিয়ে আসছি তুমি বুজিবাকে একটু অপেক্ষা করতে বলবে।
বলেই উত্তেজিত ভাবে উঠে দাঁড়াল। মালাইকা আবেলের হাত চেপে ধরে আবার বসিয়ে দিয়ে বলল
না না তুমি ভুলেও এই কাজ করতে যেও না। কি বললাম তোমাকে? বুঝনি? মাথা গরম করছ কেন?
না না মালাইকা তুমি যা বলছ তা হতে পারে না, ওদেরকে একটা উচিত শিক্ষা দিতে হবে। ওরা জানে না কার মিনারের দিকে চোখ তুলেছে!
মালাইকা অনেক কষ্টে আবেলকে থামাল।
একটু শান্ত হলে মালাইকা আবার জিজ্ঞেস করল
আমি যা বলেছি তুমি কি বুঝতে পেরেছ?
বুঝেছি কিন্তু আমার মন মানছে না যে!
কেন মন মানছে না? মনকে যে মানাতেই হবে! তুমি কি চাও আমাদের জন্য এত বড় ক্ষতি হোক?
আমি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না মালাইকা, তুমি কেন ওদের উচিত শিক্ষা দিতে নিষেধ করছ!
বললামতো, আমাদের জন্য এত বড় অশান্তি হবে, কত মানুষ মরে যাবে এই কি তুমি চাও? তার চেয়ে আমরা যদি এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাই তাহলে এর কিছুই হবে না। আবার ওদিকে আমরাও সুখেই থাকব। এটাই কি ভাল হয় না?
সে তো ভাল হয় কিন্তু ওদের একটা শিক্ষা দিতে হবে না?
শিক্ষা দিয়ে কি লাভ হবে?
বেশ তুমি যদি না চাও তাহলে হবে না, তুমি যা বলবে তাই হবে। এখন বল কিভাবে কি করতে হবে।
মালাইকা এদিক ওদিক দেখে আবেলের একটু কাছে এসে ফিসফিস করে যা বলল
সামনের পূর্ণিমার রাতে আমরা পালাব। তুমি ঠিক মাঝ রাতে দেদেসা পার হয়ে বনের পথ ধরে কোসি গ্রামে এসে থাকবে আর আমি সন্ধ্যার পর সবাই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পরলে এখান থেকে বের হয়ে কোসি পৌঁছব। ওখানে তোমাদের গ্রামের যে পথ বনের মধ্যে দিয়ে এসে কোসি পৌঁছেছে সেখানে আমরা মিলিত হয়ে পরে নিকেমতা যেয়ে আমার মামার বাড়ি উঠবো। শুনেছি নিকেমতা অনেক বড় শহর কাজেই এরা কেউ জানবে না আমরা কোথায় আছি।
পূর্ণিমা রাতে কি করে পালাবে? সে রাতে কেউ দেখে ফেলবে না?
আমাদের গ্রামের খবর আমি ভালই জানি, তাছাড়া এখন এখানে সে পরিস্থিতি নেই, আর থাকলেও কোথা দিয়ে পালাতে হবে কোন পথে গ্রামের বাইরে যেতে হবে সে আমার ভাল চেনা আছে তোমাকে এ নিয়ে মোটেই ভাবতে হবে না।
আচ্ছা ঠিক আছে, তারপর?
তারপর আবার কি?
ওখানে আমরা কি করব?
মামার কোন ছেলে মেয়ে নেই ইচ্ছে হলে ওখানেই থাকব কিংবা পরে যদি তোমার ভাল না লাগে তাহলে আমরা আরযোতেও ফিরে আসতে পারি তবে এখানে আর নয়।
খারাপ বলনি। তাহলে আমি বাড়ি ফিরে যাই। আর মাত্র দুই রাত পরেই পূর্ণিমা।
এবারে এখানে কেন এসেছে সে কথা বলে বলল তুমি বুজিবাকে বলবে আমি কেন এসেছিলাম এবং কখনও দরকার হলে বাবাকে খবর দিতে যেন ভুলে না যায় সে কথা মনে করিয়ে দিও।
সে যা বলার আমি বলব এ নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।
[মালাইকা এত দূরের পথ কি ভাবে পাড়ি দিবে? জানার জন্য একটু অপেক্ষা করুন।]

No comments:

Post a Comment

Back to Top