নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-২

৪।
বিগত দশ বছর ধরে বিলাতে থাকা মেঝ ভাইয়ের টাকা দিয়ে এই জমি কিনেছিলেন। সেখানেও এক কথা হয়েছিলো। বাবা চেয়েছিলেন তার নামে দলিল করতে কিন্তু রাশেদ সাহেব তা বাঁধা দিয়েছিলেন। না আব্বা এটা করবেন না। সে
জানে বিদেশে থেকে টাকা উপার্জন করা কত কঠিন। নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে, সমস্ত সুখ শান্তি বিসর্জন দিয়ে, দিন রাত অমানুষিক পরিশ্রম করে উপার্জন করতে হয়। কত রাত কেটে যায় ঘুমহীন, কত কি খেতে ইচ্ছে হয়, কত কি অনিচ্ছা সত্যেও পেট ভরার জন্য, বেঁচে থাকার জন্য খেতে হয়, কত জনের অশ্রাব্য কথা হজম করতে হয়। সেই রোজগারের টাকা কেন তার নামে করবেন না? ওর নামে করুন, এখানে আপনার নামে দলিল করার পক্ষে কোন যুক্তি নেই। এই জমি কেনার পর থেকেই পড়েছিলো, এখান থেকে কোন আয় ছিলো না বা আয় করার কোন পথও ছিলো না। ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করে ওকে দিয়ে বাবাকে রাজী করিয়ে বাবা এবং ভাইএর দেয়া কিছু আর কিছু টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এটা গড়ে তুলেছিলেন। সে ছিলো শুধু পরিচালক, কোন মালিকানা তার নেই। ভেবেছিলেন একবার ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেলে তখন এটা পারিবারিক ব্যবসা হবে কাজেই তার নিজের আর কি দরকার?

সব ব্যবসায়ীরা মিলে প্রধান মন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাল, ভারতীয় আমদানির বিরুদ্ধে মিছিলও করলো সারা দেশ জুরে চিৎকার করলো মাননীয় প্রধান মন্ত্রী এর বিহিত করুন, দেশের শিল্প বাঁচান, দেশের উৎপাদন ব্যবহার করুন খবরের কাগজে লেখালেখি হলো কিন্তু প্রধান মন্ত্রীর কানে সে চিৎকার পৌঁছল না। সে তার গদি বাঁচাবার ধ্যানে পূর্ণ উদ্যমে মশগুল রইলো। ফলে যা হবার তাই হলো।

রাশেদ সাহেব নিশ্চিত এগিয়ে চললেন ধ্বংসের দিকে। প্রাণান্তকর চেষ্টা করলেন। কর্মচারীরাও বসে থাকেনি তারাও কোথা থেকে ধার কর্জ করে টাকা এনে রাশেদ সাহেবের হাতে তুলে দিয়ে বললো  ভাই দেখেন চেষ্টা করেন। ডুবন্ত প্রায় মানুষ যেমন তার কোলের শিশুর উপর দাঁড়িয়ে নাক উঁচু করে শ্বাস নেয়ার জন্য বেঁচে থাকার ব্যর্থ চেষ্টা করে ঠিক তেমনি মনিরা তার গহনা গুলি এনে দিল। নাও দেখ কদিন চলে। গহনা বলতে আর কি মনিরা যা নিয়ে এসেছিলো তাই, সে নিজে কিছু দিতে পারেনি। কিছু অদরকারি জিনিষ পত্র বিক্রি করে কিছু দিন চালালেন এতেও হলো না। শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে বেড় হলেন ধার করার জন্য। কিন্তু তাকে কে ধার দিবে? সবার একই কথা তোমার হাতি পোষার খরচ আমরা কি ভাবে জোটাবো? তোমার দরকার অনেক তা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
কতজনের কাছে কাকুতি মিনতি করে বোঝালেন, এরকম থাকবে না অবশ্যই পরিবর্তন হবে। মনে কর তোমরা চালান খাটাচ্ছ। দিনের পরিবর্তন হলেই আমি তোমাদের লাভ সহ ফেরত দিব। কিন্তু এতে কোন লাভ হয়নি। সবাই তাকে দেখলেই ভাবতো এইতো টাকা চাইতে এসেছে। আগেই বলে নিত টাকা চাওয়া ছাড়া আর কোন কাজ থাকলে বল। বিভিন্ন দোকানে বাকীর খাতা বেশ ঊর্ধ্ব গতিতেই বাড়তে থাকল, দোকানদাররাও আর মাল দিতে চায় না। তাদেরও একই কথা আগের কিছু শোধ করে মাল নিন এভাবে আমি আর কত বাকী দিতে পারি বলুন আমার ক্ষমতাই বা কতটুকু আমি তো আমার ব্যবসার চালান এক জায়গায় ফেলে রেখে আমার ব্যবসা বন্ধ করে দিতে পারি না। রাশেদ সাহেব দেনার দায়ে জর্জরিত, কি করবেন তিনি? রাতে ঘুম নেইএই দুর্দিনে তার একমাত্র সঙ্গী স্ত্রী মনিরা। দুজনে হাজার পরামর্শ করেও কোন কূল কিনারা পায় নি।

রাশেদ সাহেব মনিরাকে না জানিয়ে ভাবছেন, অনেকেই তো নষ্ট হয়ে যাওয়া কিডনি বা চোখের কর্নিয়া সংগ্রহ করার জন্য খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়। দেখি না তেমন কিছু পেলে একটা কিডনি বা একটা কর্নিয়া বিক্রি করে। এক কিডনি বা এক চোখ দিয়ে চলা যাবে। প্রতিদিন খবরের কাগজে এমন বিজ্ঞাপন খুঁজেন, তন্ন তন্ন করে খুঁজেন। যাও বা দুই একটা পাওয়া যায় তা তার রক্তের গ্রুপের সাথে মিলে না। অবশেষে  যখন হতাশ হতে বসেছেন তখন একদিন যেন একটু আশার আলো দেখতে পেলেন। জার্মানি থেকে এক ভদ্র লোক কিডনি চেয়ে একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছেন যাতে তার রক্তের গ্রুপের সাথে মিলে যায় কিন্তু যোগাযোগের জন্য স্থানীয় বা ঢাকার ফোন নম্বর না দিয়ে জার্মানির ফোন নম্বর দিয়েছেন। সমস্যায় পড়লেন। বাড়ির ফোন থেকে ওভার সিজ কল করা যায়না। বাইরের ফোনের দোকান থেকে ফোন করতে হবে এবং এ জন্য তিন চারশো টাকার দরকার। কোথায় পাই এই টাকা? ভেবে না পেয়ে মনিরাকেই বললেন, -কিছু টাকার যোগাড় করা যাবে?
-কি করবে টাকা দিয়ে?
-দেখ না একটু কাজ আছে
-কি কাজ শুনি!
-আছে, তুমি দেখ
-বলই না কি কাজ, কী আমাকে বলা যাবে না?
-না
-তাহলে টাকাও যোগাড় করা যাবে না।
ব্যাস ঐ পর্যন্তই, আর এগুতে পারেননি, ওখানেই সমাপ্তি। সেদিন দুপুরে খাবার পর এই সবই ভাবছিলো।

৫।
মনিরা ডাকল,
-একটু শুয়ে বিশ্রাম নাও, ওখানে বসে কি করছ?
-একটু চা দিতে পার?
-আচ্ছা দিচ্ছি
কিন্তু ঘরে চা পাতা বা দুধ নেই সে কথা মনিরা জানে, তবুও বললো  দিচ্ছি। একটু পরে পরদিন মেয়েদের স্কুলে যাবার ভাড়া থেকে টাকা নিয়ে বাসার কাজের মেয়ে মমতাজকে পাশের দোকানে পাঠাল। রাশেদ সাহেব বুঝতে পারলেন মমতাজ কোথায় গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যে মমতাজ চা পাতা আর গুড়া দুধের একটা ছোট প্যাকেট নিয়ে যখন এলো তা দেখে রাশেদ সাহেব মনিরাকে বললেন-
-তাহলে আর কি দরকার ছিলো? ঘরে যখন ছিলো না তখন নাই দিতে!
-তুমি একটু চা চেয়েছ তা কি করে না দিই বল!
-টাকা কোথায় পেলে?
-সে থাক তোমার অত কিছু জানার দরকার নেই, একটু বস আমি চা নিয়ে আসছি
মমতাজকে দিয়ে চা বানিয়ে সে চা মনিরা তার স্বামীকে দিতে পারে না। নিজেই চা বানিয়ে এনে স্বামীর হাতে কাপটা দিয়ে আস্তে করে বললেন নাও। চায়ে এক চুমুক দিয়ে নামিয়ে রেখে পাশে দাঁড়ানো মনিরাকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রেখে বললেন-
-তুমি এতো ভাল কেন মনি? এই অপদার্থ স্বামীকে তুমি এখনও এতো ভালবাস? যার কোন রোজগার নেই স্ত্রী সন্তানকে খাওয়াবার যোগ্যতা নেই তার জন্য এতো মায়া কোথায় লুকিয়ে রেখেছ?
মনিরার চোখ বেয়ে দু ফোটা জল গড়িয়ে এলো, স্বামী দেখে ফেলে তাই তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়ে মুছে নিয়ে বললো-
-কে বলেছে তুমি অপদার্থ, তুমি অপদার্থ বা অযোগ্য হবে কেন? তোমাকে কি আজ নতুন দেখছি? বুদ্ধি হবার পর থেকেই তো তোমাকে দেখে আসছি, তুমি কোন দিন অযোগ্য বা অলস ছিলেও না এখনও নেই। মানুষের জীবনেই এমন দুর্যোগ আসে আবার তা কেটেও যায়। তুমি এতো ভেঙ্গে পরো না একটু ধৈর্য ধর দেখবে সময় এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, আবার নতুন সূর্য উঠবে। মন খারাপ করো না, চা টা খেয়ে শেভ হও তারপর চলো কোথাও থেকে একটু ঘুরে আসি। সেই সকাল থেকেই এই যে এক ভাবে কেমন মন মরা হয়ে বসে আছ।

এমন সময় ও পাশের ঘর থেকে সেঝ বৌ রেখা ডাকল ভাবী একটু এদিকে আসবেন! সঙ্গে সঙ্গে রাশেদ সাহেবকে ছাড়িয়ে ওদিকে চলে গেলো। রাশেদ সাহেবের সামনে চায়ের কাপ হাতে ধরা কিন্তু আর চুমুক দিচ্ছেন না ভুলে গেছেন

রান্না ঘরের জানালা দিয়ে ওই নারকেল গাছের মাথায় দুটা কাক বসে ছিলো। মনে হচ্ছিল যেন কাক দুটিকে দেখছে। বৃষ্টিতে ভেজা কাক। এক মনে ওই দিকেই তাকিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন। সব ছবি গুলি মনে হচ্ছে একে একে নারকেল গাছের মাথায় কোন স্ক্রিনে ভেসে ভেসে আসছে আর যাচ্ছে। ওই ভেজা কাক দুটি যেন প্রজেক্টর চালাচ্ছে। কতক্ষণ এ ছবি দেখছিলেন তা খেয়াল নেই। বেশ কিছুক্ষণ পর মনিরা এসে এই দৃশ্য দেখেই বললো-
-কি ব্যাপার চা খাও নি? এ কি! চা তো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, কি ভাবছ এমন করে?

রেখা কি যেন সেলাই করছিলো তাই দেখিয়ে দেবার জন্য বড় জাকে ডেকেছিলো। মনিরার ডাকে রাশেদ সাহেবের সিনেমা দেখা থেমে গেলো হঠাৎ চমকে উঠলেন। মনিরা জানে রাশেদ সাহেব ঠাণ্ডা চা খেতে পারে না। কাপটা নিয়ে রান্না ঘরে এলো। এই ঠাণ্ডা চা আবার গরম করে স্বামীর জন্য নিয়ে যেতে পারবে না। তা কি করে হয়? সেই যে তার সব, সে ছাড়া আর কি আছে মনিরার? অগাধ ভালোবাসা। বলতে গেলে বাল্য বিবাহই তাদের, আজকাল এতো কম বয়সে সাধারণত বিয়ে হয় না। মনিরা মাত্র স্কুল ফাইনাল দেয়ার পরই এ বাড়িতে বড় বৌ হয়ে এসেছে। সেই ছোট বেলা থেকেই যাকে দেখে আসছে সে মানুষটাকে আজ পঁচিশটা বছর ধরে বুকে করে রেখেছে তাকে এই ঠাণ্ডা চা আবার গরম করে দেয়া যায়? আবার নতুন করে আর এক কাপ বানিয়ে এনে স্বামীর হাতে দিলেন আর পুরনো কাপের চা গরম করে নিজের জন্য নিয়ে এসে স্বামীর পাশে বসে কথা বলতে বলতে দুজনেই একসাথে চা খেলেন। এর মধ্যেই মনিরা প্ল্যান করে ফেলেছে,
-চলো কল্যাণপুর বড় আপার বাসায় যাই। তুমি ওঠ শেভ হয়ে নাও।
-আচ্ছা উঠছি, চলো যাই একটু ঘুরেই আসি, কাছে আর কোথায় বা যাব? এই, চলো না হেঁটে যাই!
-হেঁটে যাওয়া যেত কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে যে, থাক রিকশায়ই চলো
রাশেদ সাহেব স্ত্রীর তাগিদে উঠে শেভ করে, ওজু করে নামাজ পরে কাপড় বদলে দেখে মনিরা রেডি হয়ে রেখাকে বলছে,
-তোর দাদাকে নিয়ে একটু ঘুরে আসি, খেয়াল রাখবি আর বড় মেয়ে এলে খেতে দিস
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top