মরীচিকা [২]-২

[পূর্ব প্রকাশের পরঃ-  ওদিকে দিন চলে যায় কিন্তু আম্বিয়ার গর্ভে কোন সন্তান সম্ভাবনার দেখা নেই। ফজর আলি কি আর কম চিকিৎসা করিয়েছে, নিজের এবং স্ত্রীর। কিন্তু কোন সুফল পায়নি। আশে
পাশে নানা জনে নানা আলাপ করলেও বাচ্চু মিয়ার এতে কোন বিকার নেই, তার মনে হয় আম্বিয়ার বাচ্চা না হলেই ভাল!]

৬।
এর মধ্যে একদিন হঠাৎ করেই এক দুর্ঘটনা ঘটে গেল। দুপুরে খেতে আসার পথে দোকান থেকে বের হয়ে রাস্তা পাড় হবার সময় এক ট্রাকের একটু ধাক্কায় ফজর আলি ছিটকে পড়ে গেল। আঘাত খুব মারাত্মক কিছু নয় মাথায় আঘাত লেগে বেশ ভোগাচ্ছে। এক্সরে, এবং নানা প্যাথলজি টেস্ট করে কোন অস্বাভাবিক কিছু ধরা পড়েনি তবে অবস্থার উন্নতি না দেখে ঢাকায় নিয়ে নিউরোলজিতে টেস্ট করে দেখা গেল স্মৃতি শক্তি কিছুটা ক্ষতি হয়েছে বলে কাওকে চিনতে পারছে না, ডাক্তার বলেছে ঠিক হয়ে যাবে আশা করা যায়। ওদিকে বাচ্চু মিয়া মনে মনে বুদ্ধি করে বোন জামাইকে দেখা শোনা আর সুচিকিৎসার জন্য নিজের বাড়িতে নিয়ে এলো। বাড়িতে থাকলে আম্বিয়া একা চতুর্দিক সামাল দিয়ে স্বামীর সেবা যত্ন করতে পারে না তাই বোন সহ বোন জামাইকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছে। দোকান থেকে কুদ্দুস এক দিন পর পর নবগ্রাম এসে দোকানের বিক্রির টাকা পয়সা দিয়ে যায়। এ টাকা আগে আম্বিয়ার হাতেই দিত এখন বাচ্চু মিয়াই নিয়ে নেয়। বোন জামাইর জন্য অনেক খরচ। কয়েকদিন পরে পরে ঢাকায় নেয়া,  ডাক্তার দেখান, নানা রকম পরীক্ষা করা, ভাল পথ্য এগুলি জোগাড় করতে অনেক টাকার প্রয়োজন। সবসময় কি বোনের কাছে হাত পাতা যায়?

বাচ্চু মিয়ার সেই কাঠুরিয়ার জীবন আর নেই। বোনের বিয়ের পরে ফজর আলি নিজেই তার দিন ঘুড়িয়ে দিয়েছিল কিন্তু তাতে বাচ্চু মিয়ার মন ভরেনি। ফল খেয়ে কি আর জীবন চলে? আস্ত গাছটা যে তার প্রয়োজন!  অনেক দিন থেকেই গাছের দখলের চিন্তায় বিভোর ছিল কিন্তু তেমন সুযোগ আসছিল না। নবগ্রামের খাল পাড়ের বাড়ির বাংলা ঘরের বারান্দায় বসে হুঁকা টানে আর ভাবে কি করে কি করা যায়।
৭।
ফজর আলির অবস্থা উন্নতির দিকে না গিয়ে দিনে দিনে অবনতির দিকেই যাচ্ছে। এতদিন অন্তত কাওকে চিনতে না পরলেও নিজের কাজ নিজে করতে পারত। খাওয়া দাওয়া, সকাল সন্ধ্যায় বাড়ির বাইরে থেকে বেড়িয়ে ঘুরে ফিরে আসা, ক্ষুধা লাগলে খাবার চাওয়া। কিন্তু ইদানীং তা পারছে না। এক ভাবে বিছানায় পড়ে থাকে। বাচ্চু মিয়া বোনের সাথে এই নিয়েই দিনরাত আলাপ করে কি করা যায়? নানা ভাবে ভেবে দেখে, আবার ঝাঁর ফুক তাবিজ কবজে ফজর আলির গলা ভরে গেছে কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না। যেখান থেকে যেই যে প্রস্তাব নিয়ে আসে তাই করা হচ্ছে কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না।

মানুষের মনের পরিবর্তন হতে খুব বেশি কিছু প্রয়োজন হয় না ঢাক ঢোল পেটাতে হয় না। সামান্য একটু ছুতা ধরে নিরবেই হয়ে যায়। বাচ্চু মিয়া এবং তার বোন আম্বিয়া বেগমেরও তেমন বেশি কিছু প্রয়োজন হয়নি। এ জন্যে ফজর আলির দুর্ঘটনাটাই যথেষ্ট। বাচ্চু মিয়া বুঝিয়েছে। এর এখন বেচে থাকা আর না থাকায় কোন তফাত নেই। কি হবে বেচে থেকে? চেষ্টা চিকিৎসা কি কম হচ্ছে? বোন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে এ কথার মানে বোঝার চেষ্টা করে কিন্তু কিছু বুঝে উঠতে পারে না। ভাই ঠিক কি বলতে চাইছে? একদিন শ্রাবণের এক মেঘলা দিনে আম্বিয়া বেগম যে ঘরে থাকে সে ঘরের বারান্দায় বসে ভাই বোনে কথা হচ্ছে।
এর বাইচা থাকার চাইতে না থাকাই ভাল, কি কস
হ ভাই তাইতো দেখতেছি
এক কাম করবি?
কি কাম ভাই?
এমনিও টিনের চালের নিচে বৃষ্টির শব্দে কিছু শোনা যাচ্ছিল না তবুও বাচ্চু মিয়া খুব সাবধানে এদিক ওদিক দেখে বোনের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল
আমার মনে হয় এই যন্ত্রণার চাইতে এর মইরা যাওনই ভাল
তাই কইলেই কি আর হয় ভাই? যতদিন আয়ু আছে ততদিন ঠেকাইব কেরা?
শোন, আমি কই কি মানুষটারে এমনে কষ্ট দিয়া কি হইব, ?
তাইলে কি করুম?
এক কাম করবি?
কি
এহনতো ঘুমাইতেছে, আশেপাশে কেও নাই, বালিশটা নিয়া মুখে চাইপা ধর, দেখবি সব যন্ত্রণা শেষ হইয়া যাইব!
কি কও ভাই, নিজের স্বামীরে এমনে মাইরা ফালামু?
আরে ধুর বোকা, এইডা কি মাইরা ফালান হইল? এইডা তারে যন্ত্রণা থেইকা মুকতির একটা পথ কইরা দেওয়া হইল, বুঝছস? আমি কেমনে কই তর স্বামীরে নিজে মাইরা ফালা!
আম্বিয়া বেগম ভাইয়ের প্রস্তাব শুনে ডুকরে কেঁদে উঠল।
তুমি কি কও ভাই!
আরে শোন আমি তর ভালর জন্যেই কইতেছি। তুই সব কিছুর মালিক, যত চিকিৎসা করবি তত খরচ হইবো। তুই খালি বালিশটা চাইপা ধরবি আর কিছু করা লাগব না।
নিথর আম্বিয়া বেগম অসহায়ের মত ভাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে রইল
বাচ্চু মিয়া ছাতা মাথায় তার নিজের ঘরে গিয়ে টিনের একটা বাক্স খুলে একটা সাদা স্ট্যাম্প নিয়ে এসে
নে উঠ, বলে বোনের হাত ধরে টেনে উঠিয়ে নিয়ে ঘরের ভিতরে ফজর আলির কাছে গেল। ফজর আলি গভীর ঘুমে অচেতন। বাচ্চু মিয়া একটা কলমের কালি ফজর আলির বাম হাতের আঙ্গুলে মাখিয়ে কাগজের এক পাশে চেপে একটা ছাপ নিয়ে নিল। নে এবার এই বালিশটা চাইপা ধর। সব তর নামে কইরা দিমু আর কোন চিন্তা নাই কিন্তু আম্বিয়া বেগমের হাত চলছিল না। ভাইয়ের এই প্রলোভন আম্বিয়াকে সায় দিতে পারছিল না। বাচ্চু মিয়া নিজেই বোনের বালিশটা নিয়ে ফজর আলির নাকে মুখে চেপে ধরল। অনেক দিনের অসুস্থ নির্জীব দুর্বল ফজর আলি কিছুক্ষণ ছট ফট করে নিস্তেজ হয়ে এক সময় থেমে গেল।

৮।
সময়ের প্রলেপ দিয়ে একদিন সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে আসল, আম্বিয়া বেগমের কান্নাকাটি থেমে গেল। মনের কোণে জমা মেঘগুলা আস্তে আস্তে দূর আকাশের অন্য প্রান্তে উড়ে গেছে। আস্তে আস্তে আকাশটা নীল হয়ে আসছে। একটু একটু করে সংসারের কাজ কর্ম রাখাল চাকরের দেখা শোনা করতে পারছে। দুই ভাই বোনে মিলে শোকের যে আস্তরণ তৈরি করেছিল তা মুছে ফেলেছে। বাচ্চু মিয়া তাইজুদ্দিন মুহুরির সাথে দেয়া নেয়ার বিনিময়ে ঘিওর সাব রেজিস্ট্রি অফিস থেকে বোনের পরিবর্তে সব কিছু নিজের নামে করে নিয়েছে।

বাচ্চু মিয়া নবগ্রামের খাল পাড়ের ছোট্ট বাড়ি ছেড়ে ছেলে মেয়ে নিয়ে এখন বোনের বাড়িতে উঠে এসেছে। বোনের বাড়ি এখন তার নিজের বাড়ি। তার অবস্থা এখন রমরমা। এই জমি জমা যা আছে সবই তার। হ্যাঁ, যে বোনের বিনিময়ে এত কিছু তাকে কি আর ফেলে দেয়া যায়? এতটা নির্মম হতে পারে না। মা মরা বোনটাকে যে ছোট বেলা থেকেই কোলে করে বড় করেছে, তাকে আগলে রাখতেই হবে। ছেলে মেয়েরা স্কুল ছাড়িয়ে কলেজে যায়। এমন সুযোগ হাতে পাওয়া কঠিন ব্যাপার হলেও সে এই বোনের জন্যেই তা পেয়েছে। কাজেই বোনকে কোন অবস্থায়ই অনাদর হতে দিবে না। শলা পরামর্শ যা করার দুই ভাই বোনে মিলেই করে। বোনের যখন যা প্রয়োজন তা আগে থেকেই হাতের কাছে এনে দেয়। বোনের কোন দুঃখ সে রাখবে না। বোনের কোন অযত্ন হতে দিবে না।

৯।
এমনি করেই অনেক দিন চলে গেল। বাচ্চু মিয়ার বয়স হয়েছে শরীরটাও আর আগের মত নেই, ভাটার টানে পড়ে গেছে। ছেলে মেয়েরাও বড় হয়েছে বিয়ে শাদী করে তারা এখন ঘর সংসার করছে। ফুফুর প্রতি বাবার আদিখ্যেতা তাদের কোন দিন ভাল না লাগলেও বাবার সামনে কিছু বলার উপায় নেই। অনেকদিন ভুগে বাচ্চু মিয়া একদিন এই সব সম্পত্তির মায়া কাটিয়ে সব কিছু ফেলে রেখে চলে গেল। যাবার আগে ছেলেদের ডেকে বলেছিল তোরা ফুফুর অযত্ন করবি না। ছেলেরা বাবার যাত্রা পথে কিছু বলেনি কিন্তু তারা জানত বাবার মৃত্যুর পর কি করতে হবে।

এত দিন আম্বিয়া বেগম ভেবেছে যে ভাই তাকে আগলে রেখেছে সে ভাই চলে গেলে ভাইয়ের ছেলেরা তার দেখা শুনা করবে সে তাদেরকে জমি জমা যা আছে ভাগাভাগি করে দিয়ে যাবে। এক দিন আম্বিয়া বেগম ভাইয়ের বড় ছেলে হারুনকে ডেকে এগুলির একটা বন্দোবস্ত করার কথা আলাপ করল। সব শুনে ছেলে  বাবার রেখে যাওয়া টিনের বাক্স খুলে দলিল পত্র বের করে দেখল সবই তার বাবার, ফুফুর কিছু নেই। আম্বিয়া বেগম অবাক হয়ে দূরের আকাশের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল। তার কিছু বলার নেই। ছেলে বলল
ফুফু, যা হইছে অনেক হইছে তোমার জইন্যে আমরা গ্রামে মুখ দেখাইতে পারি না। সবাই কয় তোর ফুফু গলা টিপা তগো ফুফারে মাইরা ফালাইয়া তর বাপেরে সব সম্পত্তি দিছে। তাই তুমারে আর আমরা আমাগো সাথে রাখা পারতেছি না আবার তাই বইলা এক্কেবারে ফালাইয়াও দিবার পারুম না। তুমারে ওই উত্তরে বাঁশ ছোপের যে ভিটাডা আছে ওই জাগায় একটা ছাপরা উঠাইয়া দিমু ওই হানে থাকবা। তুমি এই বাড়ি ছাইড়া আমাগো একটু নিরিবিলি থাকবার দেও।
দেখতে দেখতে দূরের আকাশের কাল মেঘগুলা অনেক নিচে নেমে এসে আম্বিয়া বেগমকে ছেয়ে ফেলল। আম্বিয়া বেগম কাল মেঘের নিচে ঢাকা পড়ে গেল, সেখান থেকে তার আর বেরিয়ে আসার কোন উপায় নেই সামনে শুধু ধু ধু মরীচিকা।

No comments:

Post a Comment

Back to Top