নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-২৭

৫৩।
-আসেন ভাইছাব।
-আমি কি করবো?
-না আজকে কিছু করতে হবেনা আপনি বসেন।
টেবিলে পানির জগ, গ্লাস, খেজুর, আপেল, বড় কাবলি ছোলা ভুনা আর কি যেন এক রকম পায়েস এর মত মনে হলো।
ঘড়ি দেখে একজন বললো টাইম হয়ে গেছে পানি মুখে দেন সবাই। ইফতারের ফাঁকে ফাঁকে সবার পরিচয়ের পর্ব শেষকবিরের সাথে আগেই আলাপ হয়েছে। কবির কিচেনে কাজ করে, সে কুক। প্রধানত পেঁয়াজ রসুন আদা ছেলা- কাটা, এগুলির পেস্ট তৈরি করা, পোলাও রান্না, মাংস সবজি ডাল ইত্যাদি কাস্টমারের পসন্দ মত তৈরির জন্য সেফকে প্রস্তুত করে গুছিয়ে দেয়া এই হলো তার কাজ। মারুফ তন্দুরে নান বানানো, মুরগি ভেড়ার মাংস, কিমা তন্দুরের আগুনে পুরিয়ে যে সব তৈরি করা হয় তাই করে। সে হলো তন্দুরি সেফ। আর এক জনের নাম দেলোয়ার সে সেকেন্ড সেফ। সেফ সাহেব আজ নেই তার স্ত্রী হাসপাতালে সেজন্য তিন দিনের ছুটি। আগামী সোম বারে আসবে। রাশেদ সাহেব এতক্ষণে একটু স্থির হয়েছেন। যারা উপস্থিত আছে সবার সাথে কথা বার্তা বলে কার কি কাজ মোটামুটি জেনে নেয়ার চেষ্টা করছেনআর সে নিজে হলো কিচেন পোর্টার। তার কাজ পিঁয়াজ আলু ছেলা, যাবতীয় হাড়ি পাতিল ডেকচি, কাস্টমারের প্লেট বাটি, অন্যান্য ডিশ ধুয়ে পানি ঝরিয়ে শুকিয়ে জায়গা মত রাখা। তবে গ্লাস ধুতে হয়না, ওগুলি ওয়েটাররাই ধুয়ে থাকে।
সরবরাহকারির দেয়া কিচেনের মালামাল উঠিয়ে গুছিয়ে রাখা। সেফ বা কিচেনের অন্যান্য কর্মচারীর হুকুম তামিল করা মানে এটা ধুয়ে দিন, ওটা এনে দিন, স্টোর থেকে পিঁয়াজের বস্তা আলুর বস্তা নিয়ে আসেন, এই আবর্জনা গুলি উঠিয়ে বিনে ফেলেন। বিনটা বাইরে কাউন্সিলের বিন বক্সে ফেলে আসেন। কিচেন ঝাড়ু দিয়ে মপ মেরে দেন। মপ মারা  লাঠির মাথায় লম্বা সুতার ব্রাশ দিয়ে বিশেষ ভাবে তৈরি বালতি ভরে গরম পানির সাথে সাবান ব্লিচ এবং এনটি ব্যক্টেরিয়াল সুগন্ধি মিশিয়ে মেঝে ব্রাশ দিয়ে মুছে এনে বালতির উপরে চিপড়ানোর জায়গায় চিপড়িয়ে আবার মুছে এনে বালতির ভিতর ধুয়ে চিপড়িয়ে সমস্ত ঘর মুছে নেয়া। অবশ্য মাঝে মাঝে বেশি বিজি হলে সবাই সাহায্য করে। এরাই হলো কিচেন স্টাফ। কোন কোন ক্ষেত্রে সেফ নিজেই মালিক বা অংশীদার। কিন্তু তা হলে হবে কি তাকেও সবার মত একই কাজ করতে হয় কারণ সেও সবার মত বেতন নেয়।

ওদিকে সামনে যারা কাজ করে তারা হলো ওয়েটার। এখানে তিনজন অংশীদার। একজন  সেফ, অপর দুই জন সামনে কাজ করে। শিক্ষানবিশ ওয়েটার হলো কুমি ওয়েটার। এ ছাড়া আরও আছে মিড ওয়েটার এবং ওয়েটার। নুরুল ইসলাম, রেস্টুরেন্টে ঢুকেই যাকে দেখেছিলো সে কুমি ওয়েটার। সে রাশেদ সাহেবের সাথে এক রুমে থাকে। দুপুরে কাজ শেষে কোথায় যেন গিয়েছিলো যার জন্য রুমে দেখতে পায়নি । কাস্টমারের অর্ডারে পাপর থাকলে পাপর এবং তার সাথে চাটনি পরিবেশন করে। খাবার পর হট টাওয়েল এনে দেয়, সাথে একটা ডেসার্ট মেনু আর মৌরি জাতিয় কিছু। টেবিল পরিষ্কার করে, বার থেকে ট্রে করে মদের গ্লাস এনে দেয়, ওয়েটার কাস্টমারকে অভ্যর্থনা জানাবার পর কুমি ওয়েটারকে বলে দেয় একে অত নম্বর টেবিলে বসতে দাওতাকে এনে সেই অনুযায়ী বসিয়ে দিয়ে খাবার মেনু দিয়ে যায়। যত জন কাস্টমার ততটা মেনু। আবার কাস্টমার যাবার সময় তার কোট বা জ্যাকেট থাকলে যা কিনা ঢোকার সময় খুলে হুকে ঝুলিয়ে রেখেছিলো সেটি এগিয়ে গায়ে দিয়ে দিতে হবে। সদর দরজা খুলে পাশে দাঁড়িয়ে গুড নাইট স্যার/ম্যাডাম, আবার আসবেন বলে বিদায় জানাতে হবে। ওয়েটার বা মিড ওয়েটারদের মধ্যে কেও একজন বারে থকে, সে মদের ধরন অনুযায়ী গ্লাসে মদ ঢেলে দেয়। আবার এরাই কেও কাস্টমার টেবিলে বসার পর অর্ডার বই নিয়ে এসে জানতে চায় তোমরা কি অর্ডার দেয়ার জন্য প্রস্তুত? যদি বলে হা, তখন তাদের দেয়া অর্ডার লিখে একটা কপি কুমি ওয়েটার এর হাতে দিয়ে দেয় তাতে টেবিল নম্বর থাকে। সে ওটা নিয়ে কিচেনে দিয়ে আসে আর একটা কপি বার এর কাউন্টারে দেয়। বারে যে থাকে সে হিসাব নিকাশ এর কাজও করে।
কখনো কাস্টমার অচেনা মেনু দেখে চিনতে পারে না তখন জানতে চায় এটা কি? হ্যাঁ হ্যাঁ এইটা কি? ওয়েটার ব্যাখ্যা করে বলে দেয় এটা এই, ওটা এই, এটায় ঝাল বেশি, ওটায় ঝাল কম। এটা এইভাবে তৈরি, ওটা ওইভাবে। যতটা সম্ভব মনোরঞ্জন করে একটা ভাল দামি অর্ডার আদায় করা। কোন কোন কাস্টমার আবার বলে, দেখ আমার বাদাম বা দুগ্ধজাত খাবারে এলার্জি আছে তা আমি কোন অর্ডার দিতে পারি? তাকে সেরকম মেনু দেখিয়ে দিতে হয়। আসাদ হোসেন ওয়েটার। সে এদেশে সিএ পরতে এসেছেতার বাড়ি ময়মনসিংহ এছাড়া আর সবাই সিলেটের।

ইফতার কি হলো না হলো সে দিকে খেয়াল করার মত সময় নেই। কোন রকম পেটে ঢোকান। মোটামুটি ইফতার আর পরিচয় পর্ব সেরে আবার উপরে উঠে এলো সবাই। এর মধ্যেই প্রায় পৌনে পাঁচটা বেজে গেছে। আবার  পাঁচটায় নামতে হবে।
নিজের বিছানায় এসে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে বসে ভাবল মনি ফ্লাই করেছে কথাটা ঢাকায় জানানো দরকার কিন্তু কিভাবে জানাবে?  অবশ্য মনিকে বলে দিয়েছে সে ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমে আনুষ্ঠানিকতা সেরে বাইরে এসে বাসায় ফোন করবে। তবে কায়সার বেয়াই যদি সাথে এসে অন্তত কল্যাণপুর পর্যন্ত দিয়ে গেলেও হবে তবে তা সে করবে কিনা কে জানে। সে ভরসায় থাকা যায়না। তাছাড়া আগে থেকে বাসায় জানা থাকা আর ফোন পেয়ে যাওয়া তো এক কথা নয়। সামনে বসা নুরুল ইসলামকে বললো-
-ভাই, কি ভাবে একটা ফোন করা যাবে?
-আপনার কাছে ফোন কার্ড আছে?
-হা আছে।
-তাহলে ওই টয়লেটে যাবার পথে দেখেন একটা ফোন আছে ওইটা দিয়ে করতে পারবেন তাড়াতাড়ি করেন ডিউটিতে যাবার সময় হয়ে গেছে।
কথাটা শুনেই তাড়াতাড়ি যেতেই দেখে হ্যাঁ একটা ফোন আছে। সঙ্গে সঙ্গে নম্বর মেলাতেই ওপাশে রিং হবার শব্দ শুনতে পেল। ফোন ধরল ছোট মেয়ে
-আব্বু! তুমি কেমন আছ?
-হ্যাঁ আব্বু আমি ভাল আছি, শোন তোমার মা কাল সন্ধ্যায় ঢাকা নামছে সে এখান থেকে আজ সকালে ফ্লাই করেছে।
-তুমি কোথায় আব্বু?
-আমি অক্সফোর্ডে একটা রেস্টুরেন্টে কাজ নিয়ে এসেছি আজ দুপুরে, তোমরা ভাল আছ তো আব্বু?
-হ্যাঁ আব্বু আমরা ভাল আছি।
-আচ্ছা আব্বু আজ সময় নেই, এইতো এখনি কাজে যেতে হবে সময় মত আমি কাল আবার ফোন করব। তোমার মা পৌঁছল কিনা শুনব আজ তাহলে রাখি আব্বু তোমরা সাবধানে থেক।
ফোনটা শেষ হতেই দেখে আর সময় নেই রুমে না ঢুকে সরাসরি নিচে নেমে এলো।
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top