নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৬৫

 ১২৮।
বাসা ছেড়ে বাইরে এসেনাসিরকেজিজ্ঞেস করলো-
-কি নাসির রিতা আপাকে দেখলে?
হ্যাঁ, দেখলাম এবং অবাক হলাম এই দেখে যে সকালের ঘটনা সম্পর্কে ওনার কোন বিকার নেই, আর ভালো লাগলো
যে
আপনিও কিছু তুলেন নি।
-তুলে কি লাভ হবে বল, দুলাভাইকে দেখলে, তাকে দেখে তার সাথে কথা বলে কি মনে হয়েছে আপা যা বলেছে তা সত্য? আরও ঘটনা আছে যা তুমি জানো না, সে সব পরে আস্তে আস্তে বলব। এখন যেখানে যাচ্ছি আমার এই বন্ধু কিন্তু রিতা আপার মত না। সে আমার ছোট বেলার বন্ধু এবং এখানে আমার জন্য অনেক করেছে ।
ফিরোজের বাসায় আসতে প্রায় সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেলো।
-বল কি খবর, আচ্ছা তোমার রিতা আপার সাথে দেখা হয়েছে?
-হ্যাঁ হয়েছে।
-মহিলা গত কাল ফোন করে আমাকে বললো
-রাশেদের আগামী কাল এখানে আসার ব্যাপারে কি আপনি জানেন?
-হ্যাঁ জানি।
একথা শুনে তোমার দুলাভাইয়ের নানা রকমের সমস্যার কথা বলে ডাক্তারের রেফারেন্স টেনে শেষ পর্যন্ত বললো আমার কাছে ওর ফোন নম্বর নেই কাজেই আমি তোমাকে উনার ওখানে আসতে নিষেধ করতে পারব কিনা জানতে চাইল
-তুমি কি বললে?
-আমি কি বলব, বললাম এ কথা আমার বলা ঠিক হবেনা, আমি জানি এটা বেশ কয়েক দিন আগের ঘটনা, ও কাল আসবে আর আজ এই সংবাদ আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। আমার কাছে ফোন নম্বর আছে আপনি নিজেই ফোন করে বলে দেন তাই ভালো হবে বলে আমি ফোন নম্বর দিয়ে দিলাম।
-হ্যাঁ আমি যা ভেবেছি তাই। আমি কাল বিকেলে তার ফোনের খবর পেয়ে ফোন করলাম কেও ফোন ধরে না, তোমাকে ফোন করলাম তুমি বাসায় নেই। গ্লাসগো এসে আবার ফোন করলাম কেও ধরে না। আমি জানতাম তোমার কাছ থেকেই ফোন নম্বর পেয়েছে। সকালে বাসায় পৌঁছার পর তোমাকে যা বলেছে আমাকেও তাই বলেছে। তার এ কথা শুনে আমি আর দেরি করিনি, সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে সোজা ব্রিকলেন চলে গেছি।
-তা তুমি হঠাৎ করে ওখানে যাবার ইচ্ছা করলে কেন, এখানে কি অসুবিধা ছিলো?
একথা শুনে রাশেদ সাহেব বিব্রত বোধ করলেনসে জানে এই প্রশ্নের সামনে তাকে পরতেই হবে! নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললো-
-না, আসলে ব্যাপারটা তাহলে খুলে না বললে বুঝবে না। শোন, তাহলে তোমাদের সাথে স্কুল শেষে ছাড়া ছাড়ি হবার পর থেকেই উনার ভাই এর সাথে কলেজে পরিচয় এবং বন্ধুত্ব এবং পরবর্তীতে কর্ম জীবনেও একই সাথে, সেই সুবাদে ঘনিষ্ঠতা। তুমি নিখোঁজ, মানে আমরা কে কোথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছি, তার পরে শাহিনের সাথে ওই ঘনিষ্ঠতা এখনও গভীর ভাবেই আছে। মালেকের কথা মনে আছে? -কোন মালেক? -ওই যে আমাদের সাথেই ছিলো মনিরার ভাই। -ও হ্যাঁ মনে আছে। -আরও অবাক হবে যে মালেকের বোন মনিরার সাথে যে আমার বিয়ে সেই ঘটকও ওই শাহিন। কাজেই বুঝতে পারছ এখন, তার বোন তাই। এ ছাড়া আর কোন অসুবিধা না। ভাবলাম কখনো যাইনি, একবার যাই এইতো!
-না রাশেদ আমার মেজাজ খারাপ হয়েছে, কাল তুমি আসছ আর উনি আজ নিষেধ করছে! কেন তুমি থাকতে দিবে না তো তখন রাজী হয়েছিলে কেন? তখন নিষেধ করলেই পারতো! আচ্ছা যাক এখন বল কি খবর?

রাশেদ সাহেব সব কিছু খুলে বললেন। নাসিরের সাথে হঠাৎ ব্রিকলেনে দেখা। নাসিরের ওই মহিলাকে দেখার ইচ্ছার প্রেক্ষিতে এখন ওখানে গিয়েছিলাম, কাল লন্ডন ছেড়ে চলে যাচ্ছি একথাও বলে এসেছি।
-নাসির তুমি ফিরোজের সাথে আলাপ কর আমি ফুফু আম্মা আর ভাবীর সাথে দেখা করে আসছি।
ভাবী জিগ্যেস করলো-
-ভাই, আপনি এবারে লন্ডনে থাকা নিয়ে এই ঘটনা কেন ঘটালেন? আজ দুপুরে আপনার বন্ধু বলছে রাশেদ এসেছে কিনা বা কোন ফোন করেছিলো কিনা? আপনিও কাল ফোন করেছিলেন কিছু বলেননি, আজ এসেছেন সেই সকালে একটা ফোনও করেননি। ও তো চিন্তায় অস্থির।
-আচ্ছা ভাবী, এবারের জন্য মাফ করা যায়না?
-আচ্ছা যাক যা হবার হয়েছে এখন কি একবারে ভাত খাবেন নাকি এখন চা দিব?
-না ভাবী, আজ ভাত খাব না আপনি চা দেন।
-কি বলেন সঙ্গে নতুন মেহমান নিয়ে এসেছেন খেয়ে যাবেন না?
-না ভাবী, ফাহমিদা মানে ওর বৌ অনেক রান্না করে রেখে গেছে, আমি কাল চলে যাচ্ছি আর ও যাবে পরশু কাজেই এখানে খেয়ে গেলে অনেক খাবার ফেলে দিতে হবে।
-আচ্ছা ঠিক আছে আপনি ওখানে গিয়ে বসুন আমি চা নিয়ে আসছি।
-আমি কি একটু হেল্প করবো? নতুন ওয়েটারি শিখেছি টেস্ট করে দেখতে পারেন।
-না ওয়েটার সাহেব আপনার হেল্প লাগবেনা আমার পুরনো ওয়েটার আছে আপনি ওখানে বসেন।
চা নাস্তার পালা শেষে বিদায়ের পালা। ভাবী সেই আগের খাতা এনে সামনে ধরলেন,
-ভাই লেটেস্ট ফোন নম্বর আর ঠিকানা।
খাতাটা নিয়ে পকেট থেকে জব সেন্টার থেকে দেয়া ঠিকানা বের করে লিখে ভাবীর হাতে দিয়ে-
-আচ্ছা তাহলে এবার আসি।
-ফোন করবেন।
-আচ্ছা।

১২৯।
-রাশেদ ভাই আপনি ভাল একজন বন্ধু পেয়েছেন আর ভাবীও কম না।
-হ্যাঁ কোন সন্দেহ নেই, আমরা সেই স্কুল জীবনের বন্ধু। তুমি তাহলে কাল সকালেই ওখানে চলে যেও।
-হ্যাঁ যাবো কিন্তু আমার একটু কাজ আছে।
-আবার কি কাজ?
-আমি বাড়িওয়ালাকে একশ পাউন্ড এডভান্স দিয়েছি সেটা চাইতে হবে।
-, তাহলে কাল সকালে তাকে বলে তারপর ওখানে যাবে।
-তাই করতে হবে।
-ওই লোক কি টাকা ফেরত দিবে, এ লোক কি বাঙ্গালি?
-না, পাকিস্তানি
-আগে নোটিশ দিয়েছ?
-হ্যাঁ ওদের যাবার ডেট কনফার্ম করেই নোটিশ দিয়েছিলাম।
-এ আবার আর এক ফ্যাঁকড়া, একশ পাউন্ড কম না। বাংলাদেশের হিসাবে অনেক টাকা, দেখ কি করে, আমি শুনেছি পাকিস্তানিরা বদমাইশিতে সবার উপরে।
-আমিও তাই ভাবছি, দেখি চেয়ে দেখি যদি দেয় তো ভালো না দিলে কিছু করার নেই, আমি এখানে এই টাকা আদায়ের জন্য অপেক্ষা করতে পারব না, না দিলে এটা ফেলেই যেতে হবে।
-হ্যাঁ তাই, এ ছাড়া আর কিছু করার নেই! আচ্ছা শোন আমি কালই যাচ্ছি কিন্তু আমাদের যোগাযোগ হবে কিভাবে?
-কেন আমার মোবাইল আছে এখানে এসেই নিয়েছিলাম।
-তাই নাকি তো দাও নম্বরটা এখনি দাও আর আমি যেখানে যাচ্ছি এই নম্বরও রেখে দাও। আমি ওখানে যেয়ে দেখি কি অবস্থা, যদি সম্ভব হয় চেষ্টা করব তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যেতে, হয়ত এক রেস্টুরেন্টে হবে না তবে এক এলাকায় হলেই হবে। কি জানি আমার ব্রীজেন্ড আর তোমার ডিড কোট কত দূর কে জানে, একটা ম্যাপ হলে দেখতে পারতাম। ওহ ভুল হলো ফিরোজের বাসায় ম্যাপ ছিলো ওখানে দেখে নিতে পারতাম। আচ্ছা দেখব আমি আগে যাই ওখানে গিয়েই দেখব। বাসায় গিয়ে তোমাকে কিছু ভাত রেঁধে দিয়ে যেতে হবে। তরকারি যা আছে দেখেছি তাতে হয়ে যাবে। তোমার বৌ আমার হিসাব করেনি তাই ভাত কম হবে। চলো সরাসরি বাসায় চলো আর কোথাও যাবার সময় নেই।

বাসায় এসে নাসির বললো-
-রাশেদ ভাই আপনি এক কাজ করেন আপনি ভাত রান্না করতে থাকেন আমি দেখি বাড়িওয়ালাকে পাই কিনা যদি পাই তাহলে বলে আসি
-ঠিক আছে তাই কর।
-ভাত রান্না হয়ে গেছে নাসির আসছে না, প্রায় ঘণ্টা খানিক পর এলো।
-কি ব্যাপার দেখা হলো?
-হ্যাঁ হয়েছে কিন্তু সে যা বলছে তাতে টাকা পাওয়া সম্ভব হবেনা, সে বলছে এখন টাকা নেই আগামী সোমবারে দিবে।
-তুমি কিছু বললে না?
-হ্যাঁ তাইতো এতো দেরি হলো। অনেক বুঝালাম, অনুরোধ করলাম বললাম আমি বৃহস্পতি বারে চলে যাব এই টাকা নেবার জন্য কিভাবে আসব, না তার একই কথা নট বিফোর মানডে, বলে তোমার একাউন্ট নম্বর দিয়ে যাও আমি জমা করে দিব। শালার না দেবার ফন্দি, জানে আমি টুরিস্ট আমি একাউন্ট নম্বর পাবো কোথায়।
-তার মানে একশ পাউন্ড লস, বললাম না এরা এই ধরনের সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। কাকে কি ভাবে ঠকাবে।
-যাকগে বাদ দেন ও টাকা আর পাব না, ওটা ফেলেই যেতে হবে।

১৩০।
খেয়ে দেয়ে অনেক রাত পর্যন্ত নাসিরের সাথে গল্প করলেন। দেশে কি করতেন, কেন, কি অবস্থার প্রেক্ষিতে এখানে এলেন সব কিছু প্রাণ খুলে বললেন। এখানে এসে কাজের অভিজ্ঞতা, লোক জনের আচরণ, কোথায় কোথায় কি ভাবে গেছে, কি কি কাজ করেছে, কি ভাবে দিন গেছে রাত গেছে, ঘুমের ওষুধ খেয়েও না ঘুমিয়ে কত রাত কেটেছে, কত চোখের পানিতে বালিশ ভিজেছে যা কখনো মনিকে বলা হয়নি, মনিকে অনেক কথা বলেছে কিন্তু এই একটা কথাই বলতে পারেনি, সে কথা আজ নাসিরকে বলেছে, সব বলেছে। অনেক দিন পর কথা বলার মত মানুষ পেয়ে মনটা ভালো লাগছে। ফিরোজের সাথে কথা হয় কিন্তু সেতো সামান্য, বিশেষ করে কাজের কথা বলতে বলতেই সময় চলে যায় টেলিফোনে আর কত কথা বলা যায়? দুএক বার যাও দেখা হয়েছে সেও খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের দেখা এ সময়েও কাজের কথাই মুখ্য। এই ক’টা মাস যে কিভাবে গেছে! আশে পাশে মানুষ ছিলো কিন্তু যারা ছিলো তাদের সাথে কি আর মন খুলে কথা বলা যায়? সাগরে ভেসে থেকেও জল পিপাসার মত। মন খুলে কথা বলতে না পারা যে কি যন্ত্রণা, মনের মধ্যে কেমন যেন একটা চাপা ব্যথা। না ব্যথা না, কি যেন কেমন যেন আলাদা একটা কষ্ট লুকিয়ে থাকেসে কষ্ট বের করে দেয়া যায় না, সরিয়ে দেয়া যায় না। কেমন যেন ভারী বোঝা বয়ে বেড়ানোর মত, হাঁটতে গেলে পা চলে না, কাজে হাত চলে না মন বসে না, এলোমেলো আকাশ পাতাল ভাবনায় দিন যায়, রাতে চোখের পানিতে বালিশ ভিজে যায়। কেমন যেন বলতে না পারা একটা অন্য রকম অনুভূতি। মেয়েরা কে কি করছে, কে কেমন সব বলেছে। রিতা আপার ভাই শাহিনের সাথে কবে কি ভাবে পরিচয়, কখন কোথায় কি করেছে, কি ভাবে উভয়ের অজান্তে গভীর বন্ধুত্ব ঘনিষ্ঠ থেকে আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে সব কিছু খুলে বলতে পেরে সকালে রিতা আপার কারণে যে আঘাত পেয়েছেন তার কিছুটা যেন হালকা মনে হচ্ছে।
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top