নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৬৪

১২৬।
-বেশ তাহলে আজ আমাদের আর কোন কাজ নেই। এখন চলো দেখি আমার একটা থাকার জায়গা খুঁজতে হবে। ওটা পেলে তারপর ভিক্টোরিয়া যাব কাল ব্রীজেন্ড যাবার টিকেট করার জন্য।

-আপনার থাকার জায়গা নেই?
-থাকলে আর খুঁজবো কেন?
-আরে না না কিছু খুঁজতে হবেনা! বললাম না আমার ওয়াইফ আজ চলে গেলো আমার বাসা খালি ওখানেই থাকবেন। যাবার আগে ও রান্না বান্নাও করে রেখে গেছে। কিচ্ছু করতে হবেনা সব রেডি আছে।
-বল কি! এ যে স্বপ্নাতীত ব্যাপার মেঘ না চাইতে জল! আমি যে কিছুই ভাবতে পারছি না!
-রাশেদ ভাই, এক কাজ করি চলেন! এখন বাসায় যাই। আপনার ব্যাগটা রেখে খেয়ে দেয়ে দুজনে বেড়াই। আমার ডে টিকেট নেয়া আছে।
-আমিও সকালে ডে টিকেট নিয়েছিলাম, কিন্তু যাবো কোথায়? হ্যাঁ চলো, ইস্ট একটনে আমার এক বন্ধু আছে তার ওখানে যাই!
-চলেন আগে বাসায় যেয়ে খেয়ে বের হই!।
-তাহলে এক কাজ করি, আগে ভিক্টোরিয়া থেকে আমার টিকেট নিয়ে আসি।
-হ্যাঁ, তা করা যায়।
আলাপ করতে করতে নতুন দুই বন্ধু অল্ড গেট ইস্ট টিউব স্টেশনে নেমে ডিসট্রিক্ট লাইন ধরে ভিক্টোরিয়া চলে এলো। টিউব থেকে বের হয়ে একটু হেঁটে কোচ টার্মিনালে এসে রাশেদ সাহেবের ব্রীজেন্ড যাবার টিকেট নিয়ে নাসিরের ফরেস্ট গ্রিনের বাসায় চলে এলো। বাসায় এসে নাসির বললো-
-রাশেদ ভাই আপনি ফ্রিজে দেখেন কি আছে আর কি লাগবে, আমি আবার এসব ব্যাপারে একেবারে আনাড়ি।
-আচ্ছা দেখছি
ফ্রিজ খুলে দেখে নাসিরের বৌ চিকেন, সবজি আর ভাত রান্না করে রেখে গেছে। ফ্রিজে টমাটো কাঁচা মরিচ, শসা, পিঁয়াজ, ব্রেড জ্যাম মাখন সবই আছে।
-তোমার বৌ দেখছি সবই রেখে গেছে!
-হ্যাঁ আমার ক্ষমতা সম্পর্কে সে জানে তাই দুই চার দিনের মধ্যে যাতে কিছু করতে না হয় সে ব্যবস্থা করে গেছে।
-একটু সালাদ বানাই, কি বল?
-হ্যাঁ হ্যাঁ আপনার যা ইচ্ছা তাই করেন আমাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে কোন লাভ হবে না।
সালাদ বানিয়ে ভাত তরকারি মাইক্রোওয়েভে গরম করে দুজনে খেতে বসলেন। এত আয়োজন সামনে দেখে রাশেদ সাহেবের সকালে রিতা আপার বাড়ির কথা মনে হলো। চোখ ছল ছল করে উঠল, মনটা ভারি হয়ে গেলো। চুপ চাপ কোন কথা বলছেন না, ভাতও মুখে দিতে পারছেন না। ভাতে হাত দিয়ে বসে রইলেন। নাসির লক্ষ করে জিজ্ঞেস করলো-
-কি ব্যাপার রাশেদ ভাই হঠাৎ কি হলো? এরকম নীরব হয়ে গেলেন! আপনার চোখ ভেজা কেন?
-না কিছু না!
-না না, কিছু অবশ্যইভাবীর কথা মনে হচ্ছে?
-না না, বললাম না তেমন কিছু না।
-না রাশেদ ভাই, পথে পরিচয় বলে লুকাতে চাইছেন, এখনও আপন ভাবতে পারছেন না?
-না না কি যে বল ভাই, তোমার এই ঋণ আমি কি ভাবে শোধ করব জানিনা। তবে এইটুক বুঝতে পারছি যে আল্লাহ তাআলা আমার প্রতি বিশেষ কৃপা করে আজ আমাকে তোমার সাথে দেখা করিয়ে দিয়েছেন।
-ভাই একটু খুলে বলেন, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। তবে এটুক বুঝছি যে আপনার ভিতরে প্রবল একটা ঝড় বইছে যা আপনি প্রকাশ করতে চাইছেন না। সারাদিন একসাথে রইলাম, এতক্ষণ কি সুন্দর হাসি খুশি ছিলেন আর এখন হঠাৎ এমন হয়ে গেলেন! দেখুন রাশেদ ভাই আমিও কিন্তু কম দেশ ঘুরিনি! আমার ব্যবসার কারণে বলেন আর যে কারণেই বলেন আমাকে অনেক দেশে ঘুরতে হয়েছে। সে কারণ আমি পরে বলব আপনাকে। এরকম অনেকের সাথেই পরিচয় হয়েছে, আলাপ হয়েছে এবং পরবর্তীতে কারো কারো সাথে ঘনিষ্ঠতাও হয়েছে যা এখনও টিকে আছে। কাজেই পথের পরিচয় বলে এড়িয়ে যাবেন না। কি হয়েছে খুলে বলেন।
-না নাসির আমি এড়িয়ে যেতে চাইনা, সত্যি করেই কঠিন কিছু তাই আমার ভাষা স্তব্ধ হয়ে গেছে বলার মত ভাষা পাচ্ছি না। তোমার সাথে দেখা না হলে এতক্ষণ আমার যা হোত তার পরিবর্তে আমার সামনে এই আয়োজন আমার কাছে অনেক বড় কিছু মনে হচ্ছে। যা আমি কিছুতেই ভাবতে পারছি না।
-আচ্ছা যা আছে থাকুক আগে খেয়ে নেন তারপর বলেন।
রাশেদ সাহেব খেতে শুরু করলেন, আস্তে আস্তে বললেন-
-শুনতে যখন চাইছ তাহলে শোন
ওবান থেকে ফেরার আগে রিতা আপার সাথে ফোনের আলাপ থেকে আজ সকালে রিতা আপার বাসা পর্যন্ত সব কিছু খুলে বললেনতখন ব্রিক লেনে বসে শুধু এই কথাগুলি লুকিয়ে রেখেছিলেন
শুনে নাসির বললো-
-এমন কোন বিপদ নেই যা মানুষের অতিক্রমের বাইরে, যার যার সৃষ্টিকর্তা সেই ভাবেই নেটওয়ার্ক তৈরি করে রেখেছেন। আপনার রিতা আপার মত অনেকেই আছে যারা এই সত্যটা অনুভব করেনা। চলেন রাশেদ ভাই উনার বাসায় যাই। আপনার কথা শুনে উনাকে দেখার একটু লোভ হচ্ছে, দেখে আসি এ কেমন মহিলা।
-না, কি হবে দেখে? আমি ভুলে যেতে চাই। সুখের কথা মনে রাখতে হয় আর দুঃখের কথা ভুলে যাবার চেষ্টা করতে হয়। বাদ দাও কি হবে গিয়ে!
-না অন্তত এই ব্যাপারটা একটু জানিয়ে আসুন যে আপনাকে তার ওখানে বেশিদিন থাকতে হোত না। এইতো আপনি কালই লন্ডন থেকে চলে যাবেন এই ব্যাপারটাই একটু জানিয়ে আসুন। আপনি লন্ডনে থাকতে আসেননি। প্লিজ চলেন রাশেদ ভাই!
-আচ্ছা দেখি তাহলে। আমাদের তো আর যাবার জায়গা নেই রিতা আপার বাসা থেকে ফিরোজের বাসায় যাব। তবে নাসির, তোমার ওয়াইফের রান্না কিন্তু চমৎকার। একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ? দেখ, যে রেঁধে রেখে গেছে সে এখন ঢাকার পথে আকাশে উড়ে যাচ্ছে আর তার রান্না কে খাচ্ছে! এই হলো নিয়তি! কি আশ্চর্য নিয়তির কারুকাজ! রান্নার সময় সে বা কেও কি ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিলে যে এই রান্না আমি খাব?
খাবার শেষ করে রাশেদ সাহেব চা বানালেন। দুইজনে বসে চা খাবার সময় নাসির বললো-
-বাহ! বেশ ভাল চা বানিয়েছেন! আমিনার চা ভালো হয়না ও নিজে চা খায় না মনে হয় তাই ভালো চা বানাতেও পারে না।
-কি বললে আমিনা?
-হ্যাঁ আমার ওয়াইফের ডাক নাম আর ভালো নাম ফাহমিদা পারভিন।
-তাই নাকি? আমিনা তো আমার মায়ের নাম।
টেবিলের ড্রয়ার টেনে নাসিরের ছেলে আর ফাহমিদার ছবি দেখাল। ছেলের ছবি দেখে রাশেদ সাহেব চমকে উঠে নাসিরের দিকে তাকালেন। পোলিওতে আক্রান্ত ছেলে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনা।
নাসির লক্ষ করে বললো-
-হ্যাঁ ভাই। এইটাই আমার একমাত্র দুঃখ, এই আমার ছেলে ফারুখ। এর জন্যেই আমি এতো দেশে ঘুরছি। শুধু ছেলেটার চিকিৎসার জন্য। এখানেও চেষ্টা করেছি। এরা বলেছে চেষ্টা করে দেখতে পারে তবে সময় লাগবে। আমি এখানে এত সময় দেব কিভাবে? ওর নানা নানী থাকে আমেরিকায়। ওদেরকে নিয়ে আমি এত দেশ ঘুরছি শুধু আমাদের পাসপোর্ট ভারি করার জন্য। যখন আমেরিকার ভিসার জন্য এপ্লাই করব তখন যাতে রিফিউজ না হয় এই ধারনা নিয়ে এতো টাকা খরচ করছি

১২৭।
কথা বলতে বলতে বেড় হয়ে রিতা আপার বাসায় যাবার টিউব স্টেশনে এসে পড়েছে।
প্রায় মিনিট চল্লিশের মধ্যে রিতা আপার বাসায় এসে বেল বাজাবার সাথে সাথেই দরজা খুললেন দুলাভাই। রাশেদ সাহেবকে দেখে একটু হেসে বললেন-
-কি যেন তোমার নাম, শাহেদ!
-না আমি রাশেদ আর আমার সাথে এ আমার বন্ধু নাসির
-ও হ্যাঁ, আমি তোমাদের দুই ভাইয়ের নাম গুলিয়ে ফেলি, আস, কোথা থেকে আসলে?
ড্রইংরুমে বসে আপা উল দিয়ে কি যেন বুনছিলেন। টিভি চলছে পাশে।
-কি খবর রাশেদ কাজ পেয়েছ?
-হ্যাঁ আপা পেয়েছি।
-কোথায়?
-সাউথ ওয়েলসে কার্ডিফ আর সোয়ান সির মাঝা মাঝি কি যেন জায়গার নাম ভুলে গেলাম, ভাবলাম কাল চলে যাব তাই দেখা করে যাই।
-ভালো করেছ। কখন কোথায় থাক যোগাযোগ রেখ, বস আমি চা নিয়ে আসছি।
শুরু হলো দুলাভাইর আলাপ
নানা প্রসঙ্গে, বিশেষ করে বাংলাদেশের দুর্নীতি, ত্রুটিপূর্ণ চিকিৎসা ব্যবস্থা, এখানকার ব্যস্ত জীবনের একঘেয়েমি, অবসরপ্রাপ্তদের অসহায়তা ইত্যাদি, আর শেষ হতে চায়না। এমনিতে দুলাভাই খুবই আলাপী মানুষ। রাশেদ সাহেব আপার সকালের ব্যাবহারের কোন কারণ এখনও খুঁজে পেলেন না। সকালে যে এসেছিলো সে প্রসঙ্গ ঘুণাক্ষরেও তুলেনি। এদিকে রাত হয়ে যাচ্ছে, শীতের রাত। ফিরোজের বাসায় যেতে হবে। রাশেদ বললো-
-দুলাভাই আজ আমরা উঠি আবার এলে তখন সময় নিয়ে আসব!
-না না বস, তুমি এসেছ কবে তা কিন্তু বলনি!
-আজই স্কটল্যান্ড থেকে সকালে এসেছি। এসেই ব্রিকলেন গেলাম, সাথে সাথেই একটা কাজ পেলাম। কাল সকালেই চলে যাব।
কথা গুলি একটু জোড়েই বললো , বিশেষ করে রিতা আপা যাতে ভাল করে শুনতে পায়!
-আর একটু বস
-না দুলাভাই আমাকে এখন ইস্ট একটন যেতে হবে।
-কেন একটন কেন?
ফিরোজের বাসায়, আমি লন্ডন এসেছি আর ফিরোজের সঙ্গে দেখা করব না এটা হতে পারেনা যেতেই হবে দুলাভাই, এখন উঠি।
আপাও সায় দিল হ্যাঁ ওর বন্ধু, কাজেই দেখা করতে যাবে ওকে এখন যেতে দাও।
-আচ্ছা তাহলে ফোন করবে আর আবার লন্ডন আসলে আসবে।
-হ্যাঁ অবশ্যই আসব।
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top