নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৪৬

৯১
সেদিন সময় মত কোচ স্টেশনে আসতে পারলেন। গ্লাসগোর কোচ পেলেন, ডবল ডেকার। ড্রাইভার টিকেট দেখে ব্যাগটা লাগেজ ডেকে রেখে দিল। নাস্তা আর পানির বোতল সহ ছোট ব্যাগ সাথে রাখলেন। কোথায় বসবেন কিছুক্ষণ ভেবে
নিচেই এক জায়গায় বসে পরলেন। মাঝখানে টেবিলের মত, দুপাশে চারটা সিট। গাড়ি ছেড়ে দিল ঘড়ির কাটা ধরে। এক জন মহিলা ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে আর একজন পাশের বিশেষ একটা সিটে বসে আছে। মনে হয় দুইজনে ভাগ করে চালাবে। এতো লম্বা পথ সেও আবার রাতের বেলা। একজন কী করে এতো দুর ড্রাইভ করে? অন্য কোন হেলপার বা সুপারভাইজার নেই বলে একটু অবাক হলেন। এতো দুরের পথ মাত্র দুইজন ড্রাইভার! আর কেও নেই? টার্মিনাল থেকে বের হয়ে এসে ড্রাইভার মাইকে ভদ্র মহিলা ও ভদ্র মহোদয়দের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রথমে ন্যাশনাল এক্সপ্রেসে ভ্রমণ করার জন্যে ধন্যবাদ জানিয়ে শুরু করল-
-আমি জেনি এবং আমার সহকর্মী পিটার আপনাদের নিয়ে গ্লাসগো বুচানান কোচ স্টেশনের পথে যাত্রা শুরু করেছিসকাল আনুমানিক ছয়টায় সেখানে পৌঁছবো। রাত প্রায় একটায় কোন একটা সার্ভিস স্টেশনে আধা ঘণ্টার জন্যে থামব সেখানে আপনারা রিফ্রেশ হতে পারবেন। সেখান থেকে আমার সহকর্মী গাড়ি চালাবে। প্রতি সিটের হ্যান্ডেলের সাথে হেড ফোন রয়েছে, এতে চারটি চ্যানেল পাবেন আপনাদের ইচ্ছেমত যে কোন চ্যানেল উপভোগ করবেন। গাড়ির পিছনে নিচের ডেকে টয়লেট রয়েছে প্রয়োজনে ব্যাবহার করবেন। সিট বেল্ট বেঁধে নিবেন। যেহেতু রাতের বেলা তাই আপনার সহযাত্রীকে বিরক্ত না করে মোবাইল ফোন সতর্কতার সাথে ব্যবহার করবেন। গাড়ির বাইরে তাপমাত্রা -3 ডিগ্রী কিন্তু আমি গাড়ির ভিতরের তাপমাত্রা আপনার জন্য আরামদায়ক অবস্থানে রাখতে চেষ্টা করব। আপনার যাত্রা আনন্দময় হোক, আবার ধন্যবাদ।

কোচ বাকিংহাম প্যালেস রোড ধরে এগিয়ে চলেছে। সারা বিশ্বের শতকরা নব্বই জন মানুষের স্বপ্নের মহানগরী লন্ডনের বুকের উপর দিয়ে রাশেদ সাহেব তার ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্ন জোড়া তালি দিয়ে তার পরিবারকে বাঁচাবার একটা সুপ্ত আশা নিয়ে অজানার পথে এগিয়ে চললেন।

মানুষের বুকের ভিতরে একটা সাগর থাকে তাকে মহা সাগরও বলা যায়। সেই সাগরে অনেকগুলি আশা বা স্বপ্নতরী ভেসে বেড়ায় যা মানুষকে বাঁচতে প্রেরণা যোগায়, মনে শক্তি যোগায়, বেঁচে থাকার আনন্দ দেয়। রাশেদ সাহেবের সেই স্বপ্নতরী গুলি একটা একটা করে প্রায় সবই ডুবে গেছে। দুই একটা এখনও প্রায় ডুবি ডুবি অবস্থায় রয়েছে তার মধ্যে থেকে যদি কিছু রক্ষা করতে পারে সেই চেষ্টা। সে এখনও জানে না কতটা সফল হতে পারবে।
নিচের ডেকে যাত্রী রয়েছে মাত্র বার জন। এর মধ্যেই কেও চোখ বন্ধ করে ফেলেছে, কেও আবার রিডিং লাইট জ্বালিয়ে পড়ছে, আবার কেও খুলে বসেছে বিয়ারের ক্যান। তার সাথে পড়ার মত কিছু নেই, কি করবেন? জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে দেখছেন। লাল নীল সবুজ হলুদ নানা রঙ্গের আলো ঝলমল ব্যস্ত নগরী, না না মহা নগরী। লন্ডন মহানগরী কখনো ঘুমায় না। লোক জনের ব্যস্ত চলাচল, ঝড়ের মত ছুটে চলা নানা রকমের গাড়ি, রাস্তার দু পাড়ে দালান কোঠা দোকানপাট। আবার কবে আসবেন এই লন্ডনে তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। আবার এলেও ঘুরে ফিরে দেখার মত ইচ্ছাও নেই। তার মনিকে নিয়ে যা দেখেছে ওই পর্যন্তই। মনি যতক্ষণ পাশে ছিলো মনে আশা ছিলো, সাধ ছিলো, স্বপ্ন ছিলো সবই ছিলো। এখন মনি নেই কাজেই ওসবের কোন বালাই নেই। মনি যেদিন আবার আসবে সেদিন তাকে সাথে নিয়ে দেখবে। ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ড মিলে পুরো গ্রেট ব্রিটেনতিনি ইংল্যান্ড ছেড়ে চলেছেন স্কটল্যান্ডে। তার ভাগ্য তাকে নিয়ে চলেছে। সে তো তার নিজের ইচ্ছায় এখানে আসেনি। তাকে নিয়ে বেড়াচ্ছে তার ভাগ্য নামের রিমোট কনট্রোল। সে যেখানে নিয়ে যাবে রাশেদ সাহেবকে সেখানেই যেতে হবে। অনেকক্ষণ পর যখন নগরীর সীমা ছেড়ে গাড়ি মটর ওয়ে দিয়ে চলছিলো তখন আর কিছু দেখার নেই। মটর ওয়ের দুপাশে সোডিয়াম বাতি আর ছুটে চলা গাড়ি। বিশাল বিশাল মাল বোঝাই লড়ি, কোন কোন লড়ি নিয়ে চলেছে দশ বারোটা করে কারএসব আর কতক্ষণ দেখা যায়? চোখ বন্ধ করে সিটের পিছনে হেলান দিয়ে বসলেন। সাড়া দিন বেশ ধকল গেছে। একটু বিশ্রাম প্রয়োজন, যদি চোখটা একটু লেগে আসে ভালোই হবে।

৯২।
কবে যেন বাড়ি ছেড়ে বেড় হয়েছিলো মনে পারছে না। হ্যাঁ ওইতো, দেশ স্বাধীন হবার পর যখন জিনিষ পত্রের দাম ক্রমে বেড়েই চলেছে কিন্তু একমাত্র বাবার আয়ে সংসার চলতে চাইছে না। গ্রামেও বাবার তেমন জমিজমা নেই যেখান থেকে কিছু এনে জোড়াতালি দেয়া যায়, তখন। তারা  ভাইবোন, বাবা মা সহ মোট সাত জনের সংসার। ছোট দুই জন তখনও স্কুলে যায়না। অন্যদের লেখা পড়া, বই খাতা কলম কালি, যাতায়াত, পোশাক ইত্যাদি। মায়ের পরনের কাপড়ে সেলাই পরতে থাকে, বাবা ময়লা কাপড় পরেই অফিসে যান। আশেপাশে থেকে শাক কুড়িয়ে এনে রান্না করা, খাবারের জন্য ছোট দুই ভাইয়ের কান্না। ওদের ক্রমে বেরিয়ে আসা বুকের হাড়, পড়নের নোংরা কাপড়, সব মিলিয়ে একা বাবা কত কুলাবেন? সংসারটাকে মনে হোত একটা বিশাল সাগর। কিভাবে এটা পাড়ি দেয়া যায়? ভাইবোনদের দিকে তাকালে কষ্ট হয়, বুকটা চিড়ে যেতে চায়সবাইকে খাওয়ানো হলে শেষে মায়ের অন্য বাড়ি থেকে আনা টিউবওয়েলের পানি খেয়ে শুয়ে পরার দৃশ্য কয়দিন দেখা যায়? কয়দিন সে নিজে ইচ্ছা করেই খেতে বসেনি। সবার খাওয়া হলে তখন এসেছে। মা খাবার বেড়ে দেয়ার পর সে জিজ্ঞেস করেছে-
-আপনার জন্য কি আছে দেখি।
-আছে তুই খা
-কি আছে একটু দেখিনা।
দেখাবেন কোথা থেকে? কিছু থাকলেতো দেখাবে।
-চালাকি করার কি এমন দরকার মা?
তার জন্যে মা যা রেখেছিলেন তাই মায়ের সাথে মিলে খেয়েছে। প্রতিদিনের ভাতের ফ্যান একটা মূল্যবান ডিশ ছিলো। এভাবে কয়দিন সহ্য করা যায়? বাবা সকালে কোন রকম নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে যাবার সময় মা দু’টা শুকনো রুটি, সাথে কোন দিন একটু আলু ভর্তা, কোন দিন পিঁয়াজ কাঁচামরিচ লবণ ডলে মেখে দিয়ে দিতেন, কিংবা একটু চিনি তাই নিয়ে বাবা যেতেন অফিসে। ছুটির পর প্রায়ই হেঁটে আসতেন মতিঝিল থেকে মিরপুরের বাসা নামক পাখির নীড়ে। যেখানে একটু বৃষ্টি হলে বিছানা পত্র গুটিয়ে সারা রাত বসে থাকতে হয়। সে বিছানাই বা কেমন? ময়লা কাঁথা, ছেড়া কম্বল যা পানির অভাবে কতদিন ধোয়া হয়নি। একদিন অফিসে কি একটা অনুষ্ঠানে প্যাকেটে করে কিছু নাশতা দিয়েছিলো কিন্তু বাবা সেটা না খেয়ে লুকিয়ে পকেটে করে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। মা আবার সেই ছোট্ট প্যাকেটে যা ছিলো তাই সমান ভাগ করে তাদের ভাই বোনদের ভাগ করে দিয়েছিলেনবাড়িতে থাকতে ইচ্ছা করেনা কিন্তু দিনের এক সময় তো বাড়িতে ফিরতে হয়। যাবে কোথায়? এই ভাবে কয়দিন পালিয়ে থাকা যায়? সে কি করতে পারে কি করবে কিছু ভেবে পায়না। লেখা পড়ায় মন বসে না। আর বসবেই বা কিভাবে? কলেজের নতুন সাবজেক্টের কিছুই বুঝতে পারেনা। এই অবস্থায় টিউটর? অসম্ভব! কল্পনাই করা যায়না। কল্যাণপুরের জাকিরের সাথে কলেজে পরিচয়। আসা যাওয়া অবসরে তার সাথে মেলামেশা থেকে বন্ধুত্ব। তার সাথে যখনই দেখা হয় এই নিয়েই আলাপ।
-কি করি জাকির, কি করলে আমি এই সমস্যা থেকে রেহাই পাবো? আচ্ছা মনে কর আমি যদি এখন কোন কাজ করি মানে চাকরি করি তাহলে?
-তোর পড়াশুনা! কাজ করলে পড়বি কিভাবে?
-কেন, মনে কর আমার পড়ালেখা এই পর্যন্তই। কি করি দেখ ছোট সব ভাইয়েরই ভাল ব্রেন, আমি যদি ব্রেক দিয়ে ওদের পিক আপ করি? হচ্ছেনা এরকম? সবাই মিলে রসাতলে যাওয়ার চেয়ে একজন যদি ত্যাগ করি অর্থাৎ একজনের বিনিময়ে অন্য সবাই উঠে এলোএরকম না হলে কি হবে ভেবে দেখেছিস? ওই যে দেখ, ওই পাড়ার হামিদ ভাই আমাদের কলেজ থেকে বিএসসি পাশ করে রিকশা চালাচ্ছে। ভাবতে কেমন লাগেনা? আমি দূর থেকে যখন দেখি হামিদ ভাই রিকশা নিয়ে আসছে তখন অন্য দিকে চলে যাইআমারও যে এমন হবেনা তা কে বলবে? হামিদ ভাই ওই পর্যন্ত যেতে পেরেছে আমিতো তাও পারবোনা। আমার মনে হয় আমি হয়তো কোন গ্যারেজে ম্যাকানিকের কাজ করবো। বাকি তিন জনের কেও কোন দোকানে কর্মচারী হবে, কেও রাজ মিস্ত্রীর হেল্পার হবে, কেও হবে ছিনতাইকারি  নয়তো পকেটমার নয়তো ফেরিওয়ালাকী, এমন হতে পারেনা?
-তুই এক কাজ করতে পারবি?
-কি?
-আমাদের ক্লাসের বাদল, ওরা খুব ধনি এবং গাবতলির প্রভাবশালী পরিবারের ছেলে, তো তুই তাকে বল তোর এই অবস্থা, ও হেল্প করতে পারবে।
-কি করবে?
-দেখ ও আর আমি এক স্কুলে পড়েছি ওকে অনেক আগে থেকেই চিনি ওরা বড়লোক, প্রভাবশালী, ওরা কোন না কোন কিছু করতে পারবে। আচ্ছা বাদ দে তোকে বলতে হবেনা আমিই বলবো।
-দেখ বলে দেখ যদি কিছু উপায় বের করতে পারে।
দু’দিন পরে ক্লাসের পর রুম থেকে বেরিয়ে আসছিলো পিছন থেকে বাদলের ডাকে থেমে ফিরে তাকাল
-কি ব্যাপার বাদল?
-শোন, তোকে আমি খুঁজছি।
-কেন?
-তোর নাম রাশেদ না?
-হ্যাঁ, কেন কি হয়েছে?
-কি আবার হবে? সেদিন জাকির তোর কথা বললোআচ্ছা তুই গরুর হাসিল লিখতে পারবি? হাসিল বুঝতে পারলি, গরু বিক্রির রসীদ।
-হাসিল! মানে কোথায়?
-কেন গাবতলির হাটে, শুধু শনিবারে হাটের দিন। কি হবে একদিন ক্লাস না করলে? কিছু হবেনা, প্রতি হাসিলের জন্যে পাবি দুই টাকা। সকাল নয়টায় যাবি সাড়া দিনে যদি পঞ্চাশটা হাসিল লিখতে পারিস তাহলে একশ টাকা নগদ নিয়ে সন্ধ্যায় চলে আসবি।
-হ্যাঁ পারবো!
-আচ্ছা তাহলে আমি দাদাকে বলে তোর একটা ব্যবস্থা করতে পারবো। করবি নাকি পরে আবার ব্যাক গিয়ারে যাবি?
-নারে বাদল আমার বাড়ির অবস্থা তোর জানা নেই জানলে আর এভাবে বলতি না, জাকির জানে।
-হ্যাঁ, ওইতো বললো আমাকে। আচ্ছা তোরা যেখানে থাকিস সেটা কি তোদের নিজেদের বাড়ি?
-কি বলবো তোকে, বাড়ি বলতে যা বুঝিস তোরা সেরকম না, কোন রকম ভেন্না পাতার ছানিপড়েছিস না? সেইরকমতবে নিজেদের। আয় না একদিন দেখবি, কাছেই তো।
-জিল্লুরদের বাড়ির কোন দিকে?
-ওদের বাড়ি ছেড়ে তিন চার মিনিট এগিয়ে যেতে হয়।
-ও আচ্ছা, যাবো একদিন, তোর মা বাবা আছে?
-হ্যাঁ সবাই আছে, মা বাবা ভাই বোন সবাই।
-যাক, বেঁচেছিস অন্তত মাসের শেষে ভাড়া দিতে হয়না। আচ্ছা তুই চিন্তা করিস না, আমি যেভাবেই হোক একটা ব্যবস্থা করবো চল এখন কাঁঠাল তলায় যাই বসি একটু।
-চল।
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top