নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৪৭

৯৩।
সেদিন এর পরে আর ক্লাস হয়নি বাসায় চলে এসেছিলো। হেঁটে আসতে সারাটা পথে মনে একটা হালকা ভাব বোধ হয়েছিলো। পা গুলো যেন আপনা আপনি এগিয়ে যাচ্ছিল, গায়ে বাতাসের ছোঁয়া বেশ স্নিগ্ধ মনে হচ্ছিল, নিঃশ্বাসের বাতাস
যেন আগের চেয়ে হালকা মনে হচ্ছিলআজও পরিষ্কার মনে পছে সেই দিনের সেই রকম আশার আলো যে কেমন হয়। জীবনের প্রথম আশার আলো। এখনও ভুলেনি, স্মৃতির পাতায় অনেক যত্ন করে রেখে দিয়েছে। যেখানে সামান্য ধুলো জমতে দেয়নি। মাঝে মাঝে কারণে অকারণে পাতা উল্টাতে হয়েছে তাই সেখানে ধুলো জমার সুযোগ পায়নি। বর্ষায় পদ্মা নদীর বুকে মাল বোঝাই তলায় ফুটো হয়ে যাওয়া নৌকা ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে দেখেও নিরুপায় মাঝি যেমন কূলের দিকে তাকিয়ে থাকে ঠিক সেরকম করে যে নিজের এবং পুরো পরিবারের অতলে তলিয়ে যাওয়ার দৃশ্য স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। সেই মানুষকে কত খানি বদলে দিতে পারে নির্ভরযোগ্য কারো কাছ থেকে পাওয়া সামান্য একটু আশ্বাস। বাদল কিছু করতে পারে, এই আশায় অপেক্ষা করবেওর সাথে তেমন আলাপ ছিলো না শুধু জাকিরের কাছ থেকে শুনে যে নিজেই এগিয়ে এসে বলেছে সে কিছু পারুক বা না পারুক অন্তত চেষ্টা করবে। জাকির সত্যিই বলেছে। একে তো বড়লোকের ছেলে যে কখনো অভাব দেখেনি তার উপরে পুরনো ঢাকার প্রভাবশালী পরিবার, এধরনের ছেলেরা সাধারণত যেমন হয় বাদল তেমন না। কাছে না গেলেও দূরে থেকে তো দেখেছে। মাকে কথাটা বলবে। না আজ না, আগে হোক পরে বলা যাবে। সেদিন বাড়িতে ফিরে কোনরকম কিছু খেয়ে মাকে জাকিরদের বাড়ি যাবার কথা বলে বেরিয়ে এসেছিলো।

পথে দূর থেকে দেখতে পেল ধীর পায়ে মেঝ ভাই স্কুল থেকে ফিরছে। সেই মোহাম্মদপুর থেকে হেঁটে আসছেকাছে আসতে দেখল শুকনো মুখ, মনে হয় আজ মা টিফিন দিতে পারেনি। রাগ, কষ্ট, দুখ:, লজ্জা অভিমানে মুখ দিয়ে কথা বের হলো না। দাঁড়িয়ে থেকে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ও চলে গেলে বুক থেকে যন্ত্রণায় পোড়া তপ্ত একটা ভারি দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো। বুকের সব যন্ত্রণা যদি এইভাবে বের করে দেয়া যেত তাহলে? আমি কী ভাবে পারবো এই সব যন্ত্রণা দূর করে দিতে? কি লাভ এই স্কুলে যাতায়াতে? শেষ পর্যন্ত হতে হবে রাজমিস্ত্রীর নয়তো কাঠমিস্ত্রীর হেলপার, নয়তো গ্যারেজের মেকানিক নয়তো কাগজের ফেরিওয়ালা। এখন বাড়িতে গিয়ে কি খাবে? ঘড়ের পাশে করা ছোট্ট বাগানের ঢেঁড়স আর পুই শাক ভাজি করেছে মাওকে যা দিয়েছিলো তার থেকে একটু তুলে ও স্কুল থেকে ফিরছে বলে ওকে দেয়ার জন্য রেখে এসেছে। মা বলেছিলেন তুই খেয়ে নে ওর জন্যে আছে। থাকুক ঐ অতটুক দিয়ে খাবে কি ভাবে? এখান থেকে একটু রেখে দেন আমার এত লাগবে না। এইতো! আর পানির চেয়েও পাতলা একটু ডাল। কি পড়াশুনা করবে, সে শক্তি আছে শরীরে? খাবার পর অবসাদে ক্লান্তিতে শরীর ঝিমিয়ে পরবে, চোখ আপনা আপনি বন্ধ হয়ে আসবে, কি পড়বে? শুধু ভাণ করা। বাবা কেন বলছেনা আমি আর পারছিনা তোমরা কিছু কর, বন্ধ করে দাও এই সব লোক দেখানো স্কুল কলেজে যাতায়াত। কি লাভ হবে এতে? মা কেন বলছেনা আমার শিক্ষা দীক্ষার দরকার নেই তোমরা যে যেদিকে পার যাও ঘড়ে চাল নিয়ে এসো, ডাল নিয়ে এসো, ঘড়ের ফুটো টিন গুলি বদলে দাও। এগুলি কি এতোই কঠিন কথা? কেন পারছেনা এই সহজ কথা গুলি বলতে? কেন বলছেনা? কিসের ভয়? কাকে ভয়? কখন যে রাস্তার সাথেই জাকিরের ঘড়ে নক করেছে লক্ষ করেনি। জাকিরের বোন নীলিমা, কিন্তু জাকির নীলা বলে ডাকে, দরজায় দাঁড়িয়ে হাসছে।

৯৪।
-কি ভাই কার সাথে কথা বলছেন?
-কি বললে?
-আমি সেই কখন দরজা খুলে দেখি আপনি ওই দিকে তাকিয়ে কি যেন বির বির করছেন কার সাথে কথা বলছিলেন?
-না কারো সাথে না একা একাই ভাবছিলাম।
একটু সরে দাঁড়িয়ে বললো-
-আসেন ভিতরে আসেন, ভাইয়া তো বাড়িতে নেই।
-কোথায় গেছে জান?
-না কিছু বলে যায়নি।
-তাহলে আমি দেখি ও কোথায় গেছে।
-আমার মনে হয় জসীম ভাইয়ের ওখানে যেতে পারে
-হ্যাঁ আমারও তাই মনে হচ্ছে, দেখি কোথায় গেলো।
ঘুরে দু পা এগুতেই পিছনে নীলা ডাকল-
-ভাইয়া আব্বা ডাকছে আপনাকে।
-ও চলো।
-আপনি বসেন আব্বা আসছে।
-সালামালেকুম চাচা, কেমন আছেন?
-হ্যাঁ বাবা আছি ভালোই, বস দাঁড়িয়ে রইলে কেন?
-তোমরা বাসায় কে কেমন আছ?
-ভালোই, চলছে কোন রকম।
-তোমাদের পড়াশুনার কি অবস্থা?
-পড়াশুনার অবস্থা আর কি বলবো চাচা, আমার অবস্থা খুবই খারাপ তবে জাকির মনে হয় মোটামুটি চালিয়ে যেতে পারছে
-খারাপ কেন, তোমার কি সমস্যা?
-সে চাচা অনেক কথা।
-কি ব্যাপার বলা যাবে আমাকে?
-চাচা আমি কিছু একটা চাকরি বাকরির কথা ভাবছি।
-কেন?
-আমার বাবার খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছে অন্তত এই সময় আমি যদি তাকে একটু সাহায্য করতে পারি তাহলে আমার মনে হয় আমার ছোট ভাইবোনদের পড়ালেখা সম্ভব হবে নয়তো সব তছনছ হয়ে যেতে পারে।
-বল কি?
-হ্যাঁ চাচা।
-ও বুঝেছি, তুমি তো আমাকে আগে কিছু বলনি জাকিরও কিছু বলেনি, তোমার রেজাল্ট শুনেছি ভালো ছিলো, জাকিরও বলেছে তোমার চাচার কাছেও শুনেছি। তুমি এরকম করে ভাবছ কেন এটা কি করে হয়? তুমি এক কাজ কর আমিও যা করেছিলাম, তুমি দুই একটা টিউশনি কর। পারবেনা?
-হ্যাঁ খুঁজেছি কিন্তু পাচ্ছি না, আমাদের ওদিকে তো লোকজন কম।
-আচ্ছা আমি দেখছি, আমাদের এদিকে আসতে পারবে?
-হ্যাঁ আমি তো এদিকেই থাকি, জাকির, জসীম, মামুন এদের সাথে।
-তাহলে ওসব চিন্তা আর মাথায় জায়গা দিও না আমি দেখছি কি করা যায়।
-রাশেদ ভাই চা খাবেন?
ভিতরের দরজায় দাঁড়িয়ে নীলা জিজ্ঞেস করলো।
-খাবে না কেন, খাবে যা নিয়ে আয়।
একটু পরে ট্রেতে করে গরম পিয়াজু আর দুই গ্লাস পানি এনে টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে বললো-
-নেন খেতে থাকেন আমি চা আনছি।
-নাও রাশেদ খাও।
এমন সময় আলতাফ এলো।
-কিরে কোথায় গিয়েছিলি?
-জসীমের কাছে, আরে বলিস না ক্লাস করবে না নোট নিয়ে টানাটানি।
-হ্যাঁ নীলাও তাই বলছিলো আমিও ভাবছিলাম।
-কিরে আলতাফ রাশেদের এই অবস্থা তুই এ ব্যাপারে আমাকে কিছু বলিস নি
বলতে বলতে জাকিরের বাবা উঠে গেলেন।

কত বছর হবে? মনে মনে হিসাব করে দেখল প্রায় ত্রিশ বছর হয়ে গেছে অথচ ভাবতে অবাক লাগছে কোথা দিয়ে ত্রিশটা বছর চলে গেছে। মনে হচ্ছে এইতো সেদিনের কথা, ধোয়া উঠা গরম পিয়াজুর প্লেট হাতে নীলা এলো, নীলার চোখের দিকে তাকিয়ে রাশেদের কেমন যেন মনে হলো। সে কি চোখের কোন ভাষা? কি ছিলো সে ভাষার মানে? ক্ষীণ কণ্ঠে বলেছিলো নেন খেতে থাকেন আমি চা আনছি। সেই নীলা আজ আর নেই। অনেক দিন আগেই চলে গেছে। জাকির বলেছে। ভাল বিয়ে হয়েছিলো প্রথম বাচ্চা হবার সময় হাসপাতাল থেকে আর ফিরেনি। একটাই বোন ছিলো সে আজ নেই। বলার সময় জাকির কেঁদে ফেলেছিলো। রাশেদের চোখও ভিজে গিয়েছিলো।
সে রাতে আর বাড়িতে ফেরা হয়নি। একটু পরেই টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হলো। নীলা চা দিয়ে গিয়েছিলো। বৃষ্টি কিছুক্ষণের মধ্যে আকাশ ভেঙ্গে মুষল ধারে নামছিলো, বৃষ্টির এক টানা রিম ঝিম শব্দে জাকিরের টিনের ঘরের ভিতরে কথা শোনা যাচ্ছিল না। জাকিরের মা এসে বলেছিলো-
-এর মধ্যে আর যাবার কি দরকার এখানেই থাক আজমাকে বলে এসেছ তো?
-হ্যাঁ খালাম্মা আমি সাধারণত মাকে না বলে কোথাও যাই না।
-তাহলে উনি বুঝবেন বৃষ্টির জন্যে যেতে পারনি চিন্তা করবেনা। আমি খিচুড়ি রান্না করছি তুমি কিন্তু যেওনা।
-আচ্ছা খালাম্মা ঠিক আছে থাকবো।
মায়ের পিছনে দাঁড়িয়ে নীলা জিজ্ঞেস করলো-
-ভাইয়া তোর লুঙ্গি এনে দিব রাশেদ ভাইয়ার জন্যে?
-নিয়ে আয়, আবার জিজ্ঞেস করতে হয় নাকি?
লুঙ্গি এনে দাঁড়িয়েছিল
-নে ওঠ, লুঙ্গি পরে হাত মুখ ধুয়ে নে।
সেদিন রাতে বসে বসে দুই বন্ধু সুখ দুখের অনেক গল্প করেছিলো। জাকির বলছিলো-
-তুই এক দিক দিয়ে ভালো আছিস, তুই আমার খবর জানিস না, এই যে আমার মাকে দেখলি ইনি কিন্তু আমাদের মা না।
-মানে?
-মানে আমার মা থাকেন বগুড়া, আমাদের গ্রামের বাড়িতে। আমরা এই এক আমি আর নীলা
-তাহলে ইনি?
-হ্যাঁ ইনি হলেন আমার দ্বিতীয় মা
-আমার বাবা তার অফিসের এক কলিগকে বিয়ে করেছিলেন ইনি সেই।

No comments:

Post a Comment

Back to Top