নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৩৯

৮২।
এর মধ্যে আসাদ সাহেব চলে গেছে। তার জায়গায় প্রবীণ নামে নেপালি এক ছেলে এসেছে। প্রবীণ আসাতে নুরুল ইসলাম নিচের রুমে চলে গেছে। এখন তার রুম মেট প্রবীণ। অল্প বয়সের ছেলে। লেখাপড়ার নাম করে এদেশে
এসেছে কিন্তু কলেজে নাম লিখিয়ে রেখে কাজ করে যাচ্ছে দুই বছর ধরে। মাসে একবার যেয়ে কলেজে হাজিরা দিয়ে আসে। রাশেদ সাহেবের সাথে বেশ আলাপ জমে উঠেছে। কখনো মন খারাপ দেখলেই এগিয়ে আসে, হিন্দিতে কথা বলে।
-ভাইয়া আপনি প্রায় আমার বাবার বয়সের, আপনি এই বয়সে এখানে কেন এসেছেন তা আমি বুঝি। আমার বাবার ব্যবসা যখন খারাপ যাচ্ছিল তখন সেও এখানে এসেছিলো, কয়েক বছর থেকে গেছে। তখন নেপালিদের এখানে আসতে ভিসার প্রয়োজন হোত না। যাই হোক এখন কাঠমুন্ডুতে কাঠের আড়ত করেছে,
স মিল সহ ভালই চলছে। আপনি বেশি চিন্তা করবেন না, চিন্তা করলে শুধু মন খারাপ থাকবে, কাজে মন বসাতে পারবেন না। আর কোন লাভ হবে না। তার চেয়ে হাসি খুশি থাকেন, মন ভালো রাখেন, সুস্থ ভাবে কাজ করেন। আমি আপনাকে বলে দিব কিভাবে কাজ সহজে করতে হয়। আমিও কিচেনে কাজ করেছি প্রথম দিকে। কিচেনে কাজ কষ্টের কাজ, সবচেয়ে ভাল হয় আপনি যদি সামনের কাজ করেন। মাঝে মাঝে সামনে আসবেন, আমি আপনাকে সামনের কাজের কিছু ধারনা দিয়ে দিব শিখে নিবেন। জব সেন্টারে গিয়ে বলবেন আমি সামনের কাজ করি, দুই এক মাস করেছি। ওখানে থাকার সমস্যা তাই অন্য কাজ খুঁজছি। এদেশে মিথ্যা না বললে চলে না, সবাই মিথ্যা পছন্দ করে কারণ মিথ্যা চকচকে হয়। আর সত্য মিথ্যার মত চকচকে হয়না তাই কেও পছন্দ করে না। আপনি যত সুন্দর করে মিথ্যা বলতে পারবেন তত আকর্ষণীয় হবেন। এক সপ্তাহ আমার কাছে দেখেন, তারপর নেক্সট অফ ডেতে লন্ডন গিয়ে জব সেন্টারে সামনের কাজ খুঁজেন ভাল হবে। আপনাকে দেখেই বুঝেছি আপনি এই ধরনের কাজে অভ্যস্ত নন। আপনি কোন বড় ধরনের কাজ করতেন। আপনার চশমা দেখেই বুঝেছি সাধারণ লোকেরা এতো দামি চশমা ব্যাবহার করে না। সেদিন সেফ আর ওসমান আপনার ব্যাপারে আলাপ করছিলো। বলছিলো এই লোকের চশমার দাম বাংলাদেশে দশ হাজার টাকা হবে, এই লোক নিজের পরিচয় গোপন করছে। আমি তখন বারে কাজ করছিলাম ওরা মনে করেছিল আমি বাংলা বুঝি না কিন্তু আমি বংলা বলতে না পারলেও বুঝিআসলে আমি গত দুই বছর ধরে বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টে কাজ করছিকোথাও কিন্তু আপনার মত কাওকে পাইনি। আপনার কথাবার্তা আচার ব্যাবহার সবই অন্যদের চেয়ে আলাদা, সত্যি করে বলেনতো আপনি কি করতেন ওখানে?

-তা শুনে আর কি করবে ভাই। আচ্ছা দেখি তুমি আমাকে কিছু শিখিয়ে দাও, আমি তোমার কথা মতই করব আমার বন্ধুও তাই বলেছে। আমি কোন কূল কিনারা পাচ্ছিলাম না তাই কিছু করতে পারছি না। তুমি যখন বলছ একটা পথ পাবো বলে মনে হচ্ছে। নেক্সট উইকে লন্ডন যাব। আচ্ছা মনে কর কাজ পেলাম, তারপর কি করবো? মানে, এখান থেকে ছুটবো কি ভাবে?
-সেজন্যে ভাববেন না, সেটা আমি বলে দিব কি করতে হবে। আপনি আগে কাজ নিয়ে আসেন তখন দেখব।
-নাও একটু তামাক নাও।
-বানিয়ে দেন আমিতো পারিনা
সত্যি সত্যি এর পরদিন থেকেই প্রবীণের কাছে তালিম নেয়া শুরু করলেন রাশেদ সাহেব। কয়েক দিনের মধ্যে বেশ যত্ন করেই প্রবীণ তাকে খুঁটিনাটি সহ মোটামুটি একটা তালিম দিয়ে দিল। সাথে বলে দিল-
-যা শিখিয়ে দিলাম আপনি যদি মনে রাখতে পারেন কেও বুঝতে পারবে না যে আপনি কখনো সামনে কাজ করেননিশুধু মনে সাহস রাখবেন অসুবিধে নেই। আপনি ইংলিশ জানেন আপনার ইংলিশ ভালোই আমি লক্ষ করেছি, আর কি? বেতনের জন্যে ভাববেন না এখানে যা পাচ্ছেন ওখানেও তাই পাবেন।

৮৩।
পরের অফ ডেতে সকালে উঠে নাস্তা সেরে দেরি না করে বেরিয়ে পরলেন অক্সফোর্ডের উদ্দেশ্যে। চেনা পথ, সেদিন যেখান থেকে গিয়েছিলেন সেই ভাবে এসে অক্সফোর্ড থেকে লন্ডনের রিটার্ন টিকেট কিনলেন। ফিরবেন আগামীকাল। গত সপ্তাহে ফিরোজের সাথে কথা হয়েছে। ও বলেছে সরাসরি ব্রিকলেন যেতে। ওখান থেকে কাজ সেরে তারপর বাসায় আসবে। রাতে ওখানে থাকবে পরদিন সকালে অক্সফোর্ড চলে আসবেন।
বেকার স্ট্রিটে নেমে গেলেন কোচ থেকে। টিউব স্টেশন খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এদিক ওদিক তাকিয়ে কূল কিনারা না পেয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলে সে দেখিয়ে দিল। ঐ যে সামনে দেখা যাচ্ছে, ডানদিকে রাস্তার ওই পাশে। টিউব স্টেশনে পৌঁছে প্রথমে একটা ম্যাপ নিয়ে দেখে নিলেন ব্রিকলেন যেতে হলে এখান থেকে হ্যামারস্মিথ লাইন ধরে অল্ডগেট ইস্টে নামলেই হবে। হিসেব করে জোন এক এবং দুই এর একটা ডে টিকেট নিয়ে নিলেন।
ব্রিকলেন পৌঁছেই সোজা চলে গেলেন চেনা সেই জব সেন্টারের কাছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলেন আরও কয়েকটা জব সেন্টার আছে। তার কাছে সবই সমান। এর আগে যেটায় গিয়েছিলেন সেখানে গেলেন না। অন্য আর একটায় ঢুকলেন। সামনে কয়েকজন দাঁড়ানো। একটু পরেই টেবিলে বসে যে এতক্ষণ অন্যদের সাথে কথা বলছিলো, সে এবারে তাকে বললো-
-বলেন ভাই কি করতে পারি।
-একটা কাজ দরকার।
-সামনে না পিছনে?
-সামনে।
-আগে করেছেন কখনো?
একটু থতমত খেয়ে গেলেন হঠাৎ করে ডাহা একটা মিথ্যা মুখ দিয়ে বের হতে চাইল না। জীবনে যা কখন করেননি যা তিনি মনে প্রাণে ঘৃণা করেন আজ তাই বলতে হবে। সারা জীবন ভরে ন্যায় নীতির বোঝা মাথায় নিয়ে বেড়িয়েছেন। মিথ্যাই যদি বলতে হবে তাহলে এদেশে কেন এলাম? নিজের দেশে যেখানে ছিলাম সেখানে প্রমোশন হোত, বেতনের বাইরেও বেশ কিছু পেতে পারতাম। না, যা চাওয়া যায় তা পাওয়া যায় না। সবাই যেভাবে চলতে চায় সেভাবে চলতে পারে না। এজন্যে চেষ্টার সাথে আরও কিছু প্রয়োজন আর সম্ভবত তা হচ্ছে সাহস, এমন সাহস রাশেদ সাহেবের নেই। দেরি হয়ে যাচ্ছেপ্রবীণের কথা মনে পরে গেলো। মিথ্যা কথা চকচকে হয় তাই সবাই পছন্দ করে। হ্যাঁ, সে তো একথা মেনে নিয়েই এসেছে। মিথ্যা কথা বলবে।
এখন দ্বিধা করার কি দরকার?
-হ্যাঁ করেছি দুই মাস।
-আচ্ছা একটু বসেন।
আশে পাশে দেখলেন বসার কোন জায়গা নেই, একটু সরে দাঁড়ালেন। এবারে অন্যদের কথাবার্তা শুনতে লাগলেন কে কিভাবে কি বলছে। তিন চার জনের সাথে আলাপ সেরে টেবিলের ওপাশে বসা লোকটা এবারে টেলিফোন ধরে কার সাথে যেন আলাপ শুরু করলো। মাঝে মাঝে রাশেদ সাহেবের দিকে তাকাচ্ছে। এবারে তাকেই উদ্দেশ্য করে বললো-
-এই যে ভাই স্কটল্যান্ডে যাবেন?
রাশেদ সাহেব বুঝতে পারলেন না। পাশে দাঁড়ানো এক জন জিজ্ঞেস করলেন আপনার ফ্যামিলি কি এখানে, মানে লন্ডনে?
-না এখানে আমার কেও নেই।
-তাহলে আপনার জন্য কাছে আর দূরের মধ্যে কোন তফাত নেই রাজী হয়ে যান, ওখানে ভালো পয়সা দেয় তবে শীত বেশী।
টেবিলের ওপাশের লোক আবার বললেন -কি বলেন ভাই, যাবেন?
-হ্যাঁ যেতে পারি।
-তাহলে এই যে নেন মালিকের সাথে কথা বলেন।
টেলিফোনের রিসিভার এগিয়ে দিল
-হ্যালো,
ওপাশ থেকে প্রশ্ন, -আপনি কতদিন এই কাজ করেছেন?
-বেশি দিন না মাত্র দুই মাস।
-আচ্ছা, কবে আসতে পারবেন?
-আমি অক্সফোর্ডে এক জায়গায় কাজ করছি তাদেরকে তো এক সপ্তাহ সময় দিতে হবে, আগামী মঙ্গল বারের আগে পারা যাবে না।
-আচ্ছা ঠিক আছে আপনি মঙ্গলবারেই আসেন।
-ঠিক আছে আসতে পারব।
এমন সময় টেবিলের ওপাশের লোকটা বলে দিল বেতনের কথা জিজ্ঞেস করেন।
-আচ্ছা বেতনের ব্যাপারটা বলা যাবে?
-হ্যাঁ, দেখেন আপনি নতুন মানুষই বলা যায়, কাজেই আমি একশ চল্লিশ পাউন্ডের বেশি দিতে পারব না আপাতত।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
-তাহলে এই কথাই রইলো আগামী মঙ্গল বারে আসবেন।
-হ্যাঁ ঠিক আছে, তবে কি ভাবে যাবো ওখানে?
-ভিক্টোরিয়া থেকে ওবান এর টিকেট করবেন। দশ বারো ঘণ্টা লাগবে। সন্ধ্যায় যাত্রা করলে সকালে এসে পৌঁছবেন। এখানে এসে ফোন দিবেন। ঠিকানা ফোন নম্বর সামাদ ভাইয়ের কাছ থেকে নিয়ে নিবেন, আচ্ছা সামাদ ভাইকে দেন একটু আমি বলে দেই।
-এই যে নেন
বলে রিসিভারটা লোকটার হাতে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেনসামাদ ভাই কথা শেষ করে রাশেদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো-
-এই যে ঠিকানা আর ফোন নম্বর লিখে নেন।
এক টুকরো কাগজ আর কলম এগিয়ে দিল। ওগুলি লেখা হলে বললো  দেন বিশ পাউন্ড দেন। রাশেদ সাহেব ঠিকানা লেখা কাগজ পকেটে রেখে ওয়ালেট বের করে দশ পাউন্ডের দুইটা নোট বের করে এগিয়ে দিয়ে বের হয়ে এলেন। বাইরে এসে মনে হলো মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছেন। একটা তৃপ্তির নিশ্বাস ফেললেন। দেলু মিয়ার গালাগালির হাত থেকে মনে হচ্ছে এবারে রেহাই পাবেন। কোন রকমে এই কয়টা দিন কাটাতে পারলেই হলো। হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যে অফিসের নিচে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট বানিয়ে আরাম করে টানলেন। তারপরেও অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েই রইলেন। মুক্তির আনন্দে যেন শীত লাগছে না তবে মনে হচ্ছে ক্ষুধা লেগেছে। হা্তের ঘড়ি দেখে ভাবল ক্ষুধা লাগবেই অন্ধকার হয়ে গেছে, চারটা বাজে। এতক্ষণ নিষ্কৃতির একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিলাম বলে বুঝতে পারিনি। কি খাবো, কি পাওয়া যায় এখানে? এইবার দেখতে পেলেন আশেপাশে অনেক রেস্তোরা আর ফাস্টফুডের দোকান। আগেও ছিলো তখন চোখে পড়েনি। মেইন রোডের দিকে এগিয়ে গেলেনএবারে হাতের ডানে একটা ফাস্টফুডের দোকানের সামনে এসে একটা চিকেন এন্ড চিপস আর এক ক্যান ডায়েট কোক নিয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে আরাম করে নিশ্চিন্তায় আস্তে আস্তে খেলেন। কোন তারা হুড়ো নেই। খেতে খেতে মনে হলো বাসায় যাবার আগে ফিরোজকে একটা ফোন করে যাই যদি আরও কিছু করতে বলে। খাওয়া শেষ হলো। কোকের ক্যানে শেষ চুমুক দিয়ে বিনে ফেলে দিয়ে আবার একটা সিগারেট বানালেন। রাস্তার পাশে একটা ভাঙ্গা বেঞ্চের পাশে বসলেন। মনের আনন্দে অনেকক্ষণ ভরে সিগারেট টানলেন 
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top