চোরাবালি [২]-পর্ব ২



[পূর্ব সূত্রঃ বড় দুলাভাইকে জানালে সে এসে মানিককে তাৎক্ষণিক ভাবে দোকান বিক্রি করে পরিবার সহ ঢাকায় যেয়ে তার পরিচিত শহিদ সাহেবের গার্মেন্টসে চাকরি নেয়ার জন্য বলল। তুই ওখানে যা আমি শহিদকে বলে দিব, যে করেই
হোক একটা ব্যবস্থা করে দিবে। সে আবার শুধু পরামর্শ দিয়েই ব্যাপারটা শেষ করেনি। রীতিমত বিজয়নগর বাজারে গিয়ে বাজার কমিটি এবং ওখানকার গণ্যমান্য লোকদের সাথে আলাপ করে বিস্তারিত জানিয়ে এসেছে। তাদের সাথে আলাপের সময় ময়নার বাবা শেখ বোরহানকেও ডেকেছিল।]


মাস বছর চলে গেল। দেখতে দেখতে দুই বছর পর ফিরে এসে মাজেদ দেখল তার ঘরে রঙ্গিন টিভি সহ কিছু ফার্নিচার আর তার পরীর গায়ে কিছু অলংকার হয়েছে এ ছাড়া আর কিছুই নেই। কি করবে এখন? ডানা কাটা পরীর সাথে অনেক বাক বিতণ্ডা হলো কিন্তু ফলাফল যা হবার তাই হলো। চ্যাঁচামেচি, ঝগড়াঝাঁটি, গালাগালি এবং মারামারি নিত্য দিনের সঙ্গী হলো।
মাজেদ কি করবে কি করবে ভাবতে ভাবতে স্থানীয় চেয়ারম্যান চাচাত ভাই কালামের সাথে পরামর্শ করল।
আরে তুই এত ভাবছিস কেন, আমি আছি না? আমারতো একজন এসিসট্যান্ট দরকার তুই এখন থেকে আমার সাথেই থাকবি! সেই থেকেই সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে গেল। গম বিক্রি করা থেকে সালিস দরবার করা এবং নানা কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে গেল। রাতে বাড়ি ফেরার পথে বা শনিবার ঝিটকার হাটের দিন যা হাতে দিয়ে দেয় এই সম্বল করে ভাইয়ের সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে থাকল। চেয়ারম্যান সাহেব কি করতে চাইছে তা মাজেদকে জানিয়ে দেয় আর মাজেদ সম্ভব হলে তার চেয়ে একটু বেশি করে ফেলে। অন্তত কালাম ভাই যতদিন চেয়ারম্যান আছে তত দিনের জন্য একটা গতি হলো।
ওদিকে বড় শ্রীমান সেলিম আগের মতই গোপনে গোপনে জমি বিক্রি করা বন্ধ করতে পারল না। আজ বৌয়ের শারী, কাল গয়না, পরশু এটা সেটার দাবী মেটাতে তার আর কোন পথ খোলা নেই।

স্বপন এসবের কিছুই জানতে পারেনি। স্বপন জানে তার ভাগে যে পরিমাণ জমি আছে তাতে সেগুলি চাষ করে তার চলে যাবে। এই ভাবনা ভেবে স্বপন বিয়ে করে একটা বৌ নিয়ে এলো। না, এ বিয়ে মাজেদের মত নয়। বাড়ির মা বোনদের দেখে শুনে আনা বৌ। ঢাকার কাছেই শিঙ্গাইর গ্রামে বাপের বাড়ি। শিক্ষিত মেয়ে, সাহানা। বাপের বাড়ি থেকে বিএ পাশ করেই এসেছে। বৌ স্বপনের ঘরে এসেই দেখতে পেয়েছে বাড়ির অবস্থা স্বাভাবিক অন্যান্য বাড়ির মত নয় বিশেষ করে তাদের বাড়ির মততো নয়ই। তার বাবা একজন সফল কৃষক। ওখানে ধান পাটের সাথে নানা রকম শাক সবজি এমনকি পোলাওর ধান পর্যন্ত চাষ করে। ছোট বেলা থেকেই বাবাকে দেখে দেখে অনেক কিছু শিখেছে। সারা দিন কাজ কর্মের ব্যস্ততা সেরে রাতে শোবার পর  মাথায় এসে নানা চিন্তা ভিড় করে। স্বামীর এই অবস্থা দেখে ভাবনার দুয়ার খুলে গেল। কি করা যায়? ভাইয়েরা যে সব জমি বিক্রি করে ফেলেছে সেগুলি উদ্ধারের কোন উপায় নেই। এখন চলতেও হবে, বাচতেও হবে আবার ভবিষ্যতের একটা উপায়ও করতে হবে। কয়েকদিন যাবার পর একদিন রাতে খাবার পর শোবার আগে স্বপনকে মধুর সুরে বলল
কিছু আলাপ করতে চাইছিলাম
কি আলাপ? কাল সকালে করলে হয় না? ভীষণ ঘুম পাচ্ছে
না সকালের আলাপ নয়, এ আলাপ একান্তে করার আলাপ
এমন কি আলাপ, বল শুনি
কয়েকদিন থেকেই ভাবছি এভাবে কত দিন চলবে তাই আমি একটা ভাবনা ভেবেছি
কি ভাবনা বল
তুমি সেদিন বলছিলে দক্ষিণ দিকের ওই জমি নিয়ে একটা প্রজেক্ট করবে, তাহলে করছ না কেন?
এত দিন করিনি কিন্তু এখন তুমি এসেছ এখন করব। আসলে এত টাকা পাব কোথায়?
তাহলে দেরি না করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শুরু কর।  জমি যেখানে যা আছে সেগুলি বর্গা দিয়ে দাও আর একটা মেশিন কিনে এখানে বাড়ির দক্ষিণে ইরির প্রজেক্ট কর, টাকার ব্যবস্থা আমি করছি। এদিকে যাদের জমি আছে তাদের সাথে আজই আলাপ কর। বাড়ির সাথে আমাদের যে জমি আছে ওখানে ভাল সবজি হবে, অঘ্রাণ মাস থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত সবজি করা যাবে। শীত আসার আগে আমি এর ব্যবস্থা করে ফেলব
মেশিন কেনার টাকা কোথায় পাব?
বললামতো আমি ব্যবস্থা করব
তুমি কি করে ব্যবস্থা করবে?
করব, দরকার হলে বাবার আছ থেকে আনব
দেখ যা ভাল মনে কর, এখন চল শুয়ে পরি।
চল
সকালে ঘুম ভাঙলে সাহানা তাড়াতাড়ি নাশতা বানিয়ে স্বামীকে খাইয়ে দিয়ে বলল এখনই যাও তুমি ওদের সাথে আলাপ কর।
যাই দেখি কি বলে

দুপুরের মধ্যে ফিরে এসে সাহানাকে জানাল, সবাইকে পায়নি তবে যাদের সাথে আলাপ হয়েছে তারা মোটামুটি ইতি বাচক জবাব দিয়েছে। যারা বাকি আছে তাদের সাথে সন্ধ্যার পর আলাপ করে সবাইকে নিয়ে একটা মিটিং করে ব্যবস্থা নেয়া যাবে। কয়েকদিনের মধ্যেই মিটিং করে সিদ্ধান্ত হলো স্বপন পানি দিবে এবং এজন্যে ফসলের তিন ভাগের এক ভাগ সে পাবে। জমি থেকেই ভাগের কাজটা করে নিবে। টিউব ওয়েলটা স্বপনের বাড়ির দক্ষিণ পাশে আম গাছের নিচে পোতা হবে ওখান থেকেই নালা কেটে সব জমিতে পৌঁছে দেয়া হবে। অঘ্রাণ মাসে বর্ষার পানি সরে গেলে নালা কাটার ব্যবস্থা হবে। চৈত্র মাসের মধ্যেই মেশিন কেনা, মেশিনের জন্য একটা চালা ঘর করা এগুলি সেরে ফেলবে। আপাতত এই হোক পরের ব্যবস্থা পরে হবে। ফলপ্রসূ আলাপে সাহানার প্রথম পরিকল্পনা কার্যকর হতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে মনে মনে উল্লাসিত হলো এবং রাতের বেলা সে উল্লাসের ঢেউ তার স্বামীর দেহে মনেও ছড়িয়ে দিল।

ভোরে দুইজনেই চোখে মুখে আনন্দের একটা ঝিলিক আর স্বপ্নের ছায়া নিয়ে ঘুম ভেঙ্গে উঠে এক সাথে রান্না ঘরে বসে রুটি আর ডিম ভাজি দিয়ে নাশতা খেয়ে দুইজনে মিলে পুকুর পাড়ে যেখানে শীতকালীন শাক সবজির চাড়া ফলাবে সে জায়গা ঠিক করে আগাছা পরিষ্কার করে কুপিয়ে বীজ বোনার উপযুক্ত করল। সন্ধ্যায় সাহানা বলল
আমি কাল সকালে শিঙ্গাইর যাব
কেন, হঠাৎ করে আবার শিঙ্গাইর কেন?
কেন আবার, বীজ আনতে হবে না? বাবার কাছ থেকে কিছু ভাল জাতের ফুলকপি, টমাটো, ঢ্যাঁড়স আর কাচা মরিচের বীজ নিয়ে আসি
ভাল কথা বলেছ।
বাবার বাড়ি থেকে উন্নত জাতের বীজ এনে বাড়ির সামনে পিছনে স্বপনের দখলে থাকা মাত্র চার বিঘা জমিতে ওই সব  চাড়া বুনে নিয়মিত ভাবে দুইজনে মিলে ভাল যত্ন করে। সময়মত সেচ দেয়া, উপযুক্ত সার দেয়া, কীট নাশক স্প্রে করার কাজ সাহানা নিজেই করে স্বামী স্বপন শুধু তার সাথে থেকে তাকে জোগান দেয়। দেখতে দেখতে আশাতীত ফলন হলো এবং তা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে বেশ লাভ হলো। পাশাপাশি ইরির প্রজেক্ট থেকেও ভাল ফলন পাওয়া গেল। সাহানা নিজেই পাম্প চালান থেকে শুরু করে সমস্ত প্রজেক্ট ঘুরে ঘুরে কোন জমিতে কখন পানি দিতে হবে তা সে নিজেই নিয়ন্ত্রণ করে বেশ মনের মত ফল পেল। পুকুরের জন্যে শিঙ্গাইর থেকে মাছের পোনা এনে আশ্বিন মাসে ছেড়েছিল সেগুলাও এখন বেশ বড় হয়েছে। নিজেদের খাবারতো চলেই কিছু বিক্রিও করা যায়। এ ছাড়া এত বড় বাড়িতে রান্না ঘরের পাশে একটা দোতলা মুরগির খোপ বানিয়ে তাতে উপরে মুরগি আর নিচে হাস পেলে বাড়ির ডিম মাংসের যোগানতো আগে থেকেই করেছে।  আর এই সাথে সারা গ্রামে সোর পরে গেল যে, স্বপন একটা বৌ এনেছে! সবার মুখে মুখে এই এক কথা। স্বপনের সংসারে সুখের কোন অভাব নেই। স্বপন বাড়ির সামনে দক্ষিণের পুকুর পাড়ে বড় বকুল গাছের নিচে বসে সামনে সবজি ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে।

সাহানা এবার নজর দিল স্বামীর  ভাগের জমিগুলি যেগুলি বড় ভাইয়েরা বাগি দিয়ে দিয়েছে সেগুলি নিজেদের আওতায় এনে চাষ করার জন্য।  সাহানার নিয়ম অনুযায়ী রাতে স্বামীকে আনন্দ দিয়ে নিজে কিছু পেয়ে সকালে উঠে স্বামীকে পাঠিয়ে দেয় নতুন কাজে। তেমনি একদিন সকালে ভোরে তোলা ফুলকপি ভাজি আর ডিম ভাজি দিয়ে রুটি খেয়ে স্বপন চলল জমিগুলির বাগির ভাগ ছাড়িয়ে আনতে? কিন্তু দিনান্তে যে সংবাদ জেনে আসল তা মোটেও সুখের কোন  সংবাদ নয়। বড় ভাইয়েরা বিশেষ করে সেলিম এবং মাজেদ এর মধ্যে সব বিক্রি করে ফেলেছে। এটা কেমন করে করল? কিছুতেই স্বপন ভেবে পাচ্ছে না এমন হলো কি করে? এই কাজ কখন করল? বড় দুলাভাই যে নিষেধ করে দিয়েছিল! তাহলে তাকে অমান্য করেই করেছে এগুলি? সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি ফিরে এসে সাহানার সাথে পরামর্শ করে ঢাকায় মেঝ দুলাভাই, বড় দুলাভাইকে মোবাইলে জানাল। বড় দুলাভাই বলল আচ্ছা ভেবে দেখি কি করা যায়। দুই দিন পরে স্বপন আবার দুলাভাইকে জিজ্ঞেস করল
কি করবেন?
এক কাজ কর সামনের শুক্রবারে আমি আসছি তুই ওখানে তাহের, হানিফ, জলিল, বাদল এদেরকে বলে রাখ ওরা যেন নামাজের পরে থাকে আর তাহেরকে বলবি সেলিম, মাজেদ, মানিক দের বলতে যাতে ওরাও উপস্থিত থাকে, ওরা যেন অবশ্যই থাকে ওরা না থাকলে কিন্তু কোন সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। আর শোন, কালাম চেয়ারম্যানকেও বলবি।
ওদিকে সাহানাও তার বাবাকে জানাল সালিশের দিনে যেন সে এখানে আসে।
শুক্রবারে নামাজের আগেই বড় আর মেঝ দুলাভাই সহ সব বোনেরাও আসল। নামাজের পরে সাহানার খোপের মুরগির মাংস, পুকুরের মাছ, ক্ষেতের সবজি দিয়ে ভাত খেয়ে ওই বকুল গাছের নিচে পাতা মাদুরে বসে অপেক্ষা করছে কখন সবাই আসবে। একে একে গ্রামের যাদের বলা হয়েছিল তারা প্রায় সবাই এলো। বাড়িতে খোজ নিয়ে দেখা গেল মেঝ ভাই বাড়িতে নেই। বড় ভাই, সেঝ ভাই এবং চেয়ারম্যানের দেখাও নেই। মোবাইলে কথা বলার চেষ্টা হলো কিন্তু কেও ফোন ধরছে না। তাহেরকে জিজ্ঞেস করল
তুমি কি ওদের জানিয়েছ?
হ্যাঁ আমি সেদিনই জানিয়েছি আবার গতকালও মনে করিয়ে দিয়েছি
কি বলেছিল?
বলেছিলতো আসবে
এমন সময় হারুন আসল। কি, ওরা কেও আসেনি?
তাহের বলল এলেতো দেখতেই
ওরা আসবে না
কে বলল আসবে না?
সেদিন আমি মাজেদের সাথে এ নিয়ে আলাপ করছিলাম ও তখন বলল
স্বপন যদি জমি পায় তাহলে ওকে নিতে বল
কি করে নিবে? তোমরাতো সব বিক্রি করে দিয়েছ
বেশ তাই যদি হয় তাহলে আদালতে যেতে বল
আদালত তোদের তিন ভাইকে জেলে দিবে, তখন কি করবি?
জেলে দিবে কি করে, হিসেব অনুযায়ী আমরা আরও পাব
পাবি কেমন করে, তোদের কি আর কোন জমি আছে?
কেন, বাড়িটা আছে না? দোকান আছে না?
শুনে সবাই স্তম্ভিত হয়ে নীরব হয়ে রইল।  

বাড়ির দক্ষিণে যেখানে তাদের জমির আল দিয়ে হেটে আসতে কয়েক ঘণ্টা লেগে যেত সেখানে আজ স্বপনের কোন দাবী নেই। বড় ভাইয়েরা সব বিক্রি করে দিয়েছে। যে জমির আশায় দিন গুনছে, অপেক্ষা করছে কখন চাষ দিয়ে ফসল ফলাবে। সাহানার জানা আধুনিক চাষ পদ্ধতি প্রয়োগ করবে সে জমি এখন তার কাছে চোরাবালি! অনেকক্ষণ ওই চোরাবালির দিকে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কাছেই নারকেল গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ান সাহানা স্বামীর এই অবস্থা দেখে কাছে যেয়ে ইশারা করে ভিতরে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল
এত চিন্তা করছ কেন? এই বুকে তোমার জায়গা হবে না? মাথা গোজার এই বাড়িটাতো আছে। যেভাবে চলছে, যা আছে এভাবেই আমাদের চলে যাবে, দরকার হলে আমি মাস্টারি করব।

No comments:

Post a Comment

Back to Top