চোরাবালি [২]-পর্ব-১



এই কুত্তার বাচ্চা আর কতক্ষণ বিছানায় থাকবি? রাইতে ঘুম হয় না? রাইত ভইরা কি চুরি করছ? তোর গুষ্টির পিণ্ডির যোগারে যাবি না? যা ওঠ! সকাল বেলা মেঝ ভাবির কণ্ঠে এই সুমধুর বানী শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল স্বপনের! কাকে বলছে?
নিশ্চয় তার স্বামী দেবতা মেঝ ভাইকেই বলছে! ওপাশে আবার মেঝ ভাবির সাথে যোগ দিয়েছে তার গরুটা, সেই ভোর থেকেই হাম্বা হাম্বা শুরু করেছে। করবে না কেন। গরুটা দুইয়ে বাছুরটাকে একটু দুধ খেতে দিলেই হয় শত হলেও ওরইতো প্রাপ্য! না, তা করবে না।  দোয়ানো হয়ে গেলে বাছুরটাকে দূরে বেধে ঘাস খাওয়াবে। আহা অতটুক বাছুর! মা কি আর তাই মেনে নিতে চায়? পশু বলে কি মায়া দয়া কিছুই নেই? বেশ কিছুদিন থেকেই শুরু হয়েছে এমন ধারা। আগে এরকম ছিল না। বাবার জমি যতদিন বিক্রি করতে পেরেছে ততদিন বেশ সুখেই কেটেছে। এমন হতে শুরু করেছে যখন বিক্রি করার মত আর কোন জমি নেই, অভাব এসে  চতুর্দিক থেকে ঘিরে ধরেছে তখন থেকে। লেখাপড়ায় অষ্ট কলা, স্কুলের গণ্ডিও পার হতে পারেনি। কোথায় পাবে সাহেব গিরি করার মত চাকরি? গায়ে গতরে দেখতে কামলা দেয়ার মত হলে কি হবে সে মুরোদও নেই। ওদিকে আবার চাচাত বোনের শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে গিয়ে সেখান থেকে কেমন করে যেন এই চিজ ধরে নিয়ে এসেছে। মাত্র দুই দিনের পরিচয়ে যে মেয়ে মায়ের বাড়ি ছেড়ে অচেনা এক ছেলের হাত ধরে চলে আসতে পারে তার কাছে আর কতটুকই বা আশা করা যায়?
 
চার ভাই চার বোনের সংসার, মা আছে বাবা নেই। বাবা হামিদ খান হঠাৎ করেই এক দুর্ঘটনায় মারা গেল। ঝিটকা বাজারের দোকানের মালামাল কেনার জন্য ঢাকার মৌলবি বাজারে যাতায়াত সেই অনেক দিনের। কেনা কাটা করে লঞ্চে  মালামাল বুকিং দিয়ে বাসে করে চলে আসে। সেদিন বাড়িতে ফিরে আসার পথেই বানিয়া জুরি বাস স্ট্যান্ডের কাছে সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা মারা গেল। মা এত দিন সংসারের কিছুই খোজ খবর নেয়নি, কিছুই জানে না। বড় মেয়ে বিয়ে হয়েছে বেশ অনেকদিন, বছর খানিক আগে মেঝ মেয়েরও বিয়ে হয়েছে তারা তাদের মত ভালই আছে। বড় ছেলেটা কলেজের গণ্ডি এবং মেঝ ছেলে স্কুল শেষ করতে পারল না। বাবা মারা যাবার পর সবাই পরামর্শ দিল বাবার দোকানে বসার জন্য কিন্তু সাহেবদের বাবুগিরি করার মত উপায় হবে না তাতে তাই দোকান ভাড়া দিয়ে দিল। এখন সংসার চলবে কি দিয়ে? জমিজমা বেশ ছিল, প্রায় পঞ্চাশ বিঘা। এই জমি দিয়েই হেসে খেলে দিব্যি চলে যায় এমন সংসার। কিন্তু এতদিন মা ছিল  অতিথির মত, বাবাই দোকান জমি সব সামাল দিত।  কিছুদিন যাবার পর বড় ছেলের একটা চাকরি হলো। কিন্তু চাকরি হবার সাথেই কি আর বেতন দেয়? মাস পূর্তি না হলে যে বেতন মিলে না। চলবে কি দিয়ে? সহজ উপায় একটা আছে, বাড়ি এসে এক বিঘা জমি বিক্রি করে কিছু মাকে দিয়ে গেল আর বাকিটা নিয়ে বড় সাহেব তার কর্মস্থানে চলে গেল। শুধু মাস চলা নয় বৌয়ের চাহিদা অনুযায়ী রঙ্গিন টিভি, স্টিলের আলমারি, ঘরের অন্যান্য ফার্নিচার এগুলিও বাবার জমি বিক্রির টাকা দিয়ে মোটামুটি নির্ঝঞ্ঝাটেই চলছে। যাবার সময় মায়ের হাতে দুই এক হাজার টাকা দিয়ে গেলেই মা খুশি। টাকা কোথায় পেল সে কথা জিজ্ঞেস করার কি প্রয়োজন! গ্রামের মানুষ দশ হাজার টাকার জমি ছয় হাজারে পেলে এমনি করেই কিনে। তারা যে হামিদ খানের জমি কেনার জন্য উন্মুখ হয়ে বসে আছে! যারা কিনে তারা সবাই এলাকারই লোকজন। সবাই জানে এই ছেলে হামিদ খানের জমির বেশ কিছু অংশ পাবে কাজেই ভয় নেই এক সময় রেজিস্ট্রি করে দিলেই হলো। এক ভাই বিক্রি করে তার অন্য ভাইয়েরা কেউ কিছু জানতেও পারে না। 

হরিরামপুরে রেজিস্ট্রি অফিসে যেয়ে সব ভাইকে একসাথে  রেজিস্ট্রি করে দিয়ে আসতে হবে এমন কোন দরকার নেই। যার যখন প্রয়োজন হয় বা টাকার দরকার হয় তখন যার যার মত খরিদ্দার ঠিক করে রেজিস্ট্রি করে দিয়ে আসলেই হলো। কে কতটা পাবে বা অন্য ভাই বোনেরা কে কতটা পাবে তা দেখার প্রয়োজন নেই। আমার এখন টাকার দরকার আমি বিক্রি করলেই হলো। শেষ অবধি যদি কিছু থাকে তখন দেখা যাবে কে কতটা পায়। আমারটা হিসেব করে বাদ দিয়ে দিলেই হবে। এভাবেই চলছে। বড় জন সেলিম চাকরি করে, সরকারি চাকরি তবুও তার অভাব লেগেই থাকে। মেঝ জন সংসার দেখাশুনা করে। জমি বিক্রি করে আনে আর সংসার চালায়। মা কোনদিন জিজ্ঞেস করেনি হ্যাঁরে মাজেদ টাকা কোথায় পেয়েছিস বা চাল কিনে আনলি কি দিয়ে? ওদিকে সেঝ জন মানিক পাশের বিজয়নগর বাজারে ওষুধের দোকান করে। সন্ধ্যার পরে বাজারে এক কোণায় কয়েকজন মিলে নতুন করে আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থা করে নিয়েছে সেখানে জুয়া খেলা হয়। মানিক  তাদের সবার সাথে সংগ না দিলে তার মান থাকে না বলে ওই আড্ডায় নিয়মিত বসে এবং প্রতিদিনই হেরে আসে। এতে করে দোকানের চালান পত্রে টান পরছে এখন কি করে? বন্ধু স্বজনেরা বুদ্ধি দিল আরে তোর বড় ভাই মেঝ ভাই জমি বিক্রি করে শেষ করে দিল আর তুই দোকানের চালানের জন্য ভাবছিস? চল তোকে একটা জাঁদরেল কাস্টমার যোগার করে দিচ্ছি জমি বিক্রি করে দোকানে কিছু মাল উঠাবি আর বাকিটা দিয়ে সন্ধ্যার আসর চালাবি। এই করে করে স্বপনের এবং চার বোনের যে অংশ ছিল তার তলায় এসে পৌঁছেছে। স্বপন সবার ছোট। বড় ভাইদের এই কীর্তি কাহিনী কিছুই বুঝতে বা জানতে পারেনি। ছোট দুই বোন বড় বোনেদের কাছে থাকে বলে বোনেরাও  কেউ কিছু জানতে বুঝতে পারেনি।

স্বপন একটু বড় হলে যখন এতদিনের চেনা নিজেদের জমিতে অন্যদের চাষ করতে এবং ফসল তুলতে দেখল তখন একদিন মেঝ ভাইকে জিজ্ঞেস করল আচ্ছা ভাইয়া ওই জমিটাতো দেখেছি আমাদের ছিল তাহলে ও পাড়ার হাবুলরা কেন চাষ দিল আর ফসলই বা কেন কেটে নিয়ে গেল?
তুই ছোট মানুষ এগুলি বুঝবি না, তোর মাথা ঘামাবার দরকার নেই
বারে, এ আবার কেমন কথা! আমাদের জমির ধান কেটে নিয়ে যাবে আর এ কথা আমার জানার দরকার নেই কেন?
স্বপন এই প্রশ্নের কোন জবাব কোনদিন পায়নি।

দিন থেমে থাকে না। ছয় ঋতুর এই দেশে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা তাদের নির্ধারিত নিয়মে অনেকগুলি বছর নিয়ে চলে গেছে আর সাথে সাথে স্বপনও বড় হয়ে উঠেছে। স্বপনের এখন বিয়ে করে সংসার করার সময় হয়েছে। এর মধ্যে দুই এক জন নিকট আত্মীয় ভাইদের সবাইকে ডেকে পারিবারিক ভাগ বাটোয়ারা করে দিয়েছে। একান্নবর্তী থাকা কালীন বড় ভাইয়েরা যারা কোন রোজগার না করে শুধু বাবার  জমি বিক্রি করে সংসার চালিয়েছে এবং যার যার বৌয়ের সাধ মিটিয়েছে হিসেব করে তাদের হিসাব বাদ দিয়ে বর্তমানে অবশিষ্ট যে পরিমাণ জমি আছে তাই হিসেব করে দেখা গেল বড়রা জমি বিক্রি করার পর তাদের ভাগে আর কোন জমি নেই কেও তার প্রাপ্যের বেশিই বিক্রি করে ফেলেছে। এখন যতটা রয়েছে তা স্বপনের, বোনদের আর মায়ের অংশ। বাড়িটা ভাগাভাগি না হলেও মোটামুটি একটা নির্দেশনা দিয়ে দেয়া হলো যে তোমরা ওখানে ঘর তুলে বসবাস করতে পার। বড়দের চূড়ান্ত ভাবে বলে দেয়া হলো যে তোমরা আর কোন জমি বিক্রি করতে পারবে না। বাজারে যে দোকান আছে সেটা নিয়ে এখন আর কিছু হলো না তবে ওটার ভাড়া বাবদ যে টাকা আসবে সে টাকা মা পাবে এই ভাবে সিদ্ধান্ত হলো। একটা সাদা কাগজে এই মর্মে সর্ব সম্মতিক্রমে যা যা সিদ্ধান্ত হয়েছে উপস্থিত সবার সই স্বাক্ষর নিয়ে লিখে রাখা হলো যেন শ্রীমান সেলিম, মাজেদ এবং মানিক ভবিষ্যতে আর কোন জমি বিক্রির সুযোগ না পায়। অবশ্য এ বিষয়ে আইনগত আর কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। নিতান্ত পারিবারিক সমস্যা মনে করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি।

চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনী। স্বপনের বড় ভাইয়েরাও তেমনি করে সেদিন সই স্বাক্ষর দিয়ে আসলেও দুই এক বছর যেতে না যেতেই আবার সবার অগোচরে কাউকে না জানিয়ে যারা জমি কিনে তাদের সাথে গোপন আঁতাত করে কিছু জমি বিক্রি করতে শুরু করল। এর মধ্যে মেঝ সাহেব মানিকগঞ্জের পাশে চাচাত বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে একজন ডানাকাটা পরী ধরে এনেছে। পরীর নানা চাহিদা মেটাতে গিয়ে শ্রীমান মাজেদ বুঝতে পেরেছে যে জমি বিক্রি করে ভবিষ্যৎ চলবে না কারণ আর তেমন কিছু অবশিষ্ট নেই। এই ভেবে এবং পরীর পরামর্শে বিদেশে যাবার একটা যোগাযোগ পেয়ে আবার আসল জমি বিক্রি করতে কিন্তু তার প্রাপ্য আর কোন জমি না থাকায় স্বপনকে বলল তুই আমাকে মালয়েশিয়া যাবার জন্য হাজার পঞ্চাশেক টাকা ধার দে আমি ওটা বাজারের দোকানের অংশ থেকে ব্যবস্থা করে দিব। সরল স্বপন ভাইয়ের এই দুরবস্থার কথা ভেবে রাজি হয়ে ধার কর্জ করে ভাইকে টাকার ব্যবস্থা করে দিল। কিন্তু ওদিকে মাজেদ যাবার আগে গ্রামের একজনের কাছে গোপনে কিছু জমি বিক্রি করে টাকা নিয়ে পরীর হাতে দিয়ে গেল। স্বপন এর কিছুই জানতে পারল না। মাজেদ মালয়েশিয়া চলে গেল।  মাসে মাসে টাকা পাঠায় আর সে টাকা দিয়ে পরী মনের সুখে সংসার চালায়। ঢাকায় খালার বাড়ি গিয়ে রঙ্গিন টেলিভিশন, গয়না, সুন্দর সুন্দর শারী কিনে আনে।

মাজেদ চলে যাবার পর মানিক বেশ পসার জমিয়ে ফেলেছিল। আশেপাশের রুগীদের প্রেশার মেপে দেয়া, স্যালাইন দেয়া, ইঞ্জেকশন দেয়া এবং সাধারণ কিছু ডাইরিয়া আর জ্বর জারির চিকিৎসায় বেশ হাত পাকিয়ে ফেলেছিল কিন্তু এই পসারের সাথে আর এক দিকেও বেশ পসার জমিয়ে নিয়েছিল। জুয়ার আসরে হাজিরা দেয়া আগে থেকেই নিয়মিত ছিল, এর সাথে আবার নতুন করে যোগ হয়েছে বিজয় নগর বাজারের পাশে শেখ বোরহানের বিধবা মেয়ে ময়নার সাথে মন দেয়া নেয়ার খেলা। ঘরে স্ত্রী সন্তান রেখে ময়নার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। কোন কোন রাতে বাড়িতেও আসে না। ময়নার সাথে অভিসার সেরে অত রাতে বাড়িতে পুরনো হয়ে যাওয়া মর্জিনা আর কাছে আসার কোন আগ্রহ তৈরি করতে পারে না বলে দোকানেই থেকে যায়। নিরীহ মর্জিনা  যন্ত্রণায় অস্থির। কাওকে বলতেও পারছে না আবার নিজের মধ্যে চেপেও রাখতে পারছে না। কিন্তু সে না বললে কি হবে, বিষয়টা বিজয় নগর এলাকায় রাষ্ট্র হয়ে গেছে। এমন অবস্থায় ভেবে ভেবে শরীর মন দুইই যখন দুর্বল হয়ে গেছে যখন এই অবস্থা জটিল থেকে আরও জটিলের দিকে গড়াচ্ছে তখন আর কোন কুল কিনারা না পেয়ে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে মায়ের বাড়িতে যেয়ে মাকে জানিয়ে আসল। মা বলল তোর শাশুড়ি জানে?
সবাই যখন জেনে গেছে তখন সে জানে না এ কথা কি করে বলি?
তুই নিজে তাকে বলে দেখ কি হয়
বলে দেখব কিন্তু কোন লাভ হবে বলে মনে হয় না। ছেলেরা কি মায়ের কোন কথার দাম দেয়? এই যে যার যার ইচ্ছা মত জমিগুলি বিক্রি করে ফেলল তাতে কি মা কোনদিন কিছু বলেছে? কিছুই বলেনি। কাজেই তাকে বললে কিছু হবে না।
তাহলে তোর বড় ননাসকে বল, দেখ সে কি করে।
বড় দুলাভাইকে জানালে সে এসে মানিককে তাৎক্ষণিক ভাবে দোকান বিক্রি করে পরিবার সহ ঢাকায় যেয়ে তার পরিচিত শহিদ সাহেবের গার্মেন্টসে চাকরি নেয়ার জন্য বলল। তুই ওখানে যা আমি শহিদকে বলে দিব, যে করেই হোক একটা ব্যবস্থা করে দিবে। সে আবার শুধু পরামর্শ দিয়েই ব্যাপারটা শেষ করেনি। রীতিমত বিজয়নগর বাজারে গিয়ে বাজার কমিটি এবং ওখানকার গণ্যমান্য লোকদের সাথে আলাপ করে বিস্তারিত জানিয়ে এসেছে। তাদের সাথে আলাপের সময় ময়নার বাবা শেখ বোরহানকেও ডেকেছিল।
[ স্বপন কি তার ভাগের জমি ফিরে পাবে?]

No comments:

Post a Comment

Back to Top