নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-২৫

৫০।
সুন্দর ছাউনি দেয়া ছোট্ট বাস স্ট্যান্ড, কাঁচের দেয়াল, ভিতরে বেঞ্চ আছে। তাকিয়ে দেখল বিভিন্ন বাসের সময় সূচী লেখা পোস্টারের মত কাঁচের দেয়ালে লাগানো। খুঁজে দেখল তার দরকার যে বাস ওটা আসতে আরও দশ পনের মিনিট
বাকি। একটা সিগারেট হলে ভাল হোত কি মনে করে আর সিগারেট বের করলো না। আশে পাশে তাকিয়ে দেখল ডান দিকে একটু দূরে ট্রেন স্টেশন দেখা যাচ্ছে। এবারে ওই জব সেন্টারে দেখা মারুফ সাহেবের দেয়া ঠিকানা টা পকেট থেকে বের করে দেখল জর্জ স্ট্রীট, আবিংডন। রেস্টুরেন্ট এর নাম হোল্ডিং নং মনে থাকবে। চার দিকে দেখতে দেখতেই বাস এসে দাঁড়াল। মাল পত্র নিয়ে উঠে পরতেই ড্রাইভার মাল রাখার জায়গা দেখিয়ে দিল। যাত্রীদের মালামাল রাখার জন্য গেটের পাশে আলাদা জায়গা আছে। ওগুলি রেখে ড্রাইভারকে ২ পাউন্ড ১০ পেনি ভারা দিয়ে টিকেট নিয়ে সামনের একটা সীটে বসলএতক্ষণ কি ভাবনাই না ভাবছিলো। লোকাল বাসে এই মাল পত্র কিভাবে কোথায় রাখবে? সে তার নিজের দেশের মত করেই ভেবে নিয়েছিলো। যাই হোক বেশিক্ষণ লাগেনি কিছুক্ষণের মধ্যেই পথে দু এক জায়গায় থেমে শেষ এক জায়গায় এসে দাঁড়াল বাসটা। লোকজন নামার ভাব দেখেই অনুমান করলো এটাই গন্তব্যের শেষ।
বাস থেকে নেমে আবার এদিক ওদিক তাকিয়ে সুবিধা মত একজনকে ঠিকানাটা দেখাতেই দেখিয়ে দিল ওই যে ওইটা জর্জ স্ট্রিট। এদেশের ঠিকানা খুঁজে বের করার কায়দা লন্ডনে ফিরোজ শিখিয়ে দিয়েছিলো। রাস্তার এক দিকে জোড় নম্বর এবং অপর দিকে থাকবে বেজোড় নম্বর। সেভাবেই এগিয়ে মিনিট পাঁচেক হেঁটে একটু দূর থেকেই রেস্টুরেন্টের নাম দেখতে পেল। কাছে গিয়ে দেখে রেস্টুরেন্ট খোলা। একটু ইতস্তত করে কাঁচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকেই বাংলা চেহারার একজনকে দেখল চেয়ার টেবিল মুছতে। তখন প্রায় একটা বাজে।
রেস্টুরেন্টের ভিতরে ঢুকেই মন ভরান একটা সুঘ্রাণ এলো নাকে। দেখল বাম পাশের পুরোটাই কাঁচের দেয়াল। দেয়াল এর নিচে সুন্দর করে সাজানো সুন্দর সব ঘর সাজাবার গাছ। সামনের দেয়ালে বিভিন্ন ছবির ফ্রেম। মেঝেতে সুন্দর কার্পেট বিছানো, তার উপর দুই জন চার জন বসার মত করে আলাদা আলাদা চেয়ার টেবিল সাজানো। টেবিলের উপর সাদা টেবিল ক্লথ বিছানো তার উপর ছুরি, কাটা চামচ, টেবিল চামচ, ন্যাপকিন, ওয়াইন গ্লাস এবং তার পাশে একটা করে কোয়ার্টার প্লেট। ডান পাশে একটা ছোট কাউন্টার এর মত যার ভিতরে নানান রকমের বোতল। দেখে চিনতে পারলো মদের বোতল। এটা রেস্টুরেন্টের বার। পিছনের দেয়ালে ব্র্যাকেটে আরও অনেক বোতল সাজানো তার নিচে ওই সব মদ পরিবেশনের জন্য বিভিন্ন রকমের গ্লাস। পুরো বারটাই সুন্দর কারুকাজ দিয়ে সাজানো। সামনে দুইটা টেলিফোন, পিছনে একটা টিল, পাশে একটা পিডিকিউ মেশিন যাতে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড দিয়ে লেনদেন করা হয়। সামনে ব্যারেলের লাগার ঢালার কয়েকটা টেপ তাতে বিভিন্ন কোম্পানির লোগো  আঁকা।

৫১।
যে লোকটা চেয়ার টেবিল মুছছিলো সরাসরি তার দিকে এগিয়ে গেলো। লোকটাও তার দিকে এগিয়ে এলো।
-আমি রাশেদ, মারুফ সাহেবের সাথে লন্ডনে জব সেন্টারে
কথা শেষ করতে হলো না। লোকটা সিলেটী বাংলায় বললো-
-হ্যাঁ জানি আপনার আসার কথা তা এতো দেরি করলেন কেন? জানেন না আজ শুক্র বার, আচ্ছা আসেন।
বলে রেস্টুরেন্টের পিছন দিকে ঘুরে বেরিয়ে গেলো। রাশেদ সাহেব শুক্রবার আর মঙ্গলবার এর পার্থক্য কিছু বুঝতে পারল না তবে অনুমান করলো কিছু একটা আছে নিশ্চয়। ভাবতে ভাবতে তাকে অনুসরণ করে যেখানে এসে দাঁড়াল তা দেখে বুঝল এটা রান্নাঘর। মারুফ সাহেবকে দেখল খুব ব্যস্ত। সাথে আরও দুই জন, তারাও ব্যস্ত। সবার পরনে এপ্রণ মাথায় কাগজের টুপি। বড় বড় কয়েকটা চুলা জ্বলছে তাতে বিশাল ডেকচিতে কি কি যেন রান্না হচ্ছেসাড়া রান্নাঘরে যা কিছু জ্বাল হচ্ছে তার মিলিত গন্ধ আর ধোয়া। যারা কাজ করছে তাদের চিৎকার শুনে মনে মনে ভাবছিলো এরা কি স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারেনা? এই সব কিছু মিলিয়ে এক ভিন্ন নতুন জগত বলে মনে হলো । মারুফ রাশেদ সাহেবকে দেখেই বললো-
-যান তাড়াতাড়ি উপরে যান কাপর বদলে চলে আসেন। আজ শুক্র বার, দেরি করে ফেলেছেন।
কোথায় উপরে যাবে কোন কুল কিনারা পাবার কথা নয় তবুও আর কি করা আজ যখন শুক্র বার তখন যাই দেখি কোথায় যাওয়া যায়। শুক্র বারের মহাত্ম পরে জানা যাবে। উপরে উঠেই একটা রুম দেখল দরজা খোলা। আরও দু একটার দরজা বন্ধ। যাই হোক খোলা ঘরের ভিতরেই ঢুকে পরল। মিট মিটে আলোয় দেখল চারটা বিছানা, একটা ছোট টেবিল, দুটা ফোল্ডিং চেয়ার, একটা রুম হিটার। ঘরের মধ্যে নোংরা দুর্গন্ধ। এলো মেলো কাপর চোপর জুতা মুজা ইত্যাদি সারা ঘর ভরে ছড়ান ছিটানো। ঘর জুরে বিছানো কার্পেটটায় যে কখনো রঙ ছিলো সেটা যে কি রঙ তা বোঝার উপায় নেই। এই কি লন্ডনের পরিবেশ? এর মধ্যেই থাকতে হবে তার ভাগ্যের পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত? যাক, ভাগ্যে যা আছে তাই ই তো হবে। এখন এসব দেখার সময় নয়। এক পাশে তার সুটকেস ব্যাগ রেখে কাপর বদলে কাজের জন্য আগে থেকে ঠিক করে রাখা কাপর পরে ফিরোজের দেয়া জুতা জোড়া পায়ে নিচে নেমে এলো।
আবার কিচেনে ঢুকতেই মারুফ ডাকল
-এদিকে আসেন, ওই ঐ দিকে দেখেন একটা বক্স আছে ওর ভিতর এপ্রণ আছে একটা গায়ে দিয়ে আসেন
কথা মত এগিয়ে গিয়ে কাঠের বাক্সটা খুলে এপ্রণ বের করে গায়ে দিয়ে মারুফের সামনে দাঁড়াতেই মারুফ বললো-
-এই যে সিংক এর নিচে উপরে ডেকচি ওই গুলি সব ধুয়ে ফেলেন।
রাশেদ সাহেব তাকিয়ে দেখল সাত আটটা বিভিন্ন সাইজের ডেকচি, সাথে আছে আরও অনেক গামলা বাটি ইত্যাদি। কোথায় কিভাবে এগুলি ধুবে তার কিছুই বলেনি। খুঁজতে লাগল কোথায় ধোয়া যায়। হঠাৎ মারুফ চিৎকার করে উঠল-
-কি হলো ধোয়া হলো? এদিকে আসেন এই যে এখানে এই গুলি সব উঠিয়ে ওই বিনে ফেলেন।
রাশেদ সাহেব হতভম্ব হয়ে জানতে চাইল-
-কোথায় ধুব এগুলি?
-বলেন কি এখনও ধোয়া হয়নি আরে ওই যে এতো বড় সিংক দেখছেন না তাড়াতাড়ি করেন।
হ্যাঁ এতো বড় সিংকই বটে কিন্তু এর মধ্যে যে তার চেয়েও বড় ডেকচি কিভাবে ধোয়া সম্ভব তা বুঝে উঠতে না পারলেও বুঝতে পারল এখানেই ধুতে হবে এবং এখানে এই ভাবেই কাজ করতে হবে। মানিয়ে নিতেই হবেএখন বাছ বিচার করার উপায় নেই। বিশাল ডেকচি, তার একটা উঠিয়ে নিয়ে সিংক এর পাশে লিকুইড সাবান, তারের জালি, সবুজ রঙের হাড়ি মাজার শক্ত প্যাড সব সরঞ্জামই আছে। ঠাণ্ডা গরম পানির টেপ দেখে নিয়ে ডেকচি মাজতে শুরু করলেন। ওই সিংক এর মধ্যে এতো বড় ডেকচি নারা চারা করাই সামাল সামাল অবস্থা। তার মধ্যে ধোয়া! কি করবেন কি ভাবে করবেন কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। এমনি সময় আবার তাগাদা-
-কি ভাই সাহেব হইলো?
অথচ তখনো মাত্র একটা ধুয়ে নিচে নামিয়ে রেখেছেন।
-হ্যাঁ ভাই এই তো হচ্ছে।
এই ভাবে মোটামুটি আধ ঘণ্টার মধ্যে ধোয়া হলো। ওদিকে অন্য যারা ছিলো তারা যে তামাশা দেখছে আর সিলেটী ভাষায় নানান রকম অশ্লীল মন্তব্য করছে তা নীরবে শুনে যাচ্ছেন। ওরা ভাবছে লোকটা আমাদের কথা বুঝতে পারছে না। কেও কেও ফাঁকে ফাঁকে কৌতূহল মেটাচ্ছেন।
-ভাইছাবের বাড়ি কোথায়, নাম কি, ছেলে মেয়ে কয় জন, ফ্যামিলি কোথায়, কবে এসেছেন, কি ধরনের কত দিনের ভিসা, কেন এসেছেন এখানে আর কে আছে, আগে কখনো এসেছেন কিনা, দেশে কি করতেন????
ইত্যাদি যা সাধারণ বাঙ্গালির সাধারণ কৌতূহল। রাশেদ সাহেব বিরক্ত হলেও বেছে বেছে কিছু প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাচ্ছেন। নিজে কোন প্রশ্ন করছেন না, বিরক্তি প্রকাশ করছেন না। এদের সাথেই থাকতে হবে।
মনি চলে যাবার ব্যথা, অচেনা পরিবেশ, অনভ্যস্ত কাজ। এমনিতেই কোমরে ব্যথা হচ্ছে, হাত দুটা অবশ হয়ে আসছে। সেই ভোরে উঠেছে, পা দুটা শরীরটাকে আর দাঁড় করিয়ে রাখতে চাইছে না তার পর এই সব মন্তব্য। মনের ভিতর শুধু ঝর বইছে, প্রচণ্ড ঝর। ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে। অনন্ত ধারায় মনরক্ত ঝরছে, আর থাকতে পারছেনা শরীর। রাশেদ সাহেব জানে না আর কতক্ষণ চলবে এই ভাবে। এক সময় ওগুলি ধোয়া শেষে অন্যান্য কাজ যা বলেছিলো তা শেষ হলে পর একজন বললো-
-এই যে ভাই সাহেব একটু হাত চালিয়ে কাজ করবেন, আরও ফাস্ট করবেন। আচ্ছা ওই যে ওই ব্রাশ টা নিয়ে এবার কিচেনের ফ্লোরটা ঝাড়ু দিয়ে ফেলেন। তার পর ওই যে দরজার বাইরে ওই ঘরটা দেখা যায় ওখান থেকে এক বস্তা পিঁয়াজ এনে ছিলবেন।
মারুফ বললো -
-কেন পিঁয়াজ লাগবে কেন পিঁয়াজ তো ওই বালতিতে আছে
-ও আচ্ছা থাক তাহলে পিঁয়াজ আনা লাগবে না।
রাশেদ সাহেব ভাবলেন যাক এখন না হয় লাগল না কিন্তু পরে আমাকেই আনতে হবে। এটাও তা হলে আমার কাজ।
কিচেন ঝাড়ু দেয়ার পর লক্ষ করলো আড়াইটা বাজে। একটু দুই মিনিটের জন্য দাঁড়াবার সুযোগ পেয়ে কবির নামে ছেলেটাকে বললো-
-এখন কি কাজ?
-না এখন শেষ।
এর মধ্যে সবাই যাদু মন্ত্রের মত কিচেন ছেড়ে চলে গেছে।
-উপরে চলেন আপনার বিছানা দেখিয়ে দেই। আসেন আমার সাথে। আচ্ছা এক মিনিট, ওই যে ওই দরজা টা বন্ধ করে আসেন, ঠাণ্ডা বাতাস আসবেউপরে যাবার সময় সব সময় ওই দরজা বন্ধ করে যাবেন।
এই বলে কবির আবার নিচে নেমে এলো।
-আসেন আমার সাথে আপনাকে দেখিয়ে দেই।
ওই দরজা দিয়ে বাইরে এলো। রাশেদ সাহেবও এলেন ওর পিছে পিছে বাইরে আসতেই ঠাণ্ডায় সমস্ত শরীরে কাঁপুনি দিয়ে উঠল কিন্তু তা চেপে দাঁত কামড়ে রেখে তাকিয়ে দেখলো পিছনটায় কাঠের বেড়া দিয়ে ঘেরা। ভিতরে একটা গাড়ি। ও পাশে একটা ছোট কাঠের ঘর। ঘরের ভিতরে আলু পিঁয়াজের বস্তা, আদা রসুন, ধনে পাতা, ক্যাপসিকাম, গাজর, ফুল কফি, আরও অনেক কিছু।
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top