আলো আঁধারির ভূত

মানিক তখন ফরিদপুর জেলার পাংশা থানায় তার এক আত্মীয়ের বাড়ি লজিং থেকে পড়াশুনা করে। পাংশা স্কুলের শেষ বর্ষের ছাত্র। ভারত স্বাধীন হবার অল্প কিছুদিন পরের ঘটনা। তখন গ্রামে গঞ্জে বিজলি বাতি চালু হয়নি। মাটির পিদিম বা

কুপি বাতির প্রচলনই বেশি তবে খুব খানদানি যারা তারা দুই এক ঘরে হারিকেন জ্বালায়। তখন কেউ টর্চ লাইট চিনতই না।  এমনি কোন এক সময় মানিকের স্কুলের ছুটি শেষ হয়ে গেছে কাজেই আগামী পরশু স্কুল খোলার আগেই পাংশা যেতে হবে বলে মাকে জানিয়ে দিয়েছে। মা এমনিই আজ না কাল যাবি করে করে তিনটা দিন কমিয়ে দিয়েছে। আজ যেতেই হবে। মা, ছোট চাচি, বড় চাচি সবাই যেতে নিষেধ করছে, বলছে আর একটা দিন থাক।
এই কয় দিন রইলি একটা পিঠা বানাইবার পারলাম না গুড় নাই বইলা আইজ গুড় পাইলাম আর তুই চইলা যাবি?
না, মা আইজকাই আমার যাওয়া লাগব।
দেখ, আমরা সবাই নিষেধ করতেছি এই বাধা ডিঙ্গাইয়া গেলে তোর পথে কু লাগবআইজকের দিনটা থাইকা কাইল সকাল সকাল যাবি।
তোর মা এত দিনে গুড় পাইছে বইলা পিঠা বানাইবার জন্য চাইল ভিজাইছে আর তুই এই পিঠা না খাইয়া কেমনে যাবি? না চাচি আমার ক্লাস শুরু হইব কাইল কাজেই আর দেরি করার উপায় নাই সামনে ফাইনাল পরীক্ষা!
কোন মতেই যখন মানিককে ঠেকান যাবে না তখন মা বলল
ঠিক আছে যাবি যা, তয় সাবধানে যাইস। সবাই না করতেছে সেই নিষেধ না মাইনা যাবি আমার মনডায় কেমন জানি কু ডাকতেছে
না মা তুমি কোন চিন্তা কইর না।

মানিক মায়ের দেয়া পোটলা পাটলি নিয়ে ঝিটকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। ঝিটকা থেকে কদম তলি আবার কদম তলি থেকে নৌকায় পদ্মা পাড় হয়ে গোয়ালন্দ। গোয়ালন্দ থেকে ট্রেনে পাংশা। সারা পথ বেশ ভালই এসেছে শুধু গোয়ালন্দ থেকে ট্রেন ছাড়তে দেরি হয়েছিল বলে পাংশা পৌছাতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেল। সূর্য ডোবার বেশ অনেকক্ষণ পরে পাংশা এসে পৌঁছল। স্টেশন থেকে বের হয়ে দেখে চার দিকে ঘুট ঘুটে অন্ধকার, এর মধ্যে ঝি ঝি পোকা ডাকছে, এ ছাড়া আর কোন সারা শব্দ নেই। দুইটা জোনাকি একটুখানি আলো জ্বেলে আবার একটু লুকোচুরি খেলার জন্য কোথায় যেন চলে গেল। মানিক এসব দেখে একটু ঘাবড়ে গেল ঠিকই কিন্তু ভয় পেল না। ভয় পেলে  খোলা বিলের মধ্যে দিয়ে কি করে দুই মাইল পথ এই অন্ধকারে একা একা যাবে? নিরুপায়, কোন সঙ্গী না থাকলেও তাকে যে একা যেতেই হবে!

স্টেশনের বাইরে ঘুণ্টি ঘরের মত ছোট্ট দোকান থেকে এক প্যাকেট শালপাতার বিড়ি আর একটা দিয়াশলাই কিনে একটা বিড়ি জ্বালিয়ে প্যাকেট পাজামার পকেটে ভরে হাতে সাথের বোচকাটা নিয়ে হাটা শুরু করল।

ঘুট ঘুট অন্ধকারের মধ্যে আরও বেশি অন্ধকার হলো চারিদিকে অঘ্রাণ মাসের একটু একটু কুয়াশা। কুয়াশায় পথ দেখতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। রাতের আকাশে যতই অন্ধকার থাকুক অন্ধকারেরও একটা আলো থাকে কিন্তু আজকের অন্ধকার যেন মানিকের সাথে বিদ্রূপ করছে। একটুও আলো নেই ঘুট ঘুটে অন্ধকার নিঝুম নিস্তব্ধ। সামনের রাস্তার কিছুই প্রায় দেখা যায় না। আকাশে শুধু দুই একটা বাদুরের উড়ে যাবার শব্দ পাচ্ছে মাঝে মাঝে। মা চাচিদের কথা মনে হলো। তারা আসতে নিষেধ করেছিল কিন্তু সবার কথা উপেক্ষা করে কিছুটা গোঁয়ার্তুমি করেই বেরিয়ে এসেছে। এখন তার খেসারত দিতেই হবে। মা বারবার বলেছে আমার মনে কু ডাকতেছে তুই আইজকের দিনটা থাইকা কাইল যা। কিন্তু মায়ের কথাটাও রাখেনি।


আইলের পথে গ্রামের সীমানা প্রায় শেষ। এইতো সামনেই বিল শুরু হবে। হঠাৎ সামনে এটা কি এসে দাঁড়াল? হাটা থেমে গেল! সাহস করে ভাল করে চেয়ে দেখে একটা কুকুর। এখানে এই সময়ে কুকুর! একটু নয় বেশ অবাক হলো! আশে পাশের গ্রামের লোকজন রাত দুপুর মনে করে বাতি নিভিয়ে কাঁথা গায়ে শুয়ে পরার আয়োজন করছে আর ইনি এখানে এলেন কি করে? যাক যেভাবেই আসুক। পাশের কলই ক্ষেতের বেড়া থেকে কায়দা মত একটা খুঁটি উঠিয়ে হাতের লাঠি বানিয়ে একটু হট করতেই মনে হলো লাঠির সাথে উঠে আসছে! গা ছম ছম করে উঠল। মনে হচ্ছে সাধারণ কুকুর নয়! তাহলে? দাঁড়াল। পকেট হাতিয়ে বিড়ি দিয়াশলাই বের করে একটা বিড়ি জ্বালিয়ে কাঠিটা ওই কুকুরের দিকে ছুড়ে দিল। কাজ হলো মনে হচ্ছে! একটু ঘেউ করে পাশ কাটিয়ে পিছনে চলে গেল। মানিক লাঠিটা ফেলে না দিয়ে কাঁধে করে নিয়ে চলল, কি জানি সামনে কি আসে কে জানে। কাজে লাগবে। ওই দূরে গ্রামের বাড়িতে কোন আলো দেখা যাচ্ছে না সবাই ঘুমিয়ে পরেছে। রাত অনেক হয়েছে। একটু এগিয়ে পিছন ফিরে দেখে নিল কুকুর চলে গেছে নাকি তাকে অনুসরণ করছে। না ও চলে গেছে। দাড়িয়ে একটু ভাল করে যতদূর চোখ যায় দেখে নিশ্চিত হয়ে নিল। না, এটা আসলেই কুকুর, হয়ত কোথাও নেমন্তন্ন খতে গিয়েছিল। বিলের মাঝে আবার কিছুটা পথে জলা ভূমি। জলাভূমি হলেও মাঝের আইলটা বেশ চওড়া। হাটতে কোন অসুবিধা হয় না। এদিকে সরষে বুনছে বেশির ভাগ জমির নাড়া তুলেনি তার মধ্যেই কলই বুনেছে কোথাও একটু বেড়ে উঠেছে। হাটা পথের আইল বা হালটের দুই পাশে যতটা দেখা যায় প্রায় একই রকম। আজ কি অমাবস্যা নাকি? আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল। মনে হচ্ছে তাই, এই জন্যেই এত অন্ধকার। একটা তারাও দেখা যাচ্ছে না।

গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে এসেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। বিলের জলা ভূমি যেখান থেকে শুরু হয়েছে সেই জায়গা এইতো সামনেই।  এক হাতে বোচকা আর এক হাতে লাঠি। মানিক মিয়া লাঠিটা বগলে চেপে একটা বিড়ি জ্বালিয়ে নিল। দ্রুত হাটার চেষ্টা করছে। সামনের এই জলা এলাকাটা খুব সুবিধার নয়, নানান বদনাম শোনা যায়। একে কাদায় পুতে রেখেছিল, ওকে টেনে টুনে কোথায় নিয়ে যায়, ছাগল এসে পায়ে জড়িয়ে বাধা দেয় আর অমনি উপুড় হয়ে পড়ে যায়, পথের পাশে কেউ নাকি সুরে কাঁদে অথচ কাউকে দেখা যায় না এমনি নানা কিছু। হঠাৎ সামনে যেখানে জলা প্রায় শেষ হয়েছে রাস্তার ওই দিকে চোখ গেলে এক অদ্ভুত দৃশ্য চোখে এলো। একটা আলো একবার জ্বলছে আবার নিভছে। থমকে দাঁড়িয়ে পরল মানিক। কি হতে পারে? সজাগ

দৃষ্টি রেখে কান পাতল। একটু একটু খপ খপ শব্দ হচ্ছে না? ভাল করে কান পেতে শুনল! হ্যাঁ তাইতো! আলোটা যখন জ্বলছে তখন খপ করে একটা শব্দ হচ্ছে। হাতের বিড়ি শেষ হয়ে গেছে। মানিক রীতিমতো দোয়া কালাম পড়তে শুরু করল। নিজের অজান্তেই বগলের লাঠির অস্তিত্ব খুঁজে দেখে নিল। ভয়ে সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে। এদিক ওদিক খুঁজে দেখে কিংবা চিৎকার দিয়ে কোন লাভ নেই এই এলাকার এক মাইলের মধ্যে কোন বসতি নেই এমনকি কেউ যে এই পথে চলাচল করবে তেমন কোন সম্ভাবনাও নেই কারণ অঘ্রাণ মাসের শীতে সবাই কাঁথা গায়ে নিঝুম নিদ্রায় আচ্ছন্ন। কে আসবে? কেউ আসবে না! কিছুক্ষণ দাড়িয়েই রইল। না, দাঁড়িয়ে থাকলে কি হবে বাড়ি যেতে হবেতো! মা বলে দিয়েছিল এমন সময় পরনের গেঞ্জি উলটো করে পরলে কোন কিছু কাছে আসতে পারে না! হাতের ব্যাগ আর বগলের লাঠি নামিয়ে রেখে জামা খুলে গেঞ্জি উলটো করে পরে নিল এবার জামা চাদর গায়ে দিয়ে বোচকা আর লাঠি হাতে হাটতে শুরু করল আবার। এক পা যায় তো দুই পা পিছায়। সেই একই রকম আলোটা জ্বলছে আবার নিভছে। জ্বলার সময় খপ করে একটা শব্দ হচ্ছে। কোন পরিবর্তন নেই। না, দেখে শুনে এভাবে এগুনোটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। এবার আর এক কাণ্ড। আলোটা স্থির হয়ে জ্বলছে এবং কোন শব্দ হচ্ছে না। দেখি একটু সামনে যেয়ে দেখি। আবার আস্তে আস্তে হাঁটছে। বেশ কাছে চলে এসেছে। আবার শুরু হলো সেই আগের মত আলো জ্বলা নেভা আর তার সাথে খপ খপ শব্দ। ওই দেখে মানিক আবার দাঁড়ালঅঘ্রাণ মাসের শীতের মধ্যেও সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গেছে, বুক ঢিব ঢিব করছে, হাঁটু কাঁপছে। এক পা এক পা করে এগুচ্ছে। বেশ অনেকটা কাছে চলে এসেছে। একটু একটু নড়াচড়ার মত দেখা যাচ্ছে মনে হচ্ছে কেউ কিছু করছে। কিন্তু এই রাত দুপুরে এখানে এই বিলের মধ্যে কে কি করছে? অনেক সাহস করে জিজ্ঞেস করল এই কে কি করে ওখানে?
ওপাশ থেকে জবাব এলো, কে?
মানুষের কথা শুনে মানিকের প্রাণ ফিরে এলো মনে হয়।
আমি মানিক, পাতুরিয়া যাব।
ও আচ্ছা, আস
এবার মানিক একটু দ্রুতই এগিয়ে গেল। কাছে গিয়ে দেখল এক লোক জলা ভূমিতে মাছ ধরার জন্য ছোট একটা বাধ দিয়েছে আর বাধের ভিতর থেকে পানি সেচে ওপাশে ফেলছে, হারিকেনটা আইলের উপরে রয়েছে। লোকটা যখন নিচু হয়ে পানি তুলে তখন হারিকেনের আলো বাধা পায় তাই আলোটা নিভে যায় বলে মনে হয় আবার ওপাশে পানি ফেলে যখন সোজা হয়ে দাঁড়ায় তখন হারিকেনের আলো বাধাহীন ভাবে দেখা যায় তাতে মনে হয় জ্বলছে আবার পানি পরার সময় খপ করে শব্দটা হয়। একটু একটু করে মানিক কাছে এলে লোকটা পানি সেচা থামিয়ে জিজ্ঞেস করল
ওই মিয়া এত রাইত করলা কেন? কই যাইবা?
কইলামনা পাতুরিয়া যামু
কাগো বাড়ি যাইবা?


মল্লিক বাড়ি
ও তুমি ওই বাড়ির মাস্টার নাকি?
হু
রাইত বিরাইতে একলা চলাফেরা ভাল না। এত রাইত করলা কেন? দেও দেহি বিড়ি থাকলে একটা দিয়া যাও
আছে এই নেন
পকেট থেকে বিড়ির প্যাকেট বের করে দুইজনে বসে কিছুক্ষণ টেনে মানিক বলল
আমি যাই এহনও মেলা দূর যাওন লাগব।
আইচ্ছা সাবধানে যাইও।

No comments:

Post a Comment

Back to Top