তাল গাছের ভূত

কয়েক দিন হলো মেরাজ মামা বাড়ি বেড়াতে এসেছে। ক্লাস এইট থেকে নাইনে উঠেছে এমন দিনে স্কুল বন্ধ হলে মামা বাড়ি হলো আসল ছুটি কাটাবার জায়গা, সারা দিন আড্ডা আর টো টো করে ঘুরে বেড়ালে কেউ নিষেধ করে না। এ ডাল

থেকে ঘুঘুর ছানা নিয়ে আসা ওই ঝোপের আড়াল থেকে পাকা টস টসে হলুদ গাব পেড়ে আনা মানে একেবারে স্বাধীন জীবন। কেউ নিষেধ করে না। কি মজা! এত স্বাধীনতা রেখে কি আর নিজের বাড়িতে বাবার ধমকানি মায়ের হুকুম এত কিছু সহ্য করা যায়? সবাই জানে মেরাজের খুব সাহস। মেরাজ নিজেও এ কথা খুব জোর দিয়েই বলে বেড়ায়। আসলে সাহসের প্রশ্ন এলেই মেরাজের উদাহরণ দেয়া হয়। মোট কথা মেরাজ খুব সাহসী ছেলে একথা এ গায়ের সবাই জানে। আর সবাই মোটামুটি অপেক্ষায় থাকে মেরাজ কখন আসবে। মেরাজ আসলে তাকে দিয়ে কিছু দুঃসাহসিক কাজ করিয়ে রাখতে হবে যা এ গায়ের ছেলেদের দিয়ে হচ্ছে না! এই গায়ের নাম গালা আর মেরাজদের বাড়ি এই গ্রাম থেকে মাইল পাঁচেক দূরে উত্তর দিকে তাড়াইল গ্রামে, ঢাকা আরিচা রোডের ধারে। মেরাজের বন্ধু যারা আছে তারা হলোঃ মাজেদ মানে মেরাজের মামাত ভাই ওর সাথে ওই দোপ চকের বিলে ফাঁদ পেতে বক শিকার করতে মেরাজের বেশ ভাল লাগে। আরও আছে সেলিম ও পাড়ার কুদ্দুস, শিপলু আর বিজয় নগরের নরেন।

গত কয়েক দিন ধরে তাল তলা দিয়ে যাতায়াতের সময় অনেকেই ভয় পাচ্ছে। মাজেদদের এই তালগাছ থেকে ওই ও পাড়ার কুদ্দুসদের বাড়ি যেতে যে তাল গাছ ওই গাছে দুই পা রেখে কোন এক ভূত দাঁড়িয়ে থাকে। শুধু দাঁড়িয়ে থাকে না রীতিমত সবাইকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকে। আবার ওই ধুসুরিয়ার চৌরাস্তার বট গাছেতো রীতিমত এক ভূত থাকে যে কিনা সন্ধ্যার পরে পরেই গাছের মাথায় নাচের অনুষ্ঠান শুর করে দেয়। সেখানে রীতিমত আশে পাশের যত মেটে ভূত, লম্বা ভূত, মোটা ভূত, শাঁকচুন্নি, মেছো ভূত আছে সবাই মিটিং করে। এই এলাকার লোকজনেরা খুব চালাক হয়ে গেছে ওই ঢাকি জোড়ার হরি দাস ওঝাকে দিয়ে সব বাড়ির সীমানায় কাঠি পুতে রেখেছে বলে এরা আর সহজেই সব জায়গায় অবাধে যাতায়াত করতে পারে না। কাজেই ওরা এখন সবাই এ পাড়ার লোকদের নানা ছুতা ধরে নানা সাজ ধরে নানান উপায়ে ডর ভয় দেখাতে ব্যস্ত। অমাবস্যা, সকাল সন্ধ্যা, ভর দুপুরে কাউকে একা পেলেই হলো। এইতো সেদিনও মাজেদের বাবাকে কি হেস্ত নেস্তই না করেছিল! ঝিটকার হাট থেকে খালইতে করে মাছ নিয়ে সন্ধ্যার একটু আগে একা ফিরে আসছিল তাল তলা দিয়ে। আর পিছন থেকে মাছের খালই ধরে টানাটানি।

সেদিন দুপুরে পশ্চিমের ওই শুনা ভিটার পাশে বিশাল তেঁতুল গাছের নিচে হালটের কিনারায় বসে এই নিয়েই আলাপ হচ্ছিল। মামার কথা শুনে মেরাজ ক্ষেপে গিয়ে বলে উঠল
মামাএই অবস্থা করেছে? আসলে তোরা সবাই ভীতুর ডিম কারো একটুও সাহস নেই! আমি হলে মজা দেখিয়ে দিতাম!





তাহলে আর বলছি কি? তুই কি পারবি রাত দুপুরে ওই তালগাছের নিচে দিয়ে একা যেতে?
পারব। কিন্তু বল যদি পারি তাহলে কি দিবি?
কি আবার দিব! আমরা বুঝব তোর সাহস আছে!
না এমনিই হবে না, বল কি দিবি তাহলে একটু দেখিয়ে দিতাম!
নরেন বলল আচ্ছা তুই এপাশের রাস্তা থেকে তালগাছের নিচে একটা খুটি পুতে দিয়ে ওই ওপাশের রাস্তা পর্যন্ত যাবি তাহলে তোকে ঝিটকার হাটের দিন হাটে নিয়ে আমাদের দোকান থেকে পেট ভরে রসগোল্লা খাওয়াব। যাবি? পারবি?
হু, পারব, কবে যেতে হবে?
আজই চল, দেখিয়ে দে
আচ্ছা ঠিক আছে
পাকা কথা?
হ্যাঁ, কথা পাকা!
ঠিক আছে। তাহলে আজ সবাই মাজেদদের বাড়ি আসবি ওখান থেকে শুরু হবে ঠিক রাত ১২টায়, কি ঠিক?
হ্যাঁ ঠিক
সবাই একটু এগিয়ে মেরাজের পিঠ চাপরে বলল সাবাস মেরাজ! আজই দেখা যাবে
এ চুক্তির পরে সবাই যার যার মত চলে গেল। মাজেদ আর মেরাজ বাড়িতে আসার পথে মাজেদ বলল মেরাজ তুই কিন্তু ভুল করছিস, আমার মনে হয় তুই পারবি না
আরে ধুর কি বলছিস মাজেদ, দেখ না কি হয়
আচ্ছা ঠিক আছে দেখব!
রাতের খাবার খেয়ে সবাই একে একে এসে হাজির। নরেন, কুদ্দুস, রহিম, জসীম, শিপলু সবাই এসে হাজির। এটা সেটা নানান হাবিজাবি গল্প। এই এলাকায় যত ভূতের কাহিনী আছে তাই নিয়েই রসালো আলাপ চলছে। ওদের মধ্যে সবার চেয়ে ভিতু শিপলু বলল
তোরা যাই বলিস না কেন আমার মনে হচ্ছে মেরাজ একটা ঝামেলা বাঁধাবে!
শিপলুর এই কথায় কুদ্দুসও সায় দিয়ে বলল
আমারও তাই মনে হচ্ছে।
আবার নরেন বলল নারে
আমার মনে হয় ও পারবে! আচ্ছা ঠিক আছে দেখা যাক না কি করে! এইতো আর একটু পরেই দেখা যাবে।

সে রাতে খেতে বসে মেরাজ মাছের তরকারি নেয়নি, মামি বারে বারে জোর করছিল। শত হলেও মামা বাড়ি বেড়াত এসেছে ভাল করে না খাওয়ালে মামির বদনাম হবে। না মেরাজ কিছুতেই মাছের তরকারি নিবে না। মাজেদ ওর দিকে তাকাল কিন্তু দুই ভাইয়ের মধ্যে কি কথা হলো কে জানে শেষ পর্যন্ত মাজেদ বলল
থাক না মা ও খেতে চাইছে না শুধু শুধু জোরা জুরি করে কি হবে!


মামি আশ্বস্ত হয়ে কিছু বলল না। কোন ভাবে কিছু গিলে মেরাজ আর মাজেদ বৈঠক খানায় এসে দেখে প্রায় সবাই এসেছে। ওদের সবাইকে দেখে মামা বাড়ির রাখাল বরকত জানতে চাইল,
কি খবর সব সাহেব দেখি হাজির, কোন মতলব আছে?
না বরকত ভাই এমনিই মেরাজ এসেছে তাই গল্প করতে এসেছি
না আমি ভাবছিলাম মেরাজ এলেইতো তোমরা কিছু না কিছু একটা কাণ্ড ঘটিয়ে বস কিনা কাজেই জানতে চাইলাম।
না বরকত ভাই আপনি একটুও ভাববেন না।
ঠিক আছে ভাবতে না হলেই ভাল
বরকত তার ঘরে যেয়ে শুয়ে পরল।
গল্প চলছে আর ঘড়ি ঘুরতে ঘুরতে রাত বাড়িয়ে চলেছে, সাথে বাড়ছে অন্ধকার। শীতের রাত এমনিতেই সন্ধ্যা লাগার সাথে সাথেই প্রায় গভীর হয়ে যায়। তারপরে চারিদিকে থাকে কুয়াশার চাদরএকটু দূরেও দেখা যায় না।

ঘড়ি দেখে নরেন বলল চল তাহলে এখন যেতে হয়। চল। সবাই উঠে বাড়ির বাইরে নেমে এসে পুকুর পাড় হয়ে আইলের পাশে দাঁড়াল। মেরাজ শোন, তুই এখান থেকে যাবি আর ওই তাল গাছের নিচে মাজেদদের জমিনে যে কলই বুনেছে ওই ক্ষেতের কোণায় এই খুঁটিটা পুতে রেখে আসবি তাহলে আমরা বুঝব হ্যাঁ সত্যিই তুই ওখানে গিয়েছিলি, ঠিক আছে? বলেই হাতের ছোট একটা খুঁটি আর খুঁটি পোতার জন্য একটা ছোট মুগুর মেরাজের হাতে ধরিয়ে দিল।
তাহলে শুরু কর, তোর অবশ্য ভয়ের কিছু নেই আমরা এখানেই থাকব যদি মনে হয় নিতান্ত ভয় পাচ্ছিস তাহলে আমাদের ডাকবি। 
মেরাজ পরনের লুঙ্গি ভাল করে পরে নিল, গায়ের চাদর ভাল করে গায়ে জড়িয়ে খুঁটি আর মুগুর নিয়ে চারিদিকে একবার দেখে নিয়ে সোজা হেটে চলল।

এখানে ওরা সবাই দাঁড়িয়ে রইল। ঘাসের উপরে বসার উপায় নেই কুয়াশা পড়ে ভিজে গেছে। মেরাজের যেতে মিনিট পাঁচেক লাগবে কাজেই এর মধ্যে চুপচাপ থাকাই ভাল। ওখানে গিয়ে যখন খুঁটি পুঁততে থাকবে তখন মুগুরের শব্দ হবে। শব্দ হলেই বুঝব মেরাজের মিশন পূর্ণ হতে চলেছে।
সময় আর যেতে চাইছে না। প্রতিটা সেকেন্ড এক ঘণ্টার মত মনে হচ্ছে। নরেনের ঘড়ির কাটা ঘুরতে চাইছে না। সবাই অস্থির। শুধু পায়চারি করছে কিন্তু কেউ কথা বলছে না। শীতের রাতে নিস্তব্ধ গ্রামের মাঠে একটু শব্দ হলেই অনেক দূরে শোনা যায়। ওদের কথার শব্দ পেলে মেরাজের সাহস বেরে যাবে ও কোন ভয়ই পাবে না, শুধু শুধু এত গুলি মিষ্টি খরচ হবে। না বাবা তার কোন সুযোগ দেয়া যাবে না। কতক্ষণ পরে ঠক ঠক শব্দ
ভেসে এলো তালগাছের নিচে থেকে। ওরা সবাই এ ওর দিকে তাকাচ্ছে। অন্ধকারের যে আলো আছে তাতে


দেখার চেষ্টা করছে কার চেহারা কেমন দেখাচ্ছে। ওইতো মেরাজ ঠিক পৌঁছে গেছে এবং সফল ভাবে খুঁটি পুঁতছে।
শব্দ শুনে নরেনের মুখ শুকিয়ে গেল তাহলে মিষ্টি খরচ করতেই হবে মানে বাবার কাছে আবদার করে চাইতে হবে, বাবা আমার বন্ধুরা এসেছে কিছু মিষ্টি দাওনা! বাবা যদি ভালয় ভালয় দিয়ে দেয় ত ভাল নয়তো ভিন্ন পথ
ধরতে হবে! আরে ধুর আমি এসব কি আবোল তাবোল ভাবছি! আগে ও আসুক তখন ভাবলেও হবে! ভেবেছিল মেরাজ এই কাজ করতেও পারবে না কাজেই ওর মিষ্টির ব্যবস্থাও করতে হবে না কিন্তু ছেলেটা যে এমনি করে রাজী হবে বুঝতেই পারে নি। ভয়তো কম দেখানো হয়নি। একটুও ভয়তো পেলই না উলটো রাজি হয়ে গেল।

কয়েকটা ঠক ঠক শব্দ হয়ে শব্দ থেমে গেল। ওরা বুঝে গেল খুঁটি পোতা হয়ে গেছে। মানে খুঁটি পোতা হয়ে গেছে এবার নিশ্চয়ই মেরাজ বীরের মত ফিরে আসছে! কিন্তু একি! হঠাৎ মেরাজের এক চিৎকার! মাজেদ আমি গেলাম! আর কোন শব্দ নেই। কি হলো? এই চল ও নিশ্চয়ই ভয় পেয়েছে। সবাই দৌড়ে যাচ্ছে। হন্ত দন্ত হয়ে ওখানে পৌঁছে দেখে মেরাজ কাত হয়ে কলই ক্ষেতে পড়ে রয়েছে গায়ে চাদর নেই, চাদরটা কয়েক হাত দূরে পড়ে রয়েছে। এই কি হয়েছে কি হয়েছে? ডাকা ডাকি করে কোন জবাব না পেয়ে বুঝল বেহুঁশ! দুই জনে ধরে কাঁধে উঠিয়ে পুকুর পাড়ে নিয়ে গেল অন্যরা চাদর উঠবার জন্য টান দিয়ে দেখে গায়ের চাদর খুঁটির সাথে মাটিতে পুতে গেছে। খুঁটি তুলে চাদর বের করে পাশে পড়ে থাকা মুগুর নিয়ে ফিরে এলো। ওকে পুকুর পাড়ে এনে শুইয়ে দিল। পুকুর থেক আঁজলা ভরে পানি এনে চোখে মুখে ছিটিয়ে দিল একটু পরেই মোটামুটি হুশ ফিরে এলো। চোখ মিট মিট করে তাকাতে দেখে জিজ্ঞেস করল, কিরে এখন কেমন লাগছে? এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে ওর সব বন্ধুরা ওকে ঘিরে রেখেছে। আশ্বস্ত হয়ে বলল, ভাল।
কি হয়েছিল?

আমি খুঁটি ঠিক মতই পুঁতেছি কিন্তু খুঁটি পুতে দাঁড়াবার সময় আমাকে কে যেন টেনে ধরল কিছুতেই ছাড়ে না। দৌড় দিলাম কিন্তু তবুও দেখি পিছে থেকে টানছে, আর কিছু বলতে পারব না, কিছু মনে পরছে না। ওরা তখন সবাই মিট মিট করে হাসছিল। বলতো কে ধরেছিল কিছু দেখেছিস? বললাম তো কিছুই দেখিনি। আরে বোকা এই দেখ তুই তোর গায়ের চাদর সহ খুঁটি পুঁতেছিলি এই দেখ মাটি লেগে রয়েছে। আমরা খুঁটি তুলে তবে তোর চাদর বের করেছি। এই কথা বলে বলল চল সবাই বাড়ি যাই আজ অনেক হয়েছে আবার কাল দেখা হবে। মাজেদ মেরাজকে নিয়ে বাড়ির পথে হাটা শুরু করল।
নরেন বলে উঠল, কিরে মেরাজ মিষ্টি খাবি?

No comments:

Post a Comment

Back to Top