নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-২১

 ৪৩।
বাসায় এসে ওরা উপরে গিয়ে শীতের কাপড় বদলে নিচে নেমে এসে দেখে ফিরোজ একটা বাংলা পত্রিকা নিয়ে বসে আছে। রাশেদকে দেখে বললো-

-দেখ এখানে রেস্টুরেন্টের কাজের অনেক বিজ্ঞাপন আছে, কিছু জব সেন্টারের ঠিকানাও আছে। তুমি কাল কোন একটা জব সেন্টারে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখ কি বলে। এই সব জব সেন্টারে রেস্টুরেন্টের কাজের চাহিদা আসে, ওরা কোথাও প্রোভাইড করে দিতে পারবে তবে ওরা একটা ফি নিবে। আমি এই ব্যবসা অনেক আগে ছেড়ে দিয়েছি বলে এই লাইনের কারো সাথে যোগাযোগ নেই না হলে আমিই করে দিতে পারতাম। এখানে এই কাজই বাঙ্গালিদের জন্য সবচেয়ে ভাল। থাকা খাওয়ার কোন চিন্তা নেই, সপ্তাহ পার হলেই কিছু বেতন পাবে, সপ্তাহে এক দিন ছুটি। তোমার কোন অভিজ্ঞতা নেই বলে প্রথম দিকে বেশ কম দিবে তবে আস্তে আস্তে অভিজ্ঞতা বাড়বে সে সাথে বেতনও বাড়বে। আমার মনে হয় এটাই ভাল, ভাবী কি বলেন?
-আমি আর কি বলবো ভাই আপনি যা ভাল মনে করেন তাই করেন। কাল কিন্তু আমার যাবার ব্যবস্থা করবেন।
-আচ্ছা সে দেখা যাবে আগে ওর কিছু হোক, তারপর আপনি যাবেন। ওর কিছু হওয়া পর্যন্ত আপনি থাকেন।
এমন সময় ভাবী কিচেন থেকে খাবার জন্য ডাকলেন।

পরদিন সকালে রাশেদ সাহেব ওই পত্রিকাটা হাতে নিয়ে বের হয়ে টিউবে করে ইস্ট লন্ডনের ব্রিক লেনের দুই একটা জব সেন্টারে গেলেন। তাদের কাছে কাজের কথা বলতেই বলে ফেলল আপনার বয়স হয়েছে এখন আর এসব কাজ আপনাকে দিয়ে হবে না, রেস্টুরেন্টের মালিকেরা সবাই ইয়াং ম্যান চায়। রাশেদ সাহেবের মনটা দমে গেলো। সেখান থেকে বের হয়ে পত্রিকা দেখে ঠিকানা বের করে আর একটা সেন্টারে গেলো। কাজের কথা বললো
-আপনার কি কোন অভিজ্ঞতা আছে?
-না
-ইংরেজি জানেন?
-কোন রকম কাজ চালাতে পারব মনে হয়
-কি কাজ করবেন?
-দেখুন আমার কিছুই জানা নেই, যা হয় তাই দেন
-আচ্ছা কিচেন পোর্টারের কাজ করতে পারবেন?
-এটা আবার কি কাজ?
-তাও জানেন না?
-কিচেন পোর্টার হলো হাড়ি পাতিল ধোয়া, বাসন পেয়ালা ধোয়া, আলু পিঁয়াজ ছিলবেন আর সেফ যা হুকুম করে তাই করবেন, পারবেন?
-রাশেদ সাহেব না বুঝেই বলে ফেললো, হ্যাঁ পারবো

লোকটা একটা ডাইরি উল্টিয়ে ফোন নম্বর বের করে ফোন করে জানতে চাইল আপনারা একজন কিচেন পোর্টার চেয়েছিলেন, নতুন এসেছে কোন অভিজ্ঞতা নেই, চলবে? হ্যাঁ নেন আপনি নিজেই কথা বলেন বলেই রিসিভারটা রাশেদ সাহেবের হাতে দিয়ে দিলো।
রাশেদ সাহেব ফোন হাতে নিয়ে সালাম জানালো, কি বলতে হবে কিছুই জানে না।
ওপাশ থেকে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় জানতে চাইল -কবে এসেছেন?
-এইতো তিন দিন
-ভিসা আছে?
-হ্যাঁ আছে
-কাজ করতে পারবেন তো?
-চেষ্টা করে দেখব।
-আমাদের এখানে থাকবেন, খাবেন, সপ্তাহে একদিন ছুটি আর সপ্তাহে একশত বিশ পাউন্ড মজুরী পাবেন
-আছা ঠিক আছে
-কবে আসতে পারবেন?
এবার রাশেদ সাহেব একটু মনির কথা ভেবে নিলেন হয়তো তিন চার দিনে ও যেতে পারবে, ভেবে নিয়ে চার দিন সময় চাইলো।
বলেই ফেললো -দেখুন আমার স্ত্রী চলে যাবে সে গেলেই আমি আসতে পারব। এখনও তার টিকেট কনফার্ম করা হয়নি, আজ করবো।
-আছা ঠিক আছে যেখান থেকে কথা বলছেন ওদের কাছে আমাদের ফোন নম্বর ঠিকানা সব আছে আপনি এখানে এসে ফোন করলে আমাদের লোক এগিয়ে নিয়ে আসবে
-আচ্ছা ঠিক আছে
-তাহলে এই কথা রইলো, আপনি চার দিন পর আসছেন
-হ্যাঁ ঠিক আছে
ফোন রেখে দেয়ার পর এক লোক এসে জানতে চাইল, আচ্ছা আমাদের যে কিচেন পোর্টার চেয়েছিলাম তার কি করেছেন? হ্যাঁ এইতো, বলে রাশেদ সাহেবকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন এই যে ইনি।
আপনি যেখানে যাবেন ইনি সেখানকার কুক, এনার সাথে কথা বলেন।
-আচ্ছা, আমি রাশেদ
-আমি মারুফ বলে দুই জনে হ্যান্ড সেক করে আলাপ শুরু করলো
-ভাই আমিতো একেবারে নতুন কি ভাবে যেতে হবে, ওখানে কি কাজ করতে হবে একটু দেখিয়ে দিতে হবে
-হ্যাঁ সব দেখিয়ে দিব নেন এই ঠিকানাটা রাখেন। কোথা থেকে যাবেন, ভিক্টোরিয়া?
-না সম্ভবত আমাকে হিথরো থেকে যেতে হবে
-আচ্ছা ঠিক আছে যেখান থেকেই যান অক্সফোর্ড নেমে বের হয়ে এসে আবিংডনের বাস ধরবেন, যেখানে এসে থামবে তার কাছেই রেস্টুরেন্ট। তাহলে কবে আসছেন?
রাশেদ সাহেব সব খুলে বললো,
-সে যাবার সাথে সাথেই আমি আসতে পারব। আজই টিকেট কনফার্ম করবো দেখি কবে সিট পাই। বুঝতেই তো পারছেন ভাই আমি এ লাইনে একেবারে নতুন কাজেই আমাকে সব শিখিয়ে নিতে হবে
-হ্যাঁ হ্যাঁ সে জন্য ভাববেন না। আপনি সময় মত চলে আসবেন। তাহলে ভাই আসি


৪৪।
রাশেদ সাহেব জব সেন্টারের বিশ পাউন্ড পরিশোধ করে একটু খুশি মনে চলে এলো। এসেই মনিকে বললো চাকরি একটা পেয়েছি
হায়রে রাশেদুল হাসান! তুমি জান না কি চাকরি তুমি পেয়েছ। জানলে এতো খুশি হতে পারতে না। সারাটা জীবন শুধু হুকুম দিয়েই এসেছ, তোমার হুকুম তামিল করার জন্য কত জন তোমার চারপাশে ছিলো, হুকুমের সাথে সাথে তা যাদুর মত হয়ে যেত। আজ যা করতে যাচ্ছ তার জন্য তুমি কখনো ভাবতেও পারনি। শুধু তুমি কেন তোমার পারিপার্শ্বিক কেওই কখনো ভাবতে পারেনি কোন দিন তুমি এই কাজ করবেতোমার নিয়তি তোমার জন্য এই বরাদ্দ করে রেখেছে। রাশেদের মুখে চাকরি পেয়েছি শুনে হাল ভাঙ্গা মাঝি যেমন ঝড়ের তোড়ে কূল হারিয়ে ফেলে আবার ঝড় থামলে কূলের দিকে নৌকার গলুই ঘুড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে মনিও যেন তেমনি কূলের সন্ধান পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। ফিরোজ বাইরে ছিলো। ফিরে এসে রাশেদের কাছে সব শুনল। মনিরা বললো-
-ভাই এবার আমার যাবার ব্যবস্থা ঠিক করে দেন
ফিরোজ টেলিফোনে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনের অফিসে কথা বলে নভেম্বরের সাত তারিখে সকালে মনিরার যাবার দিন ঠিক করে নিলো।
কায়সার বেয়াইর সাথে ফোনে আলাপ হলো।
-আরে বেয়াই আমিও তো ওই ফ্লাইটে কনফার্ম করেছি
-তাহলেতো ভালই হয়েছে
আজ চার তারিখ, মনিরা যাচ্ছে সাত তারিখে। মাঝে আর মাত্র দুই দিন। এই দুই দিন ওরা আর কোথাও বের হয়নি। রাশেদ সাহেব যেতে চাইলেও মনিরা ধার করে আনা টাকা এ ভাবে খরচের ভয়ে এড়িয়ে গেলো। রাশেদকে বোঝাবার চেষ্টা করলো
-তুমি বোঝ না কেন, এইতো শেষ নয় তুমি রোজগার কর তারপর এসে বেড়াতে পারবতখন মনে আর কোন কাটা বিঁধবে না
একথা শুনে রাশেদ সাহেব আর কিছু বলতে পারেনি, যুক্তি সঠিক। আর কী বলবে, বলার মত কিছু নেইও। এ দুই দিন ঘরে বসে গল্প সল্প করেই কাটিয়ে দিল।
মনিরা যাবার আগের রাতে ফিরোজ বললো
-ভাবীকে নিয়ে এয়ারপোর্টে আমি যাব শেফালি যেতে পারবে না ওর ক্লাস আছে। তুমিও লাগেজ নিয়ে এক সাথে বের হবে ওখান থেকে অক্সফোর্ডের কোচ আছে। তোমাদের নামিয়ে দিয়েই আমাকে চিজউইক আসতে হবে একটা কাজ আছে।
রাতে শোবার পর মনিরা বললো-
-তুমি একা একা কেমন করে থাকবে? তোমার ওষুধ পত্র কি মনে করে খাবে? তুমি অত উদাস হয়ে থেকো না লক্ষ্মী আমার, একটু সজাগ হবার চেষ্টা কর। তোমার তিনটা মেয়ে রয়েছে তাদের জন্য তোমাকে শক্ত হতে হবে। যখন খারাপ লাগবে এখানে চলে আসবে। কদিন পর পর ফোন করবে না হলে আমি পাগল হয়ে যাব।



আস্তে আস্তে রাশেদের কাছে আরও কাছে এসে রাশেদের বুকে মাথা রেখে নির্জীবের মত পরে রইলো। কণ্ঠ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। রাশেদের বুকে কেমন একটা উষ্ণ ভাব অনুভূত হলো, আবার এরকম, আবার। ক্রমেই এই অনুভূতির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে এদিকে মনিরার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে।
হাতের স্পর্শে দেখলো মনিরার চোখের নোনা জল পরে তার বুক ভিজে গেছে। শীতের পোষাক গায়ে বলে এতক্ষণ বুঝতে পারেনি। তবুও রাশেদ সাহেব তার মনিকে কিছু বলতে পারেনি। মনি কাঁদছে, কাঁদুক। এতে যদি একটু হালকা হতে পারে তাতেই মঙ্গল। কান্না থামিয়ে দিলে বোঝা আরও বেশি ভারী হতে পারে এই ভয়ে কিছু বলতে পারেনি। রাশেদ সাহেবের ভিতরে একটু দুঃখ, একটা চাপা অভিমানের উদয় হলো। যে মনিকে ছাড়া রাশেদ অচল সেই মনি এই রাত পোহালেই তাকে একা বনবাসে রেখে চলে যাবে। কি যেন বলতে চাইল কিন্তু মুখ দিয়ে সামান্য একটু শব্দের মত বের হলো কিন্তু সেটা কোন কথার মত  না
রাশেদ আবার মনির মাথা বুকে চেপে চুপ করে রইলো। মনিরা কাঁদছেই। সারা জীবনের জমে থাকা মনির চোখের নোনা পানি রাশেদের বুক ভিজিয়ে দিচ্ছে।
হোক, মনি কেঁদে কেঁদে হালকা হোক। ওর দুঃখ গুলি নোনা জলে ধুয়ে যাক। মনিকে যে শক্ত হতে হবে দেশে ওদের মেয়েরা আছে তাদেরকে মায়ের স্নেহ দিতে হবে বাবার স্নেহ দিতে হবে, মানুষ করতে হবে। রাশেদ সাহেব আবার কি যেন বলতে চাইলো কিন্তু এবারও সেই একই অবস্থা, মুখ দিয়ে কথা বের হলো না।
কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর রাশেদ ডাকলো-
-মনি!
-হু!
-কাঁদছ কেন?
-তোমাকে রেখে যেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি যে ভোলা মনের মানুষ থাকবে কি করে তারপর আবার ডায়াবেটিসের রুগী। কে তোমাকে দেখবে, আর কেই বা তোমার খাবার পথ্য যোগার করে দিবে?
-না মনি, তুমি শুধু দোয়া করবে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি কোন চিন্তা করবে না দেখবে রাতের পরেই দিন আসে। এক দিন দেখবে আমাদের এই দিন থাকবে না। তখন সবাই মিলে একত্রে থাকবো। আবার সেই আগের মত সব হবেএখানে তোমার আসার ব্যবস্থা করে নিলাম যখন ইচ্ছা হবে চলে আসবে। আমি এখান থেকে টাকা পাঠাব তুমি মেয়েদের নিয়ে চলবে।
-সারা জীবন ভরে দেখে আসছি নিজের জন্য কিছু ভাবতে পারনি, নিজের কিছু করতেও পার না তাই তো ভাবনা তুমি একা থাকবে কি ভাবে?
-না মনি, সে জন্য ভাবনার কিছু নেই। প্রকৃতি মানুষকে অনেক কিছু দেয়, তার মধ্যে অনেক কিছুই থাকে। আমিও তেমনি করে শক্তি পেয়ে যাব, এ তো প্রকৃতির বিধানএতো আমরা চাইলেই পরিবর্তন করতে পারবো না। কাজেই এ জন্য তোমার ভাবনার কিছু নেই, চিন্তারও কিছু নেই। এখন একটু ঘুমাবার চেষ্টা কর, ভোরে উঠেই লম্বা জার্নি শুরু হবে। একা যেতে পারবে তো?
-পারতে যে হবে।
[চলবে] 

No comments:

Post a Comment

Back to Top