মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-৮

খালাম্মা আমি বাড়ি যাই, হাবিব এলে আমাদের বাড়ি যেতে বলবেন
বিকেলে হাবিব এলো। দুই বন্ধু একে অপরকে জড়িয়ে কোলাকুলি করে বলল
আমি সাতার জানি না বলে মা রাজী হচ্ছে না। দেখ তুই একটু বুঝিয়ে দেখ কোন লাভ হয় না কি। তারপর রাতে
আব্বার সাথে কথা বলে দিন ঠিক করতে হবে তুইও খালুর সাথে আলাপ করে কি বলে কাল সকালে এসে জানাবি।
আচ্ছা আমি খালাম্মাকে বুঝাই। দেখি কি বলে।
একটু পরে হাবিব এসে জানাল না রে নিশাত খালাম্মা রাজী হচ্ছে না।
আচ্ছা আব্বা আসুক দেখি সে কি বলে। তুইও দেখ খালু কি বলে। কাল আবার আসবি।

কাল সকালেই হাবিব এসে হাজির।
কিরে খালু কি বলল, খালু কি খুশি হয়েছে?
হ্যাঁ আব্বা আম্মা সবাই খুব খুশি, তোর খবর কি?
মা রাজী হচ্ছিল না আব্বা বুঝিয়ে কোন রকম রাজী করিয়েছে তবে আব্বা খুশি হলেও চিটাগাং গিয়ে কোথায় থাকব সেই চিন্তা করছে।
এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই আমি আমার খালার বাড়ি থাকব, তুইও আমার সাথে থাকবি। তাহলে কবে যাবি ভাবছিস?
কিছু গোছ গাছ করতে হবে তা ছাড়া আব্বা কবে চিটাগাং যাবার ভাড়া যোগার করতে পারে তা ঠিক দেখে নিই আগে। আমার বাবার তো তোর বাবার মত অবস্থা না, তাকে একটু চেষ্টা করতে হবে। তবে আমার মনে হয় মোটা মুটি আগামী রোববারের মেইল ধরে গেলেই হবে। তোর কি মনে হয়?
হ্যাঁ আমিও তাই ভাবছি।
তা হলে দেখি আজ আব্বার সাথে একটা ফাইনাল ডিসিশন নিতে হবে, কি বলে না বলে আমি কাল তোকে জানাব।
ঠিক আছে তা হলে আমি এখন আসি।

সেদিন রাতে খাবার পর বাবা নিজেই জিজ্ঞেস করলেন। কবে গেলে সুবিধা হবে।
ওরা আগামী ২৩ তারিখের মধ্যে যেতে বলেছে কিন্তু আমার মনে হয় একটু আগে যেতে পারলেই ভালো। তাই ভাবছি আগামী ২১ তারিখে রবিবারের রাতের মেইলে যেতে পারলে হয়। হাবিব বলল ও ওর খালার বাড়ি থাকবে আমিও ওখানে ওর সাথে থাকতে পারব।
তা হলে ঠিক আছে তাই কর, দেখি এর মধ্যেই টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
নিশাতের মা বলল
যাবি যখন তোর মেঝ মামার সাথে দেখা করে বলে আয় দেখ ও কি বলে।
তাহলে সকালেই যাই?
যেতে চাইলে যা।
মায়ের মুখে কথাটা শুনে নিরুর কথা মনে হলো। নিরুর সাথে দেখা করতে হলে গ্রামে যেতে হবে কিন্তু গ্রামে যাবার সুযোগ একমাত্র দাদুর সাথে দেখা করা। এছাড়া গ্রামে যাবার কোন অজুহাত নেই!
আম্মা, গ্রামে যেয়ে দাদুর সাথে দেখা করব না?
হ্যাঁ অবশ্যই করবি। চল কাল যেয়ে আম্মার সাথে দেখা করিয়ে নিয়ে আসি!
হ্যাঁ আম্মা তাই ভাল হবে
সকালে উঠে নিশাত কাপড় বদলে মতিঝিলে মামার অফিসে চলে গেল। মামা অফিসে কি একটা জরুরী মিটিঙে ব্যস্ত।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর মামা এসে নিশাতকে দেখেই জিজ্ঞেস করল
কি রে, কি ব্যাপার এখানে এসেছিস?
মামা একটা ভালো সংবাদ আছে তাই মা বলল তোর মামার সাথে আলাপ করে আয়, তাই এলাম।
কি খবর?
আমি আর আমার বন্ধু হাবিব বিদেশের জাহাজে চাকরী পেয়েছি।
বাহ! বেশ ভালো কথা, তা দুলাভাই আপা কি বলে?
নিশাত এক এক করে সব বলল আর সাথে করে আনা নিয়োগ পত্রটা দেখাল।
মামা নিয়োগ পত্র পড়ে খুব খুশি। চিন্তা করিস না, তোর লেখা পড়া হলো না বলে মন খারাপ করিস না। এখানেও এক দিন জাহাজের ক্যাপ্টেন হতে পারলে অনেক দাম, অনেক বেতন পাবি। আমার বন্ধু আনিসকে মনে আছে? ও কিন্তু জাহাজের ক্যাপ্টেন। তা কবে যাবি ঠিক করেছিস?
হ্যাঁ, সামনের রবিবার রাতের মেইলে।
কেনা কাটা করেছিস কিছু?
না, কি কিনব, চিটাগাং যাবার টাকা দিতেই আব্বার অবস্থা কাহিল। থাক ওখানে যেয়ে বেতন টেতন পেয়ে যা লাগে কিনে নিবো।
বোকা ছেলে একটা দেশ থেকে বিদেশে যাবি এই ফকিরনির হালে যাবি নাকি? অন্তত কিছু কাপড় চোপর বানিয়ে নে। কি গায়ে দিয়ে যাবি?
বলেই মামা পকেট থেকে মানি ব্যাগ বের করে একশ টাকার দশটা নোট নিশাতের হাতে দিয়ে বলল
যা যা লাগে কিনে নিবি, কোন কিপ্টেমি করবি না। তুই এখন আন্তর্জাতিক পথে পা ফেলতে যাচ্ছিস কাজেই সেই ভাবে চলাফেরা করবি। যাবার আগে তোর মামির সাথে দেখা করে যাবি।
আচ্ছা মামা। হ্যাঁ মামির সাথে দেখা না করে কি যাব না কি, শুক্রবারে বাসায় যাব। সবার সাথেই দেখা করে যেতে হবে। তা হলে আমি আসি এখন?
কিছু খেয়ে যা।
না, বাসায় গিয়েই খাব।
দেখিস টাকা গুলি সাবধানে নিবি।
আচ্ছা মামা।

টকাটা পকেটে রেখে মামাকে সালাম করে অফিস থেকে বের হয়ে এসে নিশাতের মনে আনন্দের আর সীমা নেই। এক হাজার টাকা! নিশাত ভাবতেই পারছে না। এই এত টাকা ও কোথায় খরচ করবে? থাক বাবার কাছ থেকে তা হলে আর ওই টাকা নেয়ার দরকার নেই। মামা যা দিয়েছে এতেই চলে যাবে। সোজা বাসায় এসেই মাকে আনন্দ সংবাদটা জানাল। মা মামা আমাকে কেনা কাটা করার জন্য এক হাজার টাকা দিয়ে ফকিরনির মত বিদেশে যেতে নিষেধ করে দিয়েছে। ভালো জামা কাপড় বানিয়ে নিতে বলেছে।
তুই হলি ওর প্রিয় ভাগ্নে তোকে তো দিবেই। যাক বাবা ভালো হয়েছে, তাহলে ওখান থেকে আসার পথে গুলিস্তান থেকে সার্ট প্যান্টের কাপর কিনে নিয়ে আসলেই পারতি। এক কাজ কর কিছু খেয়ে আবার যা, কাপড় নিয়ে আয় আর তোর তো জুতাও নেই এক জোড়া জুতাও নিয়ে আসবি।
আচ্ছা মা আমি হাবিবকে নিয়ে যাই।
হাবিবকে নিয়ে গুলিস্তান গিয়ে দুইটা সার্ট, দুইটা প্যান্টের কাপড়, একটা ব্যাগ, গেঞ্জি আরও কিছু টুকি টাকি যা মনে পড়ল সে সব কিনে বাটার দোকান থেকে দেখে এক জোড়া জুতা, কিনে বাসায় চলে এলো। পর দিন সকালে মাকে নিয়ে বের হলো। কল্যাণপুরে দর্জির দোকানে আর্জেন্ট ডেলিভারি দেয়ার কথা বলে মাপ দিয়ে মায়ের সাথে গাবতলি গিয়ে ঢাকা আরিচা রুটের বাসে বানিয়া জুরি নেমে গ্রামে চলে গেল।



নিশাত জানে না তার ভাগ্য তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। হায়রে মানুষ তুমি জান না আজকে যে পাহাড় সমান সম্পদ পেয়ে তুমি আনন্দে আত্মহারা হয়েছ কালই সামান্য একটা ইঁদুর তার কত বড় ক্ষতি করতে পারে। কিংবা আজ তোমার সামান্য একটা পয়সা না থাকায় দুঃখে মন ভারাক্রান্ত হয়ে রয়েছে হয়ত কাল তোমার পকেটে দেখবে সহস্র মুদ্রার ঝলকানি। সবই সেই অদৃশ্য শক্তির কারুকাজ।

গ্রামে এসে প্রথমে নিজেদের বাড়িতে না ঢুকে পথের পাশে শিহাব যুঁইদের বাড়িতে গেল। যাবার সময় মাকে বলে গেল আপনি বাড়ি যান আমি আসছি।
কিরে নিশাত কবে এসেছিস?
এইতো আসছি।
কি খবর বল
শুনেছিস, আমি লন্ডন যাচ্ছি!
শুনে যুঁই আর শিহাব এক সাথে বলে উঠল, কি বললি
হ্যাঁ যা বলেছি সঠিক বলেছি
কবে যাবি?
এইতো এখান থেকে ফিরে রবিবারে চিটাগাং যাব ওখান থেকে দিন তারিখ ঠিক হলেই চলে যাব। এখানে এসেছি তোদের সাথে দেখা করতে।
ওমনিই যুঁই বলল, ঈশ তোর বৌয়ের সাথে দেখা করে যাবি না? ও তো ঢাকা যাবে লালমাটিয়া কলেজে ভর্তি হবে।
কথাটা শুনেই আনন্দ আর লজ্জায় নিশাতের মুখ লাল হয়ে গেল। কিছুক্ষণ কোন কথা বের হলো না। তাহলে? তাহলে কি নিরুকে না দেখেই চলে যেতে হবে? কোন কুল কিনারা পাচ্ছে না। একটু সময় থেমে পরিস্থিতি বুঝে আস্তে করে জিজ্ঞেস করল নিরু কোথায়?
কেন নিরুর কি দরকার? বৌকে দেখে না গেলে হবে না? ওতো মামার বাড়ি গেছে। আজই আসার কথা। বীণা এসেছে দুই তিন দিন হলো, ওকে নিয়ে যাবে। বীণা সহ ওদের মামা বাড়ি গেছে।
নিশাত উঠে দাঁড়িয়ে বলল তাহলে আমি যাই দাদুর সাথে দেখা হয়নি এখনও
ঢাকা যাবি কবে?
আগামী কাল যাব
তাহলে আবার বিকেলে আসবি?
নিশাত এতক্ষণে নিরুর সাথে দেখা হবার জন্য বিকেলে আবার এখানে আসার সুযোগ খুঁজছিল। যুঁইয়ের কথা শুনে সে সুযোগ পেয়েছে বলে একটু জোরেই বলল হ্যাঁ আবার আসব, শিহাব কোথাও যাবি?
না এখন আর কোথাও যাব না
তাহলে আমার সাথে চলনা মইন চাচার বাড়ি যাব এক সাথেই যাই
চল
দুইজনে এক সাথে নিশাতদের বাড়ি চলে এলো। হাতের ব্যগটা নামিয়ে রেখে দাদির সাথে দেখা করে শিহাবকে নিয়ে চলল মইন চাচার বাড়ি। চাচা বাড়িতে ছিল না, পারাগ্রামের কোন এক জমিতে নিড়ানি দিতে গেছে। একটু বসে মইন চাচার মাকে বলল দাদু আমি একটা খুব ভাল চাকরী পেয়েছি আমাকে লন্ডন চলে যেতে হবে ওখানেই চাকরী। দাদি খুব খুশি হয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে অনেকক্ষণ দোয়া করলেন। দাদিকে বলে আসল চাচা এলে আমাদের বাড়ি যেতে বলবেন
আচ্ছা দাদা আমি বলব, তুমি সাবধানে থেকো, শুনেছি বিলাতি মেমসাহেবদের কোন লাজলজ্জা নাই দেখবে আবার অমন কাউকে সাথে করে নিয়ে এসো না।
না দাদু আপনাকে সেজন্যে ভাবতে হবে না।
সন্ধ্যার আগে মইন চাচা এলে তাকে নিয়ে আবার শিহাবদের বাড়ি। বাড়িতে ওঠার আগেই বীণা আপাকে দেখল পুকুর পাড় থেকে বাংলা ঘরের দিকে আসতে। বুঝতে পারল বীণা আপার সাথে নিশ্চয়ই নিরু এসেছে। এখন ওকে দেখার সুযোগ খুঁজতে হবে। নিশাতকে দেখে বীণা আপা কতবেল গাছের নিচে দাঁড়াল।
নিশাত, যুঁই বলল তুই নাকি লন্ডন যাচ্ছিস?
হ্যাঁ আপা, যুঁই ঠিকই বলেছে।
বেশ, খুব ভাল কথা। তা ঢাকায় কবে যাবি?
কালকেই যেতে হবে।
কালই যাবি! তাহলে আমাদের সাথে চল, আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি।
আপা আমিতো একা না মাও আছে সাথে আবার দাদুও যাবে।
তাতে কি হলো এ তো আরও ভাল হলো। তারাও যাবে তোদের নামিয়ে দিয়ে আমি নিরু আর বাবা চলে যাব।
এখানে এ কথা সে কথা, নানা গল্পে গল্পে বেশ রাত হয়ে গেল। এখনও নিরুকে দেখার সুযোগ হয়নি। চাচীদের সাথে দেখা করার অছিলায় বীণা আপার সাথে ভিতরে চলে এলো। চাচীদের সাথে কথার ফাঁকে দেখল নিরু ছোট চাচাত বোনকে কোলে নিয়ে খাটের এক কোণায় বসে আছে। হারিকেনের মৃদু আলোতে যেন আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। চোখের দিকে তাকাল কিন্তু কোন সারা নেই দেখে মনটা একটু খারাপ হলো। আবার ভাবল কাল এক সাথে ঢাকা যাবার সময় প্রাণ ভরে দেখে নিবে।
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top