মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-৭

৪।
সদ্য স্বাধীন দেশে সব জিনিস পত্রের দাম দিনকে দিন বেড়েই চলছে। প্রকৃতি তার রুদ্র রূপ মেলে দিচ্ছে। জীবন হয়ে উঠছে কঠিন থেকে কঠিনতর। নতুন দেশ, নতুন অর্থনীতি, শূন্য ভাণ্ডার আর তার সাথে অবাধ চাহিদা। চারিদিকে শুধু
ক্ষুধা আর ক্ষুধা। বিরূপ পরিবেশ। এর মধ্যেই আবার প্রকৃতি নিয়ে এলো তার প্রচণ্ড হিংস্র মূর্তি। দেশে দেখা দিল বন্যা। এমনিই মানুষ সামাল দিতে পারছে না তার মধ্যে আবার এই দুর্যোগ। রেশন কার্ড নিয়ে নিশাত রাত তিনটায় রেশন দোকানে লাইনে দাঁড়াত, তবুও গিয়ে দেখত তার আগে আরও কয়েক জন এসে পরেছে। ঘুমে চোখ একা একাই বন্ধ হয়ে আসতে চাইত কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি আর ঘুমানো যায়? তীর্থের কাকের মত চেয়ে থাকত কখন সূর্য উঠবে কখন নয়টা বাজবে, কখন দোকান খুলবে! এই রেশন নিয়ে বাড়ি গেলে মা রান্না করবে। ক্ষুধা নামক জীবের অদৃশ্য শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য প্লাস্টিকের চাউল যা সেদ্ধ হতে জ্বালানী খরচ হত অনেক, পোকা ধরা দুর্গন্ধে ভরা কিছু গম আর কিছু চিনি এই ছিল রেশন কার্ডে বরাদ্দ। তবুও নিরুপায় মানুষকে তাই খেতে হত। শাক সবজি, ডাল, মাছ এসব তো আর রেশনে পাওয়া যায় না। ওগুলি পাবার ব্যবস্থা আছে কিন্তু তা অন্য ভাবে। বাজারে ওসব পাওয়া যায় কিন্তু তা কেনার সামর্থ্য খুব কম লোকের হাতে। বাড়িটা করতে গিয়ে নিশাতের বাবা কিছু ঋণ করেছিল। গ্রামের জমি বিক্রির টাকায় হয়নি। অল্প কিছু ঋণ করতে হয়েছিল। সেই ঋণ শোধ করতে গিয়ে নিশাতের বাবাকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। তার মধ্যে আবার ওদের পাঁচ ভাই বোনের লেখা পড়া।

ওই দুর্যোগের মধ্যেই মাছ ভাতের বাঙ্গালি তার চিরাচরিত অভ্যাস ছেড়ে খেতে শিখল গমের আটার রুটি। তাও আবার যারা দিচ্ছে তাদের অখাদ্য। আরও শিখল সরষের তেলের পরিবর্তে সয়াবিন তেলে রান্না। বুড়ি গঙ্গা আর তুরাগ নদী দিয়ে অনেক পানি বঙ্গোপসাগরে মিশেছে আবার সেই পানি সূর্যের তাপে বাষ্পায়িত হয়ে হিমালয়ে কিংবা কাঞ্চনজঙ্ঘা কিংবা মানস সরোবরে এসে জমেছে। এখান থেকে নদী বেয়ে আবার গেছে বঙ্গোপসাগরে। প্রকৃতি থেমে নেই। সে তার আপন গতিতে নিজ রূপে বয়েই চলছে। তার কোন তাড়া নেই, কোন অভাব নেই। আকাশের চন্দ্র সূর্য তারা নক্ষত্র রাজি সবই উদয় হয়েছে আবার অস্তও গেছে। বাতাস বয়ে গেছে সাথে করে কখনও উড়িয়ে নিয়েছে কিছু মেঘমালা, কখন শান্ত বেগে কখন অশান্ত ঝড়ের বেগে, কখন নিস্তব্ধ মৃদু বেগে। এই ভাবেই ক্যালেন্ডারের পাতা একের পর এক উলটে গেছে। ঘড়ির কাটা ঘুরে ঘুরে ঋতুর পরিবর্তন এনেছে। যত্নে সাজানো বাগানের এবং অযত্নে বেড়ে উঠা ঝোপ ঝাঁরে বন ফুলের অনেক কলি ঝরে গেছে আবার তার জায়গায় নতুন কুড়ি এসেছে। এগুলিও কিছু আধো ফোটা অবস্থায় ঝরে গেছে, কিছু ফুটে তার সৌরভ ছড়িয়েছে আবার কিছু ঠাই পেয়েছে কারো সাজানো ঘরের ফুল দানিতে নয়ত কারো প্রিয়ার খোপায় তার হিসেব কে রেখেছে কে জানে! এই ভাবেই বয়ে চলেছে জীবন নদীর শান্ত অশান্ত স্রোত। কোনটা সাগরে মহা মিলনে মিলিত হয়েছে আবার কোনটা মাঝ পথেই শুকিয়ে গেছে। আবার কোনটা কিছু দূর এগিয়ে মাঝ পথে এসে স্তব্ধ হয়ে থমকে গেছে। এই ভাবে চলেছে, চলছে এবং মহাকালের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চলতেই থাকবে। তার পর এক দিন হবে সব কিছুর অবসান। কেউ নিজের ইচ্ছে মত নিজের বাগান সাজাতে পারেনি। সব কিছু যেন কোন অদৃশ্য এক ভাগ্য নামের রিমোট কন্ট্রোলের হাতের পুতুল হয়ে ডানে বামে সামনে পিছনে চলছে। কে কার খবর রাখে?

ছোট বেলা থেকে নিশাতের ইচ্ছে ছিল ইঞ্জিনিয়ার হবে, মস্ত ইঞ্জিনিয়ার। নিজ হাতে বানাবে নানা রকম ইঞ্জিন যা মানুষের কাজে লাগবে, মানুষের দৈনন্দিন জীবন সহজ করে দিবে। কিন্তু তার সে স্বপ্ন থমকে গেল কলেজে ইলেক্টিভ ম্যাথে এসে। নিশাত বাবার কাছ থেকে সাধারণ গণিত বেশ ভালো বুঝে নিয়েছিল কিন্তু ক্যালকুলাস, স্ট্যাটিস্টিকস, ডাইনামিকসের ধাক্কায় সব থেমে গেল। নিশাত তার মাথায় এগুলি জোড় করেও ঢুকাতে পারলো না। ওদিকে বাবার এমন সামর্থ্য নেই যে এ জন্য তাকে আলাদা প্রাইভেট টিউশনের খরচ যোগায়। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে বায়োলজি নিয়ে পড়ে ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে এমন সিদ্ধান্ত নিলো। এতেও গবেষণার সুযোগ রয়েছে যথেষ্ট। কিন্তু কলেজ শেষ করে আর বেশি দূর এগুতে পারেনি। দেশের ক্রম বর্ধমান দুর্মূল্যের ফলে তার বাবা তাদের এই পাঁচ ভাই বোনের সংসার সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিল।
মানুষ মুখে যাই বলুক যতই বলুক দেশের জন্য দশের জন্য ভাবছে। আসলে তার কতটা সত্য তা নিশাত জানে না। নিশাত এখন ভাবছে আসলে এগুলি কিছু নয়। মানুষ ভাবে শুধু তার নিজেকে নিয়েই। সে তার নিজের চাহিদা, নিজের খেয়াল অভাব মেটাবে এটাই এক মাত্র উদ্দেশে। তার নিজের চাহিদা বাস্তব রূপ নিবে, মনে আত্ম তৃপ্তি পাবে, সাথে পাবে যশ প্রতিপত্তি, সম্মান আর সুখ। সুন্দরী শিক্ষিতা স্ত্রী, সাজানো বিলাস বহুল বাড়ি তাতে থাকবে ফুলের বাগান। আরাম আয়েশের যাবতীয় ব্যবস্থা। মালী, চাপরাশি ড্রাইভার সারাক্ষণ তাকে ঘিরে থাকবে। পাশে সুন্দরী স্ত্রী নিয়ে দামী গাড়িতে চলাফেরা করবে এমন অনেক কিছু। নিশাতও ভাবে এই যে আমি চাইছি আমাদের সংসারের বর্তমান অবস্থার উত্তরণ ঘটিয়ে সংসারের উন্নতি করবো, ভাই বোনদের নামী দামী স্কুল কলেজে পড়িয়ে উচ্চ শিক্ষিত করে তুলব, তাদের দামী পোশাক পরাব। সমাজে পাড়া প্রতিবেশীদের ঈর্ষার কারণ হবো তাদের চোখ ধাঁদিয়ে দিবো, সমাজের উন্নতি করবো দেশে বিদেশে নিজের খ্যাতি ছড়াবো তার মুলে কিন্তু ওই একই। নিজের স্বার্থ জড়ান রয়েছে।

মানুষ যতই বলুক তার অন্তর্নিহিত সারমর্ম সে নিজেই। নিজের পেটে ক্ষুধা রেখে কে কার জন্য কতটা পরতে পারে, কত দূর যেতে পারে? নিজের চলার শক্তি হারিয়ে কেউ বেশি দূর যেতে পারে না। এই হয়, এটাই স্বাভাবিক। মানুষের মনের খবর আমরা কতটা রাখতে পারি? এক জন আর এক জনের মনের কথা কতটা জানতে পারি? এক জনের সাথে আর এক জনের কতটা মিল থাকে? হয়তোবা তাই নয়ত কি জানি কেন নিশাতের মনে এক ঝড় বয়ে যাচ্ছে। হায়রে নিয়তি তোমার নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কি মানুষ তার ইচ্ছে মত কিছুই করতে পারবে না? এই বিশ্ব সংসারে তুমিই কি রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে মানব জীবনের স্টিয়ারিং ঘোরাবে?
এই সব ভাবনা নিয়ে যখন নিশাত ক্ষত বিক্ষত তখন এক দিন সহপাঠী পাশে কল্যানপুরের বন্ধু হাবিব এসে জানাল, এই নিশাত, জাহাজে চাকরী করবি?
কি করে?
এই যে দেখ আমি কি নিয়ে এসেছি.
বলে একটা খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন বের করে দেখাল। নিশাত সেটা নিয়ে পড়ে দেখল. চট্টগ্রামের এক শিপিং এজেন্ট জেমস ফিনলে জাহাজের জন্য কিছু ডেক ক্যাডেট চেয়েছে। প্রথমে ক্যাডেট হিসেবে জয়েন করবে পরবর্তীতে জাহাজে কাজের অভিজ্ঞতা হলে নির্দিষ্ট সময় পর পর ইংল্যান্ডে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে পরবর্তী উন্নত পদে উন্নীত হয়ে জাহাজের ক্যাপ্টেন পর্যন্ত হবার সুযোগ আছে।
দারুণ একটা খবর এনেছিস, বেশ ভালো করেছিস এটা এনে, তা তুই কি এপ্লাই করবি?
হ্যাঁ আমিও করবো।
তাহলে চল দুই জনে এক সাথেই করি। এক মাস যাবত কলেজ বন্ধ থাকবে কাজেই এর মধ্যে আর কোন ঝামেলা নেই।
যা যা কাগজ পত্র চেয়েছে সেগুলি যোগার করে বাবা মাকে না জানিয়ে নিশাত হাবিবের সাথে এপ্লিকেশন পাঠিয়ে দিল। কয়েক দিন পর ইন্টার্ভিউ লেটার এলো বাড়িতে। চট্টগ্রাম যেয়ে ইন্টার্ভিউ দিতে হবে এজন্য টাকার দরকার। এখন আর বাবাকে না জানালে চলছে না। বাবাকে জানাবার আগে মাকে জানাতে হবে। মা নিজেই যেন বাবাকে বলে। ওই দিন মাই জিজ্ঞেস করল তোর নামে এই চিঠি কিসের, কে দিয়েছে? নিশাত মাকে সব খুলে বুঝিয়ে বলল। সবার শেষে বাবাকে বলার জন্য অনুরোধ করল। মা ওই রাতে খাবার সময় বাবার সাথে এ নিয়ে আলাপ করতেই বাবাও রাজী হয়ে গেল। কবে যেতে হবে জানতে চাইলে নিশাত বলল আগামী সোমবার।
আচ্ছা ঠিক আছে।

রবিবার রাতের চিটাগাং মেইলে করে দুই বন্ধু এক সাথে রওয়ানা হয়ে পর দিন আগ্রাবাদে জেমস ফিনলে অফিসে এসে ইন্টার্ভিউ দিল। দুই জনেরই বেশ ভালো ইন্টার্ভিউ হয়েছে। মোটা মুটি যা যা জিজ্ঞেস করেছে সঠিক জবাব দিয়েছে। ইন্টারভিউ দিয়ে আবার রাতের মেইল ট্রেনে ঢাকায় ফিরে এলো। কয়েক দিন পরেই নিশাতের নামে আর এক চিঠি, ওই ফিনলে অফিস থেকে। সেদিন নিশাতের কলেজ বন্ধ বলে কলেজে যায়নি, বাড়িতেই ছিল। পিওন সরা সরি নিশাতের হাতে চিঠিটা দিয়ে গেল। দুরুদুরু বুকে চিঠি খুলে পড়ে দেখে আনন্দে মা বলে এক চিৎকার দিয়ে দৌড়ে মার কাছে এসে মার বুকে মাথা রেখে মাকে জড়িয়ে ধরল। হঠাৎ নিশাতের এই কাণ্ড দেখে মা অবাক হয়ে জানতে চাইল
কিরে কি হয়েছে?
আমার চাকরী হয়ে গেছে!
কোথায়?
ওই যে সেদিন ইন্টার্ভিউ দিয়ে এলাম ওখানে।
তা হলে কি চিটাগাং?
না মা একে বারে বিদেশের এক জাহাজে।
কি বললি?
হ্যাঁ মা এই যে দেখেন এই চিঠিতে সব লেখা আছে।
জাহাজের চাকরী?
হ্যাঁ মা!
তুই কি সাতার জানিস যে জাহাজে চাকরী করবি?
জাহাজে চাকরী করতে সাতার জানা লাগবে কেন? জাহাজের মানুষেরা কি জাহাজে থাকে না কি সাগরে ভেসে থাকে?
না বাবা, আমার ও চাকরীর দরকার নেই! আমার দাদাও জাহাজে চাকরী করেছে আমি জানি সব।
কি বলেন মা, এখন দেশের এই অবস্থায় এমন একটা চাকরীর সুযোগ হাত ছাড়া করা কি ঠিক হবে?
না, বললাম তো আমার ও চাকরীর দরকার নেই।
আচ্ছা ঠিক আছে আব্বা আসুক দেখেন আব্বার সাথে আলাপ করে দেখেন আব্বা কি বলে।
জেমস ফিনলে ইংরেজিতে লেখা চিঠিতে জানিয়েছে তোমাকে একটা ব্রিটিশ পতাকা বাহী জাহাজে ডেক ক্যাডেট হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। স্থান কাল বেতন সহ সব কিছু উল্লেখ করে নিয়োগ পত্রের শেষ প্যারায় বলেছে তুমি যদি উপরোক্ত প্রস্তাবে রাজী থাক এবং দেশ ছেড়ে বিদেশে যেতে আপত্তি না থাকে তা হলে অপর পাতায় বর্ণিত শর্ত মেনে এই চাকরী করতে চাইলে আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে আমাদের অফিসে সাক্ষাত কর। শর্তাবলী যাই থাক বেতনের কথা আর লন্ডনে যেয়ে জাহাজে জয়েন করার সুযোগ দেখে নিশাতের মাথা খারাপ হবার দশা। খুশীতে আত্মহারা। ইংরেজ জাত যতই সভ্য হোক ওরা কাউকে আপনি বলতে জানে না। সে যাই হোক। চিঠিতে যে সব শর্তাবলী রয়েছে তাতে আপনি আর তুমিতে কিছু যায় আসে না। তারপর এক লাফে দেশের বাইরে এবং সরাসরি লন্ডনে, যাবতীয় খরচ পত্র সবই কোম্পানি বহন করবে। তার উপর লোভনীয় বেতন, বেতনের সাথে আবার বেশ কিছু বাড়তি সুযোগ সুবিধা। এমন চাকরী হাত ছাড়া করার মত বোকামি এই মূহুর্তে করা কোন অবস্থায়ই উচিত হবে না। মা যতই নিষেধ করুক তাকে রাজী করাতেই হবে!
নিশাত বলল মা তাহলে আমি একটু হাবিবদের বাড়ি থেকে আসি দেখি ওর কি খবর। হাবিবের বাড়ি গিয়ে দেখে হাবিব বাড়ি নেই। হাবিবের বোন হাসি দরজা খুলেছে। হাবিবের কোন চিঠি এসেছে কি না জিজ্ঞেস করলে হাসি বলল হ্যাঁ দাদার একটা চিঠি এসেছে আজ। দেখি, আমাকে একটু দেখাও। হাসি নিশাতকে বসতে বলে ভিতরে গিয়ে চিঠিটা এনে নিশাতকে দেখাল। সেই একই চিঠি নিশাতের কাছে যেমন এসেছে তেমন। খুলে দেখে এতেও ওই একই কথা লেখা।
হাসি, জান এটা কিসের চিঠি?
না ভাইয়া।
চল ভিতরে খালাম্মার কাছে চল এক সাথেই বলি।
এমন সময় খালাম্মা মানে হাবিবের মা নিজেই এলেন। কি রে নিশাত তোকে এত খুশি লাগছে কেন?
খালাম্মা, শুধু আমি না, শুনলে আপনিও খুশি হবেন।
কি ব্যাপার?
হাবিবের একটা চাকরী হয়েছে বিদেশে, আমারও।
তাই নাকি বলিস কি?
হ্যাঁ খালাম্মা এই যে এই চিঠি দেখেন। এতেই সব লেখা আছে। ঐযে সেদিন যে ইন্টার্ভিউ দিয়ে এসেছি সেই চাকরী!
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top