নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৯১

১৮০।
এর মধ্যে সেঝ ভাই শাহেদ দেশের চাকরী ছেড়ে বিলাত চলে এসেছে। অনেকদিন থেকেই চেষ্টা করছিল এদেশে মাইগ্রেট করার জন্য। ছোট ভাই নাহিদের ইচ্ছা দেশে কেও থাকবে না। বলতে গেলে তারই চেষ্টায় শাহেদ এসেছে।
এসে প্রথমে গ্লস্টারে মেঝ ভাইয়ের বাসায় উঠেছে। তিথিও এয়ারপোর্টে গিয়েছিল চাচাকে রিসিভ করার জন্য। নাহিদও চেষ্টা করছে এখানে অথবা কানাডা যাবার। যেখানে আগে হয় সেখানেই চলে যাবে। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা, আর্থিক অবস্থা, মানুষের মন মানসিকতা দিনকে দিন অবনতির দিকেই যাচ্ছে। খাবারে বিষ মেশানো, চিকিৎসার নামে ভাঁওতাবাজি, অনাচার অবিচারের খেলা চলছে। খুন খারাবির কোন সীমা নেই যার যেমন ইচ্ছা তেমনি চলছে কোন বিচার নেই। ক্ষমতার দম্ভ এবং অহংকারে মানুষ আর মানুষ নেই। শুধু দেহ সর্বস্ব মানুষ কিন্তু এর মধ্যে মানবিকতার কোন ছিটে ফোটা বা নাম গন্ধও অবশিষ্ট নেই। যে যেভাবে পারছে প্রতারণা, বঞ্চনা, অবিচার করেই চলেছে। বিচারের নামে প্রহসনের তামাশা চলছে।
শাহেদ এসে এয়ারপোর্টে থেকেই বাড়ি থেকে তিথির জন্য ভাবী যা দিয়েছিল সেগুলা তিথির হাতে দিয়ে মেঝ ভাইয়ের সাথে গ্লস্টার চলে গেলোএখানে কিছুদিন থেকে দেখবে কোন কাজকর্ম পেলে ভাল নয়ত লন্ডনে বেশ কয়েকজন বন্ধু আছে তিথি আছে ওখানে কোথাও উঠে চাকরি বাকরি খুঁজে দেখবে।

প্রায় মাস খানিক হয়ে গেল কিন্তু এর মধ্যে কিছু হচ্ছে না। দেশে থাকতে এদেশের একটা কোম্পানিতে চাকরী করত ওদের অফিসে যোগাযোগ করেও কিছু হচ্ছে না। এর মধ্যে রাশেদ সাহেব আগে অক্সফোর্ডে যেখানে কাজ করত সেই রেস্টুরেন্ট থেকে জানাল -ভাই আপনার চেনা কেও আছে নাকি? আমাদের এখানে ছয় সপ্তাহের জন্য একজন লোকের দরকার।
-হ্যাঁ আছে, আমার ভাই আছে
-ঠিক আছে ভাই, কোথায় আছে সে?
-এখন গ্লস্টারে আছে, সে কিন্তু একেবারে নতুন কিছুই জানে না
-কোন অসুবিধা নেই প্রথম এসে সবাই এমন থাকে এ নিয়ে ভাববেন না তাকে পাঠিয়ে দেন।
-আচ্ছা বলব আজই বলব

ফোন রেখে শাহেদকে ফোন করলেন
-যেখানে যা এপ্লাই করেছিস ঠিক আছে তবে আপাতত একটা কাজের সন্ধান পেয়েছি, আমিও এখানে ছিলাম। জাহিদের সাথে আলাপ করে ওখানে চলে যা অন্তত ছয় সপ্তাহ কিছু করতে পারবি আর অন লাইনে এপ্লাই করবি।
-কোথায়?
-অক্সফোর্ডের এক গ্রামে, ওখানে গেলে অক্সফোর্ডেও খুঁজে দেখতে পারবি
-আচ্ছা ঠিক আছে আমি মেঝ ভাইয়ের সাথে আলাপ করছি।
জাহিদের সাথে আলাপ করে বিকেলে জানাল, -তাহলে দাদা ওদের নম্বর দেন যোগাযোগ করি
-হ্যাঁ ঠিক আছে।
এখানে ছয় সপ্তাহ শেষ না হতেই আগে এপ্লাই করা ভাল এক সরকারি চাকরীর অফার পেয়ে ব্রিস্টল চলে গেল। ব্রিস্টলেও ওর দুই একজন বন্ধু ছিল, আপাতত ওদের একজনের বাসায় উঠেছে। এর কয়েকদিন পরেই নাহিদের কানাডা যাবার বিষয়টা কনফার্ম হয়ে গেল। লন্ডনে কয়েকদিনের ট্রানজিট নিয়ে কানাডা যাবে এমন করে টিকেট করেছে। প্রথমে তিথির বাসায় উঠেছেতিথি এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করে সাথে নিয়ে এসেছে ছোট চাচাকে। তানিম আবার নাহিদের বন্ধু তাই মেঝ ভাইকে নিষেধ করেছিল এয়ারপোর্টে যেতে। দুই দিন লন্ডনে থেকে বন্ধুদের সাথে দেখা করে ব্রিস্টল এলো সেঝ ভাইর কাছে এখানে এক দিন থেকে আবার গ্লস্টার। গ্লস্টারে একদিন থেকে আবার লন্ডন হয়ে কানাডা চলে গেল। একদিন ব্রিস্টল থেকে বিকেলের ট্রেনে করে শাহেদ সহ ব্রীজেন্ড গিয়ে বড় ভাইয়ের সাথে দেখা করে রাতেই আবার ব্রিস্টল ফিরে গিয়েছিল।


১৮১।
নাহিদ চলে যাবার কিছুদিন পরে রাশেদ সাহেব লন্ডনে এসেছিলেন, ফেরার পথে ভিক্টোরিয়া ডিপার্চার  টার্মিনালে এসে ব্রীজেন্ডের টিকেট নিয়ে কোচ যে গেট থেকে ছাড়বে সেখানে বসে আছেন কোচ ছাড়ার আরও প্রায় আধা ঘণ্টা বাকি আছে। এমন সময় লক্ষ করলেন সাদা শাড়ি পরনে এক বৃদ্ধা মহিলা এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। রাশেদ সাহেবকে উপমহাদেশীয় দেখে তার কাছে এসে গুজরাটি ভাষায় কি যেন জিজ্ঞেস করল কিন্তু রাশেদ সাহেব বুঝতে না পেরে বললো -মাইজি আপনি হিন্দি বলতে পারেন?
-কিছু কিছু পারি
-তাহলে আমাকে হিন্দিতেই বলুন, আপনি যা বলছেন আমি বুঝি না
-ও! আচ্ছা বলে সে ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে যাবললো,ম্যানচেস্টার থেকে তার ছেলে কোচে তুলে দিয়েছিল এবং এখানে এলে তার মেয়ে তাকে রিসিভ করার কথা কিন্তু সে কাওকে খুঁজে পাচ্ছে না বলে মেয়ের বাড়িতে একটু ফোন করে জানাতে হবেতার ফোনটা কোথায় হারিয়ে ফেলেছে।
-আপনি ওই এত দূরের এরাইভ্যাল টার্মিনাল থেকে বের হয়ে এখানে এই ডিপার্চার টার্মিনালে এসেছেন কেন? আর কি করেই বা এলেন? ওরা যদি কেও এসেও থাকে তাহলে আপনাকে খুঁজে পাবে কেমন করে?
-বাবা আমি কাওকে না পেয়ে হাঁটতে হাঁটতে এখানে এসে পড়েছি। কোন ইন্ডিয়ানকে পেলাম না, তোমাকে দেখে ইন্ডিয়ান মনে করে তোমার কাছে এসেছি।
-না মাইজি আমি ইন্ডিয়ান নই। আচ্ছা, আপনি মেয়ের বাসার ফোন নম্বর জানেন?
-হ্যাঁ আমার কাছে আছে। বলে হাতের ব্যাগ খুলে একটা ছোট ফোন বুক বের করে বললো রাশিদা নামের নম্বরটা বের করতে।রাশেদ সাহেব খুঁজে পেয়ে তার মোবাইল দিয়ে ফোন করলেনএক ভদ্র মহিলা ফোন ধরলতাকে ঘটনা খুলে বলা হলো। ভদ্র মহিলা বললো-
-হ্যাঁ মাকে আনার জন্য আমার ছেলে গিয়েছিল কিন্তু সে রাস্তায় এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে আছে এখন তাই ওখানে মা কাওকে পায়নি।
-তাহলে আমি এনাকে এখানে বসে থাকতে বলি আপনি অন্য কাওকে পাঠিয়ে দেন। আপনার মা কিন্তু ডিপার্চার টার্মিনালের C32 নম্বর গেটে বসে আছে, উনি ভাল হিন্দি বুঝে না মনে হলো আমি আবার গুজরাটি জানি না এদিকে আমার কোচ আর দশ মিনিটের মধ্যে ছেড়ে দিবে তাই আমি অপেক্ষা করতে পারছি না বলে দুঃখিত।
-না না আপনাকে বসে থাকতে হবে না আপনি মাকে বলে দিন আর ফোনটা আমাকে দেন আমি নিজেই মাকে বলে দিচ্ছি।
রাশেদ সাহেব মহিলার কথা মত ফোনটা বৃদ্ধা মহিলার হাতে দিয়ে মেয়ের সাথে কথা বলতে বললেনকথা শেষ হলে আবার রাশেদ সাহেবকে বললো মেয়ে তোমার সাথে কথা বলবে।
-আচ্ছা ভাই আপনি কোন দেশের?
-আমি বাংলাদেশের, আপনি কি ভাল করে বুঝিয়ে বলেছেন এখানেই বসে থাকতে?
-হ্যাঁ বলেছি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি সংবাদটা না দিলে অনেক ঝামেলা হতো। হয়ত পুলিশের সাহায্য নিতে হতো।
-না না ধন্যবাদের কি আছে এটা সবার নৈতিক দায়িত্ব। আচ্ছা তাহলে রাখি, আমার কোচে বোর্ডিং হচ্ছে।
ফোন রেখে মহিলাকে আবার তার মেয়ে কি বলেছে সে কথা স্মরণ করিয়ে এখানে বসে থাকতে বলে রাশেদ সাহেব ব্যাগটা হাতে নিয়ে গেট দিয়ে বের হয়ে কোচে উঠে বসলেন
ঘণ্টা দুয়েক পরে কোচ যখন নিউ পোর্ট ছাড়িয়ে এসেছে তখন রিং বেজে উঠল। পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে ওই গুজরাটি নম্বর থেকে।
-হ্যালো
-হ্যালো ভাই, আমার মাকে নিয়ে এসেছি, আপনাকে আবার ধন্যবাদ

১৮২।
বাতাস যেমন করে বয়ে যায় তেমনি করে দিনগুলিও ঠিকানা হীন গন্তব্যের দিকে বয়ে যাচ্ছে। তিথি নিয়মিত ক্লাস এবং সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা করে কাজ করছে। এখন নিজেই রান্না করে খায়। অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাবার সাথে দিনে দুই একবার কথা বলার সুযোগ পায়। ক্লাস, কাজ, বাজার করা, রান্না করে খাওয়া, তারপরে এ বাড়িতে আর এক সমস্যা হলো এখানে ওয়াশিং মেশিন নেই। হাতে কাপড় ধুতে হয়। শীতের দেশে শীতের ভারি কাপড় হাতে ধোয়া বড়ই কঠিন সমস্যা। বাসার লোকজনেরা ভাল বলে বাসা বদলের ইচ্ছেও হয় না। কঠিন জীবন যাপনে অভ্যস্ত হতে হচ্ছে। দুই তিন মাস পরে হঠাৎ করে একদিন কাজের সময় সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় পায়ে আঘাত পেল। পরে দেখা গেল পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে। প্রায় মাসাধিক সময় ধরে পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে বিছানায় পড়ে থাকতে হলো। চাকরিটা চলে গেল। ক্লাসের সমস্যা হচ্ছে। পা ভাল হবার পর অনেকদিন কোন কাজ খুঁজে পাচ্ছে না। হন্নে হয়ে খুঁজছে, চেনা জানা সবাইকে বলেছে কিন্তু কোন ব্যবস্থা হচ্ছে না। দিন গড়িয়ে যাচ্ছে। বাসা ভাড়া, খাবার, যাতায়াতের খরচের জন্য বাবার কাছ থেকে টাকা নিতে হচ্ছে। কলেজের ফি দিতে হবে সে টাকাও বাবাকে দিতে হচ্ছে। বাবা হিমসিম খাচ্ছে। বাড়ির খরচ এখানকার ওর নিজের খরচ সবই বাবার উপর চেপে যাচ্ছে। মনে অত্যধিক চাপ পড়ছে। ওদিকে ঢাকা থেকে আসার সময় বাড়ি থেকে বের হবার আগে ছোট দুই চাচা এবং দাদা যা মুখে আসে তাই বলেছে। তোর বাবা এখানে ব্যবসার নামে আমাদের দেউলিয়া করে রেখে গেছে, তুই গিয়ে সে টাকা শোধ করবি, তোর বাবা সারা জীবনে আমাদের জন্য কিছুই করেনি, অল্প বয়সে বিয়ে করে চাকরি পাবার সাথে সাথে বৌ নিয়ে ফুর্তি করে কাটিয়েছে আমাদের জন্য, সংসারের জন্য কি করেছে? তুই যেয়ে বাবার মত হবি না এমনি সব নানা কথা।
সে সব কথা ভুলতে পারছে না। ইচ্ছে করলেও ভুলতে পারছে না। বিদেশে আসার সময় সাধারণত আত্মীয় স্বজন গুরুজনেরা যেখানে নানা রকম সান্ত্বনা দেয়, বুঝিয়ে শুনিয়ে নির্ভয় থাকতে বলে ভাবনাহীন থেকে লেখাপড়া করতে বলে সেখানে এদের এই সব কথা শুনে বাড়ি থেকে বিদেশে আসার আগে চোখের পানি মুছতে মুছতে বের হয়েছে। মা বোনেরা কাছেই ছিল কিন্তু প্রতিবাদ করে এসব কথা বন্ধ করার জন্য তারাও কিছু বলার সাহস পায়নি তবে মা বোনেরা এয়ারপোর্টে আসার পথে বোঝাবার চেষ্টা করেছে, ভুলে যাবার কথা বলেছে কিন্তু এই সব কথা কি ইচ্ছে করলেই ভুলতে পারে? প্লেনে বসেও চোখ মুছা শেষ হয়নি।  নানা কারণে মানসিক চাপ বেড়েই চলেছে। মাথায় আর ভার নিতে পারছে না, মন বিষণ্ণ থাকতে থাকতে এক সময় ডাক্তার জানাল তোমার ডিপ্রেশন রোগ হয়েছে। কাজেই সাবধানে থাকবে এবং সময়মত ওষুধ খাবে। এমনিতেও এদেশে অনেকেই একা একা জীবন যাপন করে বলে তারা ডিপ্রেশনে ভুগে। এটা এদেশের কমন রোগএভাবেই প্রায় একটা বছর কেটে গেছে। প্রথম পার্টে চার সাবজেক্ট পরীক্ষা হয়ে গেছে। পাশ করেছে কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি, তার জন্য বাবার উপর বাড়তি চাপ, চাচা দাদাদের এহেন মানসিকতা সারাক্ষণ অস্থির করে রাখে, মনে সুঁইয়ের খোঁচা বিধতেই থাকে।

[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top