নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-১০৪

২১৪।
লন্ডন এসে ব্রিকলেন আর হোয়াইট চ্যাপেল থেকে সারা দিন ভরে কেয়ার সাথে কেয়ার লিস্ট অনুযায়ী বাজার করে আনলেনশাড়ি আর জামাই এর পাঞ্জাবী কেনার সময় কেয়া, শিখা ওরা তিথিকেও সাথে নিয়ে হোয়াইট চ্যাপেলের এক
বাংলাদেশি দোকানে এসেছিল।
এদিকে কেয়া আর শিখা আবার গায়ে হলুদের ব্যবস্থাও করেছে। রাশেদ সাহেব মৃদু আপত্তি জা্নালেন
-এত সবের কি দরকার?
-কি বলেন ভাই, বিয়ে এখানে হচ্ছে বলে কি আমাদের রেওয়াজ রীতি ভুলে গেছি নাকি, দেশেও যেভাবে বিয়ে হয় এখানেও তাই হবে কিছুই বাদ দেয়া যাবে না
-বেশ,তোমরা যদি ম্যানেজ করতে পার তাহলে কর আমার কোন আপত্তি নেই
-আপনি কিচ্ছু ভাববেন না, যা করার আমরাই করছি। এদেশে কি আর এমন অনুষ্ঠান সচরাচর হয়? একটা সুযোগ পেয়েছি তাই করছি। আপনি শুধু দেখেন ভাইয়া
-ঠিক আছে, তাই হোক।

শাহেদ এসে পৌঁছল হলুদের আগের দিন সন্ধ্যায়। শাহেদ আসাতে রাশেদ সাহেবের কিছুটা স্বস্তি হলো।
কেয়া আর শিখার আয়োজনে গায়ে হলুদ সহ সব কিছুই হলো। হলুদের দিন ফিরোজ ভাবী আর বাচ্চাদের নিয়ে এসে হলুদ দিয়ে গেল।  বিয়ের দিন দুপুরের মধ্যেই জাহিদরা এসে পড়ল। সন্ধ্যার পর বর এলোতানিম যেয়ে ইমাম সাহেবকে ডেকে আনল। বিয়ে পড়ান হলো। ভাবী তার বাড়ি থেকে কয়েকটা মুরগির গ্রিল, গ্রিল করা বিরাট এক স্যামন মাছ, বড় তেলাপিয়া মাছ এবং অন্যান্য অনেক কিছু দিয়ে সুন্দর করে একটা বড় ট্রে সাজিয়ে এনেছিল। কেয়ারা একেবারে দেশের মত করে সব কিছু করেছে, এমনকি বরের বসার জন্য ফুল দিয়ে সাজিয়ে হালকা একটু আয়োজনও করেছিল রাশেদ সাহেব ভাবতেও পারেনি এখানে এত সুন্দর ঘটা করে খুকুর বিয়ে হবে। রাশেদ সাহেব মনে মনে ভেবে রেখেছিলেন লিমোজিনের ব্যবস্থা করবেন কিন্তু পকেটের হিসাব করে কুলিয়ে উঠতে পারেনি বলে মনে একটু কেমন কেমন ভাব রয়ে গেছে তবুও যা হয়েছে এই বিদেশের মাটিতে মাকে ছাড়া, যা হয়েছে এই অনেক ভেবে মনকে প্রবোধ দিয়েছেনখাওয়া দাওয়া সেরে এবার কন্যা সম্প্রদানের পালা। রাশেদ সাহেব মনির সাথে আগেই আলাপ করে রেখেছিলেন জাহিদকে দিয়ে এই কাজটা করতে হবে। জাহিদকে বিকেলে জানালে জাহিদ আপত্তি জানাল।
-আমি ওদের ছেড়ে অনেকদিন ধরে বাইরে রয়েছি, আমার মনে হয় আমার চেয়ে শাহেদই ভাল হবে
-না তা কি করে হয় শাহেদ ছেলে মানুষ, তুই দিবি
-তাহলে আপনিই দেন
-আরে না আমি দেব তোর মেয়েকে, তুই দিবি এদের...
-আচ্ছা, ঠিক আছে
বিয়ের পরে জাহিদ কন্যা সম্প্রদান করল। বর কনে চলে গেল। রাশেদ সাহেব মনে মেয়ের বিয়ের আনন্দএবংমেয়ের বিদায়ের বেদনার মিশ্রিত অনুভূতিতে কেমন যেন বিহ্বল হয়ে গেলেনবিদায়েরবেহালায় করুণ বেহাগের সুর বাজছে তার মনে। তানিম ফিরোজ এরা বুঝতে পেরে সান্ত্বনা জানাল। এটাই নিয়ম, এমনিই হয়ে আসছে আদিকাল থেকে। তোমার মত মানুষের এই ঘটনায় ভেঙ্গে পড়া মানায় না রাশেদ। একে একে অতিথিরা সবাই চলে গেল, জাহিদরাও চলে গেল। পরদিন সকালে শাহেদও চলে যাবে রাশেদ সাহেবও চলে যাবে।
শাহেদ কম্পিউটারে দেশের বাড়ির সাথে স্কাইপিতে ভিডিও কানেক্ট করে হলুদের অনুষ্ঠান সহ সমস্ত আয়োজন দেখিয়েছে। বেশ আনন্দের মধ্যেই ছিল কয়েকটা দিন। ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে। সকালে তানিমের বাসা থেকে শাহেদ আর রাশেদ সাহেব এক সাথেই বের হয়ে টিউব স্টেশনে যাবার কথা ছিল কিন্তু বাসা থেকে নিচে নেমে রাশেদ সাহেব বললেন-
-তুই যা আমি টেভিয়ট রোডে যাব, যাবার আগে ওকে একটু দেখে যাই
-আপনি একা যাবেন কেন চলেন আমিও যাই সাথে
দুই ভাই এক সাথে মেয়ের বাসায় এসে কিছুক্ষণ থেকে আবার এক সাথে ভিক্টোরিয়া এসে দুই জন দুই দিকে চলে গেল, একজন ব্রিস্টল এবং আর একজন নিউ ক্যাসেল। অনেকদিন পরে তিন ভাই একত্রে হয়েছিল আবার কবে কার সাথে দেখা হবে কে জানে? এর আগে নাহিদ কানাডা যাবার সময়েও রাশেদ সাহেব এবং ছোট দুইজন একত্র হয়েছিল কিন্তু তারা চার ভাই অনেক বছর ধরে একত্র হতে পারছে না। কবে হবে বা আদৌ হবে কি না কে জানে? শাহেদ প্রায় প্রতি মাসেই একবার লন্ডন আসে। লন্ডন এসে বন্ধুদের কারো বাসায় না থেকে মেয়ের কাছেই থাকে। মেয়েকে নিয়ে বেড়ায়বন্ধুদের বাসায়, এখানে ওখানে। যাবার সময় কিছু কেনাকাটা করে বাজার করে দিয়ে যায়।

২১৫
দেখতে দেখতে রাশেদ সাহেবের সাতটা বছর কেটে গেলরাজীব পাশ করে ভাল একটা চাকরী পেয়েছে। তিথিকে নিয়ে দেশে গিয়েছিল। ওর মায়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী বৌ ভাতের অনুষ্ঠান হয়েছে, মনি দুই মেয়েকে এবং শ্বশুরকে নিয়ে বেয়াইন বাড়ি গিয়েছিলরাজীবও তিথিকে নিয়ে প্রথম শ্বশুর বাড়ি থেকে গেছে কয়েক দিন। তিথি মায়ের সাথে আরও কিছুদিন ছিল। শাহেদের দিনও মোটামুটি কাটছে, এর মধ্যে বৌ ছেলে নিয়ে এসেছে। রাশেদ সাহেব লন্ডন এলে দুই এক দিনের জন্য ব্রিস্টলেও আসেনাহিদও কানাডায় একটা চাকরী পেয়েছে। দেশে গিয়ে বিয়ে করে বৌ নিয়ে গেছেতবে রাজীব লন্ডনে থাকতে চাচ্ছে না। আমার মেধা কেন এই দেশে বিলিয়ে দিব? চল আমরা দেশে চলে যাই। এখানে নিম্ন শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকার চেয়ে দেশের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকব! তুমি কি বল? ওরা দুইজনেই একে অপরের সাথে বেশ মানিয়ে নিয়েছে। রাজীব যা বলে তিথি তা মেনে নিতে কোন আপত্তি করে না আবার রাজীবও তেমনি। সব বাবা মাই চায় ছেলে মেয়েরা তাদের স্বামী স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে মিলে মিশে সুখে শান্তিতে সংসার করবে। রাশেদ সাহেব আর মনিও এর ব্যতিক্রম নয়।

তিথি একদিন বাবাকে বললো-
-আব্বু ও এখানে থাকতে চাইছে না
-জামাইর উপরে রাশেদ সাহেবের আস্থা আছে। যথেষ্ট জ্ঞানী এই ছেলে। সে কি আর কিছু না ভেবেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে?
-থাকতে না চাইলে দেশেই ফিরে যাও। দেখছ তো এখানে আমাদের বাংলাদেশিদের কি অবস্থা!
-তুমি কি করবে?
-আমার কি এখনই যাবার সময় হয়েছে? দেশে যেয়ে কী করব? তোমার আর দুই বোন আছে না? ওদের কি হবে? এ পর্যন্ত কী কিছু সঞ্চয় হয়েছে? সে কথা তুমি ভাল করেই জান
-তুমিও চল, দেশে গেলে একটা কিছু হবে
-না বাবা তা হয় না। তোমরা চলে যাও।
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top