অক্সফোর্ড এক্সপ্রেস-[২]-২



[পূর্ব প্রকাশের পর]
মাথা নিচু করেই চলে গিয়েছিল বছর দুয়েক আগের কলকাতায়। সেই দিন আর ফিরিয়ে আনার উপায় নেই।
কলকাতার টালি গঞ্জের অতি সাধারণ একজন স্কুল মাস্টারের মেধাবী মেয়ে দোলা কলেজে যাবার পর পাড়ার ডাক্তারি পড়ুয়া অভিজিতের কাছে পড়ত আর সেই সময়ের সাথে একটা সুক্ষ সূত্র ধরে কখন যেন উভয়ের অজান্তে একজন
আরেকজনের সাথে একান্ত নিবিড় ভাবে মিশে গিয়েছিল। চোখের ভাষা থেকে শুরু করে মান অভিমানের লেনদেন এবং একদিন না দেখার বিরহ যাতনার অনুভব সবই আঁকড়ে ধরেছিল।  কিন্তু দুই জনের লেখা পড়া শেষ করে যখন অভিজিত ডাক্তারি শুরু করল তখন বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে মাকে দোলার কথা জানাল কিন্তু মা নিচু ঘর এবং বাঙ্গাল বলে বিয়েতে মত দেয়নি। বাবারও একই কথা। দেখে শুনে বাবা মা অভিজিতের বিয়ে দিল কিন্তু সে বিয়ে বেশিদিন টিকেনি। ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল বছর না ঘুরতেই।

এমনি অবস্থায় দোলার মন ভেঙ্গে চুরমার হবার অবস্থা হচ্ছে জানতে পেরে প্রিয় বান্ধবী বিশাখার উদ্যোগে অনেক খোঁজাখুঁজি করে দোলাকে এখানে রিসার্চ করার সুযোগ পাইয়ে দিল। এমন কি, এখানে আসার প্লেন ভাড়াটাও সেই দিয়েছিল। দোলার বিলাতে আসার সংবাদ জেনে অভিজিতের মা দোলার মায়ের কাছে প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল। দোলার মা অত কিছু না জেনে মেয়েকে অভিজিতের মায়ের প্রস্তাব জানাল কিন্তু মেয়ে তাতে সম্মতি দেয়নি। এত ভাল পাত্র, হোক না দোজবরে তাতে কি পুরুষ মানুষের এত খুত ধরতে নেই। বিশেষ করে তাদের মত অভাবের সংসারে অমন পাত্র যেন রাজযোটক। এই পাত্র হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে দেখে দোলার মা নানা ভাবে মেয়েকে সন্দেহ করে নানা রকম কটূক্তি করতেও দ্বিধা করেনি এমনকি এত দিনের চেনা নিজের গর্ভের শান্ত অথচ জেদী মেয়ের চরিত্রের খুঁত খুঁজে দেখতেও পিছপা হয়নি। কেন যে মেয়েকে এত পড়ালেখা শেখালাম এই ক্ষেদ তার মনে অহর্নিশ লেগেই থাকত। অসুস্থ বাবা সব কিছু দেখে শুনেও না দেখা না জানার ভাণ করেই পড়ে থাকত। এ ছাড়া রিটায়ার্ড বাবার আর কিই বা করার থাকে? মায়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে কেমন করে বাড়ি থেকে বের হতে পারে সেই চিন্তায় নানা ভাবে চেষ্টা তদবির করে বিলাতে আসার আগে টাটা কোম্পানিতে একটা চাকরি পেয়ে জামসেদপুরে চলে গিয়েছিল। বাবার পেনশনের কয়েকটা টাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই বলে মাসে মাসে টাকা পাঠাত কিন্তু কোন খোঁজ খবর নেয়ার মত ইচ্ছা হোত না।

বলেন কি! সময় হয়ে উঠেনি না কি?
দোলার ফ্যাকাসে মুখের দিকে চেয়ে,  আচ্ছা থাক এসব কথা, আপনি খুবই ক্লান্ত
দোলা চমকে উঠে আবার ফিরে এলো।
তার চেয়ে আপনার কথা বলুন, আমার কথা শুনতে ভাল লাগবে না তেমন কোন সুখের কথা নয়
আমার কথা আর কি বলব, আছি! খাই দাই ছেলেমেয়েদের পড়াই ব্যাস আর কি?
উইটনিতে কি আপনার নিজের বাড়ি? কে কে আছে ওখানে? মানে ছেলে মেয়ে
হ্যাঁ বাড়ি নিজেরই বটে তবে আর যা বললেন তার কিছু নেই
নেই! মানে?
নেই মানে নেই। কোনদিন ছিলও না আর হবেও না
কি আশ্চর্য, তা কেন হবে?
সে অনেক কথা। থাক এত শুনে কি হবে?
আপত্তি না থাকলে বলুন না!
শুনবেন? না আপত্তি নেই, তাহলে বলি
কেন যে রিজভী সাহেবের মত ব্যক্তিত্বের অধিকারী, অমায়িক, স্মার্ট এবং দুর্দান্ত প্রফেসর ঘর বাঁধেনি এ কথা নিয়ে আশেপাশে কানাঘুষা লেগেই আছে। তার কিছু যে রিজভী সাহেবের কানে যায়নি সে কথা বলার উপায় নেই কিন্তু রিজভী সাহেবের কোন মাথা ব্যাথা নেই। অনেকেরই জানার আগ্রহ থাকলেও কেও জিজ্ঞেস করার সুযোগ পায়নি তবে একান্ত কাছের বা ঘনিষ্ঠ দুই একজন বাঙ্গালির স্বাভাবিক কৌতূহল নিবারণ করতে পারেনি তা বলা যাবে না। তবে জানতে চেয়েও এ যাবত কেও জানতে পারেনি। কিন্তু আজ দোলাকে দেখে তার কঠিন ব্যক্তিত্ব কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে, বরফ গলে পানি হয়ে শিশির কণার মত টলমল করছে। মনে যেন কিসের দোলা লেগেছে! মনে চেরি ফোটা বসন্ত এসেছে, ডেফোডিল, প্রিমরোজ, ব্লু বেল, টিউলিপের নানা রঙ ছড়িয়ে যাচ্ছে, বর্ষার প্রথম কদম ফুল ফুটেছে, বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধ পাচ্ছে, জানুয়ারির স্নো মাখা নীলচে পূর্ণিমার চাদরে দেহ মন জড়িয়ে রয়েছে। কেন যেন কথা বলতে ইচ্ছে করছে। যে কথা কাওকে কোনদিন বলা হয়নি! দোলার আপত্তি না থাকলে বলুন নাকথাটা শ্রাবণ ধারার সুরের মত মনে গুনগুন করছে।

আস্তে আস্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই প্রথম দেখা শিরিনের সমস্ত কাহিনী একে একে সব খুলে বলল। জানেন, শিরিন এখন ভীষণ সুখী। ওকে সুখী করতেই আমি চেয়েছিলাম কিন্তু সে যে এভাবে সুখী হবে সে আমি কল্পনায়ও ভাবতে পারিনি। আজ আর আমার কোন দায় নেই, আমি নির্ভার। কথা গুলা বলতে পেরে  মনটা যেন অনেক হালকা হলো, এতদিনের সঞ্চিত কষ্টের বিষ বাষ্প বের হয়ে গেল। দারিদ্র্য জর্জরিত না পাবার বেদনা, হতাশার গ্লানি সব যেন এক নিমেষেই কোথায় কোন দূর মহাসাগরের অতলে হারিয়ে গেল। বলা শেষ হলে দোলার দিকে তাকাল। দোলা এক মনে কথা গুলা শুনছে। মনে হলো রিজভী সাহেবের বলা শেষ হয়নি তাই জিজ্ঞেস করল
তারপর?
তারপর আর কি, এইতো! আপনার সামনেই দেখতে পাচ্ছেন
কিন্তু এ ভাবে কতদিন চলবে? জীবন নদী কি কখনও একা পাড়ি দেয়া যায়? একজনে হাল ধরে আর একজনে  বেয়ে চলে
যে ভাবে চলছে চলুক না, বেশ তো চলছে এই বেশ
না, তা হয় না, এ যে প্রকৃতির বিধান আমরা যে কেও এর বাইরে যেতে পারি না
তাহলে আপনি আপনার মিস্টারের কথায় অমন করে ফ্যাকাশে হয়ে গেলেন কেন?
সে অনেক কথা, থাক না
না, থাকবে কেন? আমি এতক্ষণ বকবক করলাম আর আপনি চুপ করে শুনবেন তাই কি হয়? বলুন শুনি
বললামতো সে কোন সুখের কথা নয়, শুনতে ভাল লাগবে না
আচ্ছা আমি যে এতক্ষণ বললাম এ কি সুখের কথা?
মোটেই না
তাহলে? আচ্ছা প্রথম আলাপেই এত কিছু বলাবলিতে আপনি কি দ্বিধা বা কোন সংকোচ করছেন?
একটু হেসে বলল, আপনি কিন্তু নাছোড় বান্দা
দোলার হাসিটাও শিরিনের মতই মনে হলো। মধুর ক্যান্টিনে বসে বলত দেখ শিরিন আমি এত দরিদ্র ঘরে জন্মেছি যে তোমার কথা তোমাদের মত ঘরের কথা চিন্তাও করতে পারি না। তখন এমনি করেই হেসে বলত আমি শুধু তোমাকেই ভালবাসি, আমিতো আর কিছু চাই না!
তাই যদি মনে করেন তাহলে আর কথা বাড়িয়ে লাভ কি?
আচ্ছা,
বলে তার ছোট বেলা থেকে শুরু করে এখানে আসার সমস্ত কাহিনী শোনাল। বিশাখাই আমাকে এখানে নিয়ে এসে বাঁচার পথ দেখিয়েছে। মটর ওয়েতে চলন্ত কোচের ইঞ্জিন এবং হিটারের একটানা গুঞ্জণের শব্দ ছাপিয়ে দোলার কণ্ঠ শোনার জন্য রিজভী সাহেব দোলার মুখের কাছে কান পেতে মনোযোগ দিয়ে শুনেছে।

ও! মনে হচ্ছে আমরা এক সাথে একই নদীতে দুই নৌকা ডুবিতে ডুবে গিয়েছিলাম আবার এক তীরেই ভেসে উঠেছি। নিয়তি আমি বিশ্বাস করি না কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এ যেন নিয়তির ই খেলা। নিয়তি অনেক কিছু পারে যা আমাদের ভাবনার সীমা রেখা থেকে অনেক দূরে।

কথা বলতে বলতে অক্সফোর্ড গ্লস্টার গ্রিন কোচ স্টেশনে চলে এসেছে, গাড়ি পার্ক করে ড্রাইভার মাইকে জানিয়ে দিল। রিজভী সাহেব পকেট থেকে তার কার্ড বের করে দোলার হাতে দিয়ে বলল তোমার ফোন নম্বরটা দিবে? কাল তোমার সাথে দেখা করব। কোচ থেকে এক সাথে নেমে দোলার লাগেজ সহ একটা টেক্সিতে তুলে দিয়ে বলল
কাল আমি না আসা পর্যন্ত ডিপার্টমেন্টেই অপেক্ষা করবে?
টেক্সির সিটে বসে দোলা ব্যাগ থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে ফোন নম্বরটা লিখে রিজভী সাহেবের হাতে দিয়ে বলল
এসো, আমি তোমার অপেক্ষা করব
দোলার টেক্সি ছেড়ে দিল, টেক্সির পিছনের লাল বাতি ভিড়ে মিশে যাওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে থেকে রিজভী সাহেব আর একটা টেক্সি নিয়ে উইটনি চলে গেল।
----------০০০---------

No comments:

Post a Comment

Back to Top