নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৫৯

১১১।
রাশেদ সাহেব ভাবতে ভাবতে আসছিলেন এই বিলাতের মত সভ্য দেশে থেকে এরা উপমহাদেশীয় সাধারণ সঙ্কীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। আসলে অর্থ মানুষকে কত কি না দিতে পারে। মানুষকে মহান করতে পারে, হীন করতে
পারে, শক্তিশালী করতে পারে আবার দুর্বলও করতে পারে। নিচেও নামাতে পারে আবার উপরেও উঠাতে পারে। অর্থ তাকে কোথায় নিয়ে যায় পাতালে নাকি আকাশের কাছে সে ছবি অর্থের আয়নায়ই ফুটে উঠে। এই অর্থের কত শক্তি, সে তো সে নিজের জীবন দিয়েই দেখছে। তার সংস্পর্শে জড়িত যারা তারা সবাই তা অনুভব করছে, তার স্ত্রী সন্তানেরা সবাই। করুক, ময়না মিয়ার যা ইচ্ছা করুক তাতে কি এমন ক্ষতি! কত টাকা আর কম দিবে?

১১২।
সেদিনটা কোন ভাবে কেটে গেলো। পর দিন থেকে আবার কাজ। ব্যস্ততা কম। দেলু বলেছে আবার দুই এক দিন পরে নিউ ইয়ার্সে বিজি হবে। হ্যাঁ সত্যিই একত্রিশে ডিসেম্বর রাতে যে কি বিজি তা বলার মত নয়। দৌড়া দৌড়ীতে পা গুলি আর চলতে চাইছিলো না। এদিকে চড়া শব্দে মিউজিক, কান ফেটে যাবার উপক্রম তবুও কাস্টমাররা বলে লাউড! লাউড! টেবিল ছেড়ে হাতে ড্রিঙ্কস এর গ্লাস নিয়ে নাচানাচি। ক্রিকে যত জাহাজ লঞ্চ ছিলো তারা সবাই রাত বারোটা এক মিনিটে এই যে হুইসল বাজানো শুরু করলো আর থামতে চায়না। তার সাথে তাল মিলিয়ে এখানে যারা আছে তাদের উচ্চ স্বরে বেসুরো গান গেয়ে উত্তাল উন্মাদনায় নিউ ইয়ার বরণ করা। কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে আসছে, নীরব হচ্ছে। মাতাল হয়ে একেক জন টেবিলে বসেই ঘুমিয়ে পরেছে। সাথে যারা ছিলো তাদের মধ্যে যাদের একটু হুশ আছে তারা সঙ্গীকে কোন ভাবে টেনে টুনে তুলে নিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগে একটা বিয়ারের ব্যারেল খালি হয়ে গিয়েছিলোসেটা বদলাবার সময় কানেকশন ঠিক না হওয়ায় ব্যাক প্রেশারে বিয়ার ছিটে এসে পুরো সার্ট, মুখ, হাত, মাথা ভিজে গেলো। তাড়া তাড়ি একটা টেবিল ক্লথ নিয়ে যতটুক পারল মুছে নিল।
ভেজা সার্ট দেখে এক মাতাল জিজ্ঞেস করলো-
-তোমার জামা ভেজা কেন?
-রাশেদ সাহেব জবাব দিলো তুমি বিয়ার পান করছ আর আমি বিয়ার দিয়ে গোল করেছি তাই।
-ও তাই নাকি?
-তাহলে তুমি খুব ভাগ্যবান, সামনের বছর তোমার খুব ভালো যাবে দেখবে।
-বেশ! বেশ! ভালো কথা! তা তুমিও একটু গোসল করবে নাকি?
-আরে না, কি বলছ তুমি বাইরে গোসল করেছ আর আমি ভিতরে গোসল করছি। জান আজ আমি কয় পাইন্ট বিয়ার খেয়েছি?
-সারা দিনেরটা জানি না তবে আমার যতদূর মনে হয় এখানে আমি তোমাকে আট পাইন্ট দিয়েছি।
-ঠিক বলেছ, সারা দিনে আমি বত্রিশ পাইন্ট আর তোমার এই আট পাইন্ট মিলে মোট চল্লিশ পাইন্ট খেয়েছি, আমার ভিতরে যত ময়লা নোংরামি ছিলো সব বেরিয়ে গেছে এখন আমি পবিত্র।
-আচ্ছা আচ্ছা, বেশ ভাল কথা! এখন বাড়ি গিয়ে ঘুমিয়ে পর।

কাস্টমার বিদায় করে সমস্ত রেস্টুরেন্ট পরিষ্কার করে মদের গ্লাস ধুয়ে গুছিয়ে রেখে খেয়ে দেয়ে সেদিন রাত চারটা বেজে গিয়েছিলো বাসায় ফিরতে। এসে ইলেকট্রিক জগে পানি গরম করে গোসল করে তারপর ঘুম।

১১৩।
এর পর থেকেই কিভাবে যেন ব্যস্ততা কমে যাচ্ছিল ক্রমে ক্রমে অনেক কমে গেলো এমনকি কোন দিন এমন হলো যে কোন কাস্টমারই নেই। এই ভাবে সপ্তাহ খানিক পর একদিন ময়না ভাই দুপুরে তাদের সেই নির্দিষ্ট টেবিলে বসে বললো-
-ভাই, একটা কথা আপনাকে বলা দরকার কিন্তু কি ভাবে বলি তাই ভাবছি
-ভাবার কি আছে যা বলতে হবে বলে ফেলেন
-দেখতেই তো পাচ্ছেন অবস্থা এর মধ্যে বেতন দিব কিভাবে!

ইতোমধ্যে সামনে যাকে পার্ট টাইম রাখা হয়েছিলো সে চলে গেছে। রাশেদ সাহেব বললেন-
-এই কথা নিয়ে আর ভাবছেন কেন, বলে দেন আমাকে কবে যেতে হবে। কী, সামনের সপ্তাহে যাব নাকি?
-না সামনের সপ্তাহে না, সামনের সপ্তাহে আমি লন্ডন যাব আপনি এর মধ্যে একটা কাজ খুঁজে দেখেন আমি লন্ডন থেকে আসার পরের সপ্তাহে গেলেই হবে।
-বেশ তাই হবে।
-কিন্তু আপনি যাবেন কোথায়?
-কোথায় যে যাব তা কি আমি জানি? এতো বড় এই পৃথিবীতে এত তড় এই বিলাত, এর মধ্যে আমার মত এক জন রাশেদের জন্য একটু জায়গা কি পাবো না? দেখি প্রথমে লন্ডন যেতে হবে তারপর জব সেন্টারে গিয়ে দেখব কোথায় কাজ পাওয়া যায়।

রাশেদ সাহেব অনেক কষ্টে নিজেকে স্থির রেখে কথা বলছিলেন কিন্তু তার মনে হচ্ছিল মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরেছে। এখন কোথায় যাবেন, কি করবেন, কত দিন বসে থাকতে হবে, কোথায় থাকবো নানান চিন্তা এসে মাথায় গিজ গিজ করছিলো। কোনটা রেখে কোনটা ভাববেন দিশা পাচ্ছিলেন না। ফিরোজের ওখানে যেতে ইচ্ছা করছে না। তাকে কত বিরক্ত করা যায়? ও তো অনেক করেছে আর কত? নাকি দেশেই ফিরে যাব? না তা কি করে যাই? দেশে গেলে উপায় হবে কি? মনে এক জটিল ধাঁধা দেখা দিয়েছে, কি করি এখন? নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হলো। মনে হচ্ছে কোথাও কেও নেই, কিছুই নেই। মানসিক ভাবে ভীষণ দুর্বল হয়ে পরেছেন, ভেঙ্গে পরেছেন। বার বার মনির কথা মনে হচ্ছে। এই ধরনের সমস্যা হলে মনি মুখের দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে? রাশেদ সাহেব যত বড় দুর্যোগ বা বিপদ যাই আসুক মনিকে কখনো কিছু লুকাতে পারে নাসব কথা খুলে বলে। শুনে মনিই সমাধান দিয়ে দেয়।
ও এই কথা, এ নিয়ে এতো ভাবছ কেন? কাল যেয়ে এই ভাবে এই করবে এই বলবে ঠিক হয়ে যাবে। আর চিন্তা করবে না, এখন চলো হাত মুখ ধুয়ে এসো খেয়ে নাও।

মনির কথা মত সে সব সমস্যা সমাধানও হয়ে যায়। মাঝে মাঝে রাশেদ সাহেব অবাক হয়। বাইরে চাকরি করছি আমি আর তা মোকাবিলা করছে মনি। কি জন্যে যেন একবার মা বলছিলেন বৌকে কিছু দিনের জন্য রেখে যেতে। শুনে রাশেদ সাহেব বলেছি্লেন না আম্মা আমার অফিসে ঝামেলা চলছে এখন ওকে রেখে যাওয়া যাবেনা। অফিসে ঝামেলা হচ্ছে তোর তা ও কি করবে? আম্মা সত্যি কথা বললে কি মনে করবেন তাই বলতে চাই না। আসলে অফিসে চাকরি আমিই করি কিন্তু সব ঝুট ঝামেলা সামাল দেয় মনি। আমিতো অফিসের টেকনিক্যাল ব্যাপার গুলিই শুধু ভালো বুঝি, আমার বসেরাও আমাকে এই জন্যে পছন্দ করে কিন্তু এ ছাড়া আরও কত রকমের ঝামেলা এসে পরে তা আর আমার মাথায় ঢুকে না, সেগুলি আমাকে ওর সাথে আলাপ করে ওকে সমস্ত পরিস্থিতি বুঝিয়ে তারপর ওর পরামর্শ নিয়ে সামাল দেই। এইতো এবারে এখানে আসার কয়েক দিন আগে রাতে ঝড় বৃষ্টি হচ্ছিলো সেই রাত আড়াইটার দিকে কলিং বেল বেজে উঠল। সবাই ঘুমে, মনি বেলের শব্দ পেয়ে উঠে দরজা না খুলে ভিতর থেকে জিজ্ঞেস করলো-
-কে?
-ম্যাডাম আমি বসির, স্যারের অফিসের পিওন।
-কি ব্যাপার বসির ভাই এতো রাতে আপনি, কি হয়েছে?
-স্যারকে বড় স্যার অফিসে যেতে বলেছেন।
-গাড়ি পাঠিয়েছে?
-না।
-কোন চিঠি দিয়েছে?
-না।
তাহলে এই রাত আড়াইটায় আমি আমার হাজব্যান্ডকে কি ভাবে বেড় হতে দেই বলেন?
তারপর বসির অফিসে গিয়ে স্যারকে বলার পর সে অফিসিয়াল চিঠি সহ গাড়ি পাঠিয়েছিলো। তখন ও আমাকে ডেকে এই ঘটনা বলে, শুনে আমিতো ভয়ে অস্থির। স্যার না জানি কি বলে। চিঠি দেখলাম, আবহাওয়া খারাপ, সাত নম্বর সিগন্যাল চলছে তাই কন্ট্রোল রুমে ইমার্জেন্সি ডিউটি করতে হবে। রেডি হয়ে অফিসে যেয়ে স্যারকে বললাম। পরে উনি নিজেই বললো, না রাশেদ সাহেব আপনি ভুল করছেন আমি কিছু মনে করিনি। কারণ ভাবী ঠিকই করেছে, ভুল আমিই করেছি। আসলে এত রাতে কাকে খুঁজব আপনি কাছে আছেন তাই আপনার কথাই মনে হয়েছিলো কিন্তু ভাবী যেভাবে আপনার সিকিউরিটির কথা ভেবেছে সেটা আমার মাথায় আসেনি। উনি কোন ভুল করেনি এত রাতে কোন মহিলা তার স্বামীকে ছেড়ে দেয়? আপনি শুধু আমার অফিসার না, প্রথমে তার স্বামী, সেতো তার স্বামীর নিরাপত্তার কথা ভাববেই।
সাথে একটু ইয়ার্কিও করেছিলো। আরে, শোনেন নাই রাজায় রাজ্য শাসিছে রাজারে শাসিছে রানীদেখি আগামী কাল কি অবস্থা হয় আমার যদি এখানে থাকতে হয় তাহলে বিকেলে গিয়ে চা খেয়ে আসবো আর ভাবীকে সরি বলে আসবো। শুনে মা খুশি হয়েছিলেন সেদিন আর বৌকে রেখে যেতে চাপ দেয়নি।
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top