বিকেল বেলার বৃষ্টি [৬]-৩

১০।
ওরা কফি খাচ্ছে এমন সময় কয়েকটা ছেলে এসে ঢুকল তাদের সাথে নেয়ামত উল্লাহ মাহমুদও ছিল। প্রথমে  সাবিহাকে লক্ষ করেনি। বারের সামনে যেয়ে সবাই এক সাথে হৈ চৈ করতে করতে যার যার কাপ নিয়ে এসে বসার
জায়গা খুঁজছে এমন সময় হঠাৎ করে সাবিহার দিকে চোখ গেল।

আরে! সাবিহা তুমি?
হ্যাঁ এইতো
মাহমুদ নিজের কাপ নিয়ে সাবিহাদের টেবিলেই বসে পড়ল
তারপর বল কেমন চলছে
এইতো চলছে আরকি, ও হ্যাঁ! এ হলো আমার ক্লাস মেট নাজিয়া
আমি মাহমুদ
যাক আজ তাহলে রেডি হয়ে বেরিয়েছ!
হ্যাঁ, আসলে আমি আগে বুঝতেই পারিনি, এই নিয়েই নাজিয়ার সাথে আলাপ করছিলাম
ওদিক থেকে একজন মাহমুদকে ডাকল
মাহমুদ সরি, আসছি বলে উঠে গেল
নাজিয়া জিজ্ঞেস করল, আগে চিনতে?
না, এইতো মাত্র গতকাল আলাপ হলো।
কফি শেষ হলে নাজিয়া বলল আমাকে একটু বের হতে হবে, আমি উঠি?
হ্যাঁ চল, বলে সাবিহাও উঠে এলো। বের হবার আগে পিছনে তাকাল। মাহমুদ ওদের বেরিয়ে যাওয়া দেখছে, ওকে ইশারায় কি যেন বলে গেল।

১১।
এভাবে বেশ কয়েকদিন আসতে যেতে এখানে ওখানে প্রায়ই দেখা হয়। হাই! হ্যালো! ব্যাস, এই পর্যন্তই। দুইজনেই মনে মনে আলাপ করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে কিন্তু সে সুযোগ আর হয়ে উঠছে না। একদিন রবিবারে ঝুর ঝুর করে স্নো ঝরা দুপুরে জানালার পাশে সোফায় বসে রাস্তার ও পাশে গোরস্তানের বিশাল ওক গাছের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল  নাদিমের কথা মনে আসছিল কিন্তু ইচ্ছে করেই চেপে রাখার চেষ্টা করছে। কাছে ভিড়তে দিতে চাইছে না। নাদিমকে যা ভেবেছিল আসলে সে তা নয়। সাবিহা কিছুতেই ভেবে পায় না এমন একজনের সাথে সে কেমন করে জড়িয়ে পড়ল! এখানে চলে এসে ভাল হয়েছে। নয়ত কখন কোন অসতর্ক মুহূর্তে কোন ঝামেলায় জড়িয়ে যেত কে জানে? মানুষ কি সবসময় সতর্ক থাকতে পারে? মান সম্মান, পরিবারের মর্যাদা সব ধুলায় মিলিয়ে যেত। পরিণতি কি হোত ভাবতেও শিউড়ে উঠছে। কলকাতায় ফেলে আসা দিনের কথা যতই দূরে সরিয়ে রাখতে চায় কিন্তু কেন যেন বারবার জানালায় এসে উঁকি দেয়। এত দিনের সঞ্চিত কত স্মৃতি, কত কথা, কত মান অভিমান, সব কি ইচ্ছে করলেই মুছে ফেলা যায়? নানা ভাবে নানা দিক দিয়ে ভেবে এক সময় সোজা হয়ে দাঁড়াল। না, আমাকে সে সব দিনের কথা ভুলে যেতেই হবে! ভাবতে ভাবতেই কখন যেন মাহমুদ সামনে এসে দাঁড়াল। মনের দরজা আপনা আপনিই খুলে গেল। এতদিন তুমি কোথায় ছিলে? তাহলে কি তোমার জন্যেই আমি কলকাতা ছেড়ে এখানে এসেছি? সব চেয়ে ভাল লাগে মাহমুদের প্রাণ খোলা হাসি আর ছোট্ট শিশুর মত সরলতা। না হলে কি কেও প্রথম দেখায় এমন করে কোন অচেনা মেয়ের সাথে এভাবে কথা বলতে পারে? না না এ আমি কি ভাবছি? যাকে চিনি না, যার কিছু জানি না তাকে একদিন মাত্র দেখে এভাবে প্রশ্রয় দেয়া যায় না। স্নো ঝরার গতি আস্তে আস্তে বাড়ছে। দেখি, উঠে জানালার পাশে দাঁড়াল। রাস্তায় স্নো জমে সাদা হয়ে গেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে জীবনের প্রথম স্নো দেখছে। আশেপাশের গাছগাছালির ডালে স্নো জমেছে। বাড়ি ঘরের ছাদও সাদা হয়ে গেছে। ভীষণ ভাল লাগছে দেখতে। কিন্তু মাহমুদকে নিয়ে আর ভাববে না মনে করলেও মন থেকে কিছুতেই মাহমুদকে দূরে সরাতে পারছে না। বারবার মাহমুদই সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। এমন হচ্ছে কেন?

১২।
প্রথম দেখার দিন থেকেই মাহমুদ সাবিহাকে এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারছে না। সেদিন ক্যাফেটেরিয়াতে দেখা হলে ভেবেছিল সঙ্গীদের বিদায় করে কিছুক্ষণ আলাপ করবে কিন্তু তার আগেই উঠে গেল। এর পরে দেখা হয়েছে কিন্তু সে কয়েক পলকের জন্য শুধু চোখের দেখা। কথা বলার জন্য মনটা ভীষণ উদগ্রীব হয়ে রয়েছে কিন্তু কোথায় কেমন করে? জীবনের প্রথম ভাল লাগা! সাধের সাজান বাগানের প্রথম গোলাপের প্রথম কলি! কত ভাবেই যে দেখতে ইচ্ছে করে তার কি কোন সীমা আছে? না আছে কোন স্বতঃসিদ্ধ! দেখতে কেমন, সুবাস কেমন কত কি মনে হয়। পাপড়িগুলি একটু হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে ইচ্ছে করে। কেন এমন হয়? কিছুতেই কোন ব্যাকরণ কিংবা থিউরিতে ফেলতে পারছে না। গত ছাব্বিশটা বসন্ত কোথা দিয়ে কেমন করে কেটেছে কখনও ভেবে দেখেনি, ভাবার মত তেমন সুযোগও আসেনি। এত দিন লেখা পড়া নিয়েই ব্যস্ত ছিল। এর বাইরে যে আরও কিছু আছে সে কোনদিন চোখ মেলে দেখেনি। পৃথিবীটা যে এত সুন্দর তা কোনদিন তাকিয়ে দেখেনি। এর আগে এমন কেও এসে তার মনে দোলা দিতে পারেনি, তেমন কোন সুযোগও আসেনি। হয়ত কেও এসেছিল কিন্তু সে বুঝতেই পারেনি! আজ মনে হচ্ছে সাবিহা তার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়েছে, তার চোখ খুলে দিয়েছে। যে চোখ দিয়ে সে দেখতে পাচ্ছে এই সুন্দর পৃথিবী। পৃথিবী এখন অনেক সুন্দর লাগছে। চারিদিকে কত গান, কত সুর, কত রঙ যেন মন ভরে আছে!  তবে কি সে সাবিহার প্রেমে পড়েছে? এই কি তাহলে প্রেম? প্রেম কি এমন হয়? একদিন একটুর জন্যে না দেখলেও মন কেমন করে! শীতের ন্যাড়া পপলার গাছ গুলিও এখন সুন্দর লাগছে, সাউথ শিল্ড থেকে আসার পথে মেট্রো ট্রেনের ইঞ্জিনের শব্দ এখন গানের মত মনে হয়, আকাশটাও যেন অনেক বেশি নীল মনে হয়, মনে হয় যেন সারা বছর ধরেই সোনালী বসন্তের চেরি ফুল ফুটে রয়েছে।

১৩।
কয়েকদিন পরে দুপুরে ক্লাস শেষ করে সাবিহা সিভিক সেন্টারে গেল। ভিতরে ঢুকে দেখে মাহমুদ বইয়ের সেলফে কি যেন খুঁজছে। সাবিহার পায়ের শব্দ পেয়ে ঘুরে থমকে দাঁড়াল।
তুমি? ভাল আছ? অনেক দিন দেখি না!
অনেক দিন কোথায়? এইতো মাত্র কয়েক দিন!
কি বল? আমার মনে হচ্ছে কত দিন দেখা হয় না তোমার সাথে!
কি যে বল, প্রতিদিনইতো ক্লাসে আসছি, কই আমিওতো তোমাকে দেখি না, কোথাও গিয়েছিলে?
না না কোথায় যাব? ক্লাস চলছে না? সামনে পরীক্ষা
কবে?
সেপ্টেম্বরে
সাবিহা হেসে ফেলল। যেন এক সাথে অনেকগুলি পিয়ানোর তারের ঝংকার সারা ঘর জুরে অনুরণিত হচ্ছে। এমনিতে ঘরে শুধু কয়েকটা রুম হিটারের মৃদু গুঞ্জন ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।
ও! সেতো অনেক দূর! এর মধ্যেই পরীক্ষার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছ?
মাহমুদ অবাক হয়ে সাবিহার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষ এমন সুন্দর করে হাসতে পারে!
কি হলো, কি দেখছ
সত্যি বলব?
হ্যাঁ তাইতো বলবে, শুধু শুধু মিথ্যে বলবে কেন?
সত্যি কথা বললে বলতে হয় আমি তোমার হাসি দেখছিলাম। তুমি এত সুন্দর করে হাসতে পার? এত সুন্দর হাসি জীবনে এই প্রথম দেখলাম তাই অবাক হয়ে দেখছিলাম।
কি যে বল! তুমিও কিন্তু সুন্দর করে হাসতে পার। আচ্ছা, বল কি খুঁজছিলে?
একটা রেফারেন্স খুজছিলাম, একটু বসবে? চল একটু বসি!
এখানে? একটু ভেবে বলল, চল
দুই জনেই পাশের ওয়েটিং লাউঞ্জে গিয়ে একটা সোফায় পাশাপাশি বসল। সময় যাচ্ছে কিন্তু কেও কিছু বলছে না। মাঝে মাঝেই এ ওর দিকে শুধু তাকাচ্ছে, চোখে চোখ পড়লেই আবার চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। নীরব। আপ-অন-টাইন নদী দিয়ে যেমন পানি গড়িয়ে যাচ্ছে তেমনি সময়ও বয়ে যাচ্ছে কিন্তু সেদিকে কারো কোন খেয়াল নেই। এক সময় সাবিহা একটু হেসে জিজ্ঞেস করল
কি হলো, কিছু বলছ না তাহলে এখানে আসলে কেন?
তাইতো! বলত কি বলব? এখানে কেন এসেছি?
তুমিই না এখানে নিয়ে আসলে!
তাই নাকি?
কি হলো ভুলে গেলে? তুমি কি কিছু ভাবছ?
হ্যাঁ অনেক কিছু ভাবছি!
কি ভাবছ?
তোমার কথাই ভাবছি
আমার কথা আবার কি ভাবছ?
আচ্ছা, একটা কথা বলব?
কি বলবে বল
What is love?
সাবিহা আবার হেসে উঠল। আবার পিয়ানোর তারে ঝংকার বেজে উঠল। মাহমুদ আবার অবাক হয়ে সাবিহার মুখের দিকে তাকিয় রইল।
আবার কি দেখছ অমন করে?
কই, আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না?
সাবিহা হঠাৎ করেই যেন কোথায় হারিয়ে গেল। অনেকদিন ধরে যে কাল মেঘ তার মনের আকাশে ছেয়ে আছে সেই মেঘের ছায়া ছড়িয়ে গেল চোখে মুখে। সে মাহমুদের এই প্রশ্নের কি জবাব দিবে?
কি হলো কিছু বলছ না?
কি বলব বল?
সাবিহা জানালা দিয়ে বাইরে ঝুর ঝুর করে ঝরা তুষারের দিকে তাকিয়ে উদাস কণ্ঠে বলল
আসলে প্রেম এক এক জনের কাছে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ধরা দেয়। কেও দুমড়ে মুচরে আছরে ফেলে, আবার কেও অনন্ত কাল ধরে এর তপস্যা করে আবার কেউ এটাকে গোলাপের মত সুন্দর করে সাজিয়ে রেখে মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকে। এর কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। যে যে ভাবে নেয় তার কাছে তাই।
যেমন?
যেমন! সাগরের অশান্ত ঢেউয়ে কোন নাবিক তার জাহাজ রক্ষা করতে পারে না জাহাজটা ডুবে যায় আর নিরুপায় নাবিক তার অক্ষমতার ফল চেয়ে চেয়ে দেখে তেমনি, আবার কখনও নীরবে বয়ে যাওয়া শান্ত নদীর মত আবার কখনও শিশির সিক্ত গোলাপের মত স্নিগ্ধ। তোমরা জোসনা দেখ? ভরা পূর্ণিমার জোসনা দেখেছ কখনও? শীতের কুয়াশা ভেজা জোসনা! দেখেছ কখনও?
মাহমুদের মুখে কোন কথা নেই
এক নাগারে কথা গুলো বলে সাবিহা মাহমুদের দিকে তাকাল। মাহমুদ অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনছিল ওকে শান্ত সুবোধ কোন অবুঝ শিশুর মত দেখাচ্ছিল। সাবিহা এক দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে। আবার কারও মুখে কোন কথা নেই। আবার নিস্তব্ধ। অনেক, অনেক দূর থেকে ভেসে আসা অচেনা কোন সুরের মূর্ছনায় উভয়েই মগ্ন। উভয়ের মনই দুরন্ত গতিতে ছুটছে অজানা কোন নিরুদ্দেশের পথে। কে কোথায় যাবে?
এবারও সাবিহা প্রথমে কথা বলল
চল অনেক হয়েছে, এবার উঠি।
সাবিহা উঠে দাঁড়াল। মাহমুদও উঠে দাঁড়াল। যে কথা কোনদিন কাওকে বলতে পারেনি, বলা হয়নি এমনিকি এমন কথা কাওকে বলা যায় তাও কোন দিন ভেবে দেখেনি। এক মুহূর্ত ভেবে সংগে সংগে টেবিলের এ পাশ থেকে হাত বাড়িয়ে সাবিহার হাত ধরে বলল
Sabiha, I am in love with you! এই মাত্র যে গোলাপের কথা বললে আমি তোমার মুখে তাই পেয়েছি, তুমিই সেই গোলাপ
সাবিহা চমকে উঠে ধপাস করে বসে পরল। মাহমুদের হাতে ওর হাত যেভাবে ছিল তেমনিই রইল। সাবিহা ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করল না।
মুহূর্তের জন্য চুপ থেকে বলল, চল আজকে উঠি
মাহমুদ আবার বসে বলল, তুমি কিছু বলবে না?
কালকে আবার দেখা হবে।
কোথায়?
অনেক, অনেক দূর থেকে ভেসে আসা অচেনা কোন সুরের মূর্ছনায় উভয়েই মগ্ন, নিশ্চুপ। শুধু এ ওর মুখের দিকে চেয়ে আছে। সাবিহা কথা বলল
এখানেই।
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top