নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৪৯



৯৭।
শীতের ভোর, ঘন কুয়াশা ভরা, এখনও অন্ধকার। সারা টার্মিনাল জুড়ে ফ্লাড লাইট জ্বলছে তবুও আলো নেই। লাইট গুলি ঝাপসা লাগছে। কোচের ভিতরে উঠে একটু উষ্ণতা অনুভব হলো, মনে হচ্ছে অন্তত এক ঘণ্টা আগে থেকে হিটার
চালিয়ে রেখেছ। এতক্ষণ ঠাণ্ডায় জমে যাবার অবস্থা থেকে রেহাই পেলেন। আরাম করে বসে চোখ বন্ধ করলেন। মিনিট দশেক পরেই কোচ ছেড়ে দিল। টার্মিনাল থেকে বের হয়ে এগিয়ে চলেছে অজানা ওবান শহরের দিকে। সেখানে কি অপেক্ষা করছে কে জানে? চোখ বন্ধ কিন্তু, গাড়ি চলার গতি, মোড় নেয়ার ভাব অনুভব করেই বুঝলেন শহর এলাকা ছেড়ে এসেছে। গাড়ি এখন মটর ওয়েতে চলছে।
সারা রাত তো নিদ্রাহীন ভাবেই গেছে, ভেবেছিলেন একটু তন্দ্রার ভাব যদি হয় ভালো লাগবে। সিটের পিছনে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন।
মনি তুমি আমাকে ইংল্যান্ডে রেখে গেছ। আমি এখন ইংল্যান্ড ছেড়ে চলে এসেছি স্কটল্যান্ডে, যাচ্ছি আরেক অজানা গন্তব্যে।
বন্ধ চোখের পাতার আকাশে ভেসে এসেছে কত দিন আগের উড়ে যাওয়া মেঘের মত সেই ছবি, যেদিন একমাত্র ঘনিষ্ঠ বন্ধু যাত্রাবাড়ির শাহিনকে নিয়ে কল্যাণপুরে গিয়েছিলো স্কুল ফাইনালের পরে বোনের বাড়িতে বেড়াতে আসা মনিরাকে দেখাবার জন্য। আগে থেকে কিছু বলেনি। ও বাড়িতে গিয়ে দুলাভাইয়ের সাথে, আপার সাথে গল্প গুজব করে চা নাস্তা খেয়ে চলে এসেছিলো। আসার পথে শাহিনকে বললো-
-একটা কথা বলতো!
-কি কথা?
-মনিরাকে কেমন দেখলে?
-মানে কি?
-মানে আবার কি, বললাম মনিরাকে দেখে তোমার কি মনে হলো?
-হ্যাঁ ভালো মেয়ে।
-ব্যাস শুধু ভালো মেয়ে আর কিছু না?
-আর কি শুনতে চাও, তুমি কি কিছু ভেবে জিজ্ঞেস করছ?
-যদি তাই হয়?
-তাহলে সে কথা আমাকে আগে বলবে তো, সে দেখা আর এই দেখার মধ্যে পার্থক্য আছে না?
-পার্থক্য আবার কি?
-বারে, এমনি সাধারণ একজন মেয়েকে দেখা আর আমার বন্ধুর বৌ হবে এমন একজন মেয়ে বাছাই করা, এতে আকাশ পাতাল পার্থক্য আছে না?
-তুমি সাধারণ ভাবে যা দেখেছ তাই ভেবেই বলতে পার না?
-হ্যাঁ তা বলা যায় কিন্তু বিষয়টা কি আমাকে বলবে তো, ডুবে ডুবে জল খাচ্ছ নাকি?
-কি যে বল সেরকম হলে তুমি জানতে না?
-তাহলে হঠাৎ আয়োজন করে আমাকে নিয়ে এসে ওকে দেখানোর মানে কি?
-মানে টানে যাই হোক, তুমি কি দেখলে তাই বল।
-হ্যাঁ এক নজরেই চোখে পরার মত মেয়ে।
-ব্যাস এইতো, এইটাই আমি চাইছিলাম। এখন বল তুমি যা ভাবছ আমি যদি সেই ভাবে বলি তাহলে এ ব্যাপারে তোমার মতামত কি?
-দেখ রাশেদ, এতো সংক্ষিপ্ত দেখা দেখে আমি কিছু বলতে পারছিনা বলেছি তো।
-তাহলে কিভাবে বলতে পারবে?
-আমাকে আবার দেখতে হবে।
-তাহলে চলো এখনই যাই।
-ধুর বোকা, এখন গেলে আপা দুলাভাই কি ভাববে?
-ভাবুক, তাতে কি আসে যায়? আমরা কি বাঁদরামি করতে যাচ্ছি?
-না না শোন, আজ কোন অবস্থাতেই হতে পারে না বরং আমরা কাল আসি।
-ঠিক আছে তাই হবে।
কাল আবার গিয়েছিলো। ফেরার পথে শাহিন বললো-
-হ্যাঁ দেখলাম তোমার জন্য উপযুক্ত মেয়ে। আর এ ছাড়া অন্যান্য যা দেখতে হয় এখানে সেটা প্রযোজ্য নয় যেহেতু তোমাদের একই ফ্যামিলি। তবে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো শুধু তোমার বা আমাদের মত হলেই তো হবেনা, ওর মতও জানা দরকার। তুমি কি ওর সাথে এব্যাপারে কিছু আলাপ করেছ?
-না শাহিন আলাপ বলতে যা বোঝায় সেরকম কিছু না তবে আমার মনে হয় ওর অমত হবেনা।
-কি ভাবে বুঝলে?
-কেন তুমি যে ভাবে বুঝেছ, আজ এতক্ষণ ওর সাথে একা একা কথা বলে কিছু বুঝনি? আমিও সে ভাবেই বুঝেছি, আমি যে ওকে কবে থেকে দেখছি তা আমার মনেও নেই।
-আমিতো সরাসরি জিজ্ঞেস করেছি।
-কি বললো? ও তো কিছু বলার মেয়ে না!
-না কিছু বলেনি, ও ভ্যাবাচেকা খেয়ে মাথা নিচু করে চুপ করে বসে ছিলো। কিছু বলেনি, ওর মৌনতা দেখে অনুমান করেছি। এই জন্যেই, শুধু এই আলাপ টুকুর জন্যই আমি সেদিন বলেছি আবার দেখতে হবে। তাহলে এখন কি করবে?
-তুমি বল কি করতে হবে, খালাম্মাকে বলতে হবে তো?
-হ্যাঁ।
-চলো আজই বলে যাই।
-চলো।
শাহিন তার খালাম্মাকে বলছিলো।
-খালাম্মা, আপনি যে রাশেদের জন্য মেয়ে খুঁজছেন সে মেয়ে তো আপনাদের কাছেই রয়েছে।
-কার কথা বলছ তুমি?
-কেন মনিরা!
-মনিরা!
-মনিরাকে তুমি কোথায় দেখলে?
-কল্যাণপুরে ওর বোনের বাসায় দেখেছি, কোন দিক দিয়ে ওকে অপছন্দ করার মত বলেন, আমার মনে হয় রাশেদের জন্য উপযুক্ত মেয়ে।
-না সে কথা বলছি না ও ভালো মেয়ে সন্দেহ নেই। তবে, আমাকে যে একটু দেখতে হবে।
-বেশ তো দেখেন, তাহলে চলেন কাল যাই।
-না কাল না, দেখি আমি তোমার খালুর সাথে আলাপ করে নেই তারপর তোমাকে জানাবো।

সেই রাতেই রাশেদের বাবার কাছে কথাটা তুলতেই উনি যা বললেন সে কথা রীতিমত অবাক হবার মত। রাশেদের বাবা বললেন আমি আর মোসলেম একদিন ওদের বাড়ির পাশের যে দীঘি সে দীঘির পাড়ে আম গাছ তলায় বসে গল্প করছিলাম তখন দেখি দীঘির পানির কাছে কাদায় বসে একা একটা ছোট্ট মেয়ে কাদা পানি দিয়ে খেলছেআমি মোসলেমকে জিজ্ঞেস করলাম এই মেয়েটা কার? ও আমাদের ছোবহান ভাইয়ের মেঝ মেয়ে মনিরা। সেই তখন থেকে এই মেয়ে আমার চোখে। এর পরের ঘটনা খুব দ্রুত ঘটে গেলো। মনিকে বৌ করে যেদিন প্রথম নিয়ে এলো, আসতে আসতে ভোর হয়ে গিয়েছিলো। গাড়ি এসে বাসার নীচে দাঁড়ালো। ছোট খালা, সেঝ মামি এরা এগিয়ে এলো বৌ নামাবার জন্য। রাশেদ তাদের বৌ নামাতে দেয়নি, বলেছিলো
-আম্মা কোথায়?
-তোর আম্মা তো উপরে আয় তুই নেমে আয় আমরা বৌ নিয়ে যাই।
-না আম্মাকে ডাকেন আম্মা এসে তার বৌ নিয়ে যাবে।
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top