ভূতের আছর

সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। যখন নানান জাতের ভূতের বসত বাড়ি ছিল গ্রাম গঞ্জের বিভিন্ন তাল গাছে এবং বট গাছে, বিলের মাঝে ভূতদের খেলার মাঠ ছিল। মাছের পুকুরে ভূতদের রান্নাঘর ছিল, যখন হাট থেকে ইলিশ মাছ

নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ভূতদের রাঁধুনিরা ইলিশ মাছ ছিনতাই করার জন্য হাটুরেদের পিছে পিছে যেত। আবার শ্মশান ঘাটের পাশে নরমুন্ডু দিয়ে ভুতেরা ভলিবল খেলত আর পথিক দেখলেই তাদের সাথে হাডুডু খেলার জন্য টানাটানি করত এবং বাড়ির পিছনের বাঁশ ঝাড়ের পাশে ভূতদের হাট বসত সেই তখনকার কথা বলছি।

জোছনা নামে একটা মেয়ে ছিল। মেয়েটা ছিল খুবই শান্ত শিষ্ট, নরম মেজাজের। কারো সাথে কোনদিন উঁচু স্বরে কথা বলত না, কারো বিরুদ্ধে তার কোন নালিশ ছিল না। তার বিরুদ্ধেও কারো কোন নালিশ ছিল না। একা আনমনে মাটির দিকে চেয়ে নীরবে হেটে যেত আবার নীরবেই ফিরে আসত। মোট কথা ওকে নিয়ে ওর মা বাবার কোন দুশ্চিন্তা ছিল না। ছোট বড় ভাই বোন নিয়ে ওদের সুখের সংসার। গ্রামের এক পাশে ওদের খুবই সাধারণ গোছের বাড়ি। বাড়ির উত্তর পাশে গহীন জঙ্গল আবার জঙ্গলের পরেই মেঠো পথ, পশ্চিমে বাড়ির সীমানা ঘেঁসে রাস্তা এবং তারপরে তেপান্তরের মাঠ কিন্তু দক্ষিণে আর পুবে পাড়ার অন্যান্য শরিক বাড়ি। বাড়িতে চার ভিটায় চারটা টিনের কাচা ঘর। উত্তর ভিটায় যে ঘরটা ওই ঘরে জোছনা ওর দাদির সাথে থাকত।

জোছনা তখন ক্লাস নাইনে পড়ে। একদিন, সারাদিন বেশ ভালই গেছে। সেদিন বিকেলে দিব্যি সুস্থ মেয়ে স্কুল থেকে ফিরে এসে কাপড় বদলান হাত মুখ ধোয়া এবং খাওয়া দাওয়া সব ঠিক ভাবেই করেছে। কিন্তু ঝামেলা হলো রাতে খাবার সময় থেকে। ছোট বড় ভাই বোন সবাই খেতে বসেছে মা খাবার দিচ্ছে।
কইরে জোছনা আয় খেয়ে যা।
মা আবার ডাকলেন কইরে জোছনা শুনছিস না? আয়, তাড়া তাড়ি আয়!
জোছনার কোন জবাব নেই।
বিরক্ত হয়ে মা উঠে এসে দেখে খাটে বসে উত্তর দিকের খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।
কিরে ডাকছি শুনছিস না?
কোন জবাব নেই।
মা রাগ করে কাছে এসে একটু ধাক্কা দিতেই মেয়েটা টুক করে খাটে পড়ে গেল।
সাথে সাথে মায়ের চিৎকার। এই তোমরা আস দেখ আমার জোছনার এ কি হলো! জোছনা কথা বলে না কেন?
সবাই এসে এই অবস্থা দেখে কিসের খাওয়া দাওয়া। সব ওভাবেই পড়ে রইল। দাদা এলেন, দোয়া কালাম পড়ে ঝাড়ফুঁক দেয়া হলো, মাথায় পানি দেয়া হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই জোছনা স্বাভাবিক। এর পরে আস্তে আস্তে মা ওই বিছানায় বসে বসেই কিছু ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিল। পরদিন সন্ধ্যার পর থেকে জোছনা কেমন যেন অস্বাভাবিক আচরণ করছে অস্বাভাবিক কথা বলছে। নাকি সুরে বড় ভাইকে বলল এক চড় দিয়ে ওই তাল গাছের মাথায় উড়িয়ে দিব, আমার সাথে বাঁদরামি হচ্ছে? মাকে বলল ক্ষুধা লেগেছে খেতে দাও। দিচ্ছি মা একটু অপেক্ষা কর। মাকেও সেই বড় ভাইয়ের মত নাকি সুরে বলল কেন, অপেক্ষা করব কেন? দুই সের পুঁটি মাছ এনেছে হাট থেকে সেগুলি রাঁধতে পারনি এখনও? যাও তাড়া তাড়ি রেঁধে নিয়ে এসো তবে আমার জন্যে কয়েকটা মাছ কাচা এনো ভর্তা বানিয়ে খাব।  কাচা মাছের ভর্তার কথা শুনে মা তো অবাক। এই ভাবেই কয়েকদিন গেল। দাদা সকাল বিকেল ঝাড়ফুঁক করছে কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। আজ এর মুণ্ডু চিবিয়ে খাবে কাল ওকে বাড়ির উত্তরে জঙ্গলে নিয়ে বেধে রেখে আসবে অমাবস্যার সময়। এই সব নানান উলটো পালটা কথা বার্তা। এমনিতেও খেতে দিলে আগের মত খায় না একটু খানি খেয়েই উঠে যায়। এই সব

আবোল তাবোল কথা আর কাণ্ড কারখানায় বাড়ির সবার মধ্যে একটু দুশ্চিন্তার ছায়া দেখা গেল সবার মধ্যে বিশেষ করে বড়দের মধ্যে। এমন সেয়ানা মেয়ের মধ্যে এই লক্ষণ কোন ভাবেই সুখের নয়। কোথা থেকে কি হলো কে জানে! নিশ্চয়ই কোন অশরীরী কিছু ভর করেছে নইলে যে মেয়ে কোনদিন একটু মুখ তুলে কথা বলে না সেই মেয়ে করছে কি এইসব! সবাই আশ্চর্য! এ আমাদের জোছনার কাজ নয় জোছনার কথা নয়। ওর উপরে কিছু ভর করেছে সেই এসব করছে। স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। কিসের স্কুল? অ্য, আমি কি করব স্কুলে যেয়ে, ওখানে কি হয়?  আশে পাশের শরিকেরা আসছে যাচ্ছে নানা কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করছে। কি হলো কখন থেকে হলো, কোথাকার ভূত? ইত্যাদি নানা প্রশ্ন। বেশি কিছু কথাও বলতে পারছে না। কিছুক্ষণ বলেই হঠাৎ করে সেদিনের মত খাটে শুয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। তখন মাথায় পানি ঢেলে নানা কিছু করে আবার জ্ঞান ফিরে আসে। মা আর কতক্ষণ নিয়ে বসে থাকতে পারে? এই ভাবেই প্রায় সপ্তাহ দুয়েক চলে গেল। সবাই বলাবলি কানাকানি করছে। একজনে বলল নিশ্চয় ভূতের আছর হয়েছে, এটা নিশ্চয় কোন বজ্জাত ভূত সম্ভবত ওই ওদের স্কুলে যাবার পথে ধুসুরিয়ার বট গাছে যে ভূতটা আমি দেখেছিলাম ওটাই হবে! এ কথা শুনে একজনে বলল তাহলে তুই যখন দেখেছিলি তো তোর উপরে ভর না করে এই নিরীহ মেয়েটার উপর কেন আছর করল? আমি হলে তোর উপরেই আছর করতাম। আর একজনে বলল আরে না আমার মনে হয় ওদের বাড়ির ওপাশের গাব গাছে যেটা থাকে সেইটা। এই রকম নানান কথার সাথে এ পাড়া ও গ্রাম করে রাষ্ট্র হয়ে গেল এবং তার সাথে নানান হিতাকাঙ্ক্ষী নানান জায়গা থেকে এমন একটা ভাল মেয়ের জন্য তাবিজ মাদুলি, পানি পড়া, তেল পড়া, কাইতেন পড়া, চিনি পড়া, কলা পড়া, কড়ি পড়া গামছা পড়া, মিষ্টি পড়া ইত্যাদি নানা কিছু পাঠাতে শুরু করল। এখন জোছনার ওজন ওর নিজের ওজনের চেয়ে অনেক বেশি, প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেল। কিন্তু জোছনার অবস্থার কোন পরিবর্তন নেই।

এই অবস্থার মধ্যে চিন্তায় বাড়ির সবার মুখ যখন শুকিয়ে কাল হয়ে গেছে তখন হঠাৎ একদিন মহাদেব পুর থেকে হরিহর দাস নামে এক ওঝা নিয়ে আসল জোছনার এক শরিক চাচা। খুবই জাঁদরেল এবং অভিজ্ঞ ওঝা। অন্তত গোটা দশেক ভূত ছাড়িয়েছে। আশেপাশে অনেক সুনাম। যে কোন ভূত এর নাম শুনেই ডায়রিয়াতে আক্রান্ত হয়ে যায় এবং  রুগী  ফেলে দুই মিনিটের মধ্যে পালিয়ে যায়।
দেখি রুগী কোথায়?
ওইতো ওই ঘরে, চলুন
ঘরে ঢোকার আগেই দরজার চৌকাঠ এবং ঘরের গন্ধ শুকে ওঝা বলল
আপনারা খুব খারাপ জিনিসের হাতে পরেছেন
কি রকম?
চলুন আগে রুগী দেখে নিই
ঘরের ভিতরে যেয়ে বলল এইতো রুগী
ওঝাকে দেখা মাত্র জোছনা কেমন যেন উসখুস করতে লাগল, এই ওকে ঘরে ঢুকতে দিও না, ওকে তারাও
কিরে তুই আবার এসেছিস এখানে? তুই না সেদিন বলেছিলি এই এলাকা ছেড়ে চলে যাবি!
বললাম ওকে এখান থেকে তাড়াও
আচ্ছা আমাকে তারাতে হবে না, তুই থাক, আমি আজ তোকে কিছু বলব না



জোছনার বাবাকে বলল চলেন আমার যা দেখার দেখেছি, বাইরে চলেন। আমি যা অনুমান করেছিলাম ওই চৌকাঠে যে চিহ্ন দেখেছি তাই। ঠিক আছে অসুবিধা নেই শনি/মঙ্গল বারে মহাযজ্ঞ দিয়ে আসর বসাতে হবে তবেই এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। আজ হলো মোটে রবি বার কাজেই পরশু মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর আসর বসবে।

এর মধ্যে একটা বড় খেজুর পাতার পাটি, এক ঝাঁকা নারকেলের ছোবা, আধা কেজি ধুপ, এক পোয়া জৈন, এক পোয়া শুকনা মরিচ, দুইটা নতুন মাটির ঢাকনা একটা ছোট একটা বড়, একটা গরুর লাঠি, গোয়াল ঘড়ের একটা পুরানো ঝাড়ু, একটা চিমটা, একটা নতুন গামছা, এক পোয়া খাঁটি তিলের তেল, একটা প্রদীপ আর সলতে,  অল্প কিছু সিঁদুর চন্দন আর এক মুঠ তিন রাস্তার মাটি। এই মাটি সংগ্রহ করতে হবে এশার নামাজের পর গোসল করে ভিজা চুলে একা যেতে হবে কিন্তু কোন অবস্থায় কক্ষনো পিছনে ফিরে দেখা যাবে না। এই সব জিনিস গুছিয়ে রাখবেন। আমি মধ্যাহ্নের পরে এসে যা করতে হয় করব সব কিছু ।  তবে লক্ষ রাখবেন আমি এসে যেন শুনি না এটা আনা হয়নি ওটা আনতে হবে। বুঝেছেন? মানে হলো সব কিছু আগে থেকেই জুগিয়ে রাখবেন। সাথে টুকি টাকি কিছু পরামর্শ দিয়ে চলে গেল।

ওঝা মহাশয় যাবার পর শুরু হলো জোছনার ভিন্ন মূর্তি। অসম্ভব রকমের উগ্র হয়ে গেল। একে মারে ওকে ধমকায় ছোট বড় কাউকে মানে না। রীতিমত এখন রশি বেধে রাখা হলেও বাধন খুলে ফেলে। শেষ পর্যন্ত শিকল দিয়ে বেধে তালা লাগিয়ে রাখা হলো। কিন্তু দাপাদাপি করে শিকল খোলার চেষ্টা করাতে পায়ে ঘা হয়ে গেল। কিছু খাওয়াতে পারছে না। মুখ দিয়ে অনবরত ফেনা বের হচ্ছে। কথা জড়িয়ে যায়, চিৎকার করে কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিস্তেজ হয়ে ঝিমিয়ে পড়ে। আশেপাশে দিনরাত কাউকে থাকতে হয় একা রাখা যাচ্ছে না।

যথারীতি সব কিছু আনিয়ে ফর্দর সাথে মিলিয়ে গুছিয়ে রাখা হলো। মঙ্গলবারে বেলা দ্বিপ্রহরের একটু আগেই বাবরি চুলের ওঝা শ্রীমান হরিহর মহাশয় গেরুয়া রঙের থান পরে খালি গায়, গলায় একটা বড় সিমের বীজ, কি কি সব কিছুর হাড়, এ গাছ ও গাছের শিকর বাকর একটা ঝুনঝুনির মত কি যেন এবং এমন কিছু আজগুবি ধরনের বস্তু দিয়ে গাথা মালা একহাতে ত্রিশূল আর কাঁধে অদ্ভুত দেখতে একটা থলে ঝুলিয়ে সাথে একজন শিষ্য নিয়ে হাজির। রাস্তা থেকে জোছনার বাবাকে ডাকতে ডাকতে বাড়ি চলে এলো। জোছনার  কয়েকজন শরিক চাচার সাথে বাবা পথের পাশেই বসে নারকেলের হুক্কা টানছিল আর এই নিয়েই আলাপ আলোচনা করছিল। সবার মুখ গম্ভীর।
কেমন আছেন দাদা?
আমি ভাল আছি কিন্তু রুগীর কি অবস্থা?
না ভাই কোন পরিবর্তন নেই এখন আরও খারাপ হয়েছে!
এইতো, আর চিন্তা করবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে! আচ্ছা সেদিন যা লিখে দিয়েছিলাম সেগুলি কি সব আনা হয়েছে?
হ্যাঁ আনা হয়েছে, কখন লাগবে বলেন বের করে দিতে বলি
এখনই দেন আর এক ঘটি জল দিবেন সাথে
সব কিছু ঠিকঠাক মত গুছিয়ে আনা হলো।
দেখি সব কি ঠিক আছে? সিঁদুর, হ্যাঁ ঠিক আছে। ধুপ কোথায়? ও এইতো ধুপ। গামছা? ও হ্যাঁ এইযে গামছা হ্যাঁ সব ঠিক আছে। আচ্ছা গণেশ এসো, এগুলি নিয়ে এসো। উঠোনের মাঝখানে নিয়ে আসন পেতে নাও।



পান-অনুপান,  আচার অনুষ্ঠানের জন্য যা যা আনতে বলেছিল সেগুলি সব নিয়ে জোছনাদের উঠানের ঠিক মাঝখানে জোছনার ঘরের দিকে মুখ করে খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে আসন পাতা হলো। এক পাশে একটা জল চৌকি পাশে এক ঘটি পুকুরের জল, বড় ঢাকনায় করে নারকেলের ছোবায় ধুপ জ্বালান হলো মাঝে মাঝে এর সাথে জৈন দেয়া হচ্ছে আর ছোট ঢাকনায় চন্দন সিঁদুর রেখে তার পাশে চারটা পান একটা খোসা সহ সুপারি, (এই পান সুপারি ওঝার নিজের থলে করে আনা)  তিলের তেল দিয়ে প্রদীপ জ্বালান হলো। অন্যান্য সব জিনিষ পত্র জায়গা মত রেখে শিষ্য গুরুকে ডেকে দেখাল। গুরু মশায় আসন আর যজ্ঞ পেতেছি দেখুন ঠিক আছে কিনা। গুরু মশাই এসে দেখে কাঁধের ঝোলা থেকে কি যেন এক মুষ্টি বের করে ধুপের সাথে মিশিয়ে দিলে ভুর ভুর করে ধোয়া উঠল এবং চারিদিকে কেমন যেন একটা ভুতুড়ে ভুতুড়ে গন্ধ ছড়াল। আগে থেকেই ওতে ধুপ জ্বলছিল তার সাথে কি মেশাল কে জানে!

দর্শনার্থীরা যাতে কাছে না আসে সেজন্য পাটির চারিদিকে একটা চাড়া দিয়ে দাগ দেয়া হয়েছে। আসন থেকে জোছনার ঘড় পর্যন্ত দরজা সমান করে দুইটা দাগ দেয়া হয়েছে যাতে ঘড় থেকে জোছনাকে নিয়ে সোজা এই আসনে আনতে পারে এবং কেউ যেন এই দাগের মধ্যে না আসে। একটু একটু করে ধুপ আর জৈন পোড়ান হচ্ছে। একটু পরে পরে একটা করে শুকনা মরিচ দেয়া হচ্ছে আর সেই সাথে গুরু ওঝা তার থলে থেকে কি যেন বের করে ছিটিয়ে দিচ্ছে। এতেই প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। পাড়ার প্রায় সমস্ত মানুষ এবং গ্রামের অনেকেই তামাসা দেখার জন্য হাজির। সন্ধ্যার আলো মিলিয়ে যাবার একটু আগে যখন লালিমা প্রায় নিভু নিভু হয়েছে তখন গুরু ওঝা আর এক দফা ধুপ ধুনা দিয়ে প্রচুর ধোয়া তুলে রুক্ষ স্বরে জোছনার এক চাচাকে বলল মেয়েকে নিয়ে আসেন। খবরদার রাস্তায় যেন কোন বাঁধা না থাকে, এই দাগের মধ্যে কেউ যেন আসে না, খবরদার!
চাচি আর বড় বোনেরা মিলে জোছনাকে ধরে এনে গুরুর পাশে নির্দিষ্ট আসনে বসিয়ে দিল। সে কি আর বসে থাকতে চায়? এদিকে ছুটে ওদিকে ছুটে রীতিমত যুদ্ধ করে বসান হয়েছে। দুইজনে ধরে রেখেছে। গুরু তখন ওই বড় ঢাকনা যেটায় ধুপ জ্বলছে সেটা উঁচু করে  জোছনার মুখের দিকে ধরে ফু দিল আর সমস্ত ধুয়া জোছনাকে ঘিরে ফেলল। তখন জোছনার বাম হাতের করে আঙ্গুল চেপে ধরে জিজ্ঞেস করল,  বল তুই কে?
ছেড়ে দে ছেড়ে দে আমি চলে যাব
আগে বল তুই কে?
আমি হরিহর চরণ
আমি তোকে চিনতে পেরেছি আমার কাছে মিথ্যে বলছিস কেন? সত্যি বল এরা সবাই শুনবে
বললাম তো আমি হরিচরণ
আবার মিথ্যে!
এই কথা বলেই আবার আঙ্গুলে চাপ দিল আর ধুপ দানিতে একটা মরিচ ছেরে দিল আর সেই আগের মত ওর দিকে ধোয়া ছড়িয়ে দিল
কান্না জড়ান কণ্ঠে, এবার বলল বলছি বলছি, আমার নাম জগাই দাস
হুম এবার সত্যি বলেছিস, আচ্ছা এবার বল,  তুই কোথায় থাকিস?
ওই শিবালয়ের স্কুলের পাশে যে বট গাছ ওখানে থাকি
এদিকে কেন এসেছিলি? এ্রই ভাল নিরীহ মেয়েটার উপরে কেন ভর করলি?



আমি কি করব, সেদিন এই ঘড়ের পিছনের জঙ্গলের পুরনো গাবগাছে আমার দোস্ত থাকে তার কাছে একটু বসেছিলাম দুই বন্ধু মিলে ভুসকুরার বিলের পুকুরে মাছ খাবার জন্য যেতে চাইছিলাম কিন্তু যাবার সময় দেখি ও জানাল দিয়ে চুল বেড় করে রেখেছে তাই দেখে লোভ হলো আর ওমনি চুল বেয়ে এসে পরলাম।
তোর এই দোস্তের নাম কি?
ওর নাম ঝন্টু দাস
ও এখন কোথায়?
ওইতো গাব গাছে বসে আছে আমার দিকে তাকিয়ে! ওখানে আরও অনেকেই এসেছে
ও বুঝেছি সব গুলিকেই বোতলে ভরতে হবে!
না না ওদের বোতলে ভরিস না ওরাও এখান থেকে চলে যাবে
সেতো তুইও বলেছিলি, মাত্র গতমাসে তোকে শিবালয়ের কাছের এক গ্রাম থেকে তাড়ালাম তখন তুই বলেছিলি এই তল্লাটে আর থাকবি না কিন্তু এই কয়েকদিনের মধ্যেই আবার কেন এসেছিস, দূর হয়ে গেলি না কেন? আজ তোকে আমি প্রথমে গোয়াল ঘরের ঝাড়ু দিয়ে ঝেরে পরে পুড়িয়ে মারব! দেখেছিস কি এনেছি? এই ধুপ দানিতে পোড়া দিব!
দেখেছি দেখেছি, আমি আর থাকব না, আমাকে আজকের মত ছেড়ে দে, জন্মের মত চলে যাব
এমন কথা তুই আগেও কয়েকবার বলেছিস, তোকে আর বিশ্বাস করি না, এই গণেশ দে গোয়ালের ঝাড়ুটা দিয়ে ওকে একটু ধোলাই না দিলে কাজ হবে না ধোলাই দে
না না আমি সত্যিই বলছি এখান থেকে চলে যাব
চোপ
জোছনা নাকি সুরে কান্না করতে লাগল আর সেই সাথে কত বিচিত্র ঢঙ্গে ছেড়ে দেয়ার জন্য কাকুতি মিনতি, কিন্তু কোন কান্নাই হরিহর দাসের কানে ঢুকছে না।
কিরে এমনি কান্না করলে চলবে? কখন যাবি বল!
বলছি তো যাব এখনই যাব
তাহলে যাচ্ছিস না কেন? তোর দোস্তদের যেতে বল
তুই যে আমার আঙ্গুল ধরে রেখেছিস কেমনে যাই? আঙুলটা ছেড়ে দে! ব্যথা লাগছে
তোর আবার ব্যথা! বলেই আরও জোরে চাপ দিল আর অমনিই জোছনা চিৎকার করে উঠল
এই চিল্লাবি না, তুই হরিহর দাসকে এখনও চিনতে পারিসনি। দাঁড়া চেনাচ্ছি। এই গণেশ লাগা ঝাড়ু
অমনিই গণেশ ঝাড়ু দিয়ে জোছনার পিঠে ঝট ঝট করে পেটানো শুরু করল, আর ওঝা মশাই ধুপ দানিতে শুকনা মরিচ সহ প্রচুর ধোয়া বানিয়ে এক হাতে ধরে জোছনার নাকের কাছে এনে ফু দিচ্ছে আর এক হাতে সেই আঙ্গুলে চাপ দেয়া শুরু করল
আর মারিস না আমাকে, আমাকে ছেড়ে দে, ছেড়ে দে আমাকে আমি চলে যাব
তোর জন্যে যা যা আনা হয়েছে তার কিছুইতো দিলাম না কেমনে যাবি? এগুলি নিয়ে যাবি না?
তোর পায়ে ধরি আমাকে ছেড়ে দে, আর কোন দিন তোর এলাকায় আসব না
বেশ! কথা ঠিক? সত্য বলছিস?
হ্যাঁ ঠিক,  সত্যি বলছি, এখন থেকে গাছে গাছেই থাকব আর কারো দিকে চোখ নিব না, কিন্তু আমি কি করব কেউ যদি অমন করে এগিয়ে আসে তাহলে আমি কি করে লোভ সামালাই? ভরা সন্ধ্যায় চুল ছেড়ে বাইরে এলিয়ে দিবে,


শোন শোন তোর এই গীত শোনার জন্য আমি আসিনি। বল তুই যাবার সময় কি চিহ্ন রেখে যাবি? এখানে লোকজন আছে সবাই দেখবে তুই চলে যাচ্ছিস
কি করলে তুই বিশ্বাস করবি বল
ওই যে পশ্চিম দিকে নিম গাছ ওই গাছের একটা ডাল ভেঙ্গে দিয়ে যাবি, পারবি?
হ্যাঁ আমায় ছেড়ে দে আমি এখনই যাচ্ছি
না গেলে কি করব বল
কিছু করতে হবে না আমি যাবই
আচ্ছা দেখি যা তো, নে ছেড়ে দিলাম। ওদিকে গণেশকে ইশারা করল আর গণেশ ঝাড়ু দিয়ে পেটানো বন্ধ করে গুরুর হাত থেকে ধূপদানি সরিয়ে রাখল
ওঝা বলল মেয়েটাকে ভাল করে ধরেন ও কিন্তু এখন পড়ে যাবে। চাচি আর ছোট বোন জোছনাকে ভাল করে ধরে রাখল।
এবার ওঝা আস্তে আস্তে তার ধরা কড়ে আঙুলটা ছেড়ে দিল আর সত্যিই জোছনা এলিয়ে পড়ে গেল। ওখানে ওকে শুইয়ে দেয়া হলো। ওদিকে সাথে সাথেই একটা ঝরের মত শব্দ হলো আর নিম গাছের ওই উপরের একটা ডাল ভেঙ্গে পড়ে গেল মাটিতে। আগত দর্শনার্থীরা সবাই দেখল। ঘটি থেকে মুখে মাথায় পানি ছিটিয়ে দিতে দিতে এক সময় জোছনা উঠে বসল। শরীর অত্যন্ত দুর্বল। মা, মা কোথায়?
এই যে মা আমি এইতো, বলেই জোছনার মা এসে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরল।
ঘটির অবশিষ্ট পানিতে মন্ত্র পড়ে ফু দিয়ে বলল যান এবার ওকে গরম পানির সাথে এই পানি মিশিয়ে গোসল করিয়ে ঘরে নিয়ে যান আর কিছু খেতে দেন, ও যা চায় তাই দেন। কয়েকটা তাবিজ দিয়ে নানা নিয়মকানুন বলে দিলো কি ভাবে কখন এগুলি গলায় বা হাতে পরতে হবে। আগামী অমাবস্যা পর্যন্ত এগুলি পড়ে থাকতে হবে। ঘটির পড়া পানি দিয়ে সাতদিন গোসল করাতে হবে।
এই আচার অনুষ্ঠানের মেয়াদ শেষ হবার পর আস্তে আস্তে জোছনা সুস্থ হয়ে উঠল তবে শারীরিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে সম্পূর্ণ সুস্থ হতে বেশ কয়েক মাস সময় লেগেই গেল।

No comments:

Post a Comment

Back to Top