নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-১২

২৪।
লন্ডন যাবার প্রস্তুতি শেষ। নেহায়েত যা একান্ত দরকার তাই কেনা কাটা করা বা পাসপোর্টে পাউন্ড এন্ডোর্স করা সবই করে ফেলেছে যাবার আগে যাতে কোথাও বের হতে না হয়। আজ মেয়েরা কেও স্কুল কলেজে যায়নি। মেয়েরা সবা
ই উঠে নাশতা সেরে বাবা মাকে নিয়ে বসল। এ গল্প সে গল্প, আশা আকাঙ্ক্ষা কত কি এলো মেলো কথা হলো। আড্ডা জমে উঠে এতো দিনের গুমোট বাঁধা ভাবটা কেটে গিয়ে যেন বাড়িটা আবার প্রাণ চঞ্চলে ভরে উঠলো। বাড়িটা হাসি খুশিতে ভরে গেলো। মেয়েরা সবাই বায়না ধরল মা আজ খিচুড়ি রান্না কর, বাবা পছন্দ করে সবাই মিলে এক সাথে খাব। বড় মেয়ে বললো  না মা তুমি থাক আজ আমি রান্না করি।
দুপুরে ডিম ভাজি দিয়ে খিচুড়ি খেতে বসে মেঝ মেয়ে বললো  মাংস হলে ভাল হতো। ছোট মেয়ে বলে উঠলো যা হয়েছে তাই যথেষ্ট হয়েছে। শুনে মেঝ মেয়ে আবার বললো  হ্যাঁ তাই, ভাগ্যে থাকলে আবার হবে ইনশাল্লাহ। মেয়েদের এই সব বিচক্ষণতা দেখে রাশেদ সাহেব মনির মুখের দিকে তাকালেন। মেয়ে গুলি হয়েছে একেবারে মায়ের মত। কোন বায়না নেই, কোন চাহিদা নেই, কোন চাওয়া নেই, কোন দাবী নেই। যা পাচ্ছে তাতেই খুশী। না পেলেও কোন আফসোস নেই। খাবার পর মেয়েদের নিয়ে আবার বসলেন। ওরা যাবার পর মেয়েরা কি ভাবে চলবে সে ব্যবস্থা মোটামুটি করে রেখেছিলেন।
বড় মেয়ের হাতে সব বুঝিয়ে দিয়ে বলে দিল এর পরেও যদি কিছু প্রয়োজন হয় তাহলে মামা অর্থাৎ তোমাদের দাদাকে ফোন করে জানাবে। আমি মামাকে বলেছি, উনি দেখবেন। ছোট মেয়ে জানতে চাইল
-আব্বু তোমরা এয়ারপোর্টে যাবে কি ভাবে?
-আমি তো ভেবে রেখেছি আমি আর তোমার মা একটা স্কুটার নিয়ে চলে যাব। তুমি কি কিছু বলতে চাও?
মনিরা বললো, -তা কি করে হয়?
-তাহলে কি করতে চাও?
মনি একটু দ্বিধার সাথে বললো-  
-ওদের বাবা মা দুজনেই চলে যাচ্ছে ওরা যদি একটু এয়ারপোর্ট পর্যন্ত এগিয়ে বিদায় দিয়ে আসতে পারে তাহলে মনে হয় ওদের ভাল লাগবে
-কিন্তু সে রকম গাড়ি ভাড়া করার মত টাকা কোথায়? আগে বললে হয়ত কিছু খরচ কমিয়ে ব্যবস্থা করতে পারতাম
-আচ্ছা সে আমি ব্যবস্থা করছি তুমি ভেবো না।
-দেখ যদি পার কর। আমারও তো মনে হয় যাবার আগে সবার মুখে একটু হাসি দেখে যেতে পারলে ভালো লাগতো। দেখ যদি পার কর সবার হাসি মুখ দেখে যাই। আবার কবে ফিরে আসি না আসি তা কি বলা যায়?

রাশেদ সাহেব কোন বাঁধা দিলেন না। মনিরা তার হাতের শেষ সম্বল ভেঙ্গে সেঝ দেবরকে দিয়ে এয়ারপোর্টে যাবার জন্য একটা মাইক্রো ভাড়া করার ব্যাবস্থা করল যাবার সন্ধ্যায় সব কিছু রেডি। গাড়ি এসে অপেক্ষা করছে। মনির মা, বড় বোন, ছোট বোন এসেছে। তারাও এয়ারপোর্টে যাবে। রাশেদ সাহেবের সেঝ ভাই ছোট ভাই আর মেয়েরা সবাই যাবে। মালামাল গাড়িতে তোলা হয়েছে। বাড়ি থেকে বের হবার আগে বাবাকে সালাম করে বিদায় নিতে এলেন।
-আব্বা এর আগেও আমি অনেক বার এরকম যাত্রা করেছি কিন্তু সে সব যাত্রা আর আজকের এই যাত্রার মধ্যে অনেক পার্থক্য। জানি না এটাই আমার শেষ যাত্রা কিনা। ভুল ভ্রান্তি অনেক করেছি, অনেক বেয়াদবিও হয়ে গেছে মাফ করার যোগ্য মনে হলে মাফ করে দিবেন। আমি তো বাড়ি ছাড়া, দেশ ছাড়া হলাম আমার মেয়েরা রইলো
মনে মনে ভাবলেন বাবা আপনাকে আবার দেখতে পাব কিনা জানি না। এই বলেই ভেজা চোখে বেড় হয়ে গাড়িতে উঠলেন। এয়ারপোর্টে পৌঁছে সবার কাছ থেকে একে একে বিদায় নিলেনশাশুড়ি, বড় আপা, ছোট শ্যালিকা শ্যালিকার গাল টেনে একটু রসিকতা করলেন, ছোট ভাই, সেঝ ভাই, সবার শেষে মেয়েদের কাছে। মনি মেয়েদের বোঝাচ্ছে কাঁদে না মা আমি তো কয়েক দিন পরেই আসছি। মেয়েদের একে একে সবাইকে বুকে নিয়ে মন শক্ত করার কথা বলে মনিকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলেন।
এয়ারলাইন্সের চেক ইন কাউন্টারে এসেই কায়সার বেয়াইর সাথে দেখা।
-আরে বেয়াই আপনি এখানে?
-লন্ডন যাচ্ছি। আপনারা?
-আমরাও তো ওখানেই যাচ্ছি
-যাক ভালোই হলো

২৫।
চেক ইন, ইমিগ্রেশনের ঝামেলা সেরে ওয়েটিং লাউঞ্জ। কিছুক্ষণ বসেই রাশেদ সাহেব পাশে বসা মনির হাত ধরে আবার গেয়ে উঠলেন তরে লইয়া যাইমু আমি লন্ডনে—–---------মনিরা শুকনো কাঠের মত একটু হেসে হাতটা ছাড়িয়ে উঠে গিয়ে বাসায় ফোন করে খবর নিয়ে এলো গাড়ি পৌঁছেছে কি না। ওদের পৌঁছার খবর পেয়ে নিশ্চিন্ত হলো। মাইকে নারী  কণ্ঠের ঘোষণা ভেসে এলো। উঠে প্লেনে উঠার গ্যাং ওয়ের গেটের কাছে এসে কিউতে দাঁড়ালেন। বোর্ডিং কার্ড চেক হবার পর শেষ বারের মত সিকিউরিটি চেক সেরে আস্তে আস্তে গ্যাং ওয়ে দিয়ে প্লেনের ভিতর এসে সিট নম্বর খুঁজে বসে পড়লো।
মনিরা জানালার পাশে তার পাশে রাশেদ সাহেব। রাশেদ সাহেব মনির হাত ধরে গুনগুনিয়ে আবার সেই গান গাইছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে সব যাত্রী ওঠা হলে মাইকে বিমান বালার কণ্ঠ ভেসে এলো, যাত্রী দের সিট বেল্ট বাঁধার অনুরোধ এবং ঢাকা বিমান বন্দর ছেড়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই কুয়ালালামপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে জানিয়ে দিল। একটু পরেই প্লেন টারমাক ছেড়ে এসে রান ওয়ে দিয়ে ছুটে চলে এক সময় ঢাকা বিমান বন্দরের মাটি ছেড়ে আকাশে উড়ে গেলো। নিচে রাশেদ সাহেবের অপূর্ণ সব স্বপ্নের সাথে রাতের ঢাকা শহরের ঝকমকে নানা রঙের বাতি পরে রইলো।
রাশেদ সাহেবের মুখটা মলিন হয়ে গেলো। এই ঢাকা শহর আমাকে একটু জায়গা দিতে রাজী হলো না। আমার নিজের শহর, নিজের দেশ ছেড়ে আমাকে যেতে হচ্ছে ভিন্ন দেশের ভিন্ন শহরে। মনি রাশেদ সাহেবের এই পরিবর্তন দেখে তার মাথাটা নিজের বুকে টেনে নিয়ে বললো, -মন খারাপ করবে না, এইতো ক’দিন দেখতে দেখতে চলে যাবে তার পরে তো আবার আসবে। ততক্ষণে প্লেন অনেক উপরে উঠে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর শহরের দিকে উড়ে চলেছে। নিচে তখন কিছু কিছু ছিটে ফোটা আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছে। রাশেদ সাহেব মনির বুক থেকে মাথা উঠিয়ে জানালা দিয়ে নিজ দেশের শেষ বিন্দুটা দেখে নিতে চাইলেন কিন্তু আর সে সময় পেলেন নাপ্লেন ততক্ষণে বাংলাদেশের স্থল সীমা পেরিয়ে বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে এগিয়ে চলছে।

২৬
রাশেদ সাহেব অনন্তের উদ্দেশ্যে যাত্রার শেষ মুহূর্তে নিজ দেশের শেষ কণাটা দেখতে না পেরে মনটা বিষণ্ণতায় ভরে গেলো। মুখটা অন্ধকার হয়ে গেলো। মনিরা দেখতে পেয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখে তার নিজ মনের বিষণ্ণতা, যাতনা কষ্ট সব চেপে রেখে হেসে ফেলল। কি হয়েছে তাই, এমন মন খারাপ করছ কেন?
মানুষটা এইতো এতোক্ষণ কি আনন্দে ছিলো। হঠাৎ করেই কেমন নিভে গেলো। মনি সব বুঝতে পারল। বুঝেও না বোঝার ভান করে তার কাঁধে স্বামীর মাথা টেনে নিয়ে বললো দেখ একটু ঘুমাতে পার কি না। রাশেদ সাহেব কিছু না বলে সুবোধ বালকের মত স্ত্রীর কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রইল। কখন যেন একটু তন্দ্রার মত এসেছিলো বুঝতে পারেনি। মনির কথার শব্দে তন্দ্রা ভাব কেটে মনির দিকে তাকিয়ে দেখে মনি কার সাথে কথা বলছে। এ পাশে চেয়ে দেখে মালয়েশিয়ান এয়ারহোস্টেস খাবার মেনু নিয়ে এসেছে, তারা কি খাবে মনি তাই বলে দিচ্ছে। রাশেদ সাহেব মনির হাত চেপে ধরে আবার গেয়ে উঠলো সেই গানটা। মনি আবার একটু হাসল। এই হাসির আড়ালে কত কষ্ট চেপে রেখেছে তা শুধু মনিই জানে। স্বামীকে বুঝতে দেয়নি। কত দিন পরে সে তার স্বামীকে একটু হাসি খুশি দেখছে, তার ভাল লাগা দেখছে। তাকে আর বিব্রত করা কেন? থাক না তার কষ্ট চাপাই থাক। ওকে আর জানাবার কি এমন দরকার? তার ভাল লাগায় বিঘ্ন ঘটাবার কোন ইচ্ছা হলো না, যে ভাবে চলছে চলুক। নিয়তি যে দিকে নিয়ে যায় সেদিকেই চলুক।

খাবার পরে চা খেয়ে রাশেদ সাহেব আবার মনির কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে একটু চোখ বুজলেনকতক্ষণ এভাবে ছিলো তা বুঝতে পারেনি। হঠাৎ মাইকে কুয়ালালামপুর বিমান বন্দরে নামার ঘোষণা শুনেই চমকে উঠলেন।
-একি মনি, তুমি আমাকে একটু ডাকবে না? তুমি একটু চোখ বন্ধ করতে পারতে। এভাবে সারা রাত জেগে রইলে কেন?
-কেন আবার, দেখলাম তোমার নাক ডাকছে, কত দিন পর তুমি একটু ঘুমিয়েছ তাই আর ডাকিনি। বেয়াই এক বার এসেছিলো খোঁজ নিতে। ওনার সিট সামনের দিকে, তোমাকে ঘুমে দেখে কিছু বলেনি চলে গেছে। আমারও চোখ বন্ধ হয়ে এসেছিলো।
-নাও রেডি হয়ে নাও
জানালা দিয়ে দেখলেন মালয়েশিয়ার আকাশে ভোরের আলো ফুটে উঠছে। নিচে পাম বাগানের সারি দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ি লাল মাটির বুকে পাম গাছ গুলি দেখতে বেশ লাগছিলো।
-দেখ মনি একে বারে ঠিক আমাদের সাভারের মত তাই না?
মনি জানালা দিয়ে দেখে বললো-  
-হ্যাঁ তাইতো!
একটু পরেই প্লেন নেমে মাটি স্পর্শ করে মটরিং করে ধীরে ধীরে টারমাকের দিকে এগিয়ে এসে থেমে গেলো। দরজা খুলে দেয়ার পর যাত্রীরা সিট বেল্ট খুলে একে একে যার যার সিট ছেড়ে নেমে গেলো। রাশেদ সাহেবরাও নেমে এসে ট্রান্সফার ডেস্ক খুঁজে তাদের টিকেট দেখিয়ে বসার যায়গা এবং পরবর্তী ফ্লাইটের ডিপার্চার গেট জেনে নিয়ে বসে পরল। কায়সার বেয়াই এলো একটু পরেই।
-আসেন বেয়াই
-আমি এখানে দুই দিন থাকবো, আপনারা চলে যান লন্ডনে গিয়ে দেখা হবে।
-লন্ডনে আপনি কোথায় থাকবেন ফোন নম্বরটা দিয়ে যান
ফোন নম্বর নিয়ে সে যেখানে থাকবে সে বাসার ঠিকানা দিয়ে চলে গেল।

এখানে দশ ঘণ্টা বসে থাকতে হবে।
-চলো না মনি বাইরে যেয়ে কুয়ালালামপুরে একটু বেড়িয়ে আসি। তুমি ভয় পেয়ো না, আমি এখানে সব চিনি। এয়ারপোর্টে এই দশ  ঘণ্টা কি করবো?
মনি খরচের কথা ভেবে বললো-
-না আমার ভাল লাগছে না। তার চেয়ে চলো ভেতরেই হাঁটা হাটি করি। চারিদিকে তো কাঁচের দেয়াল সবকিছুই দেখা যায়। বাইরে গিয়ে আবার কি দেখবে? তারপরে আবার তো চৌদ্দ ঘণ্টার জার্নি রয়েছে, শুধু শুধু ক্লান্তি বাড়ানোর কি দরকার? চলো একটু হেঁটে দেখি।

বলেই মনিরা উঠে গিয়ে একটা ট্রলি নিয়ে এসে তাদের হাতের ব্যাগ গুলি ট্রলিতে নিয়ে এগিয়ে বললো এসো, ঘুরে দেখি। রাশেদ সাহেব মনির পিছনে উঠে গেলেন। এ মাথা থেকে ও মাথায় যত দোকান পাট যা আছে সব ঘুরে ঘুরে দেখে এক সময় ক্লান্ত হয়ে আবার এসে বসলেন তাদের লন্ডনের প্লেন যেখান থেকে ফ্লাই করবে সেই Cগেটের কাছে। মনিরা খরচের কথাটা রাশেদ সাহেবকে বুঝতেই দেয়নি যে সে খরচের কথা ভেবে বাইরে যেতে চায়নি। এখানে বাইরে গেলেই অন্তত সত্তর ডলার বা পঞ্চাশ পাউন্ড খরচ হয়ে যাবে। সে জানে তার পাগল খেয়ালের বসে যা মনে আসছ তাই বলছে। সেও যদি আবেগের বশে তাই রাজী হয়ে যায় তাহলে কি আর চলে? মামার কাছ থেকে আনা টাকা দিয়ে পাউন্ড কিনে এনেছে। তাকে যে আবার এই টাকা ফেরত দিতে হবে। লন্ডনে গিয়ে কি হবে না হবে তার কি কিছু ঠিক আছে?
[চলবে] Back to Home

No comments:

Post a Comment

Back to Top