নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-১৮

৪০।
সবাই গাড়িতে উঠা মাত্রই ভাবী গাড়ি স্টার্ট করে লন্ডনের পথে ছুটে চলল। ইফতারির আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকি। গাড়িতে এক মাত্র দুই বোতল পানি ছাড়া আর কিছু নেই। শেফালি স্ট্রাউড শহরে ঢুকে একটা সুপারস্টোরের পার্কিঙে
গাড়ি পার্ক করে ফিরোজকে বললো তাড়াতাড়ি নেমে যাও দেখ কিছু নিয়ে এসো। এখানেই গাড়িতে বসে ইফতার করে আবার লন্ডনের পথে। অল্পক্ষণের মধ্যেই সেই এম ফাইভ মটর ওয়ে। ঝড়ের মত একশত মাইল বেগে ছুটছে গাড়ি। ড্রাইভিং এর শিক্ষিকা মিসেস শেফালি আতিক মুখে কেমন একটা অস্বস্তির কালো রঙ মেখে ট্রাফিক নিয়মের কোন বালাই না মেনে এক মনে ছুটে চলেছে।

যেন পিছনে বৃশ্চিক দংশনের কোন অগ্নি দগ্ধ করুন বিভীষিকা ফেলে যত তাড়াতাড়ি পালিয়ে যেতে পারলেই বেঁচে যায়। গাড়ির ভিতরটা নিস্তব্ধ, কারো মুখে কোন কথা নেই। কেবল মাত্র ইঞ্জিনের যান্ত্রিক একটা শব্দ আর তার সাথে গাড়ির চারটা চাকার সাথে মটর ওয়ের কঠিন পাথর আর পিচ মেশানো পথের ঘর্ষণের শব্দ। একটু পরেই হঠাৎ ফিরোজ পকেট থেকে মোবাইল বের করে ওর বাসায় ফোন করে বলে দিল আমরা আসছি। ------রাশেদ সাহেব মনিরাকে বললো মনি পানির বোতলটা দাও তো
রাত সাড়ে আটটা নাগাদ ওরা ফিরোজের বাড়ির সামনে নেমে মালামাল নিয়ে নেমে এলো। এর মধ্যে কারো মুখে কোন কথা নেইরাশেদ যা বোঝার বুঝে নিয়েছে। ঘরে গিয়ে শীতের কাপড় চোপর ছেড়ে কোন ভাবে রান্না ঘরে এসে খেয়ে মনিকে নিয়ে উপরে গিয়েই এই পৃথিবীতে এক মাত্র আশ্রয় মনির বুকে মাথা রেখে শুধু জিজ্ঞেস করলো-
-মনি, একি হলো? কেন এমন হলো? এটা কিসের প্রাপ্তি?
মনিরা কিছু বলতে পারলো না শুধু স্বামীর মাথাটা শক্ত হাতে চেপে রেখে চুপ করে রইলো। মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে রাশেদের ঘুমের জন্য চেষ্টা করতে লাগল। রাশেদের ঘুম আসছে না। মনে মনে বার বার ওই একই কথা ভাবছে। কি হলো, কেন হলো? কোন জবাব সে খুঁজে পেল না। আজ যদি ফিরোজ গাড়িতে করে না নিয়ে যেত, তারা যদি কোচ বা ট্রেনে করে যেত তাহলে কি হোত? কি করতে পারত সে। এই শীতের মধ্যে এতগুলি মালামাল সহ একজন মহিলাকে নিয়ে তার কি অবস্থা দাঁড়াতো? সে মনিরাকেও আর কিছু জিগ্যেস করার সাহস পাচ্ছে না। মনিরাও একই কথা ভাবছে। দুজনের কারোরই ঘুম আসছে না। সারাটা রাত নিদ্রাহীন ভাবেই কেটে গেলো, কিন্তু এর মধ্যেও কেও কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছে না। কারো মুখে কোন কথা নেই, নীরব, নিস্তব্ধ। যেন কোন রাক্ষস পুরী থেকে তারা কোন ভাবে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছে, সেই রাক্ষস পুরীর আতঙ্ক ওদের কণ্ঠ রুদ্ধ করে দিয়েছে।

সুখের রজনী কোথা দিয়ে পার হয়ে যায় সে কেও কোন দিন টের পায় না, হিসেব কেও রাখতে পারেও না, কিন্তু দুঃখের রজনী? সে তো সহজে পোহাতে চায় না, সহজে শেষ হয় না, যেন অনন্তের যাত্রা। সে যাত্রা যে কোথায় শেষ হবে তা কেও জানে না! কণ্টক জর্জরিত সে পথ ফুরাতে চায় না! এই এত বড় পৃথিবীর কে কোথায় সুখে আছে আর কে দুঃখে আছে সে হিসেব কে রাখে? এ তো পৃথিবীর কাজ না! তোমরা কে সুখে আছ আর কে দুঃখে আছ সে দেখতে গেলে কি আমার চলে? আমিতো তোমাদের সবাইকেই জায়গা দিয়েছি। তোমরা নিজ নিজ সুখ বা দুঃখ খুঁজে নাও, আমাকে আমার পথে চলতে দাও। তোমাদের জন্য কি আমি থেমে থাকতে পারি? আমাকে কেও কখনো দেখেছ ক্ষণকালের জন্য আমি থেমেছি?

রাতের পরেই দিন আসে, উদয় হয় নতুন সূর্যের। বিগত রাতের সকল দুঃখ ব্যথা, আনন্দ বেদনা সব কিছু সূর্যের তাপে জ্বলে পুরে নিঃশেষ হয়ে আবার নতুন করে সব শুরু হয়। মানুষ নতুন প্রেরণা পেয়ে, নতুন উৎসাহ নিয়ে, শক্তি নিয়ে আবার শুরু করে। এই বুঝি প্রকৃতির উপহার। এতেই বুঝি সব দুঃখ, জ্বালা যন্ত্রণা সব শেষ হয়ে যাবে!
এক সময় রাশেদ মনিরার কাল রাত্রি শেষ হয়। এটা লন্ডন শহর, এখানে আজানের সুরে ভোর হয় না। এখানে ভোর হয় ঘড়ির কাটা ধরে। সূর্য উঠুক বা না উঠুক, ঘড়ির কাটা ধরে ভোর হয়ে যায়। আজ আকাশটা একটু ফর্সা দেখাচ্ছে, পাশের ট্রেন লাইন ধরে ভোরের প্রথম ট্রেন যাবার শব্দ ওরা দুজনেই শুয়ে শুয়ে শুনল।
এতক্ষণে মনিরা রাশেদকে ডাকল-
-উঠবে?
-ওরা কেও উঠেনি, একটু পরেই উঠি
-সারা রাত তুমি ঘুমাওনি
-তুমিও ঘুমাওনি
-শোন মনি, কাল যা যা দেখলাম তার শিক্ষাটা রেখে বাকী সব ভুলে যাবার চেষ্টা কর, আর কাওকে কিছু বলার দরকার নেই। এই লজ্জার কথা, এই অপমানের কথা কী বলা যায়? কাকেই বা জানাবে বা জানিয়ে হবেই বা কি?
-হ্যাঁ, আমিও তাই ভেবেছি, যদিও আমি সারারাত ভেবে এর কোন কুল কিনারা পাইনি, নিজের সাথে যুদ্ধ করেও কোন সমাধান পাইনি, তোমাকে আর কি সান্ত্বনা দিব? আমি সে ভাষা খুঁজে পাইনি। তাই আমিও তোমাকে বলব বলে ভেবে রেখেছি, এ ভুলে যাওয়াই ভালো। আশা করি এর একদিন পরিবর্তন হবে। যদি না ও হয় তবে ভাববো এটাই আমাদের নিয়তি।
-হ্যাঁ মনি আমিও আশা করি একদিন এই লোহার কপাট ভাঙবে তবে হয়তবা সেদিন সব শেষ হয়ে যাবে
-তুমি লক্ষ করনি ওখানে যখন ওরা দরজা খুলছিলো না বলে আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম তখন ফিরোজ আমার কানে কানে বলছিলো তোমার ভাই নিশ্চয়ই ঢাকায় ফোন করে তোমার বাবার সাথে কথা বলে নিচ্ছে, সে এখন কি করবে এই ব্যাপারে। এছাড়া আমি দরজা না খোলার আর কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছি না
একটু থেমে কি যেন ভেবে রাশেদ সাহেব জিজ্ঞেস করল -আচ্ছা কি হয়েছিল বলত।
-সে কথা না শোনাই ভাল।
-কিন্তু আমাকে যে জানতে হবে!
-ভাবী বলবে, এখানকার টানে ইংরেজি আর সিলেটী ভাষা মিশিয়ে বলেছে, ওর কথা আমি সব বুঝতে পারিনি, তুমি ভাবীকেই জিজ্ঞেস করে দেখ।
-ভাবীকে এ কথা জিজ্ঞেস করা কি ঠিক হবে?
-তাহলে ফিরোজ ভাইকেই বলবে।
-তুমি যা বুঝেছ তাই বল।
-এ কথা বলার মত না তবুও শোন, জাহিদের বৌ বলল, তোমরা এখানে কেন এসেছ? এক্ষনি চলে যাও নয়ত আমি পুলিশ ডাকব। এই বলেই ভাবীকে ইংরেজিতে অনেক গালাগালি করেছে।
-কেন পুলিশ কেন ডাকবে? আর ভাবীকেই বা গালাগালি করবে কেন, তার সাথে ওর কি সম্পর্ক?
-আমি নাকি সাপ! বলল এই সাপকে কেন নিয়ে এসেছ? আমি এইটুকই বুঝেছি।
-কি বললে?
-আমি বলিনি, ও যা বলেছে আমি তাই বললাম।

-এখন আমার মনে হচ্ছে ফিরোজের অনুমান একেবারে নির্ভুল। কি জানি হতেও পারে, আমারও মনে হয় কথাটা ভুল না। তাই বলে এ কি করে সম্ভব?
কিছুক্ষন নিরব থেকে কি ভাবল, সম্ভবত ভুলে যাবার চেষ্টা করার জন্য মনিকে বললো-  
-চলো আজ কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসি
-কি যে বল তুমি, আমার আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না
-তুমিই বা কি বলছ, কেন যেতে ইচ্ছে করবে না? কাওকে তো আর সাথে যেতে বলবো না। এমনকি ফিরোজকেও না। একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ?
-কি?
-দেখ ফিরোজ কিন্তু আমরা আসার পর আমাদের সংগ দেবার জন্য কাজে যাচ্ছে না, এটা কিন্তু এদেশে আশা করা যায় না। চলো শুধু তুমি আর আমি কোথাও থেকে একটু ঘুরে আসি। সারা দিন বাইরে ঘুরব, ঘরে বসে থাকলে আরও খারাপ লাগবে। তার চেয়ে চলো পিকাডেলি সার্কাস, টেমস নদী, বিগবেন, বাকিংহাম প্যালেস এসব দেখে আসি হয়তবা কাটা ঘায়ে একটু মলমের প্রলেপ হয়েও যেতে পারে। তুমি আমার সাথে আমার পাশে থাকবে, এই এতো বড় লন্ডন শহরে শুধু তুমি আর আমি। কেও জানবে না যে আমরা মনের আঘাতের চিকিৎসার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছি। আঘাতটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সারিয়ে তুলতে হবে। তুমি চলে গেলে আমি এই আঘাত বুকে নিয়ে থাকবো কি করে?
-তুমি যদি মনে কর এতে কালকের ঘা শুকিয়ে যাবে তাহলে বেশ, চলো। কিন্তু, তুমি কি চিনে যেতে পারবে?
-এখনও তোমার সন্দেহ যায় নি? চলো না গেলেই দেখবে, নাহয় একটু বেশি হাঁটলেই বা। এ দেশে রিকশা নেই যে এই রিকশা চলোবলে আমার মনিকে রিকশায় নিয়ে যেতে পারব।
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top