দয়ালু ভূত

ছোট বেলা থেকেই সাহেদের টো টো করে ঘুরে বেড়াবার ইচ্ছেটা মনের মধ্যি খানে জাঁকিয়ে বসেছে। দিনের সাথে সাথে যে ওর দেহ মন আস্তে আস্তে ওর অজান্তেই বেড়ে উঠছে তার কিছুই টের পাচ্ছে বলে মনে হয় না। স্কুল থেকে কলেজ

তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার সাথে সাথে সাহেদের ওই টো টো করে ঘুরে বেড়াবার সাধ পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে। এখন আর শুধু এলাকার চৌহদ্দির মধ্যে সীমিত নেই। নিজ শহর ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের সমুদ্র পাড়, কক্সবাজার, মহেশখালী, সিলেটের জাফলং, মাধব কুণ্ড, ছাতক, ওদিকে বাগেরহাট থেকে দক্ষিণে সুন্দরবন, বগুড়ার মহাস্থান গড় পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে তার এই ভবঘুরে অভ্যাস।
বাড়িতে একা কি করবে? সাথের কোন ভাই বা বোন কেউ নেই। দুই বোন ছিল তাদের বিয়ে হয়ে শশুর বাড়ি চলে গেছে। একা বাড়িতে বসে থাকা সাহেদেরমত ছটফটে তরুণের পক্ষে মোটেই সম্ভব নয়। মা কিংবা বাবা কতক্ষণ আগলে রাখবেন? ঘরের বাইরে যে তাকে যেতেই হবে। না হলে মনে হয় এই বুঝি দমটা আটকে শ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। বাইরের তেপান্তরের হাতছানি, শহরের নানা রঙের আলোর ঝলকানি তারপরে দূর গায়ের ওই স্বপ্ন ভরা সবুজের মায়া ভরা মিনতি, ধুলো মাখা রাঙ্গামাটির কাচা মেঠো পথের বুনো গন্ধ, বনের গাছের উঁচু ডালে ঘুঘুর বাসা কিছুতেই তাকে ঘরে স্বস্তি দিতে পারে না।
সাহেদের মহল্লায় একই সাথে বেড়ে উঠা এবং এক সাথে পড়া শুনার ফাঁকে নানা দুষ্টামি আর নানা কাজের সাথী রনি। যেখানেই গেছে, যেখানে যা করেছে তা এই দুই বাউণ্ডুলে মিলে এক সাথেই করেছে। ওদের আর এখন কিছু মুখে বলতে হয় না। এক জন আর এক জনের মনের কথা ঠিক চেহারা দেখে বা নিতান্ত ইশারায় বুঝতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাটা যে দিন শেষ হলো সেই দিন বিকেলে মা খুব আগ্রহ নিয়ে বলল-
বাবা, আজ কিন্তু তুই কোথাও যাসনে, এ কয় দিন পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত ছিলি বলে কিছু বলিনি। আজ তোকে নিয়ে আমরা সবাই বিউটির বাড়ি যাব। ড্রাইভারকে বলে রেখেছি। তোর বাবাও সময় মত চলে আসবে।
আচ্ছা মা ঠিক আছে যাব। আমারও বড় আপুর জন্য মনটা কেমন করছে, কতদিন আপুটাও আসে না।
কিন্তু এত সুন্দর করে বলে যেই খেয়ে দেয়ে একটু বাড়ির বাইরে বের হয়েছে আর দেখে রনি ওদের বাড়ির দিকেই আসছে।
কি রে সাহেদ কোথায় যাচ্ছিস?
না কোথাও যাচ্ছি না, তোকেই মনে মনে ভাবছিলাম। সন্ধ্যার পর মা বাবার সাথে বড় আপুর বাসায় যেতে হবে তুইও যাবি নাকি তাই বলতে চাইছিলাম।
তুই কি ভাবছিস আমার মাথা গোল হয়ে গেছে?
তার মানে?
মানে আবার কি, তুই এত সুবোধ বালক কবে থেকে হলি নিজেকে জিজ্ঞেস করে দেখ!
আহা কি ব্যাপার খুলে বলবিতো!

এই সারা জীবন ধরে পড়া শুনা করে পণ্ডিত হয়ে আজ একটু স্বাধীন ভাবে ঘুরব বলে কত দিন ধরে বসে আছি আর উনি বলছে বড় আপুর বাসায় যাব! যা ভাগ বেকুব কোথাকার!
কি করি বল মা বলছেন তাই ।
আর আমি কি ভেবে রেখেছি জানিস?
কি?

আজ রাতে লং ড্রাইভে যাব!
কোথায়?
কোন দিক নেই। যে দিকে গাড়ির চাকা যেতে চায় সেই দিকেই যাব। এবার কিন্তু যাবার পথে আমি ড্রাইভ করব তুই আসবি ফেরার পথে।
ও! তাহলে তো যেতেই হবে। দাঁড়া দেখি মাকে একটু ফাঁকি দেয়া যায় কিনা। আমি এখন বাড়ি যাই তোকে সময় মত জানাব।
চুপি চুপি বাড়িতে এসেই সোজা গ্যারেজে ঢুকে গাড়ির একটা স্পার্কিঙ্গ প্লাগের তার খুলে রেখে লক্ষ্মী বালকের মত মায়ের কাছে বসে টিভি দেখছে। একটু পরেই বাবা এসে বলল-
কি তোমরা রেডি হওনি?
হ্যাঁ এইতো হচ্ছি। বলেই সাহেদের মা সাহেদকে একটু তাগিদ দিয়ে নিজে পোশাক পাল্টাতে চলে গেল। ফিরে এসে দেখে সাহেদ যেমন ছিল তেমনই বসে আছে।
কি রে যাবি  না?
না মা তোমরা যাও, আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। আমি পরে এক দিন যাব।
সাহেদের বাবা বের হয়ে দেখে ড্রাইভার এগিয়ে আসছে। কি ব্যাপার মোতালেব, গাড়ি বের করেছ?

স্যার, গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না!
স্টার্ট নিচ্ছে না মানে কি?
হ্যাঁ স্যার, অনেকক্ষণ চেষ্টা করলাম কিচ্ছু হচ্ছে না।
আচ্ছা ঠিক আছে তুমি একটা ট্যাক্সি ডেকে আন।
বাবা আর মা বের হবার সাথে সাথে সাহেদ বের হয়ে রনিকে খবর দিয়ে এলো। আব্বু আম্মু চলে গেছে কখন বের হবি?
খেয়ে দেয়ে রাত নয় বা সাড়ে নয়টার দিকে বের হই?
হ্যাঁ ঠিক আছে। আমি গাড়ি নিয়ে তোদের বাড়ির সামনে দিয়ে হর্ন বাজিয়ে সোজা সামনের রাস্তায় যেয়ে দাঁড়াব।

কথা অনুযায়ী সাহেদ গাড়ি নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড় করে ড্রাইভিং সিট থেকে বের হয়ে পাশের সিটে বসে রইল। একটু পরেই রনি এসে উঠে সাহেদের হাত থেকে চাবিটা নিয়েই সোজা টঙ্গির দিকে চালিয়ে দিল। কিছু দূর গিয়ে বলল-
চল দোস্ত আজ নবীনগরের দিকে যাই!
চল, এর থেকে বেশি যেতে পারব না। তেল বেশি নেই আবার টেনশনে ছিলাম বলে মানি ব্যাগ ফেলে এসেছি।
আরে আমার মানি ব্যাগও রেখে এসেছি! কি আশ্চর্য ব্যাপার? তা হলে যাব কেমনে?
চল এমনিই যত দূর যেতে পারি, তেলের ইন্ডিকেটর অর্ধেক দেখালেই ব্যাক করবি।
চল তাই করতে হবে আর কি।
আশুলিয়া হয়ে পলাশ বাড়ির কাছে এসে একটা ছোট্ট ঘুন্টি ঘরের মত চায়ের দোকান দেখে রনি তার পাশে এসে গাড়ি থামিয়ে বলল চল একটু চা খেয়ে নিই।
চা খাবি পয়সা পাবি কোথায়?
বলিস কি, চায়ের পয়সাও নেই?
বলছি কি?
আচ্ছা চল।
নবীনগরের তেরাস্তার মোড়ে এসে বায়ে ঢাকার পথে না গিয়ে রনি কেন যেন ডানে আরিচার দিকে গাড়ি ঘুড়িয়ে দিল। রাত প্রায় এগারটা বাজে। রাস্তায় নাইট কোচের সাথে অল্প কিছু গাড়ির চলাচল। বলতে গেলে ফাঁকা রাস্তা। কত স্পিডে চালাচ্ছে কেউ দেখছে না। ভিতরে নীরব, কারো মুখে কোন কথা নেই শুধু সামনে এগিয়ে চলছে তো চলছেই। কোথায় কত দূর এসেছে কেউ কিছুই বুঝতে পারেনি। হঠাৎ করে গাড়ি একটা ধাক্কা দিয়ে থেমে গেল। ড্যাশ বোর্ডে তাকিয়ে দেখে তেলের কাটা নেমে গেছে। গিয়ার নিউট্রাল করে হ্যান্ড ব্রেক চেপে দুই জনেই নেমে পাশে দাঁড়াল।
রনিই এতক্ষণের নীরবতা ভাঙল।
এখন ফিরব কি ভাবে?
কি জানি!
গাড়িটা লক করে দুই জনে একটু একটু করে হাঁটছে আর শীতের কনকনে বাতাসেও ঘামছে। কোথায় এসেছে কিছুই বুঝতে পারছে না। হাটতে হাটতে বেশ কিছুটা পথ এগিয়ে গেছে। কাউকে যে জিজ্ঞেস করবে রাস্তায় তেমন কাওকে দেখছে না। গ্রামের রাস্তা এই রাত দুপুরে নিরব কোন মানুষের ছায়া পর্যন্ত নেই। শুধু একটু পরে পরে এ দিক ওদিক থেকে রাতের কিছু বাস ট্রাক ঝড়ের বেগে আসছে আর যাচ্ছে। এই গতির গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞেস করা যায় না। রাত যতই অন্ধকার হোক অন্ধকারেরও নিজস্ব একটা আলো থাকে সেই আলোতেআশে পাশে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। চারিদিকে নিঝুম নিস্তব্ধ। আশে পাশের কোন গ্রামের কোন বাড়িতে আলো দেখা যাচ্ছে না। আদৌ কোন গ্রাম বা বাড়ি আছে কিনা তাও বোঝা যাচ্ছে না। আসা যাওয়ার গাড়ির হেড লাইটেও কোন বাড়ি ঘরের ছায়া নেই। এর মধ্যে যত দূর হেটে এসেছে তাতে শুধু রাস্তার দুই পাশের ক্ষেতের সবুজ ছাড়া আর কিচ্ছু নেই।
হঠাৎ ডান দিকের দুই জমির আল ধরে এক জনকে দেখল মেইন রোডের দিকে আসছে। গায়ে চাদর জড়ানো। মাথা সহ মুখের অধিকাংশই ঢেকে রেখেছে। লোকটাকে দেখে দুজনেই থমকে দাঁড়াল। ধীর শান্ত পায়ে এগিয়ে এসে বড় রাস্তায় উঠে ওরা যেখানে গাড়ি রেখে এসেছে তার উলটো দিকে যাচ্ছে। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে রনি ডেকে বলল-
এই যে ভাই একটু শোনেন!
লোকটা সামনের দিকেই যাচ্ছিল। ওর ডাক শুনে মুখটা একটু ঘুড়িয়ে ওদের দিকে দেখল।
আচ্ছা এটা কোন জায়গা?
কোন উত্তর নেই। আচ্ছা আমরা একটা বিপদে পরেছি এখন কি করব, গাড়ির তেল দরকার। কোথায় পাব বলতে পারেন?
লোকটা হাতে ইশারা করে কাছে ডাকল। ওরা কি করবে না করবে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওদের অবচেতন পা গুলি ওই লোকটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কাছাকাছি গিয়েও লোকটার মুখ ভাল করে বুঝতে পারল না, চাদরে ঢাকা। লোকটা চাদরের ভিতর থেকে দুই হাত বেড় করে রাস্তার উপর কি যেন নামিয়ে রেখে হাতে ইশারা করে দেখাল নিয়ে যেতে।  লোকটা বোতল দুইটা নামিয়ে রেখেই যে দিকে যাচ্ছিল সেই দিকে এগিয়ে গেলএবার একটু জোড়ে হাঁটছে। পিছন থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করল এটা কোন জায়গা? আগের মত কোন জবাব নেই। ওরা দুই জনেই এক এক করে হাতে নিয়ে দেখল দুইটা বড় দুই লিটারের পানির বোতল ভরা। কি দিল এটা? লোকটা কোন কথা বলল না কেন? ভয়ে ভয়ে হাতে নিয়ে বোতলের মুখ খুলেই বুঝল এগুলি ভরা পেট্রোল। সন্দেহ হলো। আবার শুকে দেখে বুঝল, না ভিন্ন কিছু নয়, পরিষ্কার পেট্রোল। ওদের অবাক দৃষ্টি অন্ধকারের মধ্যেও একে অপরের দিকে এবং হঠাৎ আগত এই অচেনা রহস্যময় লোকটার পথের দিকে তাকাল। কিন্তু লোকটা ততক্ষণে আর নেই। এই অন্ধকারে যত দূর দেখা যাবার কথা তার আগেই নেই হয়ে গেছে।
কি করি?
চল গাড়িতে ভরে দেখ স্টার্ট হয় কিনা।
দুই জনে দুই বোতল হাতে নিয়ে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে গাড়ির কাছে এসে বোতল খালি করে চার লিটার তেল ভরে হাতের খালি বোতলটা পিছনের সিটের নিচে ফেলে গাড়িতে বসে যেই চাবি ঘুরিয়েছে অমনি গাড়ি স্টার্ট। আর দেরী নয়। গাড়ি ঘুড়িয়ে যে পথে এসেছিল সেই পথে। প্রায় দেড় ঘণ্টা চালাবার পর রাস্তার পাশের দোকানের সাইন বোর্ড দেখে চিনল এটা মানিকগঞ্জ।  রাস্তার দুই পাশে  দুইটা পেট্রোল পাম্প। ওই এক পাম্পের লোকদের নিজেদের এই বিপদের কথা বলে সাহেদ তার নিজের হাতের ঘড়ি খুলে বলল এই ঘড়িটা রেখে আমাদের ঢাকায় যাবার মত তেল দিন। কাল দুপুরের মধ্যে এসে টাকা দিয়ে ঘড়ি নিয়ে যাব। ঘড়িটা খোলার আগে দেখে এখন  রাত বারটা চুয়াল্লিশ মিনিট। দামি ঘড়িটা দেখে পথের মানুষকেও বিশ্বাস করে ট্যাঙ্ক ভরেই তেল দিয়ে দিল। তেল ভরে সাহেদ নিজেই ড্রাইভ করে রাত তিনটা চৌদ্দ মিনিটে বাড়িতে এসে পৌঁছল। সেই বোতলটা এখনও সাহেদের বাড়ির গ্যারেজে পরে আছে। শুধু বোতলটা যে দিয়েছে তার কোন হদিস বা পরিচয় কিছুই পায়নি। পর দিন মানিকগঞ্জে যেয়ে পাম্পের টাকা দিয়ে ঘড়িটা নিয়ে গত রাতে যেখানে গাড়ি থেমে গিয়েছিল সেখান অবধি গিয়ে চিনতে পারল শিবালয়ের কাছাকাছি এক জায়গা কিন্তু এখানে ওই লোকের কোন সন্ধান পায়নি। এই লোকটা কে তার কোন কুল কিনারা আজ পর্যন্ত জানা যায়নি

No comments:

Post a Comment

Back to Top