নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৩১

৬৩।
রাশেদ সাহেব উপরে এসে যোহর আসর দুই ওয়াক্তের নামাজ পড়েই বিছানায় গড়িয়ে পরলেন। ক্লান্ত লাগছে। বিছানার সামনে দেয়াল ঘড়িতে দেখলেন তিনটা দশ। কখন যে চোখ বন্ধ হয়ে এসেছে, ঘুম ভাঙল নুরুল ইসলামের ডাকে।

-কি ভাই সাহেব ইফতার করবেন না? উঠেন উঠেন সময় নাই।
লাফ দিয়ে উঠে বাথরুম থেকে ওযু করে নিচে গিয়ে দেখে ইফতারের আয়োজন চলছে। আসাদ বললো-
-ভাই আপনি ওই ওখানে দেখেন গ্লাস আছে. ওই যে ওই বারের ভিতরে। ওখানে সিংক ও আছে ওখান থেকে কয়েক গ্লাস পানি আনেন।
গ্লাস ভরে আনতে যাবে আবার আসাদ বললো -
-আরে ওখানে ট্রে আছে তো! ট্রেতে করে আনেন।
-ওহ! হ্যাঁ হ্যাঁ দেখেছি
ট্রেতে করে গ্লাস নিয়ে এসে সবার সামনে একটা একটা করে নামিয়ে রেখে নিজে বসল এক পাশে।
-রোজা আজ কয়টা যাচ্ছে?
-২৬টা।
-দেখতে দেখতে চলে গেলো।

রাশেদ সাহেব রোজার দিনে তার বাড়ির ইফতারের টেবিলে সবাইকে নিয়ে বসে এক সাথে রোজা সম্পর্কে কিংবা অন্যান্য ধর্মীয় প্রসঙ্গে আলোচনা করতেন, বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষা দেবার জন্যে। তার কথা হলো ইফতার তৈরি করে অন্তত কিছুক্ষণ আগেই যেন সবাই ধীরে সুস্থে টেবিলে এসে বসে। ইফতারির সময় এত হুলুস্থুল করার কি দরকার? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন আরও আট দশ মিনিট বাকি আছে। তিনি সবাইকে উদ্দেশ্য করে রোজার শেষ কয়দিনের সম্পর্কে বলতে শুরু করলেন। সবাই কথা থামিয়ে তার দিকে মনোযোগ দিয়ে শুনছে। বলা শেষ করে বললেন আসেন আমরা সবাই এবারে একটু মুনাজাত করি। মুনাজাত শেষ হবার সাথে সাথেই কবির বললো -
-টাইম হয়ে গেছে নিয়ত করেন।
আজকেও গতকালের মত খেজুর, ছোলা ভুনা আর পায়েসের মত দেখতে হলুদ রঙের স্বাদহীন খিচুরি। রাশেদ
সাহেব এই স্বাদ বিহীন  খিচুরি খেতে পারলেন না।
মারুফ বললো -
-তাহলে ভাই সাহেব আপনে আর একটু ছোলা নেন।
-তা নেয়া যায়।
-যদি মনে করেন তাহলে ভাত খেয়ে নিতে পারেন তরকারি রেডি আছে।
-না ভাত লাগবে না এতেই হবে।
ইফতার করতে করতে নুরুল ইসলাম বললো -
-ভাই সাহেব খুব সুন্দর মুনাজাত করলেন। যে কয়দিন আছে এইভাবে করবেন। সবাই একসাথে বলে উঠলো হ্যাঁ হ্যাঁ আগে কিছু বলে নিবেন। আজকের মত ইফতারের সময় আর গল্প হবে না। কাল থেকে ভাইছাব মুনাজাত করবে।
-আচ্ছা, নামাজ কি সবাই আলাদা আলাদা পরেন?
-হ্যাঁ অই আরকি যে যেমনে পারে।
-তা কেন, উপরে বেশ জায়গা আছে ওখানে সবাই এক সাথে পড়া যায়। চলেন সবাই এক সাথেই পড়ি এমনিতেই আমরা অনেক কিছু জেনেও না জানার মত চলি। মানার মত ব্যবস্থা থাকলেও মানি না। কত কিছু ইচ্ছা করেই হোক বা অনিচ্ছা করেই হোক ছেড়ে দিই। জামাতে সওয়াব বেশি এটা যদি পারি তাহলে করবো না কেন?
-আচ্ছা চলেন তাহলে আপনে যখন বলছেন।
উপরে এসে নামাজ পড়ে রাশেদ বললো -
-আমার একটু চা লাগবে আমি নিচে যাই আপনারা কেও আসবেন?
-হ্যাঁ আসছি চলেন।

৬৪।
আবার নিচে এসে চা পর্ব সেরে উপরে এসে এবারে একটা সিগারেট বানিয়ে বিছানায় কাত হলেন।
মেয়েরা কি করছে? নিশ্চয়ই বাবার কথা মনে করছে। মনি আজ কি ইফতার বানিয়েছিলো? নাকি মনিকে আজ মেয়েরা রান্না ঘড়ে ঢুকতে দেয়নি? এতো লম্বা জার্নি করে গেছে। ধকল তো কম না। তাহলে কে ইফতার বানিয়েছে? হয়তো রেখা নয়তো খুকুমাঝু কি বাবার জন্যে প্লেট সাজিয়েছিলো? না না তা সাজাবে কেন? বাবা নেই সে কথা কি আর মাঝু জানে না? তবে মনে করেছিলো নিশ্চয়। অভ্যস্ত চোখটা বাবাকে খুঁজেছে ইফতারের টেবিলে। বাবা নেই কেমন লাগছিলো তখন মেয়েদের? ইফতারের প্লেটটা বাবার জন্যে মাঝুই সাজাত। বাবা যা পছন্দ করে মা বলে দিতে দিতে কখন যে ওদের তা মুখস্থ হয়ে গেছে তা কি ওরা জানে? তবুও মা মনে করিয়ে দিতেন মাঝু তোমার বাবার প্লেটে পিঁয়াজু কোনটা দিয়েছ? রাশেদ সাহেব কড়া ভাজা পিঁয়াজু খেতে চায়না তার জন্যে আলাদা নরম করে ভেজে দিতো। মাঝু বলতো হ্যাঁ বাবা দিয়েছি, আমার বাবা আমি কি জানিনা আব্বুকে কি দিতে হবে? তুমি তাড়াতাড়ি মরিচ ভেজে দাও। গোলান বেসন মাখা মরিচ ভাজা তার প্রিয়। মাঝু জানে আর কারো জন্যে না হোক বাবার জন্যে অন্তত চারটা মরিচ ভাজতেই হবে। ইফতারের সময় হয়ে যাচ্ছে বাবা আসছে না মাঝু ফোন করে খবর নিতো। আব্বু তুমি কোথায়?
হ্যাঁ আব্বু আমি আসছি, এইতো মসজিদ পর্যন্ত এসেছি। তাড়াতাড়ি আস ঘড়ি দেখেছ?

এক গ্লাস ক্যান্ডিরালের সরবত। ভেজানো চিড়া, বেল, কলা, পেঁপে, তরমুজ, লেবু না থাকলে ছাদের টবের লেবু গাছ থেকে লেবু পাতা এনে তাই শরবতের সাথে ডলে দেয়। মাঝে মাঝে পুদিনা পাতা যখন যা পেতো তাই দিয়ে বাবার জন্যে এক গ্লাস ক্যান্ডিরালের সরবত। যূথী ইফতারে পিঁয়াজু, ঘুমনি, ছোলার চেয়ে আলুর চপ বেশি পছন্দ করে তাই সে সবসময় একটা চপ যূথীকে তুলে দিত। চপ নিয়ে যূথী আর ওর দাদার হইচই। দাদা বলে আমার দাঁত নেই তাই আমি চপ খাই তুমি চপ পছন্দ কর কেন? তুমি পিঁয়াজু খাও সব চপ আমার। টেবিলে প্লেট গ্লাস সাজানোর কাজটা করে যূথী আর মার সাথে থাকে খুকু। আবার ওদিকে ইফতার নামাজ সেরে মা একটু শুয়ে বিশ্রাম না নিলে অস্থির হয়ে পড়েএমনিতেই সে শ্বাসকষ্টের রুগী, তার বিছানাটাও যূথী করে রাখে। আজ কি করেছে না কি ভুলে গেছে? মনি কি আজ ইফতারের পরে একটু শুতে পেরেছিলো? ইফতারের পরে নামাজ সেরে সবাই আবার টেবিলে এসে বসতো বড় এক থালায় করে পিঁয়াজু, ঘুমনি, ছোলা, চপ, কুচানো ধনে পাতা কিংবা পুদিনা পাতা যেদিন যা থাকে কাঁচামরিচ, টমাটো রাখা থাকে। এই থালাটাও মনি কিনেছিলো। বড় দেখে, শুধু ইফতারের জন্যে। সবাই খেয়ে যা থাকে তাই দিয়ে এবার মুড়ি মাখানোর পালা। এটা করতো সেঝ ভাই। এইসব মাখামাখি ভর্তা ইত্যাদি ও যা বানায় তা মনে রাখার মত। ও না থাকলে মাঝু। এই থালাটাও মাঝুই গুছিয়ে রাখত। টেবিলের মাখানো মুড়ির গন্ধটা যেন নাকে আসছে। সামনে ওই তো একটা পেয়ালা হাতে খুকু বলে উঠলো আব্বু ধর। তার বিহীন যোগাযোগটা কিভাবে যেন ছিঁড়ে গেলো। হঠাৎ চমকে উঠলেন। সামনের ঘড়ি বলছে আমি আর মাত্র দশ মিনিট সময় দিতে পারি উঠে পর রাশেদ। হাতের সিগারেট দুই আঙ্গুলের ফাঁকেই নিভে গেছে। আবার জ্বালালেন। ছাদের দিকে তাকিয়ে পর পর কয়েকটা টান দিয়ে এ্যাশট্রেতে নিভিয়ে কাপর বদলে নিচে চললেন।

৬৫।
এসে কি করতে হবে সব ভুলে গেছেন। মনের যে অবস্থা আর এইমাত্র যে খুকুর দেয়া পেয়ালা রেখে এসেছেন তাতে আর কীইবা মনে থাকবে? সমস্ত কিচেনে ঘুরঘুর করতে লাগলেন কি করি, কি করি? আচ্ছা অন্তত ইফতারের ঝামেলা গুলি ধুয়ে রাখি এর মধ্যে কবির এলে ওর কাছে জানা যাবে কি করতে হবে। একটু পরেই কবির নেমে এলো।
-সালামালেকুম কবির ভাই, আসেন আসেন কি খবর?
-আরে আপনে এগুলি কি করেন ফ্রিজ থেকে মাল বার করেন!
-হ্যাঁ ভাই আসলে আমি ভুলে গিয়েছিলাম কি করতে হবে তাই এইটা করছিলাম।
-ও বুঝছি আসেন আমার সাথে।
দুইজনে মিলে সব মালামাল বের করে যা যা করতে হবে সব গুছিয়ে একেবারে রেডি। মিনিট দশেকের মধ্যেই অর্ডার আসতে শুরু হয়েছে। প্রথম অর্ডার নিয়ে এলো আসাদ। আজকের অর্ডার একটু তাড়াতাড়ি এলো। একের পর এক টেক এওয়ের অর্ডার আসছে আর মারুফের ফ্রাই প্যান, চামচের ঠং ঠং শব্দ, কুকের চিৎকার, কবিরের দৌড়া দৌড়ী, রাশেদ সাহেবের প্যাকেটের গায়ে কারির নাম লেখা, বিল দেখে ব্যাগে ভরা আবার সাথে সাথে মারুফের প্যান ধুয়ে দেয়া, কুককে পোলাও রাইস গরম করে দেয়া, তন্দুরি সেফের নান বানানোর শব্দ। নানের শিক উঠানো নামানোর শব্দ, একটা কিমা নান, একটা পেশোয়ারি নান, দুইটা নানের হাঁক ডাক সব কিছু গতকালের ব্যস্ততাকে ছাড়িয়ে গেলো। এর মধ্যে ঘটনা একটা ঘটে গেলো। ভিতরে চার জনের এক টেবিলের অর্ডারের কারি রাশেদ সাহেব প্যাকেটে ভরে ফেলেছে এখন আসাদ এসে ওই কারি খুঁজে পাচ্ছেনা। মারুফ বললো-
-আমি বানিয়ে সব ডিশে ভরে হট বক্সে রাখতে বলেছি। ভাই সাহেব, ওই যে দিলাম ওটা কি করলেন?
-আমিতো প্যাকেটে ভরে ফেলেছি।
-ইইশ কি করেছেন কি?
-শিগগির বের করেন আবার যেমন ছিলো তেমন করে ডিশে ঢালেন, না না থাক এটা আর দেয়া যাবেনা আমি আবার বানিয়ে দিচ্ছি। এর পর একটু দেখে ভরবেন। নতুন মানুষ নিয়ে কাজ করার কি যে ঝামেলা!
রাশেদ সাহেব মারুফকে বললেন-
-ভাই এই ডেকচিতে কিন্তু সাদা রাইস আর নেই।
-আরে বলেন কি? এই কবির শিগগির সাদা রাইস চড়াও।
-ভাইছাব চার পট রাইস ধুয়ে দেন তাড়াতাড়ি।

এই ভাবে ভুল ঠিক, এলোমেলো, বকাঝকা, গালাগালি, তারা হুড়ো, গুঁতো গাঁতি, চিৎকার, হইচই, চেঁচামেচি সব কিছু মিলিয়ে রাত সাড়ে নয়টার দিকে একটু হালকা হবার পর আসাদ গতকালের মত ট্রে করে চারটা গ্লাসে অরেঞ্জ জুস আর কোক এনে সবার সামনে ধরল। যার যা খুশি তুলে নিয়ে এক চুমুকে শেষ। এর মধ্যে একটু পানি খাবার সময় কেও পায়নি। রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়নিতবে একটু ভিড় কমেছে। তবুও একটু শান্ত পরিবেশ। টেক এওয়ের ভিড়ও কমেছে। এবারে যারা ভিতরে বসে খাচ্ছে তাদের ভিড়। এগুলি মোটামুটি সামাল দেয়া যায়। এখন একটু ধীর গতিতে চলছে। তারপরও কম না, রোজা রাখা শরীর তো এমনিতেই কাহিল তারপর ইফতার আর কি হয় মাঝে একটু পানি খাবার মত সুযোগও পাওয়া যায়না তারপরে নতুন মানুষ। এবার কবিরের একটা মাশরুম রাইসের অর্ডারের সাথে কবির স্টাফের জন্যেও কিছু বানিয়ে কয়েকটা পেয়ালায় রেখে বললো-
-ভাইছাব এই কড়াইটা ধুয়ে দেন তারপরে এই যে এখান থেকে একটা নিয়ে খান।
আসাদ এলো মাশরুম রাইস নেয়ার জন্যে। তখন তাকে বললো-
-ভাই একটু ডায়েট কোক দেয়া যাবে?
-আচ্ছা দিব আর কেও কিছু খাবেন?
-আমাকে একটা, আমাকে অরেঞ্জ, আমাকে পাইন এপল।
-আচ্ছা আনছি, এই টেবিলটা সার্ভ করে নেই।
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top