নক্ষত্রের গোধূলি-[১২৫]-৭৭

১৫৩।
যারা কর্মচারী তারা কাজ শেষ করে রেস্টুরেন্টের উপরে বা কাছে কোথাও মালিকের ভাড়া করা ঘড়ে গিয়ে শুরু করে নিজেদের আড্ডা। এর মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ রয়েছে। লাঙ্গল ছেড়ে লন্ডন এসেছে এমন থেকে শুরু করে দেশের
কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সরকারি কোন পদস্থ কর্মকর্তা, কোন ব্যবসায়ী বেশ বড় কোন ব্যবসায় মার খেয়ে জীবন বাঁচাবার জন্য এসেছে বা অন্তত পড়তে এসেছে এমন পর্যন্ত। সবার সাথে সবার আড্ডা জমে না।
ওদিকে থাকার ব্যবস্থা নিতান্ত আমাদের দেশের কাজের বুয়াদের চেয়ে খুব একটা ব্যবধান নেই। কোথাও হিটার নেই, কোথাও গোসলের পানি নেই, পানি আছে তো গরম পানি নেই এদেশে গরম পানি ছাড়া গোসলের কথা ভাবাও যায় না। কোথাও একটা ছোট্ট ঘড়ের মধ্যে ৩ থেকে ৭ জন পর্যন্ত থাকতে হয়। রাতের কাজের পর ঘড়ে গিয়ে গায়ের জামাটা খুলে কোথাও হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখবে তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। অথচ মালিকের কড়া নির্দেশ ধোপ দুরস্ত কড়া ইস্ত্রি করা জামা প্যান্ট, পালিশ করা জুতা পায়ে টাই বেঁধে ডিউটি করতে হবে। কিন্তু কাপড় চোপর ধোয়ার বা শুকবার জায়গা নেই সেদিকে মালিক পক্ষের কোন মাথা ব্যথা নেই। এদেশে সাধারণত কেওহাতে কাপড় ধোয় না।
রেস্টুরেন্টের কর্মচারীদের জন্য মালিক পক্ষ একটা সাধারণ মানের ওয়াশিং মেশিন পর্যন্ত কিনে দিতে টাকার অপচয় মনে করে। অবশ্য অসুবিধাও আছে। যেমন যারা লাঙ্গল ছেড়ে লন্ডন এসেছে তারা এই মেশিনের মর্ম বুঝবে কেমন করে? কি করে কমোড ব্যবহার করতে হয় তাও জানে না। এদের সাথেই যদি ওই একটু আগে যাদের কথা বলেছি তাদের থাকতে হয় তাহলে কি অবস্থা দাঁড়ায় তা সহজেই অনুমান করা যায়হাতের ঘড়িটা রাখতে হয় বালিশের নিচে। টুথ ব্রাশ বা মাথার চিরুনি পায়ের কাছে বা মাথার পাশে নিচে কোথাও রাখতে হয়, একটা টেবিল পর্যন্ত নেইকোন রকমে এসে ক্লান্ত শরীরটাকে বিছানা নামের একটুখানি ভাঙ্গা খাটে ছেড়ে দিয়ে আগামী কালের ডিউটির প্রস্তুতি নেয়ার অপেক্ষা। রাতে কারো একটু নীরবে ঘুমানো সম্ভব নয়। এত গুলি মানুষ এক ঘড়ে থাকলে যা হবার তাই হয়কাউকে বিরক্ত করা বা এমন কিছু করলে কেহ বিরক্ত হতে পারে এই সাধারণ বোধও অনেকের নেই। এর ব্যতিক্রম যে নেই তা কিন্তু নয় তবে সে হঠাৎ দুই একটা, সাধারণত এই ছবিই বেশি দেখা যায়।

সমস্ত সপ্তাহের কাজের অন্তত দুই সেট কাপড়, প্রতিদিনের এক জোড়া মুজা, দুই একটা বাইরে যাবার কাপড় সব কিছু মিলিয়ে প্রায় এক বালতি কাপড় এই শীতের দেশে হাতে ধোয়া আবার শুকানো এক কঠিন ব্যাপার। অনেকেই গরম কাপড় ধোয়ার ঝামেলায় না গিয়ে যত দিন এমনি গায়ে দেয়া যায় তত দিন গায়ে দিয়ে সেটা ফেলে দিয়ে আবার গরিবের বন্ধু প্রিমার্ক থেকে কম দামে আর একটা কিনে নেয়াই সুবিধা মনে করে। এখানকার মালিকেরা সাধারণত এই সব কর্মচারীদের জন্য কাপড় ধোয়ার মেশিন দেয় না বলে তাদের মনে কোন আফসোস বা বিকার নেই বললেই চলে। অযথা খরচ বাড়াবার এমন কি প্রয়োজন? এমনটা ভেবেই সামান্য একশ পাউন্ডের একটা সেকেন্ড হ্যান্ড মেশিন কিনে দেয়নাঅভাবের তাড়নায় কিংবা নিতান্ত সখের বসে কিংবা চোখে রঙিন স্বপ্নের ঘোরে আমাদের দেশের যারা বিলাতে যায় তাদের অধিকাংশের কাছে এটাই বিলাতের স্বাভাবিক চিত্র।

১৫৪।
রাশেদ সাহেবের দিন গুলি এমনি করে কেটেই যাচ্ছিল। সময় কেটে যেতে হবে তাই। রেস্টুরেন্টের পাশে লাইবেরি, মাঝে একটা ইটালিয়ান বেকারি দোকান শুধু কেক বিস্কুট পাওয়া যায়বাড়িতে যোগাযোগ যা করার তা সবই প্রায় মেইলের মাধ্যমেই করে শুধু নিয়ম করে সপ্তাহে এক দিন ছুটির দিনে ফোন করে। মেইল যাই হোক তাতে কথা শোনা যায় না, মনির বা তার মেয়েদের কণ্ঠের উষ্ণ অনুভূতি গুলি শুনতে পায় নাকেমন যেন শূন্য শূন্য মনে হয়। মন ভরে নাআবার এদিকে ফোন করতে অতিরিক্ত খরচ হয়ে যায়। সে দিকেও লক্ষ্য রাখতে হয়। এমন কীইবা বেতন পায়। সবে কয়েক মাস হলো এসেছেঅন্তত এক বছর না হলে বেতন এর চেয়ে তেমন কিছু বাড়বে না। ফোন করেই যদি সব খরচ করে ফেলে তা হলে কি আর চলে? রাশেদ সাহেব সে কথা ভালই জানে। মনিও তাই মেনে নিয়েছে।
নাসিরের ভিসার মেয়াদ শেষ হতে চলেছে আর মাত্র কয়েক দিন বাকী। দেশ থেকেই টিকেট নিয়ে এসেছে। রিটার্ন টিকেট। রেস্টুরেন্টে নোটিশ দিয়েছে। আগামী ২৩ তারিখে ফ্লাইট। রাশেদ সাহেবের মনে একটা ঢেউ বিস্তারিত হচ্ছে। এক জন সাথি ছিলো, সুখ দুঃখ ভাগ করা যেত। মনটা কিছুটা হলেও হালকাহোতনানা রকম বুদ্ধি পরামর্শ দিতদিনের অধিকাংশ সময় এক সাথেই কাটত। কোথাও যেতে হলেও এক সাথে যেত। এখন? কে তাকে সান্ত্বনা দিবে? কে এমন আপন ছায়ায় ঢেকে রাখবে? কোথায় পাবে এমন আপন জন? এত গুলি প্রশ্নের ভারে রাশেদ সাহেব অস্থির। নাসির কিছু বুঝতে পেরে যতটা সম্ভব সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে। এক দিন বললো-
-রাশেদ ভাই, দেশে ভাবী বাচ্চাদের জন্য কিছু কিনে দেন আমি নিয়ে যাই। আমার কোন শপিং নেই। আপনার যতটা ইচ্ছা দিয়ে দিন। আমি নিজে যেয়ে ভাবীর হাতে দিয়ে আসব। ভাবীকে যতটা পারি সান্ত্বনা দিয়ে বুঝিয়ে আসব।
-হ্যাঁ তাইতো!
সেই দিনই দুপুরের ডিউটি সেরে দুই জনে এক সাথে কাছের সুপার স্টোর টেসকোতে গেলো। গত কাল বেতন পেয়েছিলো বলে পকেটে পাউন্ডের নোট গুলি ছিলো। সারা স্টোর ঘুরে যা যা ইচ্ছা হলো, দুই চোখে যা যা ভাল লাগল এটা আমার খুকুর জন্য, এটা আমার মাঝুর জন্য, এটা আমার ছোটনের জন্য আর এটা আমার মনির জন্য। তিন মেয়ে আর মনির জন্য কিনে আনল। নাসির সাথেই ছিলোসব দেখল কোন বাঁধা দিল না। মানুষটাকে বেঁচে থাকতে হবেযা ইচ্ছা তাই করুক। এক দিন তাকে আবার দেশে তার স্ত্রী সন্তানদের কাছে ফিরে যেতে হবে, এত দিন তাকে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হবে। এই কয়েক দিনেই নাসির এই আত্মভোলা মানুষটাকে একান্ত কাছে থেকে দেখে চিনে ফেলেছে। এমন সহজ সরল সুন্দর মনের মানুষ তার চোখে খুব কমই পরেছে। সে নিজেও পৃথিবীর অনেক দেশ দেখেছে। ঢাকায় ব্যবসা করে, মানুষ কম দেখেনি। মাঝে মাঝে রাশেদ সাহেবকে দেখে অবাক হয়। করুক, তার যা ইচ্ছা তাই করুক। এতেই যদি সে বেঁচে থাকার কিছুটা শক্তি খুঁজে পায় তাহলে তাই হোক। এক দিন নাসিরের যাবার দিন এসে হাজির হলো। রাশেদ সাহেব নাসিরকে বুকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি সামলাতে পারলেন না। বললেন-
-এখানে যা দেখে গেলে ঢাকায় এসব কিছু বলতে যেয়ো না।
-ভাবী জানতে চাইলে কি বলব?
-একটা কিছু বলে দিও।
-তাতে কার কি মঙ্গল? এর চেয়ে সত্য জানাই কি ভাল হয় না?
-ঠিক আছে তোমার যা খুশী তাই বলে দিও, আমাকে আর জিজ্ঞেস করছ কেন?
-চিন্তা করবেন না। ছয় মাসের মধ্যেই আমি আবার আসব, তখন এখানেই আসব এবং আপনার সাথেই থাকব। আপনি ওদের সাথে সে ভাবে ব্যবস্থা করে রাখবেন
-তাই?
-হ্যাঁ।
-বেশ, খুব ভাল হবে, আমি তোমার অপেক্ষায় থাকব।
-মন খারাপ করবেন না। যেভাবে চলছেন এই ভাবেই চলবেন। আমি আসছি, আবার দেখা হবে।

আগেই হিথরোগামী কোচের টিকেট করা ছিলো। রাশেদ সাহেব নাসিরের পথে খাবার জন্য কয়েকটা স্যান্ডউইচ বানিয়ে রেখেছিলো, সে ব্যাগটা হাতে নিয়ে দুই জনে এক সাথে বের হয়ে হেঁটে কোচ স্টেশনে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সোয়ান সী থেকে কোচ এসে স্টেশনে দাঁড়াল। অন্য কোন যাত্রী ছিলো না। নাসির একাই ছিলো। লাগেজটা নিচে বক্সের ভিতর দিয়ে স্যান্ডউইচের ব্যাগটা নাসিরের হাতে দিয়ে হাত বাড়িয়ে বললো-খোদা হাফেজ
-খোদা হাফেজ
ন্যাশনাল এক্সপ্রেসের কোচটা নাসিরকে নিয়ে ছুটে চলল লন্ডন হিথরো এয়ারপোর্টের দিকে।
এমনি করেই দিন কেটে যায়। সপ্তাহ, মাস কেটে যায়, মনের মধ্যে যত ঝড় জমা আছে তার সব কিছু যেমন ছিলো তেমন রেখেই দিন চলে যায় তার আপন ঠিকানায়, সেখান থেকে আর ফিরিয়ে আনা যায়না।
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top