মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১৩

নিরু তাড়াতাড়ি হাতের জগ গ্লাস টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে পায়রার মত এক পলকের মধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নিশাতও ভাবল হ্যাঁ তাহলে এই সেই যাকে আমি ভাবছি, যাকে আমি খুঁজছি। আমার মনের গোপন ভল্টে যার নাম

লিখা আছে। যাকে সেই অনেক দিন আগে দেখেছিলাম বকুল ফুলের মালা গাঁথতে। তাহলে এইই সেই।
এর পর নিশাতরা যত দিন দেশে ছিল দুই এক দিন পরে পরেই ওদের বাড়িতে আসলে প্রায়ই সামনে পরত। দুই চার দিন ওকে দেখেই নিরু মিথ্যে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করত। এভাবে কি আর পালিয়ে থাকা যায়? কতক্ষণ পালিয়ে থাকা সম্ভব? এ তো সৃষ্টির বিধান। কোন আকাশ কুসুম ব্যাপার নয়। মানব জনমের প্রথম সত্য। এক দিন রাতে নিশাত শিহাবের সাথে ওদের বাড়ি এসে দেখে নিরু শিহাবের ঘরে বসে পড়ছে। হারিকেনের আলোতে নিরুর মুখের দিকে চেয়ে দেখল আজ যেন ওকে আরও বেশি সুন্দর লাগছে।
কি পড়ছ দেখি, ও ভূগোল! বুঝতে পার?
একটু চুপ থেকে বলল, না খুব কঠিন
কি বল! এ তো খুব সহজ বিষয়, দাও আমাকে দাও। এটা আমার খুব প্রিয় বিষয়।
বলেই দেরী না করে সামনে থেকে বইটা হাতে নিয়ে বুঝিয়ে দিল। ভূগোল বোঝার অজুহাতে আজ নিরু অতি কাছে থেকে নিশাতকে ভালো করে দেখার সুযোগ পেল। বিশ্বচরাচরে যত ঘটনা নিত্য ঘটে থাকে তার মধ্যে যা নিয়তির নির্দিষ্ট বিধান তা খণ্ডাবার কোন উপায় নেই। আজ নিশাতকে নিরুর কাছে আরও বেশি সুপুরুষ বলে মনে হলো। বোঝানো, কথা বলার ভঙ্গী, সবই যেন ভিন্ন। যা বলে তাই একে বারে অন্তরে গেঁথে যায়। আজকের মত ভূগোল শেষ করে নিশাত জিজ্ঞেস করল আর কোনটা?
জ্যামিতি।
দাও দেখি!
নিরু ঘর থেকে বের হয়ে ওর নিজের ঘর থেকে জ্যামিতি বই নিয়ে এলো। নিশাত ওটা নিয়ে যখন আলাপ করছে এমন সময় যুঁই এসে হাজির
কি রে তোর বৌ নাকি, এতো মনোযোগ দিয়ে পড়াচ্ছিস যে?
যুঁইয়ের মুখে কিছুই আটকায় না, ছোট বোন সম্পর্কে যে এই মন্তব্য করতে পারে তাকে আর কি বলবে! নিশাত মনে মনে খুশী হলেও মুখে একটু অবাক হবার ভাণ করে কৃত্রিম একটা বকুনি দিল যুঁইকে।
তুই যে কি, ছোট বোনকে নিয়ে কেউ এমন কথা বলে?

ওদের বন্ধু বান্ধবীর এই কথার ফাঁকে লজ্জায় রাঙ্গা নিরু উঠে বের হয়ে গেল। তাই দেখে নিশাত আবার বলল
দেখলি, ওর পড়াটা দিলিতো মাটি করেনিজে কখনো একটু বসবি না আমি একটু দেখিয়ে দিচ্ছিলাম তাও দিলি শেষ করেএর পরে কি ও আর আমার কাছে বসবে ভেবেছিস?
না বসলে না বসবে তাতে তোর কি? একটু ভেবে বলল, আচ্ছা দাড়া আমি ঠিক করে দিচ্ছি।
বলে ঘর থেকে বের হয়ে নিরুকে ধরে নিয়ে এসে যেখানে বসে ছিল ওখানে আবার বসিয়ে একটা মিষ্টি বকুনি দিয়ে নাক টেনে বলল এত লজ্জা কিসের? বসে কি পড়ছিলি পড়।
নিশাতকে বলল নে তোর ছাত্রীকে এনে দিলাম, কি পড়াচ্ছিলি পড়া।
কানে কানে বলল, দেখবি আবার আর কিছু পড়াতে যাবি না কিন্তু।
একটু থামবি নাকি আরও কিছু মুরুব্বি গিরি ফলাবি?
বলেই নিশাত নিরুর জ্যামিতি বই আর একটা খাতা নিয়ে যা পড়াচ্ছিল সেখানে থেকে আবার শুরু করল। কিছু ছবি এঁকে একের পর এক দেখিয়ে গেল, কি ভাবে কি লিখতে হয় মোটামুটি এক দিনে যতটা সম্ভব দেখিয়ে দিয়ে বলল
নাও এবার তুমি দেখ।
যুঁই, আমি আসি তাহলে, শিহাব তো এখন এলো না।
কাল আসবি?
শুনেই নিশাত সামনে বসা নিরুর দিকে তাকাল আর নিরুও নিশাতের দিকে। দুয়ে দুয়ে চার চোখের মিলন হলো। এক মুহূর্ত থেমে নিশাত যুঁইয়ের কথার প্রেক্ষিতে নিরুকে জিজ্ঞেস করল কি, কাল আসতে হবে? বলেই কোন জবাবের অপেক্ষা না করে বলল
হ্যাঁ আসতে পারি,  আজ যা দেখিয়ে দিলাম এগুলি তুমি ঠিক করে রেখ কাল আমি এর পরের গুলো দেখিয়ে দিবো।

এই ভাবে বেশ কয়েক দিন গেল। এর মধ্যেই নিশাত আর নিরুর মধ্যে বেশ সুন্দর একটা ভাব জমে উঠেছে। এখন দুই জনেই দুই জনের চোখের ভাষা বুঝতে শিখেছে, মান অভিমান করতে শিখেছে। এক দিন না এলে কৈফিয়ত চাইতে এবং দিতে শিখেছে। দুয়ে দুয়ে চার হয় জ্যামিতির ছলে তাও শিখতে শুরু করেছে।  নিশাত অনেক কিছু বলতে চেয়েছে কিন্তু পারেনি। যখনই বলবে ভেবেছে তখনই যেন মনে হতো কোথা থেকে একটা পাহাড় এসে ওর সামনে দাঁড়িয়েছে, এই পাহাড় ডিঙ্গিয়ে ওর কথা কি নিরুর কানে পৌঁছাবে কোনদিন? কণ্ঠ থেমে যেত গলা দিয়ে স্বর বের হতো না।
কাল কেন এলেন না, আমি আজ পড়ব না।
না পড়লে লোকে তোমাকে মূর্খ বলবে আমার কি হবে?
বলুক মূর্খ তাতে আমার কিছু হবে না।
থাক হয়েছে আর পাকামি করতে হবে না এসো, এখন থেকে যে কয় দিন আছি আর এমন হবে না।

ওদিকে যুঁইয়ের অত্যাচার দিনে দিনে বেরেই চলেছে। নিশাতকে দেখলেই নিরুকে ডেকে বলে এই নিরু ওই দেখ কে এসেছে, যা বরণ করে নিয়ে আয়। আবার নিশাতকেও একই ভাবে বলছে আমি কি জানি তোর বৌকে জিজ্ঞেস কর কিংবা নে এটা খেয়ে দেখ তোর বৌ বানিয়েছে। এদিকে নিশাতদের যাবার সময় ঘনিয়ে আসছে। নিশাতের বাবার ছুটি প্রায় শেষ। সামনে আর মাত্র পাঁচ ছয় দিন বাকী। তার পরেই আবার চলে যাবে নিশাতের বাবার কর্ম স্থল করাচী শহরে।

নিরু কিছু বলতে চেয়েছিল কি না তা নিশাত কোন দিন বুঝতে পারেনি। তবে নিরুর মনে নিশাত বেশ খানিকটা জায়গা দখল করে নিয়েছে এটা নিশাত বুঝতে পারে কিন্তু কত টুক তা বোঝার মত ক্ষমতা নিশাতের নেই। সে কথা বোঝার মত কোন গুরুর সন্ধান এখনো নিশাত পায়নি। নিরুও বুঝতে পারে নিশাত তার টানেই এ বাড়িতে আসে। কেউ কারো কাছে প্রকাশ হতে পারে না। নারীর লজ্জা ভূষণে পরিবেষ্টিত হয়ে নিরু কোন দিন কিছু বলতে পারে না। শুধু মনে মনে নিশাতকে দোষারোপ করে। এই তো আর কয়েক দিন পরেই চলে যাবে। আগের সেই চঞ্চলতা এখন নিরুর মধ্যে নেই, অনেক কমে গেছে। বাড়ির সব চেয়ে দুরন্ত মেয়ে এই নিরু হঠাৎ করে রাতারাতি নীরব নিস্তব্ধ যেন রাশভারী কোন মহিলা হয়ে গেছে। আগের সে হৈ চৈ নেই, দৌড়া দৌড়ী নেই, আগের সাথীদের এখন নিতান্ত ছেলে মানুষ বলে মনে হয়। আগের চেয়ে অনেক ধীর শান্ত হয়ে গেছে। তবুও হঠাৎ করেই সঙ্গীদের ছেড়ে আসতে পারে না। যারা কোন বিচার সালিশ নিয়ে আসে তাদের বিকেলের কোন সময় দিয়ে দেয়। সময় মত বিচার করে দিয়েই রান্না ঘরে মা চাচীর পাশে বসে থাকে, রান্নার যোগার এগিয়ে দেয়। বারেকের মাকে দিয়ে বাড়ির রাখাল সর্দার জয়নুলকে ডেকে এনে বাড়ির আশে পাশে সবজী লাগাবার নির্দেশ দেয়। বাবার মত কোন জমিতে কিসের চাষ করেছে তার খবর নেয়, কোন জমির নিড়ানি হচ্ছে, আজ কোন রাখাল কোথায় কি কাজ করছে সে খবর রাখে। জয়নুল মিয়া সিরাজ ভাইর এই মেঝ মেয়ের কাছে হিসেব দিতে পছন্দ করে। সিরাজ ভাই কিছু জিজ্ঞেস করলে বলে দেয় মেঝ মাকে বলে এসেছি, ও জানে। সিরাজ মাতব্বর অবাক হয় নিরু আবার এসব কবে থেকে শুরু করল। মনে মনে তার মায়ের কথা মনে করে স্বস্তি পায়, যাক মেয়েটা তা হলে দাদির মত হবে।

এক দিন নিশাত এসে দেখে যুঁই বা শিহাব ওরা কেউ নেই। শিহাবের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এমন সময় নিরু সামনে এসেই নিশাতকে দেখে থমকে গেল।
নিশাত অনেক সাহস করে বলে ফেলল তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।
কি কথা?
চল ঐ পুকুর পাড়ে যাই।
না এখানেই বলেন।
কেন, চল না ওখানে।
আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে?
কেন মাথা খারাপের কি হলো?
ওখানে কেউ দেখে ফেললে কি হবে জানেন?
কি হবে?
আপনি কি ছোট মানুষ কিছু বুঝেন না? এটা আপনাদের শহর না, এটা গ্রাম। এখানে সবাই সব কিছু মেনে নিতে পারে না।
, হ্যাঁ তা হতে পারে, কিন্তু এ যে কিছু একান্ত কথা যা এখানে বলা যায় না!
তা হলে চলেন ভিতরে চলেন।
হ্যাঁ তাই ভালো।
আগে নিরু শিহাবের ঘরের ভিতরে গেল, পিছনে নিশাত। নিশাত একটা চেয়ার টেনে বসল নিরু একটা খুটিতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে রইল।
এবার বলেন কি বলবেন।
আচ্ছা নিরু, তোমার মনে আছে, ওই যে তুমি বকুল ফুলের মালা গাঁথছিল আর আমি তোমার পিছনে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম।
কবে?
সে অনেক দিন আগে, ওই তোমাদের ঈদগাহের বকুলতলায়।
না, আমার কিছু মনে পরছে না। দাদু, যুঁই আপা, বড় আপা, মা এরা সবাই বলেছে আমি নাকি আপনাকে ছোট বেলায় দেখেছি কিন্তু ছোট বেলায় আপনাকে কোন দিন দেখেছি বলে আমার কিছুই মনে পরছে না। অনেক চেষ্টা করেছি খুঁজে পাইনি। হঠাৎ আজ এ কথা কেন?
না হঠাৎ না, সেদিন যখন তোমাকে দেখলাম তখন আমার মন বলছিল আমি যেন তোমাকে চিনি, আমার অনেক চেনা তুমি। কিন্তু কোথায় দেখেছিলাম তা কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না। বেশ কয়েক দিন ভাবার পর হঠাৎ করেই মনে এলো তোমাদের বাড়ির পিছন দিয়ে যাবার পথে বকুল ফুলের গন্ধ পেয়ে কেন যেন একটু এগিয়ে গেলাম আর ওখানে তোমাকে দেখলাম তুমি কুড়ানো ফুলের মালা গাঁথছ। আমার মনে হয় তুমিই সেই, সময়ের হিসেব করে মিলিয়ে দেখি তুমি ছাড়া আর কেউ নয়।
কি যে বলেন, কত জনে অমন মালা গাথে। আর কিছু দিন থাকলে দেখে যেতে পারতেন। যখন ফুল ফোটে কত জন এসে কুড়িয়ে নিয়ে যায়।

না নিরু, কত জন আর আমার মনে আঁকা ছবির মধ্যে অনেক ব্যবধান সে তোমাকে আমি কেমন করে বোঝাব বল?
এ কথা শুনে নিরু এই বয়সেই যেন সেই সুদূরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে কিসের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে। মনে হচ্ছে ওর সামনে দিয়ে ভবিষ্যৎ হেঁটে যাচ্ছে আর নিরু তাকিয়ে তাই দেখছে। নিশাতকে কি বলবে কিছু বুঝে উঠতে পারে না। অবাক হয়ে নিশাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মানুষটা কি বলতে চায় কিছু বুঝতে পারে না।
আপনারা কবে যাবেন?
সামনের মঙ্গল বারে।
আবার কবে আসবেন?
কি জানি, আব্বা কবে ছুটি পায়।
আপনি কি এখানে থেকে পড়তে পারেন না? আপনার দাদি আছে তার কাছে থাকবেন।
আমি থাকলে কি তোমার ভালো লাগবে?
এবার আর নিরু জবাব দিতে পারলো না, লজ্জা এসে ঘিরে ধরল। মাথা নিচু হয়ে গেল, হাত দিয়ে অযথাই ওড়নার আঁচল আঙ্গুলে জড়াচ্ছে। নিরু যা বোঝার তা বুঝে নিয়েছে। মনে মনে ভাবছে সে কি তোমাকে বলে দিতে হবে?
দেখি আব্বা আম্মাকে বলে দেখি যদি উনারা রাজি হয়।
এমন সময় শিহাব এসে পড়ায় ওদের কথা ওখানেই থেমে গেল। ওই দিন বাড়িতে ফিরে রাতে খাবার পর নিশাত বাবাকে তার এখানে থেকে যাবার কথা বলতেই তা সাথে সাথে নাকচ হয়ে গেল। যাবার আগের দিন নিরুর সাথে দেখা করতে এলো। প্রথমে শিহাবের সাথে দেখা হলো। শিহাবের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে বলল
চল দাদি আর চাচীদের সাথে একটু দেখা করে যাই।
যা তুই যা আমি আসছি।
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top