মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-১১

নিশাত মনে মনে ভাবল আমরা দুই জনে আমাদের ডার্লিং এর সাথে দেখা করেই এসেছি।
ওরা বুড়োকে গুড নাইট জানিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে এলো। বুড়োর কাছে আসা যাওয়া করে এর মধ্যেই কিছু
ইংরেজি ভাব কায়দা শিখে নিয়েছে।
হাবিব বলল তাহলে আমরা এক জাহাজে থাকছি না?
তাইতো শুনলি।
আমি ভেবেছিলাম এক সাথে থাকব।
আমিও তো তাই ভাবছিলাম, ওই যে ওই লোকটার সাথে যখন কথা বলছিল তখন আমার সন্দেহ হলো তা হলে কি আমরাও দুই জায়গায় যাচ্ছি, তাই জিজ্ঞেস করলাম।
চল এখন আর কোথাও যাব না বাসায় যাই।
হ্যাঁ তাই চল, রাত জাগার জন্য কেমন যেন ভালো লাগছে না, ওহ! দর্জির দোকানে যাবি না?
, হ্যাঁ তাইতো আমি ভুলেই গেছিলামচল, আরে ওইতো সামনেই, দেখেছিস?
আরে হ্যাঁ ওইতো! দেখেছি!
দর্জির দোকানে মাপ দিয়ে সেদিনের মত সোজা হাবিবের খালার বাড়ি এসে খালার কাছে সারা দিনের বিবরণ দিয়ে কিছুক্ষণ টিভি দেখে খেয়ে দেয়ে বিছানায়। সকালে উঠে হাবিব নিশাতকে নিয়ে কাছা কাছি যে সব আত্মীয় আছে তাদের সাথে দেখা করতে গেল। ওখান থেকে বিকেল চারটার আগেই এসে বুড়োর কাছে।
, তোমরা এসেছ বলেই হাতের ঘড়ির দিকে দেখেই বলল ভেরি গুড একে বারে জাস্ট টাইম। গুড! ভেরি গুড! তোমরা আগামী রবিবার বিকেলে ফ্লাই করছ। এখান থেকে ঢাকা তারপর দুবাই আর তুমি দুবাই থেকে লন্ডন। দুবাইতে হাবিব থেকে যাবে এজেন্ট নিয়ে তাকে জাহাজে পৌঁছে দিবে আর তুমি এবং তোমার সাথে আরও যে দুই জন আছে ওরা সহ গালফ এয়ারে লন্ডন। ওখানে গিয়ে ২/৩ দিন থাকবে পরে জাহাজ এলে তখন জাহাজে যাবে।
কোন দুই জন?
বস, ওরা একটু পরে আসবে। ওহ, তোমাদের ড্রেস কবে দিবে, কাল না পরশু?
কাল দিবে বলেছে।
গুড, তা হলে কাল ড্রেস নিয়ে নিও। এখন ওই জেমস রয়ের কাছে যাও ওখানে আর্টিক্যালে সই করে আবার এখানে এসো।
এই জেমস, শুনছ?
কোণায় বসা হালকা পাতলা খাট মত এক জন বুড়োর দিকে তাকিয়ে বলল
বলেন স্যার শুনছি।
এই যে এই দুই জ্যান্টল ম্যানের আর্টিক্যাল রেডি করেছ?
হ্যাঁ রেডি, আসেন ভাই আপনারা এদিকে আসেন
যাও ওনার কাছে।

জেমস রয়ের সামনে এসে বসল।
আপনাদের বাড়িতে কি মানি অর্ডার পাঠাতে হবে?
মানে কি, আমরা তো নতুন কিছু জানি না, একটু খুলে বলেন প্লিজ।
অফিসে এসে যেখানে যা কথা বলা দরকার হচ্ছে হাবিব নিশাতকে ঠেলে দিচ্ছে, তুই বল। সবার সাথেই নিশাত কথা বলছে, হাবিব শুধু ওর সাথে রয়েছে। এর মধ্যেই নিশাত বুঝে ফেলেছে এখানে সব বিদেশি কাজকর্ম, বিদেশি স্টাইল। সবাই কথায় কথায় থ্যাঙ্ক ইউ, সরি, প্লিজ এই সব বলছে।
আপনারা যখন জাহাজে থাকবেন তখন আপনাদের বাড়িতে টাকা পাঠাতে হলে আমরা সেটা মনিঅর্ডার করে পাঠিয়ে দিবো। ও ভালো কথা, আপনারা কি জানেন, আপনাদের পুরো বেতন কিন্তু জাহাজে পরিশোধ করবে না।
তা হলে?
ওখানে মুল বেতনের ৬০% দিবে আর বাকি ৪০% টাকা এখানে শিপিং অফিসে জমা হবে। আপনারা যখন সাইন অফ করে এখানে আসবেন তখন আমরা সে টাকা শিপিং অফিস থেকে এনে আপনাদের দিবো। এটাই নিয়ম। ওখানে যা পাবেন তা দিয়ে নিজের যা লাগে তা কেনা কাটা করতে পারবেন দরকার হলে ব্যাংক থেকে বাড়িতেও পাঠাতে পারবেন। আর এমনি যদি এখানে কিছু টকা লাগে মনে করেন তা হলে কার নামে কোন ঠিকানায় পাঠাতে হবে তা এই যে এই খাতায় লিখে দিন।
বলে একটা বড় হিসাবের খাতার মত একটা খাতা ওদের দিকে ঠেলে দিল। নিশাত হাবিবের সাথে আলাপ করে নিলো।
তুই কি করবি, তোর কি বাড়িতে টাকা লাগবে?
লাগবে না, তবুও কিছু দিয়ে যাই।
কত দিবি?
কি জানি কত পর্যন্ত দেয়া যায় জিজ্ঞেস কর দেখি কি বলে।
আচ্ছা জেমস সাহেব, কত টাকা পর্যন্ত দেয়া যায়?
৫০০ টাকার বেশি না।
তা হলে আমার দুইশ হলেই হবে।
আমার একটু বেশি দরকার, আমি তিনশ দেই।
ওরা ওই খাতার ছক অনুযায়ী সব পূরণ করে দিল।
এটা হয়ে গেলে জেমস রয় দুই জনের নামে দুইটা ভিন্ন বইয়ের মত বের করে দেখিয়ে দিল এখানে এখানে সই করেন।
নিশাত হাতে নিয়ে দেখল, ওই বইতে ওদের নাম ঠিকানা, আইডি নম্বর, পদ, বেতন, জাহাজের নাম, জাহাজ কোন বন্দরে রেজিস্ট্রি হয়েছে এমন নানা ধরনের তথ্য লেখা। সই স্বাক্ষর হয়ে গেলে জেমস বলল যান এবার ওখানে যান। এবার বুড়োর টেবিলে এসে দেখে অচেনা দুই জন বুড়ো ব্যাপটিস্টের সাথে কথা বলছে। ওরা দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ শুনেই নিশাত বুঝল এরা ওদের মত নতুন নয়। ব্যাপ্টিস্ট এবার নিশাতকে বলল এই যে এই দুই জন তোমার সাথে যাবেএ হচ্ছে এনামুল হক, তোমাদের কুক আর এ সালেক মিয়া, টোপাস মানে তোমাদের ক্লিনার। এদের দায়িত্ব কিন্তু তোমার।
আচ্ছা ঠিক আছে এখন তোমাদের আর কোন কাজ নেই তোমরা পরশু সকালে এসে সব কিছু নিয়ে যাবে। এখন তাহলে গুড নাইট।
এমন সময় দরজার দিকে দেখে শিকদার সাহেব আসছে।
দাঁড়াও যেয়ো না দেখি শিকদার কোন খবর পেয়েছে কি না জেনে যাও।

শিকদার, এদের কনফার্মেশন পেয়েছ? শিকদার এদিকে এগিয়ে এসে বুড়োর হাতে কয়েকটা কাগজ দিল। বুড়ো সেগুলি দেখে বলল নাও তোমাদের ফ্লাইটের ডিটেইলস নিয়ে যাও। সবার হাতে যার যার একটা ফ্লাইট সিডিউল দিয়ে দিল। নিশাত দেখে আগামী রবিবার বিকেল ৫টায় চিটাগাং থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে বাংলাদেশ বিমানে রাত ৯টায় দুবাই, দুবাই থেকে পরদিন রাত ৯টায় গালফ এয়ারে বাহরাইন হয়ে লন্ডন।
তা হলে আমরা কি এখন যেতে পারি?
ওকে মাই ডিয়ার, শনিবারে সকালে এসে সব কিছু নিয়ে যাবে আর ফ্লাইটের দিন দুপুর দুইটার মধ্যে এসে এখানে রিপোর্ট করবে, গুড নাইট।
গুড নাইট।
অফিস থেকে বের হতেই সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
নিশাত বলল, হাবিব আজ হলো মাত্র বুধবার তাহলে বাড়িতে একটা টেলিগ্রাম করে দেই, অন্তত ঢাকা এয়ারপোর্টে ওরা আসলে দেখা হবে।
হ্যাঁ চল টেলিগ্রাম অফিসে, দেখি খোলা আছে কিনা।
একটা রিকশা নিয়ে কাছের আগ্রাবাদ টেলিগ্রাম অফিসে গিয়ে হাবিব এবং নিশাত দুই জনেই নিজ নিজ বাড়িতে টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দিল, চিটাগাং থেকে আমাদের ফ্লাইট আগামী রবিবার বিকেলে, ঢাকা থেকে টার্মিনাল চেঞ্জ করার সময় কিছুক্ষণের জন্য দেখা হতে পারে, আপনারা সবাই ঢাকা এয়ারপোর্টে আসবেন। টেলিগ্রাম করে আবার আর একটা রিকশা নিয়ে মাদার বাড়ি খালার বাসায় ফেরার পথে বারেক বিল্ডিঙের কাছে এসে হাবিব নিশাতকে জিজ্ঞেস করল
কি রে নিশাত তোর কি হয়েছে আমাকে বলবি না?
নিশাতের কোন সারা নেই।
হাবিব আবার জিজ্ঞেস করল।
এবারেও নিশাত নিরুত্তর দেখে হাবিব নিশাতের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতেই নিশাত চমকে উঠে বলল
কি হয়েছে?
তুই কি এখনই লন্ডন চলে গেলি?
না।
তাহলে সেদিন থেকেই দেখছি তোর কোন কথা নেই এখনও দুই বার ডাকলাম কোন সারা নেই, কি ব্যাপার কি হয়েছে আমাকে খুলে বল।

নিশাত মনে মনে বলল না রে হাবিব আমি লন্ডন যাইনি। আমি যেখানে গিয়েছিলাম সে তোকে এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। যেখানে নিরু নামের এক চঞ্চলা দুরন্ত হরিণীর মত এক মেয়ে আছে, সারা দিন ছুটে বেড়ায়, গুন গুন করে গান গায় যার মনের কোন এক গহীনে আমার জন্য একটু খানি জায়গা আছে এবং আমি সে কথা বুঝতে পারি। সেদিন সে আমাকে বলেছে আমার জন্য অপেক্ষা করবে।
হাবিব আবার তারা দিল, কি রে বলবি না?
না হাবিব কিছু হয়নি এমনিই ভাবছি কোথায় যাচ্ছি, কেমন হবে কি হবে এই সব।
তুই কি ভয় পাচ্ছিস?
আরে না, ভয়ের কি আছে, শুনলি না বুড়ো কি বলল, ওখানে এজেন্ট আছে না?
তাই বলে এমন মন খারাপ করে থাকবি না কি?
না মন খারাপ করলাম কোথায়?
এই যে কোন কথা বলছিস না, ডাকলে তার কোন জবাব দিস না। চল কাল তো কোন কাজ নেই, আলমাস হলে একটা সিনেমা দেখে যাই।
কাল?
হ্যাঁ, কাল দুপুরে বা সন্ধ্যার শো।
চল, দেখা যায়।
কথা বলতে বলতে খালার বাসা এসে গেল। বাসায় ঢুকে গত রাতের মত খালা খালুর সাথে আজ সারা দিনের ফিরিস্তি জানাল। ফ্লাইটের খবর শুনে হাবিবের খালাত ভাই বোনেরা সবাই আনন্দে লাফিয়ে উঠলো। পর দিন সকালে নাশতা খেয়ে আশে পাশে একটু ঘোরাঘুরি করা বাসায় ফিরে এসে দুপুরে খেয়ে আবার বের হলো আলমাস হলের দিকে। সিনেমা দেখে সন্ধ্যায় ফিরে এলো। যাবার আগে এক দিন পতেঙ্গা, ফয়েজ লেক আরও কোথায় কোথায় বেড়াল।

শনি বার সকালে এসে জেমস ফিনলের অফিসে বুড়োর সাথে দেখা করল। ওরা সবাই এসেছে। বুড়ো চা খাচ্ছে। নিশাতকে দেখে হ্যাল্লো ইয়াং ম্যান গুড মর্নিং!
গুড মর্নিং।
বুড়ো টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা একটা করে বড় খাম বের করে তার ভিতরে থাকা ওদের টিকেট, ঢাকা এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন অফিসারকে লেখা চিঠি এবং আরও কিছু প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র বুঝিয়ে দিয়ে বলল এগুলি সব সাবধানে রাখবে। তোমরা এই প্রথম দেশের বাইরে যাচ্ছ সাবধানে থাকবে, ওয়েল ড্রেসে থাকবে। আর শোন মেয়েদের দিকে কিন্তু ভুলেও তাকাবে না বলে একটু হেসে দিল। কি, বুঝেছ?, অল ক্লিয়ার?
ইয়েস অল ক্লিয়ার।
ও কে, তাহলে কমপ্লিটলি রেডি হয়ে ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ নিয়ে কাল ঠিক দুপুর দুইটায় এখানে এসে ওই শিকদার সাহেবের সাথে দেখা করবে। উনি তোমাদেরকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবে।
হুট করেই শনিবার ফুরিয়ে গেল। রাতে নিশাতের চোখে ঘুম নেই। সারা রাত নিরু তার চোখের পাতা দিয়ে ধীর পায়ে কেমন একটা উদাস ছন্দে হেঁটে বেড়াল। গানের সুরে সুরে যেন কি কি বলেছে কিন্তু নিশাত তার কিছুই বুঝতে পারেনি শুধু কান পেতে দূর পাহাড়ের ঝর্ণাধারার তানের মত একটা সুর ওর কানে বেজেছে। মনে হচ্ছিল তুমি আমার তুমি আমার। চোখে ঘুমের কোন চিহ্ন নেই। সকালে হাবিব ডাকল
নিশাত উঠবি?
আমিতো উঠেই আছি।
উঠ, নাশতা করে সব গুছিয়ে নিই।

নিশাত উঠে হাত মুখ ধুয়ে খালার সাথে নাশতা খেয়ে হাবিবের সাথে এসে ব্যাগ থেকে সব কিছু বের করে আবার ভাজ করে কাপড় চোপর টুকি টাকি এটা সেটা সব গুছিয়ে সবার শেষে ক্রু ডিপার্টমেন্টের বুড়োর দেয়া প্যাকেট বের করে সিডিসি, আইডি কার্ড, টিকেট, চিঠি সব কিছু বুড়ো যে ভাবে বলে দিয়েছে সে ভাবে ভরে ব্যাগের পকেটে রেখে রেডি হয়েই বসে রইল। খালা আজ একটু তাড়াতাড়ি রান্না করে ওদের খাইয়ে দিলেন। বাসা থেকে একটায় বের হয়ে সময় মত অফিসে এসে পৌঁছে দেখে এনামুল আর সালেক মিয়া এখনো আসেনি। একটু অপেক্ষা করার পর ওরা এলো।
দুপুর তিনটা। সবাইকে নিয়ে অফিসের একটা বড় গাড়িতে শিকদার সাহেব চিটাগাং এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছালেন। এখানে ডমিস্টিক এয়ারপোর্ট তেমন কিছু দেখল না। শুধু টিকেট দেখে মালামাল চেক করে বোর্ডিং কার্ড দিয়ে দিল। শিকদার সাহেব সবার সাথে হ্যান্ড সেক করে বুড়োর মত মাগনা কিছু উপদেশ দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল আর ওরা প্লেনে উঠে বসল। একটু পরেই বিমান বালার ঘোষণা শুনে বুঝল প্লেন টেক অফ করতে যাচ্ছে। ঘোষণা শেষ হবার সাথে সাথেই প্রায় প্লেন রান ওয়ে দিয়ে ট্যাক্সিং করে এক সময় সো করে আকাশে উড়ে গেল। সামনে নিচে বঙ্গোপসাগর পরে রইল। নিশাত আর হাবিব মাত্র সেদিন পতেঙ্গা এসে এই সাগর দেখে গেছে।
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top