মম চিত্তে নিতি নৃত্যে -[২৭]-২৩

কথার সাথে সাথে শিহাবের নাশতা শেষ হলো, নিরু চা নিয়ে এলো। চা খেতে খেতে বলল এই চলনা আমি হাবিবদের বাড়ি যাব তুইও চল
আমাদের হাবিব?

হ্যাঁ, দুইজনে একসাথে গেলাম অথচ আমি চলে আসলাম ও কিন্তু এখনও আসতে পারেনি তাই চাচা চাচীদের সাথে একটু দেখা করে আসি আর ওর খবরটা জানিয়ে  আসি আর তুই যখন এসেই পরেছিস তাহলে হাসির সাথে একটি দৃষ্টি বিনিময় করে যাবিনা?
কি যে বলিস, সে দিন কি আর আছে?
কেন নেই কি হয়েছে?
কি আর হবে, কতদিন হয়ে গেল সব ভুলে গেছি
আরে যাহ! এই কি কেউ ভুলে না ভুলতে পারে? লুকাচ্ছিস কেন, চল দেখা করে আসবি, বেচারি হয়ত তোর পথ চেয়ে আছে
না রে আমার অনেক কাজ আছে সবাইকে দাওয়াত দিতে হবে কিছু কেনাকাটা করতে হবে
আরে চল পরে আমিও তোর সাথে থাকব, যে কয়দিন ঢাকায় থাকবি আমি তোর সাথে থাকব
তাহলে তুই যখন বলছিস চল ঘুরেই আসি, তুই আর হাবিব কি এক সাথেই ছিলি?
না রে, আমি ছিলাম ইউরোপে আর ও ছিল এশিয়ান লাইনে তবে আমরা যখন মিডল ইস্টে আসতাম লোড নেয়ার জন্য তখন মাঝে মাঝে কথা হত। আমি দেশে আসছি জেনে বলে দিয়েছে ওদের বাড়ি যেতে।
চল

শিহাব যতদিন ঢাকায় ছিল নিশাত শিহাবের সাথেই ছিল। এই যাত্রায় সবার সাথে দেখা হলো আর সেই সাথে নানা সময়ে নিরুর সাথেও দেখা হলো।
পরেরদিন আপা জানাল তোর দুলাভাই বিয়ের দিন যাবে আমরা হলুদের দিনেই সকালে চলে যাব তুই কিন্তু এসে পরবি
আচ্ছা আপা, আমি সময়মত চলে আসব
তিনদিন পরে শিহাব আর নিরু চলে গেল।
পরের বুধ বারে সকালে উঠেই নাশতা খাবার সময় মাকে বলল
আমি বাড়ি যাচ্ছি যূঁইয়ের বিয়েতে। আজ হলুদ, বীণা আপা যাচ্ছে তার সাথে যাব আপনারা কি শুক্রবারেই আসবেন নাকি আগে আসবেন?
আগে কেমনে আসব, তোর বাবার অফিস আছে না!
আচ্ছা, তাহলে আপনারা আসেন আমি আজই চললাম।
বিয়ে বাড়িতে নিরুর সাথে সময়ে অসময়ে দেখা, চোখে চোখ আর সবার সাথে হৈ চৈ আমোদ প্রমোদে চলে গেল। নিরুর সাথে  দুই একটা সাধারণ কথা ছাড়া একান্তে তেমন আলাপের সময় বা সুযোগ হয়ে উঠেনি। শনি বারে বাবা মা সহ বীণা আপা, দুলাভাই নিরুর সাথে এক সাথে ঢাকায় চলে এল।



১৪।
এবারে মাত্র দেড় মাস ছিল দেশে। এর মধ্যে এমনি করে আসা আর যাওয়ার মধ্যে দুইজনে কিছু টুকি টাকি কথাবার্তা একটু হাতে হাত এভাবেই চলে গেল। এখন নিরু আগের মত হাত ধরলে ছাড়িয়ে নিতে ব্যস্ত হয় না। নিশাত ভাই বলে ডাকে না। এইযে, শুনছেন এমনি করে নিশাতকে ডাকে কিন্তু আপনি ছেড়ে তুমি করে বলতে পারে না। নিশাত কত অনুরোধ করেছে কিন্তু কোন পরিবর্তন হয়নি। নিশাত ভেবেই পায়না নিরু কবে তুমি বলা শিখবে। একদিন নিশাতের যাবার সময় এসে হাজির। আগের মতই নিরু আর বীণা আপার কাছে বিদায় নিয়ে নিশাত চলে গেল।
এই যাত্রায় আবার ফিরে আসতে নিশাতের অনেক সময় লেগে গেল। নিয়ম অনুযায়ী নয় মাস পরে দেশে আসতে পারেনি। বেশ অনেকদিন পরে এসে যখন বীণা আপার বাড়ি গেল তখন শুনল নিরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার অপেক্ষায় রয়েছে। দুলাভাইয়ের সাথে কথা হচ্ছিল। দুলাভাই বেশ আমুদে মানুষ এটা সেটা নানা কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনল। মাঝে আবার ইয়ার্কিও করল
কোন বিদেশিনী বা মেমসাহেবের দেখা পাওনি এখনও?
কি যে বলেন দুলাভাই! আমি মনে প্রাণে বাঙালি কাজেই আমার পাশে দেখলে বঙ্গ ললনাই দেখবেন। পাশে বীণা আপা এবং নিরু দুইজনেই ছিল। নিরু লজ্জা পেয়ে চা আনার ছল করে উঠে চলে গেল। দুলাভাই জানাল আগামী কাল নিরুর ভর্তি হবার তারিখ কিন্তু আমাকে যশোর যেতে হবে তোমার আপাকেও ওদের নিয়ে স্কুলে যেতে হবে। এর আগে দেখেছে শুধু অয়ন স্কুলে যেত কিন্তু এখন অয়ন রায়ান দুইজনেই যায় এবং রায়ানটা হয়েছে ভীষণ দুষ্ট। কে যাবে নিরুর সাথে তাই নিয়ে একটু চিন্তিত। নিশাত বলল
তাহলে নিরুর সাথে যাবার জন্য আমি আসলে হবে?
বীণা আপা বলল তুই আসবি? তাহলে আয়, সকাল নয়টার মধ্যে চলে আসবি
বলেই আপা নিরুকে বলল
শোন কাল আমি স্কুলে যাবার পর ও আসবে ওর সাথে যেয়ে ভর্তি হয়ে আসবি
আচ্ছা
নিশাত তুই কাল সময়মত চলে আসবি
ঠিক আছে, তাহলে আমি এখন উঠি
আচ্ছা।
নিশাত নিরুর দিকে ঘুরে বলল তুমি কিন্তু এর মধ্যে রেডি হয়ে থেকো।
নিরু মাথা ঝাঁকিয়ে জানাল সে বুঝতে পেরেছে কি করতে হবে।

পরদিন সকালে যথারীতি নিশাত এসে দেখে নিরু রেডি হয়ে ওর অপেক্ষা করছে। ঘরে ঢোকার পর নিরু জিজ্ঞেস করল একটু চা খেয়ে বের হবেন?
তুমি বানাবে নাকি নার্গিস বানাবে?
নার্গিস বাসায় নেই আমিই বানাব
তাহলে দাও
চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল ছবি কাগজপত্র সব নিয়েছ?
নিয়েছি
কোন সাবজেক্টে ভর্তি হবে?
জিওগ্রাফি
এত সাবজেক্ট থাকতে জিওগ্রাফি কেন? তুমিও কি জাহাজে চাকরী করবে নাকি?
এই সাবজেক্ট আমি এখন ভাল বুঝি তাই
তাই নাকি? তুমিতো একসময় বলতে এটা খুব কঠিন
কেন, সেই যে আপনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তারপর থেকেই আমার কাছে এটা ভাল লাগতে শুরু করেছিল এখন এটাই আমার প্রিয় বিষয়।
কিন্তু সেতো মাত্র কয়েকদিন দেখিয়ে দিয়েছিলাম
হ্যাঁ তারপরে যুঁই আপাকে বলেছিলেন আমাকে পড়াবার জন্য, আপনার মনে নেই
হ্যাঁ মনে আছে কিন্তু যুঁই কি তোমাকে পড়াত?
হ্যাঁ
বেশ ভাল কথা, জেনে খুব ভাল লাগল কিন্তু তুমিতো এতদিন আমাকে কিছু বলনি!
আপনি কি ও কথা বলার কোন সুযোগ দিয়েছেন? নাকি কোনদিন জানতে চেয়েছেন?
হ্যা নিরু সত্যিই ভুল হয়ে গেছে, কথা দিচ্ছি আর এমন হবে না, আচ্ছা আজ চল
চলেন

বাইরে এসে একটা রিকশা ডেকে দুইজনে উঠে চলল বিশ্ববিদ্যালয়ের এডিমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিঙের দিকে। এরপর আর কোন কথা নেই, অনেকক্ষণ চুপচাপ। একটা বছরেরও বেশি সময়ের আগে এমনি এক দিনের কথা উভয়ের মনে পরল কিন্তু কেউ কিছু বলছে না।  মনে হচ্ছিল এই পথ যেন শেষ না হয়। যেন অনন্ত কাল ধরেই চলতে থাকে। কিন্তু এক সময় নিউমার্কেটের সামনে এসে পিছনের আর এক রিকশার ধাক্কায় উভয়েই সম্বিত ফিরে পেল।
শুনছ?
বলেন
আজ কিন্তু আমরা এক সাথে সারাদিন ঘুরব!
তাই কি হয়?
কেন হবে না? তুমি কেমন, কিছুই কি বুঝবে না?
নিরু কোন কথা বলল না।
এইমাত্র না বললে আমি কোনদিন সুযোগ দেইনি তাহলে এখন এমন কথা বলছ কেন?
নিরু চুপচাপ
কি হলো কিছু বলছ না!
কি বলব? আপনার ছেলে মানুষীর কথা ভাবছি, আপনি এখনও সেই অতটুকই রয়ে গেলেন। এত দেশ বিদেশ ঘুরে এলেন তবুও বড় হলেন না!
ঠিকই বলেছ সত্যিই আমি তোমার কাছে এলেই যেন কেমন হয়ে যাই, সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায় গুছিয়ে কিছু বলতেও পারি না কিছু ভাবতেও পারি না। মনে হয়...
কি মনে হয়? আমি কি বাঘ না ভাল্লুক?
মনে হয়...........................
কয়েকবার শুধু মনে হয়, মনে হয় বলল কিন্তু তারপরে কথা থেমে যাচ্ছে, কিছু বলতে পারছে না। তাই শুনে নিরু বলল
কি মনে হয় বলেন, শুধু মনে হয় মনে হয় করছেন কেন?
লজ্জা লাগছে
তাহলে থাক বলার দরকার নেই
কিন্তু তোমাকে যে এ কথা শুনতেই হবে!
তাহলে বলেন!
এবার সাহস করে নিশাত নিরুকে বলল আমার চোখের দিকে তাকাও
নিরু তাকাল আর অমনি নিশাত ওর চোখে চোখ রেখে একটু কাছে এগিয়ে হাত ধরে বলল
মনে হয় আমি তোমার প্রেমে পড়েছি
আস্তে করে একটু ধাক্কা দিয়ে নিরু বলল যাহ! আপনি আগে এত অসভ্য ছিলেন না বিদেশে গিয়ে বুঝি এই হয়েছে? আর এই জন্যেই বুঝি আজ আমার সাথে আসা?
কি বল তুমি, অসভ্যের কি হলো যেটা সত্যি আমি তাই বলেছি। না, নিরু তুমি বুঝতে পারছ না, সেই ছোট বেলা থেকেই আমি লক্ষ করেছি তুমি কাছে এলেই যেন আমি কেমন হয়ে যাই। আমি অনেক ভেবে দেখেছি। সত্যি করেই আমি তোমার প্রেমে পড়েছি বিশেষ করে সেদিন নোমানের ওই কথা শুনে আমি ভাল করেই বুঝতে পারলাম এত দিন কেন এমন হয়েছে। তার পর থেকেই তোমাকে এই কথাটা বলার সুযোগ খুঁজেছি কিন্তু পাইনি আজ তাই প্রথম সুযগেই বলে ফেললাম।
নিরু নিজের মনে ভাবল এ কথাতো আমারও। আমিও কেমন যেন হয়ে যাই, সব ভুলে যাই। যুঁই আপা যখন আপনাকে বলত তোর বৌ এসেছে তখন মনে হত যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছে, ভীষণ খারাপ লাগত কিন্তু আপাকে কিছু বলতে পারতাম না তাই নীরবে শুধু কেঁদেছি সে কি আপনি কিছু বুঝতে চেষ্টা করেছেন কখনও? মুখে বলল
আচ্ছা সে দেখা যাবে এখন রিকশা থেকে নামুন চলুন দেখি আগে ভর্তি হয়ে নিই। পরে বিচার করব সত্যি বলছেন নাকি বানিয়ে বলছেন!
নিশাত সামনে চেয়ে দেখে ওদের গন্তব্যে চলে এসেছে। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে নিরুর পিছে পিছে এসে যেখানে টাকা পয়সা দিতে হবে সে সব কাজ সারতে প্রায় ঘণ্টা খানিক লেগে গেল। ভর্তির কাজ সেরে ওই অফিসেই একজনের টেলিফোন থেকে বীণা আপার বাসায় ফোন করে বলল
আপা নিরুর ভর্তি হয়ে গেছে আমরা একটু পরে আসছি
কোথায় যাবি?
না তেমন কোথাও না এখানেই এলাকাটা ওকে চিনিয়ে দেই পরে যাতে কোন অসুবিধা না হয়
আচ্ছা ঠিক আছে বেশি দেরি করবি না তাড়াতাড়ি আসবি।
আচ্ছা আপা তাড়াতাড়িই আসব।
নিরুকে সাথে নিয়ে বাইরে চলে এলো। মেইন রোড।
শুনেছ তোমার আপার কাছে অনুমতি নিয়ে নিয়েছি এবার চল আমরা আজ বেড়াব এবং দুপুরে চাইনিজ খাব।
আমার কিন্তু ভীষণ ভয় করছে
তোমার ওই এক কথা, ভয় আর লজ্জা, আপার কাছে অনুমতি নিয়েছি না! তবে আবার কিসের ভয়? ভয়ের কি আছে এটা কি তোমাদের গ্রাম? এটা রীতিমত ঢাকা শহর এখানে কে কার খবর রাখে? তুমি এখন বড় হয়েছ, আজ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছ তোমার এত ভয় পেলে চলবে? এখানে লজ্জারই বা কি আছে? তোমার এখন নিজস্ব মতামত দেয়ার সময় হয়েছে
নিরু আমতা আমতা করে বলল চলেন কোথায় যাবেন।
[চলবে]

No comments:

Post a Comment

Back to Top