কবিতা কি? কবিতা কেন? কবিতা কিভাবে? কবিতা কোথায়?

 
অন্তহীন এসব সওয়াল সম্ভবত কবিতা সৃষ্টির প্রথম লগ্ন থেকে হয়েই চলেছে। যে যার নিজের মতো করে উত্তর খুঁজে নেন। সেই ব্যাখ্যা কারো কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, কারো কাছে বা নয়। আগে এ বিষয়ে কিছু কথা বলেছি। আজ তাই প্রসঙ্গান্তরে যাই। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে কবিতা লেখা যায়না। মানে, হাতে পেন নিয়ে, সামনে সাদা জাবদা বাঁধানো খাতা,

ফুরফুরে সুগন্ধী ঘরে, সুন্দর আধুনিক টেবিলের ডানদিকে ব্যাকরণ আর বাঁদিকে অভিধান নিয়ে বসে যারা ভাবেন কবিতা লিখবেন, তাঁরা কি লেখেন, তা তাঁরাই বলতে পারবেন। তবে সেগুলো আর যাই হোক না কেন, আর কিছু ত্বকপ্রেমী সেগুলোকে দেখে যতই আহা উহু করুন না কেন, কালের প্রবাহে সেসব হারিয়েই যায়, কবিতার সৌন্দর্যমণ্ডিত সারিতে বসার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনা।

কবিতা হলো কবির মনে দাগ কেটে যাওয়া ভাবনা, যা অপূর্ব নকশায় চারপাশ মুড়ে প্রসবিত হয়। জোর করে এ লেখা যায়না। হঠাৎ আসে ধূমকেতুর মতো, কিছুক্ষণ থেকেই চলে যায়। তার মধ্যেই তাকে ধরে রাখতে হয়। এরপরে পরিমার্জনের মিস্ত্রীর কাজটা কবি করেন মাত্র। ভাববেন না তাই বলে আমি কবির কৃতিত্ব কে খাটো করলাম। সুন্দর, স্বচ্ছ এবং আবেগ ও অনুভূতিপ্রবণ মনের অধিকারী না হলে কবিতা তাঁর ধারেকাছে ঘেঁষে না।

আগেই বহুবার বলেছি, ব্যাকরণ মেনে কবিতা লেখা যায় না। আমার ব্যক্তিগত মতে কবিতা আগে সৃষ্টি হয়েছিল, তারপরে সেই কবিতার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বোদ্ধারা সৃষ্টি করেছেন ব্যাকরণের। কিন্তু আবার এই আমিই এই কবি ও কবিতার প্রথম পর্বে যথাসম্ভব সহজভাবে কবিতার ছন্দ ও প্রকৃতি বর্ণনা করেছিলাম। এটা দ্বৈত মতের মনে হতেই পারে পাঠকের। কিন্তু আসল ব্যাপারটা হলো, বহুদিন কবিতার চর্চা করতে গিয়ে ব্যাকরণের সূক্ষ্ম দিকগুলো প্রচ্ছন্নভাবেই কবির মনে দাগ কেটে যায়। কবিতা লেখার সময়ে মাথার কন্ট্রোল রুমে সেই জ্ঞান অজানিতেই কাজ করে কবিতাকে বিশৃঙ্খল হতে দেয়না। তবুও যেটুকু থাকে তাকে পরিমার্জনের সময়ে কবি ঠিক করেন। তাই একটা ভালো কবিতা সর্বদাই আমরা ব্যাকরণসম্মত রূপেই দেখতে পাই।

কবিতা নিঃসন্দেহে কবির সম্পদ। তিনি সযত্নে যে শিল্পকৃতি গড়ে তুললেন ছড়িয়ে দিলেন সুসংস্কৃত পাঠকের সন্ধানে। কিন্তু পড়লেন অনেকেই, আর তাঁরা সবাই কবিতা বোদ্ধা নাও হতে পারেন। তাতে কবির কিছুই যায় আসে না, আর আসা উচিৎ ও নয়। মজাটা হলো সবাই রসগ্রাহী হন না। আর তখন বুদবুদ তৈরী হয় কেন এই কবিতাএই প্রশ্নের। নীরা কে নিয়ে লেখা কবিতার একটাও না পড়ে অথবা এক দুটো পড়েই কেউ কেউ দেখেন এ কবিতা অসম্ভব জনপ্রিয়। অথচ নীরার রসাস্বাদন করার ক্ষমতা তাঁর নেই, তখন তাঁর মনে উদয় হয় কেন নীরা কে নিয়ে কবিতা লেখা হলো? কে এই নীরা? তিনি কি কবির স্ত্রী নাকি অন্য গোপন প্রেমিকা? তাঁর সঙ্গে কবির কি দৈহিক সম্পর্ক ছিল? এইসব অবান্তর প্রশ্নের। শুরু হয় কবির ব্যক্তিগত জীবনের ছানবিন। মেঘবালিকা নিয়েও সেই একই ব্যাপার।

অজানিতেই ছাপ পড়ে নতুন কবির মনে। আসতে থাকে রাশি রাশি মেঘ-বৃষ্টির কবিতা বা কবিতার মতো কিছু। কিন্তু কোনোদিনই সেইসব নকল চীনে জিনিস কবিতা হয়ে ওঠেনা। কবি কি সর্বদাই তাঁর নিজের জীবনের সম্পর্কে লেখেন? লেখাতে যে বিরহ, প্রেম, বিচ্ছেদ, হাহাকার, বিকার, বিদ্বেষ, অনুরাগ, মিলনেচ্ছা ফুটে ওঠে তা আসল কবির ক্ষেত্রে নিজের ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনা নাও হতে পারে। পারিপার্শ্বিক মানুষ, প্রকৃতি, জীবদের পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণের ফলও হতে পারে। আর হতে পারে নয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাই হয়। যদি তা না হত, তাহলে কবিকে একটা কবিতা লেখার জন্য মাসের পর মাস, বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হত, কবে একটা ঘটনা ঘটবে, আর তাই নিয়ে তিনি কবিতা লিখতে বসবেন।

অথচ প্রকৃত কবির ক্ষেত্রে তা হয়না। তিনি চোখ মেলে রাখেন। চারপাশের চরিত্রদের আশা-নিরাশা, রাগ-অনুরাগ, সাফল্য-ব্যর্থতা, পাওয়া-না পাওয়ার খেলা রেকর্ড করেন মগজের ডার্করুমে। হঠাৎই সেখান থেকে বেরিয়ে আসে তার পরিশীলিত রূপ, যার নাম কবিতা। তাই অসম্ভব বিষাদের কবিতা লেখার পরেও সাক্ষাত প্রার্থীর সামনে তিনি আনন্দোজ্জ্বল। তাই কবিতা পড়ে কবির ব্যক্তিগত জীবনের খোঁজ করার অর্থ কবিতা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া। আর নতুন কবিদের উচিৎ চোখ খুলে রাখা।

এবারে বইমেলাতে দেখলাম, প্রচুর কবিতার বই বিক্রী হয়েছে। সব ক্রেতা যে পড়ার জন্য কিনেছেন তা নয়। অনেকে উপহার দেবার জন্যেও কিনেছেন। আর একটা কারন হলো প্রবন্ধ বা গল্পের বইএর চেয়ে কবিতার বইএর দাম কম। কিন্তু তবুও এটাও দেখলাম অনেকেই পড়ছেন।

হ্যাঁ, পড়ছেন কবিতা। আমি নিরাশাবাদী নই। হাহাকার করিনা। কবিতা কেউ পড়েন না বলিনা। পাঠককে অসম্ভব শ্রদ্ধা করি আমি। বলতে কি একজন কবির চেয়ে একজন পাঠকের গুরুত্ব আমার কাছে অনেক বেশি। আমি জানি সংবেদনশীলতা শুধু কবির একার নেই, পাঠক/পাঠিকারও আছে। আর তাই একটা ভালো কবিতা পড়ে তিনি উদাস হয়ে যান। নিজের জীবনের ঘটনাপঞ্জির সাথে মিলে যায় কবির অনুভব।

আর তখনই সার্থক হয়ে ওঠে কবিতা।

লেখকঃ

সৌমিত্র চক্রবর্তী | জুন ২২, ২০১৪ | ভারত, দূর্গাপুর

No comments:

Post a Comment

Back to Top